আমাদের বাসার একটি চুলার নামই ছিল চায়ের চুলা। যতক্ষণ আব্বু বাসায় থাকত,সেই চুলায় অবিরাম চা বানানো হচ্ছে। আব্বু ফ্লাস্কের চা বা গরম করে দেয়া চা একদমই পছন্দ করে না।
আমাদের কুকের নাম রফিক।আব্বু “রফিক” বলে ডাক দেয়া মাত্রই “স্যার আনতাছি “বলেই রফিক ভাই চা হাজির করতো।
ভাইয়া সন্ধ্যার পর বাসায় থাকত না।একদিন অফিস থেকে ফিরেই আব্বু চা চাওয়ায় আমি পড়লাম মহাবিপদে।আম্মুও বাসায় নেই। চুলায় পানি দিয়ে ভাবছি, চা পাতা আগে দিবো না দুধ আগে। যাই হোক, কোনো রকম চা বানিয়ে দিলাম। ওমা, আমি বানিয়েছি শুনে, এমন মজা করে পান করলো যে আমি খুশিতে আত্মহারা।
পরের দিনও একই ঘটনা।সেদিনও আব্বু খুব খুশি। তৃতীয়দিন রফিক ভাই বাসায়। আব্বু ঘরে ঢুকেই,
- মা চা ।
রফিক ভাই থমকে গেলো।আমি বীরদর্পে রান্না ঘরে গেলাম। চা বানাচ্ছি। রফিক ভাই আমার চা দেখে ভয়ে ভয়ে বলল ,
-আপা, আমি বানায় দেই। - না। আমার চা আব্বু কতো পছন্দ করে আপনি জানেন না।
- আপা আপনার জন্যও একটু রাখেন, খাইয়া দেখেন।
ভালো বুদ্ধি। চা বানিয়ে মুখে দিয়ে আমি হতভম্ব। এমন পানসে চা মানুষ বানায়?হতাশ হয়ে ভাইয়াকে বানাতে দিলাম।
পরেরদিন আব্বু আমার কাছে,
-চা দে না মা।
-আমার চা ভালো হয় না।
-যা পারিস তাই বানা।মেয়ের হাতের চা, সেটাই অমৃত।
এবার আম্মুর কাছে শিখে বানালাম।আব্বুর তৃপ্তি দেখে বিশ্বাস নাই।নিজে চেক করে দেখলাম।না ওতো খারাপ হয়নি, চলে। এভাবেই আমার চা বানানো শুরু।
আব্বু রিটায়ার্ড করার পর শুরু হল মহা সমস্যা। সারাদিন বাসায় থাকে।এক কাপ চা শেষ না হতে হতেই আরেক কাপ চা চায় । তাও খুশি হয় না। চা নাকি ঠান্ডা করে দেওয়া হয়।
আমার নিরীহ মাও একদিন গেলো ক্ষেপে। চায়ের হাড়ি আর ছাঁকনি নিয়ে সরাসরি আব্বুর কাছে,
- হা করো।তোমার মুখেই চা ছাঁকবো। ঠান্ডা হবে না।
আব্বু ভয়ে ভয়ে বলল,
-না ঠিক আছে।কাপে ঢাললেও চলবে। গরম থাকবে।
আব্বু কখনো যদি কারো বাসায় বেড়াতে যায়। এসে গল্প শুরু করে, - আর বলিস না।ওরা তো বিশাল আয়োজন করেছে।অনেক খাতির-যত্ন করল।
- কি করেছে?
- যাওয়ার সাথে সাথে চা।
-আর কি কি?
-তা তো খেয়াল করিনি। মাঝে একবার,আসার সময় আবার চা দিয়েছে।
এই হল আমার বাবার বিশাল আয়োজনের বর্ণনা। আমার শাশুড়িও যখন শুনতেন আব্বু তাকে দেখতে আসছে। মা আমাকে তাড়া দিয়ে বলতেন, - তাড়াতাড়ি চুলায় চায়ের পানি বসাও। তার তো স্প্রিং লাগানো। ঘরে ঢুকার আগেই বলবে যাই। চা দিলে বসবেনে। আমার বান্ধবী কেয়া যখনই বাসায় ঢুকে, সাথে সাথে আব্বু,
-কেয়া এসেছিস? যা তো মা এক কাপ চা বানিয়ে দে। ওরা আমারে চা দেয়না।
কেয়া আমার বাবাকে খুব ভালোই চিনে।ও হেসে চা বানাতে গেলে,আমি আব্বুকে বলি,
-তুমি আমার বান্ধবীকে দিয়ে চা বানাচ্ছো কেন? - মা বুঝিসনা। চা বানানো শিখা তো ভালো। শ্বশুর-শাশুড়ি খুশি থাকবে। মাথায় তুলে রাখবে।
- হ্যাঁ, সবাই তো তোমার মতো চা খোর।
কেয়া চা দেয়া মাত্র,আরেকবার চাওয়ার সুযোগ না দিয়ে, ওকে নিয়ে পালিয়ে যাই। আব্বু তার বড় জামাই নিয়ে খুব খুশি থাকে। কারন বাসায় আমি যতই চা দেই না কেন, সন্ধ্যার সময় জামাই ঠিকই শশুরের সাথে চা পান করতে চলে যাবে। আব্বু জামাইয়ের কথা বলে আরো দুই এক কাপ চা বেশি আম্মুকে দিয়ে বানিয়ে নিতে পারে। ছোট জামাই বিয়ের পর চা পান করতো না।কিন্তু আব্বুর পাল্লায় পড়ে সেও শিখে গেলো।
আব্বু যখন আমার বাসায় আসতো তখনো,
- এতো কস্ট করে আসলাম,চা দে মা।
- কতক্ষণ বসে আছি, চা দে না মা।
- চলে যাচ্ছি,চা দে।
মাঝে মাঝে দিতাম ধমক।
-এতকিছু বানাই,আগে এগুলো খাও, তারপর চা। আমাদের ধমকাধমকি তে আমার বড় মেয়ে নানার দুঃখে দুঃখিত হয়ে মাত্র দশ বছর বয়সেই চা বানানো শিখে গেলো।
আব্বু আমার বাসায় আসার আগে শিওর হয়ে নেয়, নাতনি বাসায় আছে কিনা। কারণ এখন হয়েছে নতুন সমস্যা।আব্বুর নাতনির চা ছাড়া আর কারো চা আর মজা লাগেনা।
একবার আব্বু একা বাসায় ছিলো। আম্মু বাসায় ফিরে দেখে, রান্নাঘরে ঝড় বয়ে গেছে। রান্নাঘরের ভাতের হাড়ি, ডালের হাড়ি,কড়াই, সবকিছুতেই চা বানানো হয়েছে।
এখন আব্বু নেই। আমাদের বাসায়ও এখন দুবেলার বেশি চা বানানো হয় না। আমিতো চা বানানো ভুলে গেছি অনেক আগেই।সেদিন আমার বড় মেয়ে চা বানিয়ে দিলো। সেটাও কেমন পানসে হয়ে গেছে।
দোয়া করি বাবা, আল্লাহ তোমাকে বেহেশত নসিব করুন। যেখানে তোমার চা এর অভাব হবে না।
“রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা”।
-Kazi Suraiya Nasrin Surovi
Send private message to author





