কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী সত্য চৌধুরী ১৯১৮ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের কলকাতার ৩১ নম্বর গ্রে স্ট্রীটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা যতীন্দ্রমোহন চৌধুরী ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট এবং মাতা বিমলাদেবী ছিলেন গৃহিণী।
ছেলেবেলায় সত্য চৌধুরীকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলেও, পড়াশোনাতে তিনি মনযোগী হননি। তাঁকে স্বয়ং তাঁর বাবা স্কুলে দিয়ে আসতেন কিন্তু তিনি ঠিকই পরে সুযোগ বুঝে স্কুল থেকে পালিয়ে আসতেন। শুধু তাই নয়, তাঁর বইখাতাও গোছানো থাকত না কখনো। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত তাঁর বই-খাতা। এমনকি ড্রেনের নোংরা জলেও কখনো কখনো ভেসে উঠত সেগুলো। কিন্তু তারপরও তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেননি। পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশনে তাঁর পড়াশোনা শুরু হলেও পরে তিনি মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে মেট্রিক পাশ করেন। পরবর্তীতে আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্নের মাধ্যমে ছাত্রজীবনের ইতি টানেন।
পড়াশোনাতে তিনি তুখোড় কৃতিত্বপূর্ণ স্বাক্ষর না রাখলেও, সুরের মূর্ছনায় তিনি জয় করে নিয়েছেন অজস্র স্রোতার হৃদয়। মোহিনী চৌধুরীর কথায় ও কমল দাশগুপ্তের সুরে “পৃথিবী আমারে চায়,রেখো না বেঁধে আমায়” গানটি করে তিনি শ্রোতা জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছতে সক্ষম হন।
সত্য চৌধুরী ছেলেবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন একটি সংস্কৃতমনা পরিবারে। তাঁর মা থেকে শুরু পরিবারের প্রায় সবাই সংগীতের চর্চা করতেন। বড়দের দেখে দেখে তাঁরও তৈরি হয় সংগীতের প্রতি প্রবল আকর্ষণ। বড় হয়ে তিনি কৃষ্ণচন্দ্র দে, রাইচাঁদ বড়াল, শচীন দেববর্মণ প্রমুখের নিকটে সংগীতের তালিম নেন। এর আগে তাঁর জ্যাঠামশাইয়ের দৌলতে মাত্র আট বছর বয়সে সুযোগ হয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে আসার। কবি নজরুলের এই সান্নিধ্যলাভ ছিল তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি।
তিনি কবি নজরুলের তত্ত্বাবধানে ও নজরুল অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর বহু নজরুল সংগীতের আদি রেকর্ড করেছেন। সেগুলো হল,
মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী (১৯৪২)
একাদশীর চাঁদ রে ওই রাঙা মেঘের পাশে (১৯৪২)
সুর : চিত্ত রায়
সঙ্ঘ শরণ তীর্থযাত্রা-পথে (১৯৪২)
চীন ও ভারতে মিলেছি আবার (১৯৪২)
ছেড়ে দাও মোরে আর হাত ধরিও না (১৯৪৩)
সুর : নিতাই ঘটক
নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল (১৯৪৩)
সুর : চিত্ত রায়
আগুন জ্বালাতে আসিনি গো আমি এসেছি দেয়ালী জ্বালাতে (১৯৪৩)
সুর : কমল দাশগুপ্ত
যাসনে মা ফিরে, যাসনে জননী (১৯৪৩)
মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম (১৯৪৪)
সুর : গিরীন চক্রবর্তী
দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার (১৯৪৭)
সুর : নিতাই ঘটক
জাগো অনশন-বন্দী ওঠ রে যত (১৯৪৭)
সুর : নিতাই ঘটক
ভাই হয়ে ভাই চিনবি আবার (১৯৪৮)
বল নাহি ভয় নাহি ভয় (১৯৪৮)
তোমার আঁখির মত আকাশের দুটি তারা (১৯৪৯)
সুর : নিতাই ঘটক
ভারত আজও ভোলেনি বিরাট (১৯৪৯)
মুখে কেন নাহি বল (১৯৫০)
সুর : কমল দাশগুপ্ত
হে গোবিন্দ রাখো চরণে (১৯৫০)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
“শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,
লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির॥”
অর্থাৎ দীঘিতে রয়েছে অনেক জল। তবুও শৈবালের দেওয়া একফোঁটা শিশিরবিন্দু অস্বীকার করতে পারে না দীঘি। ঠিক তেমনি, বহু গুণীজনের ঐকান্তিক পৃষ্ঠপোষকতায় নজরুল সংগীত আজ পৌঁছেছে বিশ্ব দরবারে। এক্ষেত্রে, অন্যদের তুলনায় সত্য চৌধুরীর অবদান কম হলেও কখনো অস্বীকার করা যাবে না। যতদিন বাঙালি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে কবি নজরুলকে, ততদিন বাঙালিকে স্মরণ করতে হবে সত্য চৌধুরীর এই পৃষ্ঠপোষকতাকে। সত্য চৌধুরী ১৯৯৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু পৃথিবী তাঁকে ভুলে যাইনি এবং কখনো যাবে না। তিনি বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে তাঁর গানের মাধ্যমে।
লেখা : শিবলী সাইক (Shibli Sayeek)
Send private message to author






