তিয়ানের জন্য



                                                                    
                                                                    
                                            
অপারেশন থিয়েটারের মস্ত দরজার সামনে এসে শুভ্র বসনা সেবিকা থামলো একটু। অনুসরন করে আসা তিয়ান আর তার বাবাও দাঁড়িয়ে গেল অনতিদূরত্বে।
ট্রলিতে শুয়ে থাকা মা তাঁর চুড়িবিহীন হাতটা ইশারা করতেই ওরা এগিয়ে গেলো ট্রলির একেবারে পাশটিতে। বাপ ছেলের হাত দুখানা দুজনের মধ্যে ধরিয়ে দিয়ে মা কিছু একটা বলার আগেই সেবিকা ঝড়ের গতিতে ট্রলিটা ঠেলে ঢুকে গেলো এবং মুখের উপরেই মস্ত পাল্লাটা বন্ধ করে দিল ভিতর থেকে।
অসহায় মুখ করে তিয়ানের হাতটা আঁকড়ে ধরলেন বাবা। দুর্বল কন্ঠে বললেন,

  • তোর মা ফিরে আসবেতো তিয়ান?
  • আসবে বাবা। আমার জন্যে আসবে। আমি কিছু চাইলে মা যে কখনো না করেন নি।
    মনের অনুচ্চারিত কথাগুলো বাবাকে না বলে আঁকড়ে ধরা হাতটা নিয়ে অদূরে পেতে রাখা চেয়ারের সারিতে পাশাপাশি বসে তিয়ান। সারা
    অন্তর জুড়ে তখন মায়ের মুখটা শুধু।
    বাবার চোখের পুরু লেন্সের চশমা ভেদ করা দৃষ্টি কোন এক সুদূরে।
    নিশ্চুপ, স্থির । উস্কোখুস্কো চুল। চিরুনি পড়েনি দিনমান। কদিনের খোঁচা খোঁচা কাঁচা পাকা দাড়ি। মলিন শুকনো মুখ।
    তিয়ান পাশে বসে আড় চোখে বারবারই বাবাকে অনুসরন করছে। নিজেও খুব চিন্তামুক্ত আছে তা নয়। তারপরও বাবাকে এতটা উদ্বেগ,
    শঙ্কাপূর্ণ দেখতে তার ভাল লাগছে না। সদা উৎফুল্ল সহজ সরল মানুষটা ক মাস থেকে আপাদমস্তক এক চিন্তায় ডুবে আছেন।
    অথচ ছোট থেকে এত বড় হওয়া অবধি বাবাকে সে কখনও সিরিয়াস হতে দেখেনি কোন ব্যাপারেই। মার ভাবনার রাজ্যে সবটুকু উজাড় করে দিয়ে বাবা মুক্ত থেকেছেন বরাবরই। এমনকি নিজের পছন্দ অপছন্দগুলোও মার প্রতি ছেড়ে দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন।
    চলছিল দিনগুলি এভাবেই বাবা মা আর তিয়ানের। বাবার সকাল সন্ধ্যা অফিস আর মা ঘর দোর সামলে তিয়ানকে নিয়ে স্কুল কলেজ কোচিং প্রাইভেট ছুটতে ছুটতে একসময় থামলেন। তিয়ান যখন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে হোষ্টেলেই থাকার মনস্থির করলো।
    সপ্তাহান্তে রুচি ফিরাতে মার রান্না ছাড়া তার চলতোই না।ক্লাশের ফাঁকে হুটহাট হাজির হতো সোজা ডাইনিং টেবিলে। বাড়তি চাবি বাবা ছেলে দুজনের পকেটে দিয়েই রেখেছিলেন মা,যেন এদিক ওদিক গেলে ক্ষনিক অনুপস্থিতিতে বাড়ির বাইরে অপেক্ষার সময় গুনতে না হয়।
    সেদিন তিয়ান দুপুরে বাড়িতে ঢুকে মাকে সামনে না দেখে কিচেনে উঁকি দেয়। সকালের নাস্তার এঁটো প্লেট, চায়ের কাপ সিঙ্কে অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখে খটকা লাগে মা কি কোথাও গেছেন?
    ডাইনিং ঘুরে বেডরুমে উঁকি দেয়। মা এ অবেলায় শুয়ে। শরীর ঠিক আছেতো, জ্বর টর এলো নাকি?
    মার মাথায় আলতো করে হাত রাখতেই মা চমকে তাকালেন।
  • তিয়ান তুই? কখন এলি?
  • এখনই। কি হয়েছে মা? শরীরটা ভালো নেই নাকি?
  • না, না ঠিক আছি আমি। চল খাবার দেই।
    এমনি সময় মাথার কাছে রাখা ল্যান্ড ফোনটা বেজে ওঠতেই তিয়ান রিসিভ করে,
  • হ্যালো। বাবা?
  • তিয়ান কখন এলি? আজ থাকবি?
  • না বাবা। দুপুরে খেয়েই চলে যেতে হবে।
  • ও আচ্ছা। তোর মা আশেপাশে থাকলে দেতো।
  • হ্যাঁ, এইতো।
    মা ততক্ষনে ওঠে বসেছেন। রিসিভারটা মার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের রুমে যায় তিয়ান ফ্রেশ হতে।
    বেশ কদিন পরেই আজ বাড়িতে এলো। অগোছালো টেবিলে মায়ের হাতের ছোঁয়া যে পড়েনি তা স্পষ্ট। বেডকভারে টান টান করে ঝাড়া ভাবটা নেই। ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খোলা। মোট কথা চিরাচরিত তাড়ায় তিয়ান সেদিন যেভাবে রেখে বেরিয়েছিল ঠিক তেমনি আছে। যা এর আগে কখনই এমনটি হয় নি। মা নিশ্চয় জ্বর বাঁধিয়ে বসেছেন। একা হাতে সারাটা ক্ষন পানির কাজ করতে করতে ঠান্ডা লাগানোটাই স্বাভাবিক, নিজের মনেই উত্তর খুঁজে নেয় তিয়ান।
    ডাইনিং এ চেয়ারটা টেনে বসতেই ঘর থেকে মায়ের ফোনের কথোপকথনে কানে এলো।
  • এ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছো তাহলে। অফিস শেষে তুমি নিচে এসে গাড়ি থেকেই কল দিও। আমি তৈরি থাকবো বিকেল পাঁচটায়।
    হ্যাঁ পারবো, একা নামতে পারবো।
    ফোনটা রেখে খুব স্বাভাবিকতার সাথেই
    মা ডাইনিং এ টেবিল ম্যাট সাজিয়ে খাবার বাড়তে লাগলেন। জানালার এক টুকরো রৌদ্রের ছটা মায়ের মুখে পড়ছে। একি চেহারা হয়েছে কদিনে।কান্না ধোয়া ফুলো চোখ। ক্লান্ত অবসন্ন বিধ্বস্ত চেহারা।
    তিয়ান ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
  • কোন ডাক্তারের এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন বাবা? তোমার কি অসুবিধা লাগছে মা? আমাকে কিছু বলছো না কেন?
  • তুই এসব নিয়ে ভাবিস নাতো। তেমন কিছু না। তোর বাবার কান্ড, কদিন আগে একটু ঠান্ডা লেগেছিল, এই আর কি।
    মাছের পেটিটা প্লেটে দিতে দিতে বললেন মা,
  • তিয়ান খাচ্ছিস না যে। সামনে তোর ইয়ার ফাইনাল। মনোযোগ দে। অন্য কোন ব্যাপারে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
    মা তিয়ানের কাছে লুকোতে চাইছেন কিছু, তিয়ান আঁচ করতে পারে এতক্ষনে।
    মুখ নিচু করে খেতে খেতে ভাবনায় ডুব দেয়। মার মলিন মুখটা দেখে খারাপ লাগছে খুব। দুরারোগ্য কিছু হলো নাতো?
    সিদ্ধান্ত নেয়, খাওয়া শেষে বাবাকেই ফোন করবে। না জেনে চলে গেলে মার কথা ভেবে ভেবে পড়া হবে না একটি অক্ষরও।
    মা কথাও বলছেন না রোজকার মত। প্লেট গুছিয়ে কিচেনে চলে গেলেন যেন তাড়াহুড়ো খুব।
    খাওয়া শেষ করে তিয়ান বেসিনে হাত ধুয়ে মার রুমে এগোয়।। বাবাকে ফোনটা করতে গিয়ে মনে পড়ে নাম্বারটা কত যেন। আজকাল মোবাইলে নাম্বার সেইফ করতে করতে জানা নাম্বারও মুখস্ত থাকে না আর।
    টেলিফোন ইনডেক্সটা খুলতেই একটা কাগজ খসে পড়লো নিচে। হ্যাঁ প্রেসক্রিপশনইতো। দুদিন আগের তারিখ। মায়ের নাম, বয়স লেখা। প্রেসক্রিপশনটা ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান দেওয়ান কাকুর নয়। ডাঃ ফৌজিয়ার রাইটিং প্যাডে।
    তিয়ান দুরু দুরু বুকে চোখ বুলায়। ভ্রু যুগল কুঁচকিয়ে ঠোঁটে দাঁত চেপে ধরে। এক মুহূর্ত ভেবে, ওভাবেই প্রেসক্রিপশনটা ভাঁজ করে ইনডেক্সে রেখে দেয়। বাবাকে ফোন দেয়া হয় না আর।
    লম্বা ধাপ ফেলে নিজ ঘরে গিয়ে ঢুকে।
    পড়ার টেবিলে রাখা মোবাইলে রুমমেটকে কল দিয়ে বলে,
  • আজ ফিরবে না, একটা জরুরী ব্যাপারে আটকে পড়েছে।
    রকিং চেয়ারটা টেনে ব্যালকনিতে বসে গেটের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো তিয়ান।
    বাবার গাড়িটা লনে এসে থামতেই বাবার নাম্বারে চাপ দেয়।
    ওপ্রান্ত থেকে বাবার কন্ঠ ভাসে
  • কিরে তিয়ান কল দিলি যে। কি মনে করে?
  • কথা আছে বাবা। তোমার সামনেই বলবো।আমি এক্ষুনি নামছি।
    গাড়িতে বাবার পাশটিতে বসে বলে,
    এবার মাকে ফোন দিয়ে বলো,
    আজ মার ডাক্তারের কাছে যাবার দরকার নেই।
    তারপরের ঘটনাগুলো ঘটলো যেমন দ্রুত, তেমনি অপ্রত্যাশিত। তিয়ান বাবার সাথে সোজা ডাঃ ফৌজিয়ার চেম্বার। তার আগে বাবার সাথে বোঝাপড়া খানিক করেছে যদিও।
    ডাক্তারও বিষয়টা খোলাসা করলেন। এ অবস্থায় অপারেশন থিয়েটার কোন সমাধান নয়। হিতে বিপরীত হতে পারে।
    কোন ঝুঁকিই এখন নিরাপদ না, গম্ভির মুখে বললেন ডাঃ ফৌজিয়া। ভবিতব্য মানতে হয়, হবেই। ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করেই।
    কঠিন সময়টুকুর সারমর্ম বুঝিয়ে বাবাকে রীতিমত নার্ভাস করে দিলেন। তারপরও আশা যোগালেন, সাহস দিলেন। আসার সময়
    আদেশ নিষেধ এবং ওষুধপথ্যের উপর জোর দিয়ে বললেন, নেগেটিভ কিছু বলা যাবে না তার সামনে। আর চেক আপটাও জরুরী নিন্দিষ্ট সময়ে। বাকি উপরঅলার ইচ্ছা।
    বাপ ছেলের সহযোগিতায় বাস্তবকে মেনে নেন মা ধীরে ধীরে। সময় গুনে গুনে পেরোয় দিন মাস।এক দুই তিন করে করে
    মা দুর্বল হতে থাকলেন ততটাই। কখনো কখনো কঠিন সময় মনে হলেও তিয়ানের সাহসে আশার আলোটা নিভে যায় না। বরং জ্বলে ওঠে উজ্জ¦ল শিখার হাতছানিতে।
    তিয়ানের চিন্তাচ্ছিন্ন হয় ওটির ভারী দরজাটার ক্র্যাচ শব্দে। যেন দূর সাগরের ওপার থেকে কে একজন বেরিয়ে এলো আপাদমস্তক ধোপ দুরস্ত শুভ্র সাজে।
    দু হাত বাড়িয়ে মুখে অসম্ভব সুন্দর হাসি ফুটিয়ে বললো,
  • এই নিন পরী। একেবারে ফুটফুটে একটা পরী।
    বাবা আশাতীত আনন্দে নাকি মায়ের দীর্ঘ ন মাসব্যাপী কষ্টের সমবেদনায় অন্তরের ভীত বিহ্বলতা কাটাতে না পেরে নিজের হাত দুটো বাড়াতে গিয়েও কাঁপনটাকে থামাতে পারলেন না।
    পারলেন না নিয়ন্ত্রন করতে কন্ঠটিকেও। কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন,
    তিয়ান তোর মা?
  • মা মেয়ে দুজনেই সুস্থ আছে, বলতে বলতে
    তোয়ালে পেঁচানো টুক টুক করে তাকানো পরীটাকে তিয়ানের বুকের মধ্যে একরকম গুঁজে দিয়ে চলে গেল শুভ্র বসনা।
    তিয়ান তার দীর্ঘ অপেক্ষাগুলিকে বুক ভরা ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে বুকে লেগে থাকা তোয়ালের পরীটার মায়াভরা মুখটির কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
  • আর একটু হলেইতো তোকে হারিয়ে ফেলতাম। সেদিন যদি রিপোর্টটা চুপ করে না পড়তাম তবে যে সারাজীবনের জন্য বোনহীন একলাটি হয়ে থাকতাম রে।
    তুই শুধু আমার জন্যে।
  • ফাহমিদা রিআ (Fahmida Reea)

*

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
2
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Nusrat sultana
Guest
Nusrat sultana
4 years ago

Khub shundor…aro likhben! Tobe jevabe bornona diyechilen mone hoyechilo cancer type kichu, pregnancy bujha jachilo na!

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!