চাঁদ

চারটা বেজে গেছে। অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে সেলিমের মনের ভিতর। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বাস। ঈদের সময় বাড়ী যাওয়া একটা যুদ্ধে যাওয়ার মতো অবস্থা। সেলিম অফিস থেকে বের হওয়ার আগে স্ত্রী নীরা কে ফোন করলো, ” তুমি কি বের হয়েছ?
—– না, এখনো বের হয়নি। আমার মনে হয় একটু দেরি হবে। 
—– কি বলছো? তাহলে তো বাস মিস করবে।
—– শোন, আমি বাসায় সব কিছু  রেডি করে এসেছি।  তুমি বাসায় গিয়ে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যাও। আমি সরাসরি অফিস থেকে বাস স্ট্যান্ডে চলে যাবো।
—— তুমি সরাসরি বাস স্ট্যান্ডে যাবে?
—— হ্যা আমি সরাসরি চলে যাবো।  তবে তুমি যাওয়ার আগে কিছু ইফতার কিনে নিও।
—– আচ্ছা ঠিক আছে।
এই কথা বলে সেলিম অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লো।

সেলিম আর নীরা। দুবছর হলো ওদের বিয়ে হয়েছে। সেলিম একটা কর্পোরেট অফিসে চাকরি করে আর নীরা আছে একটা এনজিও তে। ঈদে বাড়ী যাওয়া টা একটা যুদ্ধের মতো হলেও, ঈদে বাড়ী না গেলে ওদের ভীষণ মন খারাপ হয়।  তাই শত বিপত্তি স্বত্তেও ওরা বাড়ী যাবেই। সেলিম বাসায় ফিরে  গ্যাস, পানির কল সব ঠিক মতো বন্ধ আছে কিনা চেক করে,  ব্যাগ গুছিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লো। গাবতলি বালুর মাঠে হানিফ কাউন্টারে যখন পৌঁছালো তখন ঘড়িতে বিকেল পৌনে পাঁচটা। এসে শুনলো, গাড়ী এখনো এসে পৌঁছায়নি। সেলিম ব্যাগ নিয়ে কাউন্টারের বাইরে পাতা বেঞ্চে খালি জায়গা দেখে বসে পড়লো। দশ মিনিট পরে দেখতে পেল, নীরা হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে। সেলিম উঠে নীরা কে বললো,  ” আগে বসো।”
—— বাস কখন ছাড়বে?  হাতে তো একটুও সময় নেই!
—– অনেক সময় আছে।  সকাল দশটা, এগারোটা,  বারোটা, একটার গাড়ী একটু আগে ছাড়লো। আমাদের গাড়ী এখনো আসেনি।
—– কি বলছো? ওহ্ আল্লাহ,  কতক্ষণ যে বসে থাকতে হবে কে জানে!
—– অতো অস্থির হয়ো না।  বেশী অস্থির হলে বেশী খারাপ লাগবে।

সেলিম আর নীরা বসে বসে মানুষের আসা যাওয়া দেখছে। বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষ আর  শিশু দের কোলাহলে বাস স্ট্যান্ড একেবারে জমজমাট।  আর এর মধ্যে মাইকে বিভিন্ন রুটের, বিভিন্ন গাড়ী ছাড়ার ঘোষণা,  যেন ঈদের আগেই আরেক ঈদ। আর এই বিষয়টিই সেলিম খুব উপভোগ করে। সেলিম বসে বসে মানুষের কথা, হাসি ঠাট্টা, উদ্বেগ সবকিছুই পর্যবেক্ষন করছে। হঠাৎ মাইকে সেলিমদের গাড়ী ছাড়ার ঘোষণা আসলো। নীরার পাশের ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, ” আপনাদের ভাগ্য কি ভালো, এক ঘন্টার বেশী আপনাদের অপেক্ষা করতে হলো না। আর আমি দুপুর বারোটা থেকে বসে আছি,  এখনো আমাদের লাইনের গাড়ীর খবর নেই। “
—— আপনি কোথায় যাবেন?
—– খুলনা।
—– ও, আমরা রাজশাহী।
—– আপনাদের ভাগ্য কি ভালো।  আমার একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল রাজশাহী থেকে। তখন যে কেন রাজি হলাম না!
এই বলে ভদ্রমহিলা স্বামীর দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন। যেন, এই বিপত্তির জন্য উনার শ্বশুর বাড়ী খুলনা হওয়াটাই প্রধান ইস্যু। যাই হোক,  সেলিম আর নীরা সবকিছু গুছিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলো। এই গাড়ী নাটোর, রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত যাবে। গাড়ীতে বসার সাথে সাথে পেছন থেকে একযাত্রীর ফোনালাপ শুরু হলো। যাত্রী তার কোন এক মামাকে ফোন দিয়েছে, ” হা জ্বি মামা, হামি তো বাসে চড়্যেহে বসনু। রাগ করিয়ো না মামা। আসলে একটা মাত্র টিকিট প্যায়েছিনু তো তাই তুমাহকে আর কহিনি। আচ্ছা মামু, রাখছি জ্বি।”
এই কথা শুনে সেলিম আর নীরা ফিকফিক করে হাসতে থাকে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা, গাড়ী স্টার্ট দিলো। আর কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আজান দিবে। নীরা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, ” তুমি ইফতার কিনেছ?”
সেলিম মাথা চুলকে হাতের প্যাকেট টা নীরার দিকে বাড়িয়ে দিলো। নীরা প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখলো, প্যাকেটে কিছু খেজুর, তিনটা আপেল আর একটা কমলা। “এই! কিছু কিনো নি? আর এগুলো তো সব দেখচি বাসা থেকেই আনা!”
—– না, মানে… আসলে তাড়াহুড়ায় ভুলে গেছি।
—– এখন কি আমি না খেয়ে থাকবো!
—– আমার একটা খেজুরেই হয়ে যাবে। তুমি বাকি গুলো দিয়ে ইফতার সারো।
সেলিম আর নীরার এসব কথা শুনে ওদের পেছনে থাকা ভদ্রলোক নিজের  ইফতারের বাক্সটা ওদের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন, ” আমার কাছে আরও এক বক্স আছে। এটা আপনারা নিন।”
” থ্যাঙ্কুউ,  সেলিম কৃতজ্ঞ চিত্তে ইফতারের বাক্সটা গ্রহণ করলো। আর নীরা সেলিমের উপরে বিড়বিড় করে নিজের রাগ ঝাড়তে লাগলো।”
গাড়ীর সকলের মোটামুটি ইফতারি করা শেষ।  হঠাৎ ওদের এক সিট সামনের এক ভদ্র মহিলা বলে উঠলেন, ” এই আজান কি দিয়েছে,  ঐ বাবুর আব্বা কথা কহিছনা কেনে? কেউ কিছু কহিছে না কেনে।”
পেছন থেকে একজন বলে উঠলেন, ” বেকুব! “
”   ঐ বাবুর আব্বা, আজান দিয়ে দিয়েছে। ইফতার কোরেহে ল্যাউ।”
গাড়ী চলছে থামছে। এই ভাবে টুকটুক করে এগুচ্ছে। ইতিমধ্যে খবর পেয়েছি ঈদের চাঁদ দেখা যায়নি।  গাড়ীর ভিতরে সকলেই যার যার মতো ব্যস্ত। কেউ মোবাইল টিপছে। কেউ পাশের জন্যের সাথে গল্প করছে। আবার কেউবা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে আর এদিকে ঘড়িতে বাজছে রাত সাড়ে আটটা। হঠাৎ ঐ ভদ্রমহিলা আবার বলে উঠলেন, “ঐ বাবুর আব্বা, চাদ কি উঠ্যেছে? কি হলো কথা কহিছনা কেন? “
আবার পেছন থেকে শব্দ আসলো,”বেকুব।” এই বার গাড়ীর মধ্যে হাসাহাসি শুরু হয়ে গেলো।
“ঐ বাবুর আব্বা, সগলাই, হ্যাসছে কেন? কি হয়্যেছে?”
—– তুমার কথা সুন্যে হ্যাসছে। এখন কয়টা বাসছে হুস আছে। এখন তুমি চাদ দেখার কথা বুলছ?
—– বুল্যেছি তো কি হয়্যেছে। কেনে হে এর আগে একবার রাত এগারোটায় চাদ উঠ্যেনিখো!
এই কথা শুনে আবার আরেক দফা হাসি শুরু হলো। সামনে বসে থাকা এক ভদ্রলোক সকলের উদ্দেশ্য বললেন, ” উনি খুব একটা ভুল কথা বলেননি। আমরা হাসছি ঠিকই কিন্তু কথা তো সত্যি। যে কোন সময় চাঁদ উঠে যেতে পারে।”
এই কথা শুনে সামনের একজন তরুণী সাথে সাথে কাউকে ফোন দিয়ে বলতে শুরু করলো, ” এই শোন এক্ষুনি বাজারে যা, রাত বারোটাতে ও চাঁদ উঠতে পারে। তুই বাজারে গিয়ে তিনটা লিপস্টিক কিনবি।  একটা রেড ভেলভেট,  একটা বারগেন্ডি আর একটা ম্যাট মেরুন। মনে থাকবে তো। আমি কোন রিস্ক  নিতে চাচ্ছি না। “
আরেক ভদ্রলোক তার ভাই কে ফোন করে বলতে শুরু করলেন, “শোন সাবু, চাঁদ না-কি আইজ রাইত বারোটায় উঠপে! তুই ঐ নাসিম ভাইয়ের কাছে যায়ে পাঁচ কেজি গোস লিয়ে লিস। আর হ্যাঁ তোর ভাবী বুইলছে, দুকেজী স্ট্যেক গোস লিতে। কি বললি, তুই স্ট্যেক গোস চিনিস না, কি লেখা পড়া শিখেছিস? তুই এক কাজ কর, নাসিম ভাইয়ের ঐখানে য্যায়ে আমাকে কল করিস।”

আরেক ভদ্রমহিলা ফোনে তার শাশুড়ী কে বলছেন, ” আম্মা, চাঁদ কিন্তু আ্যজকেই উঠবে। আপনি রান্না শুরু করে দেন। আমার জন্য ওয়েট করেন না। কি বললেন? আমাকে কে বলেছে চাঁদ উঠবে? ক্যেনে, আপনি জানেনা এর আগে যে দুই বার রাত বারোটায় চাঁদ উঠ্যেছিল! আর এখানে সরকারের একজন ব্যুলেছে।” বলেই ভদ্রমহিলা ফোন কেটে দিয়ে স্বামীর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, ” তোমার আম্মা, সব রান্না আমার জন্য র‍্যেখে দিয়েছে। আমি য্যায়ে রান্না কইরবো, না!”

বাসের যাত্রীদের এই চাঁদ আর ঈদ নিয়ে কথপোকথন শুনতে শুনতে কখন যে চোখ বন্ধ হয়ে গেছে, সেলিম আর নীরা সেটা টেরই পায়নি।  বাসের সুপারভাইজারের যাত্রা বিরতীর ঘোষণায় ঘুম টা ভেঙে গেলো।  ঘড়িতে দেখলো রাত সাড়ে তিনটা বাজে। বাসের সুপারভাইজার কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো, ওরা এখন টাঙ্গাইলে। এদিকে তেমন আর জ্যাম নেই।  আশা করা যায় সকাল ছয়টার মধ্যে রাজশাহীতে পৌঁছানো যাবে। সেলিম আর নীরা সেহরি করে আবার গিয়ে বাসে বসলো। বাসের যাত্রীদের কথপোকথন আবার শুরু হলো। নীরা মোবাইল বের করে মা, শাশুড়ীর সাথে কথা বলে নিলো। কথা শেষ করে সেলিমের দিকে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো, “আমাকে একটা বারগেন্ডি কালারের লিপস্টিক কিনে দিয়ো তো!”

সেলিম নীরার কথার কোন উত্তর না দিয়ে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে উঁকি ঝুঁকি দিতে থাকলো। বলা তো যায় না, চাঁদ যদি ভোর রাতে উঠে।

©শোয়াইব আহমদ (Shoaib Ahmad)

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
0
1
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Shoaib Ahmad
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!