অপ্রিয় ডায়ারী,

“মাধবীর সাথে সেদিন এমনভাবে দেখা হবার পর, এত কিছু ঘটার পর নিজেকে স্বাভাবিক ভাবে পুনরায় সে চিরচেনা রূপে ফেরত পাব আশা করি নি। সম্পূর্ণ নতুন ভাবে নিজেকে আবিষ্কার করার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম, নয়নে-অধরে সবখানে শুধু মাধবী-মাধবী চক্র চলছিল। হ্যাঁ, আমি ওকে ভালোবেসেছিলাম, নিজের চেয়েও বেশী হয়তো; সেও আমাকে ভালোবেসেছিলো, আমার চেয়েও বেশী হয়তো। কিন্তু না শেষ গন্তব্যে যাবার পূর্বেই আমাদের অন্তর্নিহিত ব্যাকুল ভালোবাসা নিঃসৃত ট্রেনটি মুখ থুবড়ে পরে। নিকট-মানুষের ভেতরে সদ্য নতুনভাবে তৈরী অমানুষের নজর ওকে টিকিয়ে রাখতে দেয় নি। তাদের ঈর্ষাপরায়ণতার নির্মম বলি হতে হয়েছে আমাদের ভালোবাসার। এখন মাধবী নিজে অনেকখানি সামলে নিয়েছে, যতখানি না সে ভেঙ্গে পড়েছিল তার বিয়ের রঙ্গমঞ্চে; তাকে শেষ যারা দেখেছিল তারা এখনো সে কথা আমায় বলে। কেবলি নিথর এক প্রতিমা, যার অন্তরের সকল শক্তি শুষে নেয়া হয়েছে; দুষ্টুলোকে বলে ঈষৎ হাঁসি নাকি লেগেছিল তার মুখে। এসকল কথা শুনে নিজ মনের মাঝে অনেক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা চলে। তবুও এত কিছু হবার পরও, আমাকে সে নিমন্ত্রণ করতে ভুলে নি, খুব করে বলেছিলো; অনেক অনুনয়ও করে ছিল। তারপরও আমি সেখানে যাই নি, কেমন করে যাব? কী মুখে যাব? কার জন্যেই বা যাব?


হ্যাঁ, আমাদের বিচ্ছেদের জন্যে আমি লাখো যুক্তি দাড়া করাতে পারি, কিন্তু সে। শুধু একটি কথাই বলে, “তুমি ফিরে আসতে বড্ড বেশী দেরী করে ফেলেছিলে।” তখন আমি অদৃষ্টের হাঁসি হেঁসে বলি, “আইনস্টাইন বলেছে, সময় সর্বদা আপেক্ষিক। এমনও তো হতে পারে, আমি তাড়াতাড়ি করেই ফিরেছিলাম ততদিনে আর তোমার সে ধৈর্যে কুলায়নি।” আমার মুখে এমন উদ্ভট অপ্রত্যাশিত কথা শুনে মাধবীর শাদা মুখ অপেক্ষাকৃত বেশ রক্তিম হয়ে গিয়েছিল। গাল ফুলিয়ে অভিমান করে, আমার সামনে থেকে চলে গিয়েছিল সেবার। আর কখনও এমন কথা বলে নি, হয়তো কোনোদিনও বলবে না। ভুল কিছু কী বলেছিলাম? এখন যদি কেউ তার আর আমার পরিবার থেকে আমার সম্পর্ক মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় তবে আমাদের এখানে কী করার আছে? এমন সম্ভাবনার কথা আঁচ করে যদি আমি বলি, “কিছুদিন নাহয় আমরা আলাদা থাকি।” এবং সাথে সাথে আমরা আলাদা হয়ে যাই, দু’জনার মধ্যেকার আবছায়ার দূরত্ব সৃষ্টি করে থাকি। আর আমাদের মধ্যেকার দূরত্বটাকে যদি সকলের কাছে আমাদের বিরহ-বিচ্ছেদ হিসেবে উপস্থাপন করি। যাতে করে সকলে মনে করে এখন আমরা একে অপরে থেকে কয়েক-লক্ষ গুন যোজন দূর। আমি তাকেও বুঝিয়েছিলাম আমার সকল পরিকল্পনার কথা, সে শুনেছিলো, জেনে ছিল, কিন্তু… পরিশেষে তাকেও আমি করে দিলাম আমার এই বিশদ পরিকল্পনার একটি অংশ মাত্র। যাতে করে, আট-দশ জনের সামনে আমার সহিত আবেগী কিশোরীর ন্যায় বিরহীর আচরণ যেন সে না করতে পারে। সবচেয়ে নির্মম পরিহাস হচ্ছে, সকল কিছু জানার পরও বিষয়টা সেও সেটা ধরতে পারে নি। নইলে, এমন কী আর হতো? যেবার জেনেছিলাম, মাধবী আমার থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে, সেবার অনেক কেঁদেছিলাম। ভীষণ কেঁদেছিলাম। তখনও কোন সাক্ষ্যছিল না, এখনও নেই। যদি প্রদীপ নেভানো রাত মুখ ফুটে কথা বলতে পারত, তাহলে মাধবী শুনতে পারত আমার শব্দহীন চিৎকার করা বেদনার কথা।” কথা গুলো বলতে বলতে আমার চোখ ভিজে উঠল, সামনে অবাক চোখে হেয়ালি বসে বসে কথাগুলো শুনছে। নীরব প্রায় লোকশুন্য একটা রেস্তরাঁয় বসে আছি আমরা দু’জন।

এক ট্রেনে ময়মনসিংহ আসার পর, ভেবেছিলাম আর কখনো তার সাথে দেখা হবে না। তবুও আমার মামুলী কার্ডটা তার হাতে দিয়ে সেদিন বলেছিলাম, “আমরা কার্ড, এটা আমার নম্বর। শহরে এলে ফোনে যোগাযোগ করবেন, কেমন?” কার্ডটা হাতে নিয়ে, অল্প হাঁসি চাপানো মুখে সে বলেছিল, “জি আচ্ছা!” আজ সকালে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলো, প্রথমে ধরি নি; পাছে ভয় হয়ে কে না কে হয়। দ্বিতীয়বারও ধরলাম না, কিন্তু তৃতীয়বার যদি একই নম্বর থেকে ফোন আসে তবে সেটা গ্রহন করব বলে মনস্থির করলাম। অথচ, আর কোনো ফোন এলো না। ঠায় তাকিয়ে রইলাম মুঠোফোনের, এল, ই, ডি জ্বলা স্ক্রিনের উপর। অনেক কিছুই ভাবলাম কিছুক্ষনের সময়ে, তারপর নিজ থেকে ই ফোন দিলাম। কিছুক্ষন অপেক্ষার পর, হেঁয়ালি ফোনটা গ্রহন করল। অপার থেকে বলল, “আপনি কী খুব বেশী ব্যস্ত?” আমি আমতা-আমতা করে বললাম, “না তো, কেন?” সে একমনে বলতে থাকল, “তাহলে মফিজ উদ্দিন ইন্ডেস্ক প্লাজার তৃতীয় তলায় চলে আসুন তো” “এখনি?!” আমি বললাম। সে বলল, “জি, আপনার সে গল্পের শেষটুকু শুনব। কাজেই কথা না বাড়িয়ে চলে আসুন” আমিও আর কথা বাড়ালাম না, আধ-অল্প সাজুগুজু করে চলে সোজা এলাম এখানে।

এখন হেঁয়ালি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি নিজেকে সামলে নিয়ে, চুপচাপ বসে আছি। একবার আশেপাশে থাকা মানুষজনের দিয়ে চোখ ঘুরালাম। হেঁয়ালির ঠোঁটে জড়ানো কফির মগটাতে শেষবারের মত চুমুক দিয়ে টেবিলে নামিয়ে রাখল। আলতো করে আমার জীর্ণ-শীর্ণ হাত ধরল, সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে আস্তে আস্তে বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে” আমি হাসলাম, উপেক্ষার হাঁসি সেটা। তারপর সে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এবার নিজের কথা শুরু করে দিল। সেই কত রকম মিষ্টি মিষ্টি গল্প, শুনলে তুমি হাসবে। আমি একমনে শুনে গেলাম, মৃদু হাঁসতে লাগলাম। বলাবাহুল্য, আমি শ্রোতা হিসেবে সরবদাই সর্বউত্তম। হেঁয়ালি নিজ গল্পে যেন নিজেই হারিয়ে যেতে লাগল; সেটাতে আমি আর তার বাঁধ সাধলাম না। গল্পের এক পর্যায়ে সে বলে উঠল, “আপনি না কবি! শুনেছি কবিরা নাকি অন্তর্যামী হয়। আপনি আমার মনের ভাষা পড়ে দিবেন?” আমি বললাম, “সে ভাষা যে এখন আর আমি পড়তে পারি নে, সে ভাষা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে।” হেঁয়ালি ব্যথিত নয়নে আমার দিকে তাকালো, আমি খুব করে চাইলাম ওর মনের ভাষার অভিব্যক্তি বের করতে। কিন্তু আমি ব্যর্থতার বনে গেলাম, সমগ্র দুঃখ ছাপিয়ে এই কষ্টটা তীব্রতর ভাবে অনুভূত হলো। এই নিরক্ষরতা থেকে মুক্তি পাবার আশায় আমি হেঁয়ালির নয়ন গভীরে নয়নের প্রতিচ্ছবি এঁকে ক্ষান্ত অধরে বলি, “আমাকে শিখিয়ে দিবেন? আমি আবার সেই কবি হতে চাই।” হেঁয়ালি কিছু বলল না। আমি আবারও বললাম, “কী! দিবেন শিখিয়ে?” আমি খুব করে উপলব্ধি করতে পারলাম যে, সে মাথা নিচু করে কাঁদছে। এ কথায় কান্নার কী আছে বুঝতে পারলাম না। হেঁয়ালি সেদিন আর কিছু বলল না। এক নিবিষ্ট মনে, সে তার হাতের চুরিগুলো গুছাতে লাগল। তারপর বলল, “উঠি তাহলে” আমি কিছু বলতে যাব, তার আগেই সে উঠে হনহন করে চলে গেল, আমার জন্যে অপেক্ষাও করল না। সেদিন রাতে তাকে ফোন দিলাম, কোনো ভাবেই সে ফোনকল গ্রহন করছে না, খানিকটা সঙ্কচবোধ করতে লাগলাম; আবার পুরনো সেই অপরাধবোধ মনে জমতে থাকল। এমন করে বেশ কিছুদিন যাবার পর, একদিন ভরদুপুরে ওর নম্বর থেকে ফোনকল আসে। উচ্ছ্বাসে আমার সমগ্র চিত্ত যেন টলমল করে উঠে, খানিকটা ভয়, খানিকটা আনন্দ, খানিকটা সংশয়; মিশ্র অনুভূতি নিয়ে সাদরে ফোনকল গ্রহন করি। ওপাশ থেকে শুধু বলল, “আজ সন্ধ্যে ৭টায় জয়নুল আবেদীন পার্কের বৈশাখী মঞ্চের সামনে চলে আসবেন” আর কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দেয় হেঁয়ালি। যথারীতি সন্ধ্যে ৭টার আগেই আমি চলে গেলাম সেখানে।


লম্বা কড়ই গাছের নিচে, শাদা মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধানো চত্বরে আমি একাকী বসে আছি। কিছুক্ষন পর পর ঘড়ি দেখছি; অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হতে লাগল। সামনে দিয়ে বেশ কয়েকবার বাদাম বিক্রেতার আনাগুনা চলল, একবার মনে হলো ১০০ গ্রাম কিনে নি; পরক্ষনেই কী ভেবে আর কেনা হলো না। একসময়, দেখি নিয়ন বাতির সোনালী আবছা আলোয় এক মানবীয় অবয়বের আগমনের সন্ধান। আমি তাকিয়ে আছি, দেখছি যদি হেঁয়ালি হয়ে থাকে; হ্যাঁ হেঁয়ালি ই এসেছে। সাথে সাথে আমি উঠে দাঁড়ালাম। কিছু বলতে যাব অমনি আমার হাতে একটা মোটা-সোটা বিবর্ণ ডায়ারী ধরিয়ে দিল। হতভম্বের মত আমি আমার হাতের নীল মলাটে বাঁধানো ডায়ারীর দিকে তাকিয়ে দেখছি, এমতাবস্থায় উপলব্ধি করতে পারছি যে, কোনো প্রকারের শব্দ উচ্চারণ ছাড়া ই তার প্রস্থান হয়েছে। সম্মুখে তার ঝাপসা ছায়ার তরে হাত বাড়িয়ে আমার মুখের অস্ফুট স্বরে শোনা গেল, “শোন, হেয়া…” ততক্ষনে, সে গেল আঁধারে মিলিয়ে।

ছ’রাত জেগে হেঁয়ালির লেখা ডায়রীটা তো আমি শেষ করেছিলাম ঠিক ই। কিন্তু, এরপরও সে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে চায় নি। কেন চায় নি, তা জানি নে। ডায়রীতে তার অন্তরের অন্তঃস্থলে লুকনো কথাগুলোর বিশদ সমাহর লক্ষ করা যায়। সাথে কিছু অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এবং বঞ্চনার ছোঁয়া রয়েছে, রয়েছে ভালোবাসা পাবার তীব্র আকাঙ্খা, কিছু নির্ঘুম রাত্রি বন্দনা। শুধুমাত্র, শেষ পাতায় লিখা দুটি কথা কেমন করে জানি মনের গভীরে আটকে গেল, আমার দুনিয়ায় কল্পনার ছাপ এঁকে দিল। যেন, ইন্দ্রলোকের ধরিত্রী অবতারণ উপলব্দি করতে পারছিলাম।

হেঁয়ালি লিখে ছিলো,
“আমি কেমন করে পারব, তোমার কবিতার ভাষা হতে
তোমার কবিত্ব হতে, তোমার সঙ্গিনী হতে,
বলে দাও, লুটে নাও, সর্বস্ব এই আমারে”


এখন সে এখন আমার ঘরণী। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, এই শেষ পূর্ণতা পেতে হয়েছে আমাদের। যদিও প্রেমের পূর্ণতা বলে কিছু নেই। প্রেম সর্বদাই শাশ্বত, স্বচ্ছ, অমলিন, উচ্ছ্বসিত! এর শেষ বলে কিছু নেই; এই প্রেম অনন্ত-অনাদি। এই ক্ষান্ত ক্ষনে তাই তোমাকে লিখছি, আমি পেয়েছি, তাকে পেয়েছি, সে প্রেম পেয়েছি; তার বসনে, ভূষণে, নয়নে, অধরে! সর্বস্বটুকু দিয়ে সে আমাকে পূর্ণ করেছে আর আমি তারে।

-সূচক

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
1
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Foisal Shahriyer
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!