টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে এসে নূর নিজের ঘরে চুপ করে বসে আছে,সে ঠিক জানেনা সে ঠিক আছে নাকি ঠিক নাই।আসলে সে প্রানপনে চেষ্টা করছে ঠিক থাকার কিন্তু সে পারছে না।কারন এই অবস্থায় কারোই স্বাভাবিক থাকা সম্ভব না। তাও নূর প্রানপনে চেষ্টা করছে ঠিক থাকার, নাইলে মা-বাবাকে সামলানো অনেক কঠিন হবে। তার কানে খালি নিলয়ের বলা ‘নূরু ‘ ডাক টা বাজছে।মনে হচ্ছে সব মিথ্যা।কোথাও কোন ভুল আছে।কাল সকালেই ঘুম থেকে উঠে দেখবে নিলু ওর দোলনায় বসে ওর প্রিয় মগে চা খাচ্ছে।আর বরাবরের মতো বলবে “এইসব আইলসা মেয়েকে তোমরা ঘরে রাখো কেন?বেলা ১০ টা পর্যন্ত ঘুমায়” আর ওর দিকে তাকিয়ে চিরচেনা শয়তানি মাখা হাসি দিবে। নিলয়কে নূর নিলু ডাকে।কখনো কেউ তাকে দিয়ে ভাই,ভাইয়া বা এমন কিছু বলাতে পারেনি।নূর থেকে ১২ বছরের ভাইকে সে যখন সবার সামনে এভাবে নাম ধরে ডাকে,সবাই তাকিয়ে থাকে। না, এখন হয়তো ডাকতো বলতে হবে।আপাতত নিউজে তাই বলছে। কিন্তু নূর মনে মনে খুব চাচ্ছে যে একটা মিরাকেল হয়ে যাক।খবরটা মিথ্যা হোক।এমন ও হতে পারে বর্ডারের নেটওয়ার্ক ইস্যুর জন্য কোন মিসইনফরমেশন পাস হয়েছে।
বাবা -মা র আর্তনাদ শুনে সে আবার বের হলো। “টিভিটা আবার কে ছাড়লো?” নিশ্চয়ই পণ্ডিত বুয়া, সব কিছুতেই বেশি বেশি।নূর এসে দ্রুত টিভিটা বন্ধ করে বাবা-মা কে ঘরে নিয়ে গেল। আজকে ওদের থামানো যাবে না। আর থামাবেই বা কিভাবে? সন্তানের অকাল মৃত্যু কিভাবে মেনে নিবেন?
গতবছর মাঝের দিকেই নিলূর বর্ডারের দায়িত্ব পড়ে।গোড়া থেকেই আর্মিতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো নিলয়ের।সবসময় বলতো, ” বুঝলি নূরু, তোর কোন কাজ করতে হবে না।তুই খালি আরাম করে খাবি,আর সবাইকে বলে বেড়াবি আমার ভাই মেজর নিলয় আহসান।তুই চলবি পার্ট এর উপর।”এই মুহুর্তে এসব কথা নূরের মাথায় ঘুরছে।এই দুঃখের মধ্যেও সে কোথাও না কোথাও গর্ববোধ করছে তার ভাইকে নিয়ে।দেশের জন্য জীবন দিয়ে আজ তার ভাই শহীদ।
সে অনেকক্ষন ঝিম মেরে বসে রইলো।পাশের ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। কিছুক্ষনেই ঘরে অনেক মানুষ চলে এসেছে। সে ঘরের দরজা বন্ধ করে খাটের নিচ থেকে হলুদ বাক্সটা বের করলো। এখন তার কাছে এটা মণি রত্ন থেকেও বেশি দামী। এর মধ্যে আছে অনকে চিরকুট। সব ওর নিলুর হাতে লেখা। দুইভাইবোনের প্রতিটি অভিমানের সাক্ষী এই বাক্স।যতবার ই নূর কোন বিষয়ে রাগ করতো।নিলয় তাকে চিরকুট দিয়ে রাগ ভাংগাতো। মাঝে মাঝে ছবি একে,কখনাও এক শব্দে। কথায় আছে মেয়েরা অনেক আবেগী হয়।তাই যখন থেকে বুঝতে শিখেছে নূর সব চিরকুট এই বাক্সে জমাতো।এই বাক্সটা নিয়েও দুইভাইবোনের কাড়াকাড়ির অন্ত ছিলো না।ওদের দাদার আমলের বাক্স।লুকোচুরি খেলতে খেলতে স্টোর রুমে পেয়েছিলো। পুরোনো দিনের হলুদ বাক্সটা দেখেই লোভ হয়।প্রথম প্রথম বেশ লড়াই হলেও বড়াভাই এর লেখাপড়ার চাপে বাক্সের দায়িত্ব নূর পেয়ে যায়।তখন থেকে সে এখানে চিরকুট রাখে।সবার থেকে লুকিয়ে। সে এখন বাক্সটা হাতে নিয়ে সবগুলো চিরকুট পড়ছে। শেষ চিরকুটটা হাতে নিয়ে সে বসে আছে। শেষ বার নিলয় যায় সময় ও তাদের মধ্যে ঝগড়া ছিলো,সেখানে লেখা ছিলো “রাগ করিস না, এবার আসলে তোর স্কুলের ছুটির সাথে মিলিয়ে আসবো।নেক্সট টার্গেট সুন্দরবন। ” নিলয় বের হয় সময় নূর স্কুলে ছিলো।তাই চিরকূটটা সে নূর এর গল্পের বই এ রেখে গিয়েছিলো।
নূর একমনে সব গুলো চিরকুট গুনছে,যেন এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মুহুর্তে কিছু নাই। গুনে গুনে সে দেখলো সেখানে ৬১ টা চিরকুট।
সে মার্কার এনে লিখলো ৬১। এর পর সে একটা তালা খুজে এনে তালা মেরে দিলো।যাতে কেউ কখনো না নিতে পারে তার এই সম্পত্তি। এর পর তালাটায় হাত দিয়ে সে কেদে দিলো।তালাটা যেন তাকে বার বার বলছে ‘এখানে চিরকুট দেয়ার মানুষটা আর নেই।’
সে বাক্সটা কোলে নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো।
– Sabrina Mohammad Amin
Send private message to author





