সময়টা তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলো। ইনিয়ে বিনিয়ে ঘোর কাঁটানো সম্ভব ছিলো না। সন্ধ্যা হবে হবে মুহূর্ত। ইদানীং ইলেক্ট্রিসিটি বেশ যন্ত্রনা দিচ্ছে পাড়া মহল্লায়। কলকাতায় সাধারণত লোড শেডিং ব্যাপারটা খুবই তুচ্ছ। এ আর এমন কি । নিত্য দিনের রুটিনের মধ্যে কলকাতা শহরের রুটিনে তেমনি একটা হচ্ছে এই লোডশেডিং। বলা নেই কওয়া নেই দুম করে সব অন্ধকার করে দেয়। কিন্তু এতে কেউ তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে হয় না। এ যেনো কিছুই হয়নি।
আমি কৈলাশ। সব সময় নিজেকে এক ধরণের এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে রাখি। আমি কিছু না কিছু নিয়ে সব সময়ই ব্যস্ত থাকি। যেমন এখন দাঁড়িয়ে আছি উঁচু একটা দেয়ালের কাছে। দেয়ালের পেছনে একটা বড় নর্দমা। পঁচা দুর্গন্ধ সব সময় লেগে থাকে ওপাশটায়।সম্পূর্ণ সুস্থ কেউ যদি ৫-১০মিনিট এখানে দাঁড়ায় তাহলে নিশ্চিত সে অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে।
এর আগে কখনো এখানে আমার আসা হয় নি। যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন।এমনই অন্ধকার যে এখানে এক সাথে ২০ জন দাঁড়িয়ে থাকলেও মনে হবে কেউ নেই।
আমার পেছনে যে দেয়ালটা নিজ বলে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বড়ই রহস্যময় এক দেয়াল। এই রহস্যের সমাধান আজ আমি করবো। অনেকেই চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু কেউ সফল হতে পারেনি। দেয়ালটির রহস্য একটা বড় লেখাকে কেন্দ্র করে।
১৯৭৫ সালের ঘটনা। দেশ ভাগের বহু বছর পরের কথা বলছি। ঘটনাটি লোকমুখে শোনা। তখন সম্ভবত কোনো এক যুবকের চোখে প্রথম লেখাটি চোখে পড়ে।লাল রং দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা,
‘ জনাব! কিছু ফেলে গেলেন কি? ‘
অনেকের ধারণা লেখাটি তারও অনেক বছর আগের লেখা। কে লিখেছে? কেনো লিখেছে? তার কিছুই জানা যায় নি। এখন আসা যাক লেখাটার পেছনের রহস্য নিয়ে।
কোনো মানুষ যদি এই দেয়ালটার কাছে আসে, আর ভুল ক্রমেও তার চোখ পড়ে যায় লেখাটির উপর। তখন ওই মানুষের মনে হয় আসলেই সে কিছু একটা হারিয়েছে। যা সে কখনো চাইলেও ফিরে পাবে না।অদ্ভুত বিষয়টি ঠিক তখনি ঘটে, তখন ঐ ব্যাক্তি ৩-৪ ঘন্টা উম্মাদের মত কিছু একটা খুঁজতে থাকে। কিন্তু সেটা কি সে নিজেই জানে না। খোঁজাখুঁজির এক সময় মানুষটি যখন দেয়াল থেকে বেশ কিছুটা দূরে চলে যায় ঠিক তখনি সব আগের মত। মানুষটা কোনো ভাবেই মনে করতে পারে না ঠিক কিছুক্ষণ আগে সে কি করছিলো।১৯৭৫ সালে,সেই যুবক ছেলেটির সাথেই নাকি প্রথম এরকমটা ঘটে।
সে যাই হোক, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, এসব আমি সহজে বিশ্বাস করি না। মানুষ সহজেই প্রতারিত হতে পছন্দ করে। বিজ্ঞানের ভাষায় একটা টার্ম আছে যেটাকে ইলিউশন ইফেক্ট বলে। এই ইলিউশানের ফাঁদে পা দিয়ে অনেকের ভীমরতি হয়। তবে আমার ক্ষেত্রে তা হবে না। কারণ আমি যুক্তির বাইরে চলার মানুষ নই।
চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হওয়াতে আমাকে টর্চ লাইট জ্বালাতে হলো। উঁচু দেয়ালটির ঠিক মাঝবরাবর টর্চ লাইটের আলো পড়লো। আমার দু’চোখ যেনো মুহূর্তের মধ্যে স্থিরতা লাভ করলো। অন্ধকার আলোতে লেখাটা প্রথমে চোখে পড়ে নি। টর্চ লাইটের আলোটা কিছুটা পাশে সরাতেই দেখি সেই লেখাটা ।যেটা আমি আজ প্রথম দেখছি।লাল রং দিয়ে লেখা।টর্চের আলোতে লাল রংটাকে অনেকটা জীবন্ত লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন কিছুক্ষণ আগে এসে রক্ত দিয়ে লেখাটা লিখে গিয়েছে। বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা।
‘ জনাব,কিছু ফেলে গেলেন কি? ‘
আমি লক্ষ করলাম আমার অবচেন মন আমাকে অস্থির করে তুলছে। আমি আমার মনের অজান্তেই টর্চলাইট দিয়ে দেয়ালের নিচে, আশে পাশে কিছু একটা খুঁজছি। পাগলের মত তন্ন তন্ন করে খুঁজছি।কিন্তু সেটা কি আমি জানি না। আমার মন বলছে আমি খুব দামী জিনিস হারিয়েছি। অমূল্য কোনো জিনিস!
অনেক সময় পার হলো। হঠাৎ আমার কানে মসজিদের মাইকের ফজরের আজান ভেসে এলো।মুয়াজ্জিন আজান দিচ্ছে। আমি এখন যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা অন্য একটা গলি। গলির নাম অষ্টমেঠো। আমার মস্তিষ্ক বলছে আমি যে ঘোরের মধ্যে ছিলাম সেটা কেঁটে গেছে। নিজেকে অনেকটা হালকা মনে হচ্ছে। আচমকা আমার মনে পড়লো, আমি ঘর থেকে বের হয়েছিলাম ঠিক সন্ধ্যে নামার সময়। তখন চারদিকে লোডশেডিং এর কারণে অন্ধকার হয়ে এসেছিলো। আমার হাতে ছিলো একটা পিতলের টর্চলাইট।
চারদিকে ভোরের আলো ফুটেছে। ঠান্ডা শীতল হাওয়া শরীরে এসে লাগছে।আস্তে আস্তে আমার সব কিছু মনে হতে লাগলো। আমি একটা রহস্য সমাধানের জন্য বের হয়েছিলাম।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি ব্যর্থ হয়েছি। যুক্তির বেড়াজালে নিজেকে অপরাধি মনে হচ্ছে। মাথার মধ্যে তখন শুধু একটা কথাই ঘুরছিলো।
‘ পৃথিবীর সব রহস্যের সমাধান হয় না। কিছু রহস্য নিজেকে বেশ রহস্যময় করে রাখে…’
সমাপ্ত
– সৌরভ আহমেদ
Send private message to author







Great