একদিন সকাল এগারোটার দিকে আমার বড়ো ভাইজান অনেক বড়ো একখান ইলিশ মাছ নিয়ে ঘরে আসেন। এত বড়ো ছিল ইলিশ! আমি আর আম্মা মাছ দেখে হা হয়ে ছিলাম। বড়ো ভাইজান জানান, তাঁর এক ঘনিষ্ট বন্ধু এই মাছ উপহার দিয়েছেন। ঐ বন্ধু নাকি চন্দ্রঘোনা মাছের আড়ত থেকে অনেক মাছ এনেছেন। ভাইজানকে খুব ভালোবাসেন ঐ বন্ধু। তাই একটা ইলিশ ভাইজানকে দিলেন।
মাছ দেখে আম্মা বারবার আব্বা আর আমার আরেক ভাইজানের কথা বলতে থাকলেন, “ঈশ্ যদি তোদের বাপ আর মামুন ঘরে থাকত ভালো হতো। এত বড়ো মাছ সবাই মিলে আয়েশ করে খেতে পারতাম।” আমার আব্বা আর ছোটো ভাইজান কাজের জন্য অন্য শহরে গিয়েছিলেন। তাঁরা মাসখানেক বাদে ফিরবেন। আমাদের ঘরে ফ্রিজ না থাকায় মাছ বেশিদিন সংরক্ষণ করাও সম্ভব ছিল না।
আম্মা বটিতে একটা পাথর ঘষতে বসেন। বটি ধার হওয়ার পর ইলিশের কাটাকাটি শুরু হয়। আমিও বেশ উৎসাহ নিয়ে আম্মার মাছ কাটা দেখি। প্রথমে মাছটার মাথা কাটা পড়ল। এরপর লেজ। বাকী মাছের মাঝখান বরাবর লম্বা করে কেটে নেয়া হলো। বুকের আর পিঠের অংশ আলাদা হয়ে গেল। এবার সেই অংশগুলোকে ছোটো ছোটো টুকরো করা হলো। সেইদিন প্রথম খুব মনোযোগ দিয়ে মাছ কাটা দেখি এবং উপলব্ধি করি, মাছ কাটতে পারাও একটা শিল্প।
রান্না শেষ হলে দুপুরে আমি ভাইজান আর আম্মা খেতে বসি। ইলিশের বুকের অংশ দিয়ে সরষে পাতুরি আর নানারকম সবজির সাথে মাছের মাথাটা রান্না হয়েছিল। আমার আর ভাইজানের থালে আম্মা দুই টুকরো করে সরষে ইলিশ পাতুরি তুলে দেন। আমিও চেটেপুটে খেয়ে নিচ্ছিলাম। ভাইজান যখন আম্মাকে বলেন, “তুমি মাছ নিচ্ছ না কেন?” তখন আম্মার উত্তর আসে, “সবজিটা এত ভালো লাগছে তাই সবজি দিয়ে খাওয়া হয়ে গেছেরে বাপ।” আম্মার এই কথার অর্থ বুঝতে পারার মতো বয়স তখন আমার হয়নি।
খাওয়া দাওয়ার পর আম্মা প্রতিদিন পানের বাটা নিয়ে বসেন। একটা পান শাড়ির আঁচলে মুছে নিয়ে তাতে কিছু কুঁচি করা কাঁচা সুপারি, চুন আর পাতিজর্দা দিয়ে খিলি বানিয়ে মুখে পুরে নেন। পান, চুন, সুপারি আর জর্দার মিশ্রণে আম্মার মুখে যে গন্ধ তৈরি হয় সেই গন্ধটা আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। ভাতঘুমের সময় আম্মার গা ঘেষে শুতাম সেই গন্ধ নিতে। পান চিবোতে চিবোতে আম্মা বলেছিলেন, “আজ এত বড়ো মাছ রান্না হয়েছে অথচ ঘরে খাওয়ার মানুষ নাই। এখন ঘরে কোনো অতিথি এলে খুব খুশি হতাম।”
তখন স্কুলে পড়ি, ছোটো ছিলাম। মায়ের সেই কথারগুলোর অর্থ তখন না বুঝলেও আজ ভালোই উপলব্ধি করতে পারি। আব্বা আর ছোটো ভাইজানের কথা মনে করে আম্মা ইলিশ মাছের টুকরো মুখে নিতে পারছিলেন না। দেখেছিলাম আম্মা বেশ ক’দিন অল্প মাছ ভেজে ভেজে তুলে রাখছিলেন। সত্যি ভালোবাসাগুলো কত বিচিত্র হয়। আম্মার এমন অনেক আচরণ তখন বুঝিনি। যা নিজে মা হওয়ার পর একটু একটু বুঝতে পারছি।
এতগুলো বছর পর যখন নিজে দুই ছেলেমেয়ের মা হয়েছি তখন এই ভালোবাসাগুলো বেশ অনুভব করতে পারি। আমার ছেলে পড়ালেখার জন্য অন্য শহরে আর মেয়ে তার শ্বশুরালয়ে। ওদের পছন্দের খাবারগুলো যখন ডাইনিং টেবিলে সাজানো দেখি তখন চোখের কোণে পানি এসে জমা হয়ে যায়। ওদের ছাড়া সেই খাবারগুলো গলা দিয়ে নামাতে কষ্ট হয়। ছেলের পছন্দের গোশত হেঁসেলে এখন তেমন একটা রান্না হয় না। মেয়েটা বাপেরবাড়ি বেড়াতে এলে তার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করে খাওয়াই। এমন না যে সে তার শ্বশুরবাড়িতে খেতে পারে না। আসলে নিজের চোখে সন্তানের পছন্দের খাওয়া দেখে মনটা জুড়িয়ে যায়।। আমরা কী মায়ের জাত বলে এমনটা হয়? কী জানি, হবে হয়তো। পরিবারের সকল সদস্য নিয়ে একসাথে খেতে বসার আনন্দ যে সীমাহীন।
ছোটোগল্প
পপি ধর
২৪.০৮.২০২১







ছোট্ট করে মায়ের কষ্টের কথা বলা, ভালো লেগেছে। মা’দের অনুভূতি এমনই হয়।