১৮
আজ শম্পাদিকে দাওয়াত করেছি। শুধু উনাকে না, আরও দুজনকে। রাতে। আর কিছুক্ষণের ভেতরেই চলে আসবে। শম্পাদিকে শুধু একটু আগে আসতে বলেছি। বাকীদের আটটার আগে এক্সপেক্ট করছি না। সবাই আসছে ফ্যামিলি নিয়ে। আমি অলমোস্ট রেডি। মা আসতে চেয়েছিলেন, হেল্প করতে। আমি বারণ করেছি। রান্না বান্না একেবারে পারি না, এমন তো না। জাস্ট এবাড়ীতে প্রথম।
কলিং বেল বাজল। শম্পাদি আই গেস। এগিয়ে গিয়ে খুললাম। ঠিকই। এই মুহূর্তে অবশ্য আমি বাসায় একা। পতিদেব গেছেন মিষ্টি আনতে। দোকানে না, অনলাইন অর্ডার। একটু আগে ফোন এসেছিল, নিয়ে এসেছে। বাড়ি চেনানো যে ঝামেলা, তার চেয়ে মোড়ের ফার্মেসির কাছে ওয়েট করতে বলাটা অনেক সুবিধার। ওখান থেকেই আনতে গেছে।
— সুখ তো দেখি ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে।
শম্পাদি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন। আসলেই। সময়টা বেশ আনন্দের মাঝেই কাটছে। কিন্তু কথাটা মেনে নেয়াটা অস্বস্তিকর। বললাম
— কি যে বল না?
— ন্যাকামি করিস না। ঐ সময় আমাদেরও ছিল।
— তাই? জানতাম না তো?
— আ হা! দুটো বছর যেতে দে না, বর কাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাবি।
— তুমি পাচ্ছো?
— পাচ্ছি না আবার? এখন তো ন’টার আগে বাসায়ই ফিরে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে… বাদ দে। বাকীরা কই?
বাকীরা কে কে সেটা একটু পরে বলছি। আপাতত এতোটুকই বলা যায়, আজ তিনজন প্রথম বারের মত মুখোমুখি হচ্ছে। একসাথে একই ছাদের নীচে দেখা হচ্ছে। নাও দ্যা ভাইটাল কোয়েসচেন ইজ, হু ইজ মাই হাবি। বলছি। আগে সেদিনের বাকী গল্পটা শেষ করে নিই।
তো সেদিন যখন এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠানে প্রলয় প্রশ্নটা করল, তখন বেশ ভড়কে গিয়েছিলাম। আর যখন উত্তরটা ইয়েস অর নো তে দেয়ার অপশান দেয়া হল, তখন ব্যাপারটা পুরোটাই অফ ট্র্যাক হয়ে যায়। আর সেই প্রশ্নের উত্তরে ‘ইয়েস’ বলার পরে ঘরে ছোটখাট একটা ভূমিকম্প হয়ে যায়। আমার চোখে যখন পানি টলমল করছে তখন শুনতে পেলাম বরপক্ষের একজন মহিলার আওয়াজ।
— তুই কি এখনও বসে থাকবি?
কথাটা সোহরাব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে। ঝাপসা চোখে এটা বুঝতে পারলাম, মহিলারা প্রায় সবাই দাঁড়িয়ে। মা হয়তো বাধা দিতেন, কিন্তু উনিও রীতিমত প্যারালাইজড। উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই। শম্পাদি সোফার পেছনে থাকলেও, কোন শব্দ করলেন না। উনার হাত আমার ঘাড়ে। উনার পুরো মনোযোগ আমাকে শান্ত করায়।
— আমি থাকছি। তোমরা ইচ্ছে করলে যেতে পারো।
আওয়াজটা সোহরাব সাহেবের। বেশ গম্ভীর কণ্ঠ। এবং ডিসাইসিভ। বোঝাই যাচ্ছে, এই কাহিনীর শেষ না দেখে উনি উঠবেন না।
— আপা ঠিকই বলেছিল। এই মেয়ে তোকে যাদু করেছে।
উত্তরে সোহরাব সাহেব কিছু বললেন না। শুধু হাতটা বাড়িয়ে দিলেন উনার খালার দিকে। শম্পাদি ততোক্ষণে একটা টিস্যু এগিয়ে দিয়েছেন আমার দিকে। চোখ মোছার পর দেখলাম সোহরাব সাহেবের খালা ভয়ানক চেহারা। পারলে সোহরাব সাহেবকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন। বাড়িয়ে দেয়া হাতে এনগেজমেন্ট রিংটা দিতে দিতে বললেন
— এতো কিছুর পরও?
— যদি উনি রাজী থাকেন।
— তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?
— সত্যি বললে বিয়েটা ভেঙ্গে যাবে জানার পরেও যে মেয়ে সত্যি বলতে পারে, তার চেয়ে অনেস্ট জীবন সাথী আর হয় না।
চোখ দিয়ে তখন আগুন বেরোচ্ছে খালার। এতোক্ষণ সোহরাব সাহেবের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার এক পলকের জন্য আমাকে দেখলেন। চোখ বলছে, উনি একজন চিরশত্রুর দেখা পেয়েছেন। এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই শত্রুতা তিনি বজায় রাখবেন। আর কিছু না বলে তিনি তাঁর দলবল নিয়ে চলে গেলেন। সোহরাব সাহেব এগিয়ে গিয়ে উনাদের গাড়ীতে উঠিয়ে দিয়ে আসলেন। আমি বসেই ছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে সোহরাব সাহেব আসলেন। সম্ভবত উনাদের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আগের সোফাটায়ই বসলেন। তবে এবার সোহরাব সাহেব আর কিছু বললেন না।
মা এমনিতেই অসহায়ের মত সোফায় পড়ে ছিলেন। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে শুধু বললাম
— বাবা, মাকে ওঘরে নিয়ে যাও।
বাবা মাথা নোড করে বোঝালেন, তিনিই একমত। এরপরে তিনি মা কে নিয়ে বেডরুমের দিকে চলে গেলেন। রুমে এখন আমি, প্রলয় আর সোহরাব সাহেব। আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন শম্পাদি। শম্পাদিকে বসতে বললাম। উনি রাজী হলেন না। বোঝালেন এখানেই ঠিক আছেন।
এবার আমি প্রথমে সোহরাব সাহেবের দিকে তাকালাম। পরে প্রলয়ের দিকে। দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও প্রলয়কে কোন ব্যাখ্যা দেয়ার ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু সোহরাব সাহেবকে দিতে চাই। কিভাবে শুরু করব ভাবছি, এমন সময় উনিই আমার এরপরে আমার দিকে তাকালেন। বললেন
— সো, কোথায় ছিলাম আমরা?
হয়তো পরিস্থিতি হালকা করার জন্যই বললেন কথাটা, তবে কাজ করল। উনার সাবলীলতা আমাকেও ইনফেক্ট করল। সোহরাব সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। এরপরে প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম
— মনে আছে কিভাবে প্রথম পরিচয় হয়েছিল আমাদের?
এবার হতভম্ব হওয়ার পালা প্রলয়ের। রোবটের মত মাথা নোড করল। বলল
— হ্যাঁ।
— জানি না কেন সেদিন ওভাবে আমার সাথে আলাপ করতে এসেছিলে, বাট আমার মনে হয়েছিল, কেন শুধু ছেলেরা অ্যাডভান্টেজ পাবে। টিজ তো আমরাও করতে পারি। তাই সেদিন একইভাবে তোমাকে টিজ করেছিলাম।
এবার সোহরাব সাহেবের দিকে তাকালাম। বললাম
— অনেকটা টিজের বদলা টিজ দিয়ে প্রলয়ের সাথে আমার আলাপের সূত্রপাত হয়। এরপরে ও প্রপোজ করে। আই এগ্রিড। হ্যাঁ, ওর হাসিটা ছিল আমার উইক পয়েন্ট। হাসলে ওর গালে টোল পড়ত। সুন্দর লাগত দেখতে।
কথাটা বলে থামলাম। সোহরাব সাহেব এই মুহূর্তে একজন মনযোগী শ্রোতা ছাড়া আর কিছু না। মনে হচ্ছে না তিনি তাঁর হবু জীবন সঙ্গিনীর প্রেম কাহিনী শুনছেন। উনি আসলে বুঝতে চাইছেন, আমার ভেতরে প্রেম এখনও অবশিষ্ট আছে কি নেই। ম্যানেজার মানুষ। ক্লায়েন্ট হ্যান্ডল করাই উনার কাজ। সামনের মানুষটির মন পড়তে পাড়ার ওপর নির্ভর করছে উনার সফলতা। ব্যাপারটা খুব খারাপ পারেন মনে হয় না। এক পলক দেখলাম শুধু উনাকে। এরপরে আবার বলতে শুরু করলাম
— পাঁচ বছর চলেছিল আমাদের প্রেম। এরপরে উই ব্রোক আপ। সেই গল্পতো আপনাকে আগেই বলেছি।
উনি মাথা ঝুকালেন। বলেছি। এখন আমি অনেকটাই স্বাভাবিক। বলে চললাম
— এবার চলে আসি আমার আর আপনার গল্পে। আপনার সাথে প্রথম যেদিন দেখা হওয়ার কথা ছিল, সেদিন আমি একটু আগেই চলে যাই। যখন ওয়েট করছিলাম, তখন চোখ চলে যায় আমার আমার সামনের টেবিলে। ওখানে বসেছিল একটা ছেলে। হঠাৎ দেখি, ও রেস্টুরেন্টের নাইফ আর ফর্ক চুরি করছে। বুঝে যাই, সে ও আমার মত ক্লিপ্টোম্যানিয়াক। ব্যাপারটা কেমন যেন এক্সাইট করে আমাকে। আমি তাকিয়ে ছিলাম ছেলেটার দিকে। ছেলেটা যখন এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, তখন লক্ষ্য করে ব্যাপারটা আমি দেখে ফেলেছি। চোখাচোখি হয়। এরপরে ছেলেটা হেসে দেয়। হাসিটা অনেকটাই প্রলয়ের মত। গালে টোল পড়ে। অনেস্টলি স্পিকিং, ঠিক সেই মুহূর্তে… আই ফেল ইন লাভ। বাট… নট লাইক লাভ। আই মিন… কেন যেন হঠাৎ করে স্টুডেন্ট লাইফে ফিরে গিয়েছিলাম। দারুণ কোন হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলে মনে মনে প্রেমে পড়তাম না, সেরকম। কেন যেন মনে হয়েছিল আবার প্রেম করি।
একটানা বলে থামলাম। সোহরাব সাহেব আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি থামলে উনি বললেন
— ব্যাস?
হেসে ফেললাম। উনাকে দেখে মনে হল দারুণ রোমান্টিক এক গল্পের বিচ্ছিরী এন্ডিং শুনে উনি বেশ হতাশ। শেষটা শুনে উনার তৃপ্তি হল না। এবার উনি প্রলয়ের দিকে তাকালেন। মনে হচ্ছে কিছু বলবেন। তার আগেই আমি থামালাম। বললাম
— না। আরও আছে।
সোহরাব সাহেব প্রলয়ের দিকে ঘাড় ঘুড়িয়েছিলেন। এবার আবার আমার দিকে তাকালেন।
— তাই? শুনি তাহলে।
আমাকে তখন গল্প বলাতে পেয়েছে। আবার শুরু করলাম
— এরপরে কি যে হল, আমার মন কেবল চাইছিল, ছেলেটার সাথে যদি আর একবার দেখা হত? নামটা অন্ততঃ যদি জানতে পারতাম। কিংবা… আই ডোন্ট নো, আমি আসলে কি চাইছিলাম, বাট… আমি এরপরে কয়েকদিন ঐ ক্যাফেতে, ঠিক ঐ সময়ে যাই।
— আই আন্ডারস্ট্যান্ড। তারপর?
নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। ব্যাপারটা কি উনি লক্ষ্য করলেন? এসব নিয়ে ভাববার মতো অবস্থা তখন আমার না। আমি গল্প বলে গেলাম
— তারপর হঠাৎ করে একদিন এক রেস্টুরেন্টে ওর দেখা পাই। আমি তখন মিতুর সাথে, মানে প্রলয়ের…
— উই ব্রোক আপ।
প্রলয় জানান দিল। মিতুর সাথে আর প্রেম নেই। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না। আমি গল্প বলতে লাগলাম
— সো আমি আর মিতু তখন নাস্তা করছি। ছেলেটাকে দেখতে পেয়ে কি যে হল, মনে হল আই কান্ট মিস দিস অপারচুনিটি। কি বলব, কি করব, কিচ্ছু না ভেবে সোজা ওর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ও ল্যাপটপে কাজ করছিল। সামনে আমাকে দাঁড়াতে দেখে চোখ তুলে তাকাল। আমাকে চিনতে পারল কি না জানি না, বাট স্মাইল করল। টোল পড়া স্মাইল। দেন… আই লস্ট মাইসেলফ। নিজের পরিচয় দিই। হ্যান্ডশেক করি, অ্যান্ড… আই সেইড ইট।
কথাগুলো বলে সোহরাব সাহেবের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বেশ রিলিভড লাগছে। মনে হচ্ছে দারুণ কঠিন একটা পরীক্ষা খুব ভালো ভাবে দিলাম।
সোহরাব সাহেব দেখলাম বেশ গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এবার প্রলয়ের দিকে তাকালেন। প্রলয় কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এমন সময় সোহরাব সাহেব বলতে শুরু করলেন
— আই থিঙ্ক, শি ডাসন্ট লাভ ইউ।
কথাগুলো প্রলয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন।
— অ্যান্ড আই ডোন্ট থিঙ্ক, উনি যা করেছেন, সেটা… নট বিকজ অফ ইউ। এটা আলাদা প্রেম। এবং সেটা কতোটা সিরিয়াস, সে ব্যাপারে আমি সিওর না। তবে এটা আপনার সাবসটিটিউট খোঁজার চেষ্টা না। ইট ইজ অ্যা নিউ ওয়ান। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
— আমার অনেস্ট অপিনিওন হচ্ছে, ইউ সুড প্রসিড। আই মিন ইফ হি ইজ অ্যাভেইলেবল। যদি প্রেম ট্রেম না থাকে।
আমি চুপ করে আছি। কি বলব বুঝতে পারছি না। সোহরাব সাহেব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বললেন
— এনি প্রবলেম?
অসহায়ের মত তাকালাম সোহরাব সাহেবের দিকে। কি বলব? উনি বোধহয় গেস করলেন। সামথিং রং। জিজ্ঞেস করলেন
— ডিড হি সে নো?
মাথা দুদিকে নেড়ে বোঝালাম, ‘না’। এবার উনাকে বেশ কনফিউজড মনে হল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
— দেন? কন্টাক্ট হিম। নাম্বার আছে তো?
মাথা দুদিকে নেড়ে বললাম
— না।
এমন সময় পেছনে দাঁড়ানো শম্পাদি বলে উঠলেন
— আনিস সাহেবের কাছে আছে।
— আনিস সাহেব?
সোহরাব সাহেবের চোখে মুখে বিস্ময়। উনি হয়তো প্রশ্ন করে ডিটেইল জানতে চাইতেন, কেন নেই। শম্পাদি সেই সুযোগ দিলেন না। বললেন
— প্লিজ একটু উনাকে ফোন করবেন? বলুন না সৈকতের নাম্বারটা দিতে।
কাজটা হয়তো আমরাও করতে পারতাম। বাট… সেক্ষেত্রে ‘নো’ বলার একটা চান্স ছিল। পুলিশের জন্য ফ্রিল্যান্স করে। উনারা নাম্বার ডিস্ক্লোজ না ও করতে পারেন উনারা। কিন্তু সোহরাব সাহেবকে হয়তো ‘না’ বলবেন না।
সোহরাব সাহেব ইতিমধ্যে ফোন লাগিয়ে ফেলেছেন। কথা বলছেন। শুনছেন ওদিকের কথা। একসময় ফোনটা রাখলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে সামথিং রং।
— ছেলেটা লাপাত্তা। ফোন বন্ধ।
চলবে
Razia Sultana Jeni
Send private message to author





