এতদিন পর এভাবে যে মাধবীর সাথে দেখা হবে সেটা কখনো ভেবে দেখি নি।
যাক ভালই হয়েছে। মনে হলো, বুকের ভেতরের এক আকাশ জমে থাকা শঙ্কা নেমে গেল। বড় ইচ্ছে ছিল… জানো? না, তুমি জেনে আর কী করবে। জানবার দরকার নেই। তবুও বলি, শোনো।
মাধবীর সাথে আমার একটা প্রেমে সম্পর্ক হয়েছিল। তাও আবার দৈবচক্রে। নইলে কী ওর মতন অমন লক্ষী মেয়ে, ঘূর্ণাক্ষরে আমার মত অলুক্ষুনে ছেলের সাথে থাকে?
সেবার ঠিক সন্ধ্যেবেলায় ঝড় উঠেছে, এমন ক্ষণে মাধবীকে খুব দেখতে ইচ্ছে হল। সে একবার বলেছিলো, আচমকা একদিন বৃষ্টিতে ভিজে তোমার সামনে দাঁড়াব। জানোই তো আমার মাঝে কেমন করে জানি পাগলামীর ভাব উঠে পরে। মাকে বললাম, বাইরে যাচ্ছি, দরজাটা লাগিয়ে দাও। কিছুতেই মা যেতে দিবে না। মা হয়ত ভেবেছে, এই বৃষ্টি-বাদলের দিনে আমি বুঝি সিগারেট খেতে বাইরে যাচ্ছি। দু’দিন আগে কে যেন এসে বলেছে, সন্ধ্যেবেলায় আমাকে নাকি রেল-লাইনের ধাঁরে দেখেছে; বসে বসে কী যেন করছিলাম, হাতে আগুনের ফুল্কি উঠা নামা করছিল বোধয়, শীতের রাত বলে ঠিক করে বলতে পারছে না। তারপর সারা ঘরে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। বাবার হাতে বেল্ট, মায়ের হাতে বেলনি; নিরস্ত্র আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল, অসৎ সঙ্গ থেকে বের করে নিয়ে এসে, শুদ্ধ-পুরুষ বানাবার আশায়। মনে পড়লে আজও হাসি পায়। মা আর বের হতেই দিলো না সেদিন। সে ঠিক ই এলো আমার সামনে বর্ষাস্নাত সন্ধ্যেয় ভিজে ভিজে। মা কেমন বকুনি ই না দিল। হাজার শাসনের পরও ঠিক ই তোয়ালে দিয়ে আদর করে মাধবীর ভেজা শরীর মুছে দিয়েছিল। ছোটপা’র নীল শাড়ী পড়েছিল মাধবী। কপোলেতে হালকা টিপ। চোখের কাজলটা বাদ পরেছিলো, ছোটপা টেনে তাকে তার ঘরে নিয়ে গেল। বের হতে দেখি, ছোটপা মাধবীর শাদা মেঘের মত ভাসতে থাকা শঙ্খচিলের মত নয়নের চারিপাশে কালো প্রলেপ এঁকে দিয়েছে। বাইরে বোধয় মেঘের ঝলকানির সাথে সাথে আমার অন্দরমহলের প্রতিমাও যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। মা বলেছিলেন, “এবার না হয় ওকে, ওর বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আয়।”
দু’জন দুই ছাতার নিচে হাঁটছিলাম। এক ফোঁটা, দু’ ফোঁটা করে বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করল। গগনের অপার কেঁদে চলা যেন শেষ হবার নয়! আমরা হেঁটে চলছি নিরবে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বৃষ্টির মৃদুছন্দের সাথে মাধবীর নূপুরের শব্দ পাচ্ছিলাম। যেন অবিরাম প্রাকৃতিক নৃত্যে মত্ত প্রেয়সী আর সঙ্গী ঈশ্বরের করুণার বারিপাত। আচমকা শব্দ করে এক আকাশ বিদ্যুৎ খেলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছাতা ফেলে মাধবী আমার বাহুকে অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমি নির্বাক। তখনো কাঁপছে সে। আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। একসময়, সে নিজেকে সামলে নিল। আমার বাহু ছেড়ে দিলো। এক লগ্ন দু’জন দু’জনার দিকে তাকিয়ে, মনে হলো তার চোখের গভীরে থাকা ভালোবাসার গাঢ় স্পন্দন উপলব্দি করতে পেলাম; হয়তো সেও বুঝতে পেল। বৃষ্টির দু-এক ফোঁটা তার কপোলেতে লেগে আছে, মনে হল মুছে দেই। তবে, তা হলো না। সে ভিজে যাওয়া ছাতা তুলে নিলো। আমি বললাম, “এক ছাতায় যাই, যাবে?” ও কিছু বলল না। আমি আবার বললাম, “কী, যাবে?” ছাতাটা গুটিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমরা ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করলাম। দেখতে পাচ্ছি, বৃষ্টি ওকে ভিজিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু সে নির্বিকার, যেন বৃষ্টিতে ভিজা যেন নিত্তনৈমিত্তিক ব্যপার। আমি বললাম, “তুমি তো ভিজে যাচ্ছ, একটু কাছে এসো” মাধবী এবারও কোন কথা বলল না। এবার আর রাগ সামাল দিতে পারলাম না, টেনে ওকে আমার বুকের কাছে নিয়ে এলাম। তখনো মৌন সে। বাঁ হাতে ছাতা, ডান হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “আরও কখনো এমন করবে?” তখন পর্যন্ত সে মাথা নিচু করে রেখেছিল, আমার গর্জন শুনে মাথা তুলে এক পলক আমার দিকে তাকালো। তারপর, ধীরে ধীরে বলল, “একশো একবার করব।” বলে সজোরে ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিয়েছিল। এমন পাগলী আমি আর কোথায় পাই বলো তো?
অথচ আজ! যখন তাকে দেখলাম, মনে হলো ওর বয়স যেন অনেক বেড়ে গিয়েছে হঠ্যাৎ করেই। চোখের নিচে অল্প কালিও পড়েছে। মুখের লাবন্যতা কোথায় যেন শুষে গেছে। আমাকে দেখে অনেক উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞাস করল, “ইশ্! কত্তদিন পর দেখা, কেমন আছ তুমি?” আমি কিছু না বলে, ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হঠ্যাৎ করেই, মনে হলো এখানে এখন দাঁড়িয়ে থাকবার কোনো মানে হয় না, এরচেয়ে আমার প্রস্থান ই শ্রেয়। ওর কথার জবাব না দিয়ে হনহন করে চলে যেতে লাগলাম, পিছন থেকে সে ডাকল, “শোন” সেই মিষ্টি কোকিলের ডাক! আমি থেমে, অনেক ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুড়িয়ে মাধবীর দিকে তাকাই। এই প্রথম যন্ত্রের শহরে যান্ত্রিকতার ভীড়ে নিজেকে আবিষ্কার করা শুরু করলাম বোধয়। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, “তুমি বেশ পালটে গেছ” আমি এক মনে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এরপর বললাম, “তুমি সত্যি ই ভালো আছ?” মাধবী চুপ করে রইল, আশেপাশে তাকিয়ে, মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ, আমি অনেক ভালো আছি।” আমি তখনও তার দিকে তাকিয়ে আছি। পাশ দিয়ে সাই সাই করে মোটরযান একের পর এক চলে যাচ্ছে। আকাশের রঙ পালটে, কালো হয়ে এলো। মাধবী তখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আমি এক দৃষ্টিতে মাধবীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। নাহ্, ও এবার সত্য বলছে, সে আসলেই অনেক ভালো আছে। কৈ আমার খুশী হবার কথা, কিন্তু দুনিয়া ভেঙ্গে আমার কান্না পাচ্ছে। মাধবী তার ব্যাগ খুলে ছাতা বের করে, মেলে ধরতে ধরতে আমাকে বলল, “এখানে এসো।” আমি তখনও একদৃষ্টিতে মাধবীর নয়ন-গভীরে তাকিয়ে আছি, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটা কখন বড় হয়ে গেল ঠাহর করতে পারলাম না। মাধবী আবারও বলল, “এখানে এসো না।” উদ্বিগ্ন মাখা কন্ঠে, ওর গলা যেন ধরে এলো। আমি কোনো ভ্রূক্ষেপ না দেখিয়ে বরং চশমা খুলে, নিজের চোখ মুছে নিলাম। বৃষ্টির ধারা বেড়ে চলেছে। শেষবারের মত মাধবীর দিকে তাকিয়ে অল্প হেঁসে, উলটো দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আর পিছে ফিরে দেখাবার সাহস হলো না, সামান্য কয়েক ফোঁটা মূল্যহীন চোখের জল ছেড়ে যান্ত্রিক বৃষ্টিতে নিজেকে মেলে ধরলাম। কে জানে, এমনদিনে হয়তো…
-সূচক
Send private message to author






