বিমূঢ়

বিমূঢ়

প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকর্তা একটি লম্বা লিস্ট দোলনচাঁপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন – নতুন বোর্ডারদের অনেকেই এসে পড়েছেন। রুম নাম্বার অনুযায়ী উঠানো হয়নি, কয়েকটি রুমে কাজ চলছিল বলে। আগামীকাল থেকে বন্টন করার জন্য লিস্ট মিলিয়ে রুম নাম্বার গুলো পাশে লিখে দিবেন।
কোথাও অসুবিধা মনে করলে অফিস সহকারীর কাছে রেজিষ্টার খাতা চেয়ে মিলিয়ে নিবেন। সুপারের নির্দেশগুলি ঠিকমত বুঝে নিয়ে দোলনচাঁপা নিজের চেয়ারটা টেনে বসলেন লিস্টটা টেবিলে রেখে।
রুম নাম্বারের ছক এঁকে এক এক করে নামগুলি পাশে বসাতে শুরু করলেন মনোযোগ দিয়ে। দায়িত্বের বাইরেও এমন অনেক কাজই এখানে করতে হয় ষ্টাফ অপ্রতুলতার কারণে। প্রায় বছর খানেক হতে চললো এই প্রতিষ্ঠানটিতে যোগদিয়েছেন দোলনচাঁপা। শহর থেকে দুরে নিরিবিলি সবুজ ঘেরা এই পরিবেশটায় এসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছেন যেন অনেক দিন পর। শহরের দমবন্ধ করা কোলাহলময় জীবনটায় বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। আর না এসে তো দ্বিতীয় কোন উপায়ও ছিলনা সামনে পেছনে।
বুক ভরা কষ্ট নিয়ে যেদিন ”ছায়াসুনিবিড়” নামের এই নিবাসটিতে এলেন ইন্টারভিউ দিতে, সেদিনই ফলাফল জানিয়ে দিলেন কতৃপক্ষ। দোলনচাঁপা শুকরিয়া জানালেন পরম করুনাময়ের কাছে। পায়ের তলার মাটি যখনই আলগা হয়ে আসে, কোন না কোন ছুতোয় আবার দাঁড় করিয়ে দেন উপর অলা শক্ত মাটিতে। বারো বছরের কর্মক্ষেত্র বিদেশী এনজিওটা যখন একেবারেই পাততাড়ি গুটিয়ে নিল, তখন পঞ্চাশোর্ধ এই বয়সে নতুন করে চাকরী খোঁজার কথা মনে করে দোলনচাঁপা খুব মুষড়ে পড়লেন। হঠাৎ করেই কাগজের বিজ্ঞাপনটি এক সহকর্মি হাতে ধরিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি কাড়ে দোলনচাঁপার ”ছায়াসুনিবিড়” নামে একটি ওল্ড হোমে কর্মী নিয়োগ হবে, বয়স যোগ্যতা সবই মিলে যায়। দরখাস্তটা পাঠিয়ে যথা সময়ে ইন্টারভিউ দিলেন। পিছুটানহীন দোলনচাঁপা নিয়োগ পেলেন ”ছায়াসুনিবিড়” এ।
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বয়সের ভারে ন্যুব্জ দেহগুলির অন্তরে একই ধারার কষ্টবোধ। অবহেলা, অযত্ন আর অতিরিক্ততার ছাপ আঁকা সর্বত্র। এখানে এসে যেন এক কাতারে দাঁড়িয়েছে পুত্রের অবহেলা, পুত্রবধুর অযত্ন আর কন্যার কাছে অতিরিক্ত হবার বিড়ম্বনাপিড়ীত দুঃখবোধগুলি সবার একই।
নিঃসন্তান দোলনচাঁপা নিজের জীবনের কষ্টের সাথে এই এক জায়গায় ওদের কষ্টগুলোর সারিতে দাঁড় করালেন নিজের বঞ্চনাকেও। পার্থক্য করলেন – যে সময়টায় পুত্রকন্যাবেষ্টিত হয়ে এই বাবা মা গুলো ওদের মানুষ করে তুলেছেন ভালবাসা বিলিয়ে, কষ্ট সয়ে আর আশায় বুক বেধে। দোলনচাঁপা সেই সময়টা কাটিয়েছেন একটি সন্তানের মা হবার আশায় দিনের পর দিন প্রতীক্ষা করে। প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে এক সময় জীবন সংগ্রামে নেমেছেন। পায়ের তলার মাটি খুজেছেন হন্যে হয়ে, তার পর এক সময় এনজিওর চাকরিটায় বেঁচে থাকার অবলম্বন পেয়েছেন। বাবার রেখে যাওয়া বাড়ীটিতেও তার ঠাঁই হয় নি । কারন দুই ভাই তাদের আপন আপন আশ্রয় গড়েছেন নতুন করে। যেখানে স্ত্রী সন্তানদের বরাদ্দের বেশী জায়গা নেই। আসলে বাস্তবতা এটাই। নিজের ঘরে ঠাঁই না জুটলে অন্যের ঘরে মিলবে কেন ?
তারপর কেটে গেছে অনেক গুলো বছর। দিনান্ত পরিশ্রম আর সহকর্মীদের সৌহার্দে দিন গড়িয়ে গেছে। তারপর ছন্দ পতন, আবারও নতুন ঠিকানা। স্বজন ছাড়া, ঘর ছাড়া এই মানুষগুলোর সহচার্যে এসে মনে হয়েছে এত দিনে যেন আপন জন আর আপন ঘর পেয়েছেন দোলনচাঁপা একই পথের পথিকদের নিয়ে এই ”ছায়াসুনিবিড়” নিবাসে।
আশ্রয় এর কত বৈচিত্র দেখলেন দোলনচাঁপা জীবনভর। বাবা মা এর ছোট মেয়ে ছিল সে। বিএ পরীক্ষা শেষ করতে না করতে ডাক এল আশ্রয় বদলের। শ্বশুর বাড়ীর বিশাল উঠোনে পা দিতেই শ্বশুর জানিয়ে দিলেন – আজ হতে এটাই তোমার আসল ঠিকানা।
দোলনচাঁপা হল বড় সংসারটার একমাত্র গৃহিনী। অনেক গুলো ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় রায়হান। ভার্সিটির চৌকাঠ ডিঙিয়ে সবে একটা কম্পানিতে জয়েন করেছে। মায়ের হঠাৎ মৃত্যুতে ছোট ভাই বোন গুলোকে নিয়ে বাবা পড়লেন মহা কষ্টে। আত্মীয় স্বজনদের কথায় রায়হানকে বুঝিয়ে রাজী করালেন বাবা – বিয়ে করে বাড়িতে বৌ আনবার জন্যে। মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ একটি মেয়ের খোঁজও দিলেন তারা, যে নাকি তার সুনিপুন হাতে শাশুড়ির রেখে যাওয়া সংসারের দায়ীত্বটা কাঁধে তুলে নিয়ে সবাইকে স্বস্তি দিতে পারবে।  হলও তাই। দোলনচাঁপা কদিনেই শ্বশুর বাড়ীর সবার মনের অশান্ত অবস্থার সাথে মানিয়ে নিল নিজেকে। শ্বশুরের সময়মত খাওয়া দাওয়া, যত্ন আত্তির যাবতীয় দায়ীত্ব, স্বামীকে অফিসের জন্য তৈরী করা, নাস্তার টেবিল থেকে শুরু করে দেবর ননদের স্কুল কলেজ, পড়া লেখার তদারকিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো ক্রমেই। এত বেশী অভ্যস্ত যে  রুটনমাফিক বাবার বাড়ীতে গিয়েও বেশী দিন থাকতে পারতো না। প্রতিবারই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এসে পড়তো বাড়ীর সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে। নিজগুনে অল্প সময়েই প্রিয় হয়ে উঠলো সবার।
এক এক করে গড়ালো ষোলটি বছর । এতগুলো বছরের সংসার জীবনে কোল আলো করে এলো না সন্তান। রায়হানের কোন অনুযোগ বা আফসোস ছিল না এতে। দোলনচাঁপা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রসংগ তুললে রায়হান বলতো – নিয়তি যদি আমাদেরকে বঞ্চিত করে থাকে তবে ডাক্তার কি করবে বলো। যখন পরীক্ষা নিরীক্ষায় আমাদের দুজনের মধ্যে যে কেউ এক জন দোষী সাব্যস্ত হব, শুধু শুধু একজন আর একজনের চোখে অপরাধী হব অথচ সমাধান পাবো না। স্বাভাবিকতা যখন আমাদের জীবনে আসেনি, মেনে নেয়াটাই স্বস্তি তাছাড়া মাতৃহারা ছোট ভাইবোন গুলিকে তুমিতো মাতৃ স্নেহে এত বড়টি করেছ, ওরা নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সন্তানের চেয়ে কম কি ওরা তোমার কাছে ? রায়হানের যুক্তির কাছে দোলনচাঁপা উচ্চবাচ্য করতে চায়নি আর। ননদ দুটোর বিয়ে হয়ে গেল, দেবররাও প্রতিষ্ঠিত সবাই চাকরিতে, ব্যবসাতে। শুধু শ্বশুরের শরীরটা দিন দিন বিভিন্ন অসুখে কাবু করে ফেললো ক্রমশঃ। উকিল ডেকে নিজের অগাধ সহায় সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করলেন। কিন্তু শর্ত রইল – তাঁর জীবিতাবস্থায় যেমন চলছে তেমন চলবে সব কিছু। নিজ নিজ ভাগ তখনই কার্যকরি হবে যখন তিনি থাকবেন না। এর মধ্যে রায়হানের ডিপার্টমেন্টের স্কলারশীপটা মঞ্জুর হয়ে গেল জার্মানীতে দুই বছরের জন্য। শ্বশুরকে এ অবস্থায় রেখে দোলনচাঁপা যেতে পারলেন না, রায়হান একাই পাড়ি জমালেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মারা গেলেন শ্বশুর। রায়হান ছাড়া সব ভাইবোনেরা একত্রিত হল। শোকাভিভূত বাড়ীটাকে দুহাতে আগলে রাখতে গিয়ে দোলনচাঁপা বিস্মিত হয়ে খেয়াল করলেন, বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির পরিমান নির্ণয়ের জন্য বড় বেশী উদগ্রীব, বড়বেশী ব্যকুল তারা। পরিমান নির্ণয়ের পর সেই ব্যকুলতা পৌছুলো প্রচন্ড ক্ষোভে আর রাগে।
ওদের মতই প্রথমটায় অবাক হল দোলনচাঁপাও। অন্যান্য সম্পত্তি সবছেলে মেয়েদের মধ্যে যথেষ্ট দিলেও বাড়ীটা শুধু মাত্র দোলনচাঁপার নামে লিখে গেছেন। কারনটাও উল্লেখ করেছেন সবিস্তারে। এবাড়ীর সবাই দোলনচাঁপার স্নেহচ্ছায়ায় লালিত বলে এই ছায়ার সবার আশ্রয়দাত্রী হয়ে তিনি থাকবেন আজীবন। মমতাময়ী, নিঃসন্তান পুত্রবধূ দোলনচাঁপাকে তিনি পুরো বাড়ীটা একক ভাবে দান করে গেছেন। অবাক চোখে দেখলেন দোলনচাঁপা – তারই কাছটিতে বড় হওয়া সেদিনের ছোট ছোট দেবর ননদেরা মুহূর্তেই কেমন অচেনা আর দুরের হয়ে গেল।
নির্দ্বিধায় তারা উচ্চারন করলো – এ কারনেই ভাবী ভাইয়ের সাথে জার্মানী না গিয়ে অসুস্থ বাবাকে ছেড়ে যায় নি।
এতটা কালের আপনভাবা সন্তানসম মানুষগুলোর এমন মন্তব্যে যারপর নাই দুঃখ পেলেন দোলনচাঁপা। ভারাক্রান্তমনে রায়হানকে ফোনে অনুরোধ করলেন , তাকে নিয়ে যেতে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। রায়হান কাগজ পত্র পাঠিয়ে দিলেন, দোলনচাঁপা ব্যবস্থা করে চলে গেলেন স্বজনদের প্রতি তিলে তিলে গড়া ভালবাসা খুঁইয়ে ভাঙ্গা মন নিয়ে দুর প্রবাসে স্বামীর কাছে। রায়হান সব জানলেন, শুনলেন। চিরদিনের শান্ত স্বভাবসিদ্ধ রায়হান বাস্তবের কঠিন রূপটা যেন মেনে নিলেন বিনা বাক্যব্যয়ে। শুধু কোথায় যেন একটা শুন্যতা অনুভব করলেন তীব্রভাবে। দোলনচাঁপাকে জানালেন – দত্তক নিতে চান দেশে ফিরে। নীরব সম্মতিতে মাথা নাড়লেন তিনি।
এরই মধ্যে খবর এল, রায়হানের বিপত্নীক সেজ ভাইটি আবার বিয়ে করেছেন। তার বারো বছরের মেয়ে সুপ্তি কিছুতেই এটা মানতে চাইছে না, পিতার কাছে থাকবেনা বলে চলে এসেছে দাদা বাড়ী। পারিবারিক আলোচনাক্রমে এই সুপ্তির দায়ভার আশ্রয়দাত্রী দোলনচাঁপার উপরেই বর্তায়, সর্বসম্মতিক্রমে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সব শুনে কঠিন গলায় জানালেন দোলনচাঁপা রায়হানকে – না, কখনই নয়। সারা জীবনের অন্তর নিংড়ানো ভালবাসাগুলো যদি সম্পত্তির মূল্যের কাছে মুহূর্তেই মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে, এমন দায়ভার সে নিতে রাজী নয় আর। রায়হান বোঝাতে চাইলেন – আমরাতো দত্তক নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তবে মাতৃহারা সুপ্তিকে সন্তান মেনে নিতে আপত্তি কেন করছো দোলন ?

  • কারন সেও যখন বড় হবে আমার স্নেহের হিসেব কষবে সে মূল্য দিয়ে। বারবার একই কষ্টের পুনরাবৃত্তি সইতে পারবেনা আমার ক্ষত বিক্ষত মনটা। উদার হস্তে যে দোলনচাঁপা মায়া বিলিয়েছে এতটা কাল, হঠাৎ করেই তার এমন মুখ ফিরিয়ে নেয়া রায়হান বুঝতে চাইলোনা। স্বজনপ্রীতির বেড়াজাল ডিঙিয়ে দোলনচাঁপার মনের কাছাকাছি আসতে অপারগ হল সে। দোলনচাঁপার আহত হৃদয়ে আর ঘা খাওয়া মনটায় কাঁটার মত বিঁধলো রায়হানের কথা কয়টি – তোমার এত কালের মমত্বকে যদি শুধুই বাবাকে খুশী করবার জন্য উদ্দেশ্য প্রনোদিত মনে করে থাকে সবাই, সুপ্তিকে এড়িয়ে চলার কারন সেটা স্পষ্টতঃই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে ছাড়লে আমাকেও।
    জবাব দেবার কোন ইচ্ছা হয়নি একথার। নীরবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে দোলনচাঁপা। তার এ হেন নির্লিপ্ততায়, নীরবতায় রায়হান সরিয়ে নিল নিজেকেও। দুর প্রবাসে একই ছাদের নীচে থেকেও দুটি মানুষের দুরত্ব বাড়তে লাগলো যোজন যোজন। এ ভাবেই দেশে ফেরার সময় হল।
    এয়ারপোর্টে নেমেই দোলনচাঁপা নীরবতা ভেঙ্গে জানালো – যে বাড়ী তার স্নেহ মমতাকে ভুল প্রমানিত করেছে সে বাড়ীতে যাবার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে সে। রায়হান উচ্চবাচ্য করেনি একটিও।  ট্যাক্সি থামিয়ে বলেছে সরাসরি – যেখানে যেতে চাও ড্রাইভারকে বলো, পৌঁছে দেবে তোমাকে।
    অবাক হয়ে তাকিয়েছে দোলনচাঁপা রায়হানের মুখের দিকে – তোমার আমার পথ কি তবে আলাদা হয়ে যাচ্ছে ?
  • তা ছাড়া আর কিই বা করার আছে। কাগজে কলমে বাড়ীটি তোমার হলেও পৈতৃকতার দোহায় নিয়ে আমি ওখানেই থাকতে চাই, যতদিন থাকা যায়। আর সুপ্তি আমার নিজের বংশের মেয়ে বলে তোমার মত পা মাড়িয়ে অন্য কোথাও যাওয়াও আমার পক্ষে অসম্ভব।
    সামনে ভীড়ের মধ্যে মিশে যায় রায়হান দোলনচাঁপাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। কান্নায় গলা বুঁজে আসে। সবাই তার ভালবাসাকে ভুল বুঝলেও রায়হান তাকে চিনতে এতটা ভুল করবে ভাবতেই পারেনি দোলনচাঁপা। বিশ্বাসের সবটুকু হারিয়ে অভিমান আর জেদে নিজেকে হারিয়ে ফেলে প্রচন্ড ভাবে।
    এ ফ্ল্যাট ও ফ্ল্যাট করে দুই ভায়ের কাছে মাস খানেক কাটানোর পর দোলনচাঁপা চাকরী জুটিয়ে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করে প্রথমে। তারপর শ্বশুরের চাপিয়ে দেয়া বোঝাটা কাঁধ থেকে নামাবার ব্যবস্থা করে। কাঁপা হাতে ডায়াল করে অতি চেনা নাম্বার গুলো। ওপ্রান্তে কচি কন্ঠে সুপ্তির গলা ভাসে – হ্যালো কে বলছেন ? নিজেকে আড়াল রেখে দোলনচাঁপা বলেন – রায়হান সাহেবকে চাইছিলাম। পর মুহূর্তে রায়হানের কন্ঠ দোলনচাঁপার কানে আছড়ে পড়ে – হ্যালো কে ? ভাবাবেগ সংযত রেখে দোলনচাঁপা জবাব দেয় – আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে জানি, কিন্তু আমার কাঁধে চাপানো বোঝাটার প্রয়োজন বোধ করি আছে তোমাদের।
    —– নিজের মতটাই যার কাছে এক মাত্র সমাধান, তার কাছে কিই বা বলার আছে আমার। রায়হানের নির্লিপ্ত জবাবে কথার খেই হারিয়ে ফেলে দোলনচাঁপা।
    রায়হানের নামে বাড়ীটা ট্রান্সফার করে বোঝা মুক্ত হয়ে ভাইদের করুনার আশ্রয় ছেড়ে ঠাঁই খুঁজে নিজের শিক্ষার পুঁজিটাকে ভর করে। এন, জি, ও’র বিভিন্ন কর্মীদের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে এ জেলা থেকে ও জেলা, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। সময়ের চাকা এক সময় থামিয়েছে। পৌঁছে দিয়েছে অনেক সমব্যথী ঘরছাড়াদের সহচার্যে।
    ছকে সিরিয়ালি নাম্বার গুলি তুলতে গিয়ে ছাব্বিশ নাম্বারে গিয়ে হোঁচট খেলেন দোলনচাঁপা। – রায়হান চৌধুরী ! বয়স ঊনষাট । ব্যস্ত হাতে ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে হতাশ হলেন, লেখা নেই কিছুই। ফাঁকা রয়েছে জায়গাটি।
    অনতি দুরে বসা অফিস সহকারীর টেবিলে এগিয়ে যান দোলনচাঁপা ত্রস্তপায়ে।
  • ছাব্বিশ নাম্বার বোর্ডারের ঠিকানা লেখা নেই লিষ্টে। এ্যাডমিট ফর্মটা দেখি ?
    হাই তুলে আলস্য ভঙ্গিতে ফাইল খুলে দেখান অফিস সহকারী, বলেন – সম্ভবত ফর্মেও নেই। বুঝলেন আপা, নিজ বাড়ীতে নিজেরই যখন জায়গা হয় না, ঠিকানা লিখতে অনেকেই চায় না সেই বিতৃষ্ণায়।
  • কিন্তু ঠিকানাটাযে আমার প্রয়োজন। নাম, বয়স সবই তো মিলে যায়, স্বগতোক্তির মত বলে দোলনচাঁপা। কিন্তু তাই বা হয় কি করে ?  হতেও পারে। বারো বছরের সুপ্তি এখন স্বনির্ভর, সুশিক্ষিত। প্রতিদানতো সে দিতেই পারে। আর ভাবতে পারেন না দোলনচাঁপা। মাথাটা কেমন ঘুরে উঠে। পাশের চেয়ারটায় বসে পড়েন। অফিস সহকারী ভদ্রলোক ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করেন – আপা, কি হল ? খুব আপন জন করো নাম ? আল্লার দুনিয়ায় একই নামের কত মানুষ যে আছে। কিন্তু বলছেন বয়সটাও মিলে। অত টেনশনে কাজ কি আপা। আপনিতো ”ছায়াসুনিবিড়” এর ষ্টাফ। একটা চক্কর দিয়ে আসেন নতুন ব্লকটায়। এক সাথে তিন/চার জন এসেছেন কাল রাতে। পরিচিত যদি নাই হয়, সদ্য ঘর ছাড়া এক জনের দুঃখকে অনেকের সারিতে দেখিয়ে কিছুটা স্বান্তনা তো দিয়ে আসবেন। দোলনচাঁপা উঠে দাঁড়ান। সম্মোহিতের মত এগিয়ে যান। কিসের টানে ? নিজের জীবনের ভয়ংকর পরিনতির পুনরাবৃত্তির আশংকায় নাকি বুকের মাঝে সন্তর্পনে লুকিয়ে রাখা তেরো বছর ধরে লালন করা প্রিয়জনকে কাছে পাবার আকাংখায় ?

ফাহমিদা রিআ (Fahmida Reea)

-*

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
0
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!