ক্লিপ্টোম্যানিয়াক পর্ব ১৭

১৭

আজকে বিয়ে। বেশ অনেক ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে, অবশেষে, এখন আমি বিয়ের পিঁড়িতে। বেনারসিটা এখন পড়িনি, ওটা সন্ধ্যায় পড়ব। আসলে অনুষ্ঠান সন্ধ্যায়। এখন এটা হচ্ছে সেটা ছোটখাট আক্দ। ছোট পরিসরে বিয়ে হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলে পক্ষে আসবে। এটাই এখনকার নর্ম। বিয়েটা আগে সেরে ফেলা হয় যেন সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে মেহমান আসবার সাথে সাথেই খেতে দেয়া যায়।

শম্পাদি এতক্ষণ এখানেই বসে ছিলেন। বলছিলেন, আজ আবার কিছু না ঘটলেই হয়। এমন বিদঘুটে বিয়ে জীবনে দেখিনি।

বললাম, খুব ভরসা কিন্তু পাচ্ছি না। 

উনিও হাসলেন। এমন সময় মা ডাকতে আসলেন। ঠিক বুঝলাম না, ছেলেপক্ষ এসেছে, না এমনি কাজে হেল্প করার জন্য।

এনিওয়ে, আমার কাহিনীর বেশ কিছু অংশ ফাঁকা থেকে গেছে। এখন সেসব শূন্য স্থান পূরণ করব। প্রথমে চলে যাচ্ছি সেই খিচুড়ি ডে তে। সৈকত মশাই এইমাত্র জানালেন, তিনি একজন হ্যাকার এবং প্রলয়কে জেলে উনিই পাঠিয়েছিলেন। 

কারণটা শোনার পরে হেসে ফেললাম

— আপনি কি করতেন?

— মানে?

— মানে আপনার প্রেমিকা যদি চুরি করে একপাল মেহমানের সামনে ধরা পড়ত?

আমার দিকে তাকাল। এরপরে বলল

— আর যা ই করি, ওর হাত ছাড়তাম না।

কথাটা শুনে কেমন যেন বুকে ধাক্কা দিল। মনে হল এই মানুষটাকে পাশে পেলে দারুণ একটা জীবন কাটত। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। এখন আর কিছু হওয়া সম্ভব না। এমন না যে সোহরাব সাহেবকে সব বুঝিয়ে বলতে পারব না। আসলে আমি নিজেই জানি না আমার সম্পর্কে ও কি ভাবছে। খুব সম্ভব পাগলাটে একটা ক্যারেক্টার ভাবছে। যে নিজের মত একজন ক্লিপ্টোম্যানিয়াককে দেখে দুম করে আই লাভ ইউ বলে। কিংবা রাস্তার ধারে বসে পাঁচ টাকা দিয়ে লেবারদের খিচুড়ি খায়। 

— একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

মাথা কাত করে বোঝালাম পারেন। খাওয়া শেষ। পানির গ্লাসটা নিয়ে ঠোঁটে লাগালাম। এখন কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে গুরুতর কিছু। সময় নেবে। পানি খাওয়া শুরু করলাম। এমন সময় কথাটা বলল 

— সেদিন যা বলেছিলেন, মিন করেছিলেন? না দুষ্টুমি?

পানিটা গিলতে ভুলে গেলাম। স্ট্যাচু বলতে যা বোঝায়, এই মুহূর্তে আমার সেই অবস্থা। গ্লাসটা ধরে আছি। পানি খাচ্ছি না। মনে হল হার্ট থেমে গেছে। কি উত্তর দিব? বুঝতে পারছি না। 

অনেস্ট উত্তর দেয়া মানে কাহিনী কমপ্লিকেটেড করে দেয়া। ছেলেটার প্রেম আছে। সো ‘মিন করেছিলাম’ বললে ও হয়তো একটা সরি বলবে। আর সেটা একটা কষ্টের দাগ তৈরি করে দেবে। যেটা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। শম্পাদি যেমন বলেছিল, সব মেয়ের জীবনেই একটা শামিম থাকে। 

মিথ্যা বলার ব্যাপারে আমার পার্ফরম্যান্স বেশ খারাপ। চোখ বিট্রে করে। আসলে এই আলাপটাই করতে মন চাইছে। ছেলেটাকে মনে প্রাণে খুঁজছিলাম একটা সুন্দর গুড বাই বলার জন্য। প্রায় হয়েও এসেছিল ব্যাপারটা। কিন্তু ছোট্ট এই প্রশ্নটা সব তছনছ করে দিল।

বড় একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। সুন্দর করে মিথ্যেটা বলতে হবে। বলাটা সুন্দর হল কি না জানি না, তবে বললাম।

— ওটা দুষ্টুমি ছিল।

আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। এরপরে নোড করল। ‘বুঝেছে’। এরপরে বলল

— আপনাকে আরও একটা কথা বলা হয়নি।

— কি?

— আই হ্যাকড ইয়োর ফোন। 

— হোয়াট?

— আসলে আর কোন অপশান ছিল না। আপনি সেদিন হঠাৎ করে বললেন ’আই লাভ ইউ’। আমিও বেশ কনফিউজড হয়ে গেলাম। বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কি করব। দেন আনিস সাহেব যখন জানাল আপনি ট্রেস করেতে এসেছেন কে প্রলয়কে জেলে পাঠিয়েছে তখন আমার ভেতরেও দুষ্টুমি জাগল। ভাবলাম দেখি না মেয়েটা কে।

রেগে যাওয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু রাগতে পারলাম না। আমাকে তখন গল্প শোনার নেশায় পেয়েছে। আর কি কি করেছে এই ছেলে। বললাম

— কি দেখলেন।

— দেখলাম আপনার নাম মিনু। একটা কিন্ডার গার্ডেনে পড়ান। শম্পাদি হচ্ছে আপনার সবচেয়ে ক্লোজ। আর কয়েকদিন পরে আপনার এনগেজমেন্ট। ভদ্রলোকের নাম সোহরাব। অ্যান্ড… 

কথাগুলো শুনছিলাম আর মনে হচ্ছিল আমি তলিয়ে যাচ্ছি। মনের কোণে কি কোন আশা জেগেছিল? মনে হয়েছিল, আমার সেই ‘আই লাভ ইউ’কে ও সিরিয়াসলি নিয়েছে? ওর বলার ভঙ্গি দেখে তো সেটা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওর বসকে কোন অ্যাসাইনমেন্টের রিপোর্ট দিচ্ছে।

কিন্তু ‘অ্যান্ড’ বলার পরে থেমে যাওয়ায় প্রশ্নটা নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। 

— অ্যান্ড?

এবার আমার চোখে চোখ রাখল। সুন্দর করে হাসল। বলল

— থার্সডে তে এগারোটায় ভেনাস জুয়েলার্সে যাচ্ছেন, আংটির মাপ দিতে।

নিজের অজান্তেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ছেলেটা এই কদিন আমার প্রাইভেট আলাপ শুনেছে, জেনে আমার যে পরিমাণ রাগ হওয়া উচিৎ ছিল, তার কিছুই হল না। বরং ওর কথার উত্তরে অবাক হয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলাম

— আপনি জানতেন আমি আসব?

— ইয়া। এগারোটা থেকেই আপনার জিপিএস ট্রেস করছিলাম। দেখি কোন মুভমেন্ট নেই। একটার দিকে মুভমেন্ট শুরু হল।

কি বলছে, তার কিছুই বোধহয় আমার কানে ঢুকছে না। আমি তখন রীতিমত হতবাক। জিজ্ঞেস করলাম

— তার মানে জুয়েলারি শপে আপনার সাথে দেখা হওয়াটা কো ইন্সিডেন্স না?

মাথা দুদিকে নেড়ে বোঝাল ‘না’। 

মনে হল আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে, আমি ভালোভাবেই এই ছেলের প্রেমে পড়ে যাব। আর সেটা হলে, মাই লাইভ উইল বি মিজারেবল। কিভাবে কথাটা বললাম জানি না। তবে বললাম

— আমাকে ফিরতে হবে।

ছেলেটার দিকে তাকাতে পারছি না। মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলব। ছেলেটা কি আমার দিকে তাকিয়ে আছে? ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। 

— চলুন, আপনাকে ড্রপ করে আসি।

— আমি যেতে পারব। 

কথাটা নিজের কানেই কেমন কর্কশ শোনাল। কেন এমন করলাম জানি না। শুধু জানি আমাকে এক্ষুনি এখান থেকে পালাতে হবে। 

— এসে গেছে।

শম্পাদির আওয়াজে ঘোর ভাঙল। তাকালাম শম্পাদির দিকে। আমার চোখে পানি। সেদিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল শম্পাদি।

— আবার কি হল?

হেসে ফেললাম। বললাম

— কিছু না।

— আবার বর পাল্টাবি নাকি?

— না। এটা ফাইনাল।

— হলে এখনও বল। কবুল এখনো হয়নি।

মাথা নিচু করলাম। আমার অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে আংটিটা। সেটার দিকে তাকিয়ে বললাম

— মনে আছে এনেগেজমেন্টের দিনের কথা?

— মনে থাকবে না। আরেকটু হলে তো আমারই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত।

তাকালাম শম্পাদির দিকে। এবার হাসলাম। 

— তবে সেদিন কিন্তু তুই, তুই ছিলি না। 

একথাটা আমার নিজেরও মনে হয়। সেদিন যখন মা এসে বলল ‘সোহরাব সাহেব ডাকছে’ তখন প্রথমে মনে হয়েছিল দুনিয়ে টলছে। এরপরে যখন মায়ের ঐ পাংশু মুখের দিকে তাকালাম, তখন মনে হল, ‘আর না’। আমার জন্য আমার মাকে আর ভয় পেতে দেব না। যে আওয়াজে আগে কখনো কথা বলিনি, হঠাৎ গলায় সেই কমান্ডিং টোন চলে এলো। মাকে বেশ শক্ত গলায় বললাম

— উনাকে গিয়ে বল, আমি রেডি হয়ে একেবারে আসব।

— উনি যে…

— যদি ওয়েট করতে না পারে, বল চলে যেতে।

এরপরে শম্পাদির দিকে তাকিয়ে বললাম

— শেষ কর মেকাপ।

আমার বলার ভেতরে কিছু একটা ছিল, দেখলাম মা চুপচাপ চলে গেলেন। শম্পাদিও আমাকে আর কিছু বললেন না। 

টের পাচ্ছি, শম্পাদির হাত কাঁপছে। আয়নায় আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। মুখের মাংস পেশী শক্ত হয়ে আছে। চোখ রাগে জ্বলছে। একসময় নিজেই থামালাম শম্পাদিকে। মোটামুটি হয়ে এসেছে। 

উঠে দাঁড়ালাম। একবার ভাবলাম ঘোমটা দেব কি না। সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করলাম। এরপরে মাথা উঁচু করে হেঁটে এগিয়ে গেলাম। 

আমার রুম থেকে বেরিয়ে ডান দিকে ঘুরলে একটা প্যাসেজ। আরেকটু এগিয়ে গেলে ড্রয়িং রুম। শম্পাদি বোধহয় চাইছিলেন উনি পাশে পাশে আসবেন। উনাকে সেই সুযোগ দিইনি। বেশ দ্রুতই এগিয়ে গেলাম। 

সোহরাব সাহেবের বাসা থেকে বেশ কয়েকজন মহিলাই এসেছেন। জনা পাঁচেক হবে। খালা, মামী চাচী টাইপ হবেন। মা আসেননি। উনি আসবেন না, আগেই জানতাম। সবারই মুখ দেখলাম বেশ বেজার। 

এক পাশে দুটো সিঙ্গেল সোফার একটায় বসে আছে সোহরাব সাহেব। অন্যটায় প্রলয়। ওদের দিকে না গিয়ে প্রথমে তাকালাম বরপক্ষের মেয়েদের দিকে। উনারা আগে থেকেই একটু জায়গা ফাঁকা রেখেছিলেন। আমার ওখানে গিয়ে বসার কথা। সেটা না করে আমি এদিকে একটা সোফায় বসলাম। এরপরে উনাদের দিকে তাকিয়ে বললাম

— আপনাদেরকে আমার কিছু বলার আছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে ফার্স্ট ইয়ারে আমার একটা প্রেম হয়। এই সেই ছেলে। ওর নাম প্রলয়। বছর পাঁচেক প্রেম করি ওর সাথে। এর পরে আমাদের প্রেম ভেঙ্গে যায়। কারণ ওর এক ফ্রেন্ডের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে আমি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ি।

এতোটুকু বলে আমি থামলাম। মা আর বাবা আমার বাঁ পাশে বসে আছে। উনাদের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি, উনারা মুষড়ে পড়েছেন। আর সামনে বসা মাই চাচী বাহিনীর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। একটু বিরতি নিয়ে বাকীটা বলব ঠিক করে রেখেছিলাম। সেটা নেয়া হয়ে গেছে। আবার শুরু করলাম

— আমি ক্লিপ্টোম্যানিয়াক। এক ধরণের মানসিক রোগ। এই রোগ থাকলে মানুষ ছোট খাট জিনিস চুরি করে। ব্যাপারটা আমি সোহরাব সাহেবকেও জানিয়েছি। উনি মনে হয় না আপনাদের জানিয়েছেন। তাই আমি নিজেই জানালাম।

এবার সোহরাব সাহেবের দিকে তাকালাম। মনে হল আমার এই স্ট্রেট ফরোয়ার্ড কথাবলাটা উনি পছন্দই করেছেন। ব্যাপারটা একেবারে আশা করিনি, তা বলব না। উনাকে এই কদিনের পরিচয়ে যতোটা চিনেছি, নোংরা মন উনার না। আগে প্রেম আছে, কিংবা লোকে কি বলবে, এসব কমপ্লেক্সিটি উনার নেই। 

এবার প্রলয়ের দিকে তাকালাম। বললাম

— তোমাকে আর কতবার বললে তুমি বুঝবে, ইটস ওভার। আই মুভড অন।

মনে হয় প্রলয় প্রশ্নটার জন্য তৈরি ছিল। আমার কথা শেষ হওয়ার পরে শান্ত গলায় বলল

— শুধু একটা প্রশ্নের অনেস্ট উত্তর দাও। আমি চলে যাব।

যে কনফিডেন্স নিয়ে এতক্ষণ কথা বলছিলাম, সেটায় হালকা একটা চিড় ধরল। প্রলয়কে যতোটা চিনি, বিয়ে ভাঙ্গানোর জন্য ও আসেনি। কোন কারণে ওর মনে ধারণা জন্মেছে, আই স্টিল লাভ হিম। সে কারণেই এসেছে। ওর গলার আওয়াজ বলছে, ওর কাছে অকাট্য প্রমাণ আছে। কেন যেন বুকটা কেঁপে উঠল। কি হতে পারে সেই প্রমাণ? গলায় খুব জোর না থাকলেও, প্রশ্নটা করলাম

— কি প্রশ্ন?

— তুমি দিন কয়েক আগে একটা ছেলেকে ‘আই লাভ ইউ’ বলেছো, শুধু এই কারণে যে ওর স্মাইলটা আমার সাথে মেলে।

এতক্ষণ যে স্মার্ট নেসের সাথে আমি কথা বলছিলাম, সেটা এক মুহূর্তে নিভে গেল। এমন একটা প্রশ্নের জন্য একেবারেই তৈরি ছিলাম না। হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকলাম প্রলয়ের দিকে। মুখে কোন কথা আসছে না। শুনতে পেলাম প্রলয় বলছে

— দ্যাট মিনস, ডিপ ইন ইয়োর মাইন্ড, ইউ স্টিল লাভ মি। শুধু আমার সাথে ছোট্ট একটা মিল থাকায়, এক দেখাতে তুমি ছেলেটাকে ভালোবেসে ফেলো। এর পরও বলবে, ইউ মুভড অন?

আমি ফ্যালফ্যাল করে সোহরাব সাহেবর দিকে তাকালাম। উনি বেশ শান্ত। আমি কোন উত্তর দিচ্ছি না দেখে উনি খুব মোলায়েম স্বরে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন

— প্লিজ। গিভ অনেস্ট অ্যান্সার। শুধু স্মাইল মেলে বলে ছেলেটাকে প্রপোজ করেছিলেন?

মনে হল আমি তলিয়ে যাচ্ছি। সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। শুনতে পেলাম আমি অনেস্ট উত্তরটা দিচ্ছি

— ইয়েস। 

চলবে

Razia Sultana Jeni

Send private message to author
What’s your Reaction?
2
4
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!