ডাক্তারের চেম্বারের সামনে ওয়েটিং রুমে চেয়ারে বসে আছে নাজনীন। সাথে আছে বান্ধবী লুনা। কয়েকদিন থেকেই নাজনীনের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। কোন কিছু খেতে পারছে না। আজ লুনা এক প্রকার জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছে। মা যদিও আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু উনিও বেশ ক্লান্ত। আর ক্লান্ত হবেন নাই বা কেন! একমাত্র মেয়ের স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। টোনাটুনির বারো বছরের সংসার এক নিমিষেই শেষ। রায়হানের মৃত্যু, ওর দাফনকাজ, বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন সবকিছু ছাপিয়ে মেয়ের জীবনের চিন্তায় মাও বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
রায়হান আর নাজনীন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে টা হয়েছিল। বিয়ের পর পর সব কিছু স্বপ্নের মতোই ছিল। ছিলোই বা বলছি কেন, দশ দিন আগেও ওদের সংসারকে উদাহরণ হিসেবে দেখা হতো। দু’জন যেন শুধুই দু’জনার। এই বারো বছরে ওদের যে কোন মনোমালিন্য হয়নি তা কিন্তু না, বরং ওদের ভালোবাসা সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। আর সেই জন্যই বোধহয় সকলের কাছে ওরা আদর্শ দম্পতি ছিল। বিয়ের পর একটু একটু করে সংসার গোছানো। ঈদে উৎসবে বাড়ী যাওয়া। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আত্মীয়স্বজনের পাশে থাকা। পারিবারিক যে কোন আয়োজনে রায়হান নাজনীনের উপস্থিতি অপরিহার্য। ওদের বিয়ের আগেই রায়হানের মা মারা যান। আর তাই নাজনীনের মা রায়হানকে পুত্র স্নেহে গ্রহণ করেছিলেন। রায়হানকে উনি জামাতা নন, নিজ পুত্রের মতোই ভালোবাসতেন। রায়হানের মৃত্যু উনি কোন ভাবেই মানতে পারছেন না। আর রায়হানের বাবা স্ত্রী বিয়োগের পর নাজনীনকে পুত্রবধু হিসেবে পান। উনিও নাজনীনের উপর ভীষণ ভাবে নির্ভরশীল। আর এখন পুত্রকে হারিয়ে উনি প্রায় নির্বাক। শুধু ফ্যালফ্যাল চোখে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই মানুষগুলোকে সামলাতে গিয়ে নাজনীনের শরীর আরও খারাপ হয়ে গেছে।
দিন দশেক আগে রায়হান অফিস থেকে বের হওয়ার সময় নাজনীনকে ফোন দিয়ে বলে, ” আমি এখনই বের হচ্ছি, তুমি কখন অফিস থেকে বের হবে? আজ তো আবার ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, মনে আছে তো? “
—— হ্যা হ্যা মনে আছে। আমিও বের হচ্ছি। তুমি সরাসরি বাসায় আসো। ফ্রেস হয়ে তারপর বের হবো।
—— ঠিক আছে ম্যাডাম।
এই বলেই রায়হান ফোন কেটে দিলো। নাজনীনও সব কিছু গুছিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিলো।
রায়হান আর নাজনীনের বিয়ের অনেক দিন হয়ে গেলেও কোন সন্তানাদি নেই। ওরা আশাও ছেড়ে দিয়েছে। এই নিয়ে রায়হানের অবশ্য কোন হেলদোলও ছিল না। কিন্তু কয়েকদিন হলো রায়হানের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অনেক জোরাজুরির পরে রায়হান আজকে ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হয়েছে। নাজনীন এসমস্ত বিষয় ভাবতে ভাবতে কখন যে বাসর সামনে চলে এসেছে ও বুঝতেই পারেনি। রিকশাওয়ালার ডাকে ওর সম্বিত ফিরে। ভাড়া মিটিয়ে নামতে যাবে, এমন সময় রাস্তার দিকে একটা হইচই শুরু হয়। শব্দ অনুসরণ করে তাকাতেই নাজনীন দেখতে পেল রায়হানের বাইক আর ল্যাপটপের ব্যাগটা। এরপর আর কিছু মনে নেই নাজনীনের। যখন হুস ফিরলো, তখন দেখলো সাদা চাদরে রায়হানের দেহটা ঢাকা। তারপরে একের পর এক কাজ, শ্বশুরকে সামলানো, মাকে সামলানো, দেবর ননদের আহাজারি সব মিলিয়ে নিজের দিকে তাকানোর সুযোগই পায়নি নাজনীন। কিন্তু গতকাল সেন্স লেস হয়ে যাওয়ার পর বান্ধবী লুনার জোরাজুরিতে আজকে ডাক্তারের কাছে আসা। ডাক্তারের চেম্বারে ওয়েটিং রুমে বসে নাজনীন ভাবছে, ওর জীবন কি থেকে কি হয়ে গেলো। রায়হানকে ছাড়া ও কি ভাবে থাকবে! তিন বছরের প্রেম আর বারো বছরের সংসার সবমিলিয়ে পনের বছরের সাথী ওকে একা করে দিয়ে চলে গেলো। ও এখন সবকিছু সামলাবে কি ভাবে! রায়হানের বাবাকে ও কি ভাবে বুঝ দিবে। এই বৃদ্ধ মানুষটা আর কত সহ্য করবে! আর কিছু মাথায় আসছেনা নাজনীনের।
সিরিয়াল নাম্বার সাত, মিসেস নাজনীন। এ্যটেনডেন্টের ডাকে নাজনীন আর লুনা সচকিত হয়। ওরা ধীর পায়ে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে। ডাক্তার সবকিছু শুনে বলেন, ” কয়েকটি টেস্ট দিচ্ছি, এগুলো করে নিয়ে আগামীকাল একবার আসেন।” লুনা জিজ্ঞেস করে, ” কোন বড় সমস্যা? “
—– না, তেমন কিছু তো মনে হচ্ছে না। এগুলো সামান্য রুটিন টেস্ট। আপনারা এখানেও টেস্ট গুলো করাতে পারেন। আচ্ছা আপনি উনার কি হন?
—– আমি ওর বন্ধু।
—— আচ্ছা আগামীকাল রিপোর্ট গুলো নিয়ে আসুন। এখন আর কোন ঔষধ দিচ্ছি না। আগামীকাল রিপোর্ট দেখে ঔষধ লিখে দিবো। তবে উনাকে বিশ্রামে থাকতে হবে আর কোন মানষিক চাপ নেওয়া যাবে না।
—— ঠিক আছে ডক্টর। এখন তাহলে আসি।
এই বলে লুনা আর নাজনীন টেস্ট গুলো করাতে দিয়ে বাসায় ফিরে আসে।
পরদিন বিকেলে টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে সরাসরি ডাক্তারের চেম্বারে যায় নাজনীন আর লুনা। ওদের সিরিয়াল আসলে ভিতরে ঢুকে। ডাক্তার ওদের বসতে বলে রিপোর্টগুলো দেখতে থাকে। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার নাজনীনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ” আপনার হাসব্যন্ড কোথায়?”
লুনা উত্তর দেয়, এগারো দিন হলো ওর হাসব্যন্ড মারা গেছে।
ডাক্তার হতভম্ব হয়ে উত্তর দেয়, আই এম সরি। আসলে এই মুহূর্তে এটা আপনাদের জন্য কি সংবাদ হবে বুঝতে পারছি না। উনি মা হতে চলেছেন। লুনা আর নাজনীন মনে হয় জীবনে কখনো এতটা আশ্চার্যন্বিত হয়নি, আজকে ডাক্তারের মুখে এই কথাটা শুনে ওরা যতটা আশ্চার্যন্বিত হয়েছে। নাজনীনের মুখ দিয়ে তো বেরই হয়ে গেলো, “কি!”
—— জি মিসেস নাজনীন আপনি মা হতে চলেছেন। আপনাকে আমি গাইনিকলোজিস্টের কাছে রেফার করছি। আর দুটো ঔষধ লিখে দিচ্ছি, এখন এগুলো খান আর যতদ্রুত সম্ভব একজন গাইনিকলোজিস্টকে দেখান।
লুনা আর নাজনীন হতভম্ব হয়ে বাসায় ফিরে আসে। সকলে যখন জানতে পারলো নাজনীন প্রেগনেন্ট তখন বাসায় আরেকদফা কান্নাকাটি শুরু হলো। শুধু নাজনীনের চোখে কোন পানি নেই। নাজনীনের মা বুক চাপড়ে কাঁদছেন আর বলছেন, ” আল্লাহ এ তোমার কেমন বিচার। সেই তুমি সন্তান দিলে, তবে তাকে এতিম করে কেন পাঠালে।” কেউ কেউ বলছে এটা কি ধরনের ঘটনা! নাজনীনের এসব কথা বার্তা আর ভালো লাগছে না। ও আসলে বুঝতে পারছে না ও কি করবে। যে সন্তানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ওরা আশাই ছেড়ে দিয়েছিল, সেই সন্তান আল্লাহ দিলেন ঠিকই কিন্তু সন্তানের পিতাকে নিয়ে গেলেন। এটা কি ধরনের ফয়সালা তোমার আল্লাহ, এটা কি ধরনের ফয়সালা!
নাজনীন সন্তর্পনে বারান্দায় এসে বসে। চারিদিক অন্ধকার করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। হঠাৎ ও অনুভব করে ওর মাথায় শ্বশুরের হাত, ” কাঁদো মা, কাঁদো। তোমার চোখের জলে সব দুঃখ কষ্ট যেন দূর হয়ে যায় মা। তুমি কাঁদো। আমার ছেলে চলে গেছে ঠিকই কিন্তু যাওয়ার আগে ওর অংশ তোমার কাছে রেখে গেছে। এই সন্তান তোমার কাছে ওর আমানত। ওকে যে তোমায় মানুষ করতে হবে মা। তুমি পারবে মা। আমাদের সকলের দোয়া আছে তোমার সাথে।
অন্ধকার বারান্দায় বৃদ্ধ শ্বশুর নাজনীনের মাথায় হাত রেখে দোয়া করছেন আর নাজনীন আকুল হয়ে কাঁদছে।
©শোয়াইব আহমদ (Shoaib Ahmad)
Send private message to author





