১৫
আজ শুক্রবার। জুম্মার নামাজের একটা ব্যাপার আছে। সো একটার দিকে সবাই আসলেও ছেলেরা এখান থেকে বেরিয়ে যাবে নামাজে। ওরা ফিরে আসলে এঙ্গেজমেন্ট অ্যান্ড দেন খানা দানা। এখন বারোটার মত বাজে। সাওয়ার নিয়ে ফেলেছি।শাড়ি পড়ে নিয়েছি। আমাকে সাজানোর দায়িত্ব পড়েছে শম্পাদির ঘাড়ে। উনি কিছুক্ষণ আগে এসে গেছেন।
আমার দিকে তাকিয়ে ছোটখাট একটা শক খেলেন মনে হল।
— কি হয়েছে?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
— কি হবে আবার?
— চেহারার এই অবস্থা কেন?
আয়নার সামনেই বসে ছিলাম। তাকালাম। বললাম
— কি অবস্থা?
— ঢং করিস না। কি হয়েছে?
আবার আয়নায় নিজেকে দেখলাম। চেহারায় কিছুটা ভয় আছে। আর বোধহয় হালকা একটু বিষাদ। লাগবেই। দ্বিতীয় প্রেমকে এতো কাছে থেকে মিস করলাম। ম্লান একটা হাসি দিয়ে বললাম
— প্রাক্তনের জন্য সব মেয়েরই একটু খারাপ লাগে। কি বল?
— কোন প্রাক্তন? প্রলয়? না সেই চোরটা?
হেসে ফেললাম। শম্পাদি সহ্যই করতে পারছে না সৈকতকে। বললাম
— কোনটা হলে খুশি হও?
ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকালো আমার দিকে। এরপরে এগিয়ে এলো আমার দিকে। আমার ঘরে ড্রেসিং টেবিলটা আমার বিছানার পাশে। ফলে বিছানায় বসলেও আমার হাত ধরা সম্ভব। আমার হাতে হাত রাখল। এরপরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
— এই ভুল করিস না।
কথাটা বুঝলাম না। প্রেমে পড়াটাকে ভুল বলছে? না এনগেজমেন্টটাকে ভুল বলছে। ক্লিয়ার হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম
— কোন ভুল?
উত্তর দিল না। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। এরপরে বলল
— এর মধ্যে দেখা হয়েছিল?
যদিও গেস করছি কার কথা বলছে, তারপরও জিজ্ঞেস করলাম
— কার কথা বলছো? প্রলয়? না চোর?
কথাটা দুষ্টুমির টোনে বললেও, উত্তরটা গম্ভীরভাবে আসল। শম্পাদির চোখ বলছে, শি ইজ সিরিয়াস।
— চোরটা।
কি উত্তর দিব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এক কথায় উত্তর দেয়া যায়, ‘হ্যাঁ’। কিন্তু মনে হল উনার প্রশ্ন আসলে অন্য। উনি জানতে চাইছেন সৈকতের সাথে সম্পর্কে কোন মোড় নিয়েছে কি না। কেন যেন মুখে কিছু আসল না। এরপরে টের পেলাম, শম্পাদিকে আর দেখতে পাচ্ছি না। ঝাপসা লাগছে।
নিজেকেই নিজে বুঝতে পারছি না। কি করছি আমি? কি হচ্ছে এসব? টের পেলাম কেউ আমার চোখ মুছিয়ে দিচ্ছে। এবার দেখতে পাচ্ছি শম্পাদিকে। উনার হাতে রুমাল। এরপরে কি যে হল, গড়গড় করে বলতে থাকলাম
— কালকে আংটি কিনতে গিয়ে দেখা হয়েছিল।
— তারপর?
এরপরের ঘটনা বলতে শুরু করলাম। কিভাবে হঠাৎ প্রলয়ের আগমন ঘটল। এরপরে কিভাবে একা একা মোহাম্মদপুর গেলাম। এরপরে সেই হাত চেপে ধরা এবং ‘এবার চলুন’।
— ঐ ব্যাটাও ওখানে খায় নাকি?
— হ্যাঁ। মাঝে মাঝে যায়। খুব মন খারাপ হলে।
শম্পাদি হাসলেন। এরপরে বললেন
— তো সমস্যা কি? সোহরাব সাহেব তো বলেইছেন, তোর অমত থাকলে এই বিয়ে হবে না।
— এখন, এই এনগেজমেন্টের দিনে বলা যায়?
— বাজে দেখাবে, বাট দুজনেরই জীবনটা বাঁচবে।
— ব্যাপারটা একেবারে ভাবিনি, তা না। বাট…
— এসব ব্যাপারে কোন বাট রাখবি না। হয় ইয়েস, অর নো। নো মাঝামাঝি।
শম্পাদি বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। মনে হচ্ছে এখনই গিয়ে মাকে সব জানাবেন। এনগেজমেন্ট স্টপ করাবেন। কথাটা তাই বলতেই হল
— ওর অ্যাফেয়ার আছে।
— হোয়াট?
মাথা নোড করে জানালাম, ‘ইয়েস’। এরপরে বললাম
— আমার সাথেই আংটি কিনল।
— সেটা যে ফিয়ঁসের জন্য, তোকে কে বলল?
— ও ই বলল।
— জিজ্ঞেস করেছিলি?
মাথা ঝুঁকিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ’। শম্পাদির উৎসাহে মহা ভাটা দেখা দিল। নিচের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। এরপরে বোধহয় বুঝতে পারল, কেন আমি এই বিয়ে করছি, আর কেনই বা কাঁদলাম। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন
— ইনদ্যাট কেস, পাগলামি এখানেই বন্ধ কর। একদম স্টপ। এনিয়ে আর একটা কথা হবে না।
ম্লান হাসলাম। মাথা ঝুঁকিয়ে বোঝালাম, আমি বুঝেছি। এরপরে আমার চুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
— চুল খোলা রাখবি?
— ঠিক করিনি এখনো।
কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপরে বলল
— খোলাই থাক।
এরপরে দুজনেই চুপ করে গেলাম। শম্পাদি টিস্যু নিয়ে আরেক দফা আমার চোখ মোছালেন। এমন সময় হাসি পেল। বললাম
— ছেলেটা কি করে জানো?
— চড় খাবি?
— শোনই না। আজকেই তো শেষ।
হাসলেন শম্পাদি। আমার মুখে প্রসাধন লাগাতে শুরু করবেন এখন। বললেন
— আচ্ছা বল।
— কাল যখন আমার হাত চেপে ধরল না…
— ওটা বুঝেছি, তখন খুব এক্সাইটমেন্ট হয়েছিল। তারপর
তারপর বলতে হলে আমাকে শুরু করতে হবে আমার ফ্ল্যাশব্যাক যাত্রা। সেটা শুরু করছি।
হাতটা ধরার পরে বেশ আঁতকে উঠেছিলাম। কিন্তু গলার আওয়াজটা বলে দিল, ভয়ের কিছু নেই। ইউ আর ইন সেফ হ্যান্ড। পাশে না তাকিয়েই সাথে সাথে এগিয়ে গেলাম।
প্রায় সব টুলই ফাঁকা। তারপরও এক কোণার দিকে পাশাপাশি দুটো টুলে গিয়ে বসলাম। ভয়ে ভয়ে ভ্যানওয়ালা মামার দিকে তাকালাম। দেখলাম এরই মধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। ভ্যানের নীচে একটা বক্স মত আছে, নীচু হয়ে সেখান থেকে কিছু একটা বের করছে। এবার বেরিয়ে এলো দুটো থালি। মনে হল প্রাণ ফিরে পেলাম। আমি তো ভেবেছিলাম খাওয়া শেষ। হয়তো পাব না।
আমাদের দিকে এগিয়ে আসল। মুখে মিটিমিটি হাসি।
— কেমন আছেন বস।
— এই তো।
— অনেকদিন পর আইলেন।
— অফিস ঐদিকে চলে যাওয়াতে সমস্যা হইছে।
আর তেমন কিছু বলল না। ফিরে গেলে প্রথম প্রশ্নটা আমিই করলাম
— বলে রেখেছিলেন নাকি?
মুখে খাবার ঢোকাতে ঢোকাতে উত্তর দিল
— হ্যাঁ।
— ইন্টেরেস্টিং।
— কেন?
— এই যে, গেস করা, আমি আসব।
একথার উত্তর দিল না। কিন্তু আমার ভেতর তখন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হয় না আর সুযোগ পাব। কি কি জানতে চাইব, গুছিয়ে নিলাম। তারপর খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি করেন?
ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। চোখে বিরক্তি কি না বোঝা যাচ্ছে না। কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। ব্যাটা কি ক্লিপ্টো? না আসলেই চোর টোর টাইপ কিছু? সেক্ষেত্রে এভাবে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে বিরক্ত হওয়ারই কথা। দ্রুত তাই প্রশ্ন চেঞ্জ করলাম। বললাম
— মানে, খিচুড়ি মামা তো দেখলাম চেনে আপনাকে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
এবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। কিলার ওয়ান। বলল
— আই অ্যাম অ্যা সিস্টেম অ্যানালিস্ট।
— আই সি।
— অ্যান্ড পার্ট টাইম হ্যাকার।
আচ্ছা। মানে চুরি বিদ্যা এখানেও খাটিয়েছে। হেসে ফেললাম। জিজ্ঞেস করলাম
— কি হ্যাক করেন? ক্রেডিট কার্ড?
আমার দিকে তাকাল। বোঝার চেষ্টা করল দুষ্টামি করছি কি না। এরপরে গম্ভীর হয়ে বলল
— না। পুলিশের হয়ে কাজ করি।
শেষ কথাটা শুনে সত্যি সত্যি ভিমড়ি খেলাম। ব্যাটা বলে কি? কেন যেন গলা শুকিয়ে গেল। খিচুরিওয়ালা মামা আমাদেরকে আগেই পানি দিয়ে গিয়েছিলেন। এক ঢোকে পুরোটা খেয়ে ফেললাম। এরপরে কোন রকমে বললাম
— আপনি পুলিশে আছেন?
মাথা নাড়ল। এরপরে বলল
— ঠিক পুলিশে না। বললাম না, পার্ট টাইমার। পুলিশের হ্যাকাররা না পারলে আমাকে ডাকে।
পানি শেষ। খিচুড়ি ওয়ালা মামাকে ইঙ্গিতে বোঝালাম পানি দিতে। উনি আরেক গ্লাস নিয়ে আসলেন। সেটারও অনেকটা খেয়ে ফেলার পরে কোন রকমে জিজ্ঞেস করলাম
— মানে আনিস সাহেব…
— ইয়েস। আপনার কেসটা আমাকেই দিয়েছেন উনি।
— আই সি। সেজন্যই সেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল। আপনি ওখানেই যাচ্ছিলেন?
মাথা নোড করল। হ্যাঁ।
— আসলে কেসটা ঠিক আমার না। আমার ফ্রেন্ডের। ওদেরকে ডিস্টার্ব করছিল একজন।
— আই নো।
আমিও মাথা ঝুকালাম। এই ব্যাটাই তো ট্রেস করে দিয়েছে সেই কালপ্রিটের অ্যাড্রেস। মিতুকে ডিটেইল পাঠিয়েওছিলাম। ও দেখলাম তেমন ইন্টেরেস্ট দেখাল না। মনে হয় প্রলয়ের সাথে বেশ ভালো রকমের ব্রেকাপ হয়ে গেছে। শুকোনো একটা ‘থ্যাংকস’ দিয়েছিল শুধু। ব্যাপারটা বোধহয় সৈকতকে বলা যায়।
— পরে আর সেই ফ্রেন্ডটা পারসু করতে চায়নি। সো…
— ওটা ভুয়া অ্যাড্রেস ছিল।
— ভুয়া অ্যাড্রেস মানে? ওখানে কেউ নেই?
মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বোঝাল, ‘না’। এরপরে বলল
— পুলিশকে আমি ভুল ইনফরমেশান দিয়েছি।
নিজের অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে গেল আমার। কেন দিয়েছে ভুল ইনফর্মেশান? প্রশ্নটা করার আগেই উত্তরটা পেয়ে গেলাম।
— কারণ আসল কালপ্রিট আমি।
— হোয়াট?
মাথা বনবন করে ঘুরছে। এই ব্যাটা তো দেখছি ঠাণ্ডা মাথার ক্রিমিন্যাল। হাত পা ঠাণ্ডা হতে শুরু করেছে। চোখে এখন আমার ভয়। তাকিয়ে আছি সৈকতের দিকে। সৈকত আমার ‘হোয়াট’ এর উত্তরে বলে চলল
— মানে থ্রেটনিং ম্যাসেজ দেয়া আর মিতুর মেইল হ্যাক করে ওখান থেকে অনলাইন জিডি আমিই করেছি।
আমি তখন রীতিমত হতভম্ব। খেতে ভুলে গেছি। সৈকতকে দেখলাম বেশ শান্ত মত খেয়ে যাচ্ছে। একবার আমার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। মানে কি হয়েছে, খাচ্ছেন না কেন? উত্তরে কিছু বলতে পারলাম না। সেভাবেই হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে।
কিছুক্ষণ পরে আবার আমার দিকে তাকাল। সুন্দর করে হাসল। আমার চোখের প্রশ্নটা পড়তে পারছে বোধহয়। ওখানে লেখা আছে, ‘কিন্তু কেন?’ এবার উত্তরটা দিল। শুনে বুঝে ফেললাম, কাহিনী যতোটা কাকতালীয় ভাবছি, ততোটা না। সৈকত বলল
— প্রলয় ডিজার্ভড অ্যা পানিশমেন্ট।
কোন রকমে গলা দিয়ে একটাই আওয়াজ বেরোল।
— কেন?
সৈকতের খাওয়া শেষ। ধীরে সুস্থে পানিটা খেল। এরপরে আমার চোখে চোখ রেখে উত্তর দিল
— বিকজ, হি ইন্সাল্টেড অ্যা ক্লিপ্টোম্যানিয়াক।
চলবে
Razia Susltana Jeni
Send private message to author





