কর্দমাক্ত রাস্তা। আমি হাঁটছি। পায়জামার পেছনটায় ছোঁপ ছোঁপ দাগ পড়ছে।স্যান্ডেলের সাইজ প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত হয়ে গেছে। আমার সেদিকে মাথা ব্যাথা নেই। অধ্যাপক,মিসির আলী সাহেব আমাকে কল দিয়েছেন। কিভাবে দিয়েছেন বুঝতে পারছি না।আমার মোবাইল আছে।কিন্তু ব্যাটারি নেই ১০-১২ দিন ধরে।আলসেমির কারণে নতুন ব্যাটারি মোবাইলে যুক্ত করতে পারছি না।শরীরে জং ধরে গেছে। নড়তে ইচ্ছে করে না।
খুব সম্ভবত আজ ভোরে আমি স্বপ্নটি দেখি। মিসির আলী উনার রুমে সেগুন কাঠের চেয়ারটায় বসে আছেন।উনার দৃষ্টি স্থির।বাটা কোম্পানির সেন্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়েছেন। দু এক জায়গায় ফুটো হয়ে আছে।কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমার চোখ সেই ফুটোগুলোর দেকি বার বার চলে যাচ্ছে।একটু পর পর মনে হচ্ছে,জানালার ওপাশে নর্দমার মশা গুলো খুব আয়োজন করে আজ রক্ত বক্ষণ করবে।ঠিক যে জায়গায় গেঞ্জির ফুটো গুলো হয়েছে,সেদিকে। আজ তাদের বিশেষ নজর ফুটো গুলোর উপর থাকবে।কিন্তু কেনো থাকবে বুঝতে পারছি না।মিসির আলীর পুরো ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। আমি অবহেলিত ভাবে পড়ে থাকা বেতের মোড়ার উপর বসে আছি।স্বপ্নযোগে মিসির আলী পান চিবুতে চিবুতে আমার সাথে কথা বলছেন।কিছুক্ষণ পর পর পানের পিক জানালার ফাঁক দিয়ে ফেলে আসছেন। আমার বিরক্ত লাগছে।মিসির আলী পান খাবেন কেনো! খুব সম্ভবত আমি উনাকে বাংলা সুদ্ধ উচ্চারণে , ‘ সালা বাটপার ‘ বলে কেটে পড়ি।ঠিক তখনি আমার স্বপ্নের উপর ঠাঁটা পড়ে।
আমি চোখ মেলে কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করলাম।তখন কয়টা হবে মনে নেই।আমি লক্ষ করলাম,আমি আবার স্বপ্ন জগতে প্রবেশ করেছি।এখন আর মিসির আলী সামনে নেই।স্বপ্নের মধ্যে আমার নিজের ঘর চোখে পড়লো।আমি বিছানার উপর পা তুলে বসে আছি।হঠাৎ বিকট শব্দে মোবাইল বেজে উঠলো।কিন্তু স্বপ্নের মধ্যেই মনে পড়ে গেলো আমার তো মোবাইলে ব্যাটারি নেই।কল আসবে কীভাবে? কি মনে করে,আমি আমার ব্যাটারিবিহীন মোবাইল হাতে নেই।রিসিভার বাটনে চাপ দিয়ে কানের কাছে নেই।ওপাশ থেকে গাঢ় নিস্তব্ধতা।আচমকা একটা কাঁপা কাঁপা কন্ঠ শুনতে পাই।ওপাশ থেকে কে কি বলছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।কন্ঠের উপর বিরক্তি এনে বললাম,’ কে! ‘। ওপাশ থেকে ক্ষীণ শব্দ এলো।’ আমি মিসির আলী বলছি।তোমাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন।এক্ষুণি আসতে পারবে? ‘আমি হ্যা না কিছু বলার আগেই কল কেটে গেলো।ঠিক তখনি আমার দ্বিতীয় বারের মতো স্বপ্নভঙ্গ হলো।
চোখ মেলে দেখি আমার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে।কোনো কিছু না ভেবেই বিছানা থেকে নেমে পড়লাম।দরজার কোণায় পড়ে থাকা স্যান্ডেল জোড়া পায়ে দিলাম।দ্রুত যেতে হবে আমাকে।গলির মোড়ে এসে দেখি কোনো রিক্সা,সি.এন.জি কিছুই নেই।অপেক্ষা না করে,লম্বা লম্বা কদম ফেলে হাঁটা শুরু করলাম।গন্তব্য নীলক্ষ্যাত।
\মধ্যদুপুরের কড়া রোদ সরাসরি আমাকে কেন্দ্র করে পড়তে শুরু করেছে।মনে হচ্ছে চামড়ার প্রতিটি কোষ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলাম।আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি একটা বইয়ের দোকানের সামনে।নাম ‘আজিজ পুস্তকালয়’।নীলক্ষেত আসলে এই দোকান ছাড়া অন্য দোকানে ঢোকার নিয়ম নেই আমার।দোকানের ক্যাশ বাক্সে আনিস বসে আছে।বেশ মানাচ্ছে ওকে।বেহেস্তে গেলে,আনিস সেখানেও হয়তো এমন ক্যাশ বাক্স নিয়ে বসে থাকবে।কে জানে?
আমি দোকানের ভিতর ঢুকে পড়লাম। আনিস আমাকে দেখে চোখ মুখ উজ্জ্বল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।আমি উপেক্ষা করলাম। এখন আনিসকে পাত্তা দেয়ার সময় না।নিজে নিজেই বই খোঁজা শুরু করলাম।অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে মিলল।আমি আনিসের দিকে হাসি হাসি মুখ বানিয়ে বললাম,’ ভাই সাহেব,দাম কত? ‘
আনিস আমার দিকে বিষ্ময়ের চোখে তাকালো।মনে হচ্ছে এ মানুষকে সে আগে কখনো দেখে নি। আমি পকেট থেকে ১০০ টাকার নোট বের করে আনিসের সামনে রাখলাম।আমার কাজ শেষ। এখন ভালোই ভালোই কেটে পড়তে হবে।
আমি দোকান থেকে বের হয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম।আচমকা মনে হলো,কেউ একজন আমাকে পাশ থেকে ডাকছে।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটির দিকে তাকালাম।মধ্য বয়সি এক ভদ্রলোক।চোখে রিমলেস চশমা।চুলে কলপ দেয়া।দেখে মনে হচ্ছে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় কলপ লাগিয়ে বের হয়েছিলেন।এখনো চকচক করছে।
তিনি গলার স্বর খানিকটা গম্ভির করে বললেন, ‘ জনাব,আপনার হাতের বইটার নাম কি? ‘আমি কিছুটা ইতস্ততভাবে বললাম,’ মিসির আলী আপনি কোথায়? ‘। ভদ্রলোক মুচকি হাসি এনে বললেন, ‘ বাহ! বইটার নাম বেশ সুন্দর!আমি ক্ষণিকের মধ্যে বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম।হঠাৎ মনে হলো,এনিই কি মিসির আলী? লোকটার দিকে দ্বিতীয়বারের মতো চোখ রাখতেই দেখি ,লোকটি নেই! কোথায় গেলো? এ কি করে সম্ভব? দু সেকেন্ড আগেও তো লোকটা আমার পাশেই দাড়িয়ে ছিলো।আমার মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত নেমে যাচ্ছে।এর কারণ লোকটার উধাও হওয়া নিয়ে নয়।আমি অদ্ভুত ভাবে লক্ষ করলাম আমার ১০০ টাকা দিয়ে ক্রয় করা বইটি আমার হাতে নেই।তার চেয়েও বড় অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে,আমি এখন যে জায়গায় দাড়িয়ে আছি সেটা নীলক্ষেত নয়,আমার নিজেরই গোলির মোড়ে।তার মানে কি? আমি কি এখনো নীলক্ষেত যাই নি? আমার মাথা ধরছে।মনে হচ্ছে এখুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবো।হঠাৎ কি যেনো হলো আমার! কিছুই মনে পড়ছে না আর।
আমার ঘুম ভাঙে রাত ১১টার দিকে।চোখ মেলে দেখি,আমার বিছানার পাশে এলাকার পরিচিত ছোট ভাইগুলো বসে আছে।পাশ ফিরে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো টেবিলের উপর।একটা বই কাগজের প্যাকেটে মোড়ানো।আমি কাজগের প্যাকেটটি খুলে দেখলাম।মাঝারি সাইজের একটা বই আর তার সাথে একটা চিঠি।এ তো দেখি আমার সেই ক্রয় করা বইটি! ‘ মিসির আলী আপনি কোথায়? ‘।কাঁপা কাঁপা হাতে আমি চিঠিটির ভাজ খুললাম।চিঠির উপর লাল কালিতে দুটো মাত্র লাইন লেখা।
‘ তোমাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন।এক্ষুনি আসতে পারবে? ‘
সমাপ্ত
– সৌরভ আহমেদ
Send private message to author






