চিরায়ত বাংলার একটি গ্রাম। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সুমি। মাধ্যমিকে খুব ভালো ফলাফল করে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী সে এখন। পড়াশোনায় বরাবরই বেশ ভালো। দেখতে ও বেশ সুন্দরী। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের। ভাই বোন ৫ জন। দুই মাইল দুরে সম্প্রতি স্থাপিত একটি কলেজের ছাত্রী সে। কলেজ শূরু হয়েছে অল্প কিছুদিন আগে। কলেজে সুমি ক্লাস করেছে মোট দিন দশ। কারো সাথেই এখনো তেমন আলাপ পরিচয় হয়ে উঠেনি। চপলা, চঞ্চলা, সদা হাস্যোজ্জ্বল সুমির চোখে এখন রাজ্যের স্বপ্ন। স্বপ্ন সুন্দর এক আগামী নির্মাণের।
পড়াশোনায় ভালো সুমির প্রচন্ড ইচ্ছা পড়াশোনা চালিয়ে যাবার। পড়াশোনায় ভালো হবার কারণে শিক্ষকরা ও তাকে খুব আদর করেন। তার স্বপ্ন পড়াশোনা শেষ করে কোনো একদিন সে স্কুল শিক্ষক হবে। বেছে নেবে মানুষ গড়ার কারিগরের এই মহান পেশা।
দেখতে সুন্দরী হওয়ায় চারিদিক থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে সেই অল্প বয়স থেকেই। আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে ও কেউ কেউ তাকে বাড়ীর বউ হিসেবে নিতে চায়। এরই মধ্যে গোটা ৪/৫ টা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে সুমির বাবার কাছে। প্রথম দিকে সুমির বাবা মা এতে রাজি না থাকলে ও এক পর্যায়ে পাড়া প্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজনদের চাপে সুমিকে বিয়ে দিতে রাজী হয়ে যায় তার বাবা মা।
সুমির জন্য বিয়ের খুব ভালো একটা প্রস্তাব এসেছে। পাত্র স্বল্প পড়াশোনা জানা। কিন্তু বেশ বিত্তশালী। মাধ্যমিক পাস করেছে বেশ অনেক বছর আগে। বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে গত বছর। বিশাল একান্নবর্তী পরিবার। পাত্র পরিবারের বড় সন্তান। অনেক জায়গা জমির মালিক তারা। বাড়ীতে রয়েছে একটি পাকা দোতলা দালান। বেশ কিছু ব্যবসা ও রয়েছে তাদের। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে পাত্রকেই দেখাশোনা করতে হয় এই বিশাল সহায় সম্পত্তি।
এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা আর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য মুরুব্বীরা আলোচনায় বসলেন। সুমির খালা, ফুফু, নানী, মামাদের কেউ কেউ ও এলেন এই আলোচনায় যোগ দিতে। পাড়া প্রতিবেশী ২/১ জন মুরুব্বী ও যোগ দেন এতে। সুমিকে দুদিন আগে পাঠিয়ে দেয়া হয় এক আত্মীয়ের বাড়ীতে যাতে করে সে বিয়ের এই আলোচনাটা শুনতে না পায়।
আলোচনা চললো অনেক ক্ষণ। প্রায় সকলেই বিয়ের পক্ষে মত দেন। অপেক্ষাকৃত তরুণ ২/১ জন এই বিয়েতে দ্বিমত পোষণ করে। অন্যান্য বয়স্ক আর মুরুব্বীদের চাপে পরে এক সময় তারা হার মানে। তাদের প্রতিবাদের ভাষা ক্ষীণ হয়ে যায়। তরুন দুই একজনের এই বিরোধিতার কারণে তাদের আদব কায়দার ঘাটতি আছে বলে ও মত প্রকাশ করেন বেশ কয়েক জন মুরুব্বী। ২/১ জন মুরুব্বী তাদেরকে বেয়াদব বলে ও চিহ্নিত করলেন। এক পর্যায়ে তাদেরকে “মুরব্বিদের সাথে কথা বলতে শিখে নাই” এই অপবাদ দিয়ে আলোচনা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
অনেকক্ষণ ধরেই আলোচনা চললো। ফলাফল আর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এখন। সুমিকে বিয়ে দেয়ার পক্ষেই প্রায় সবারই মতামত। অংশগ্রহণ কারীদের অনেকেই বললেন,
- মেয়েদের এত পড়াশোনার কি দরকার?
- স্বামীকে চিঠি লিখতে আর স্বামীর চিঠি পড়তে পারলেই তো হলো।
- ভালো সম্বন্ধ পেলে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়াই ভালো।
- আরে ভাই চাইলে তো বিয়ের পরে ও পড়াশোনা করা যায়। কে নিষেধ করে?
- মেয়ের দাদীর খুব শখ নাতীন জামাই দেখে যাবে।
- যাক মেয়ের তো একটা ভালো গতি হলো। একটা উপযুক্ত পাত্রের সাথে বিয়ে দেওয়া গেল।
- এই রকম জামাই পাওয়া এক বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার।
- মেয়ের বাবা মা দুজনেই অসুস্থ। আল্লাহ না করুক কখন কি হয়ে যায়? সুমির বিয়েটা হয়ে গেলে অন্তত দুই জনই এক প্রকার নিশ্চিন্ত।
- এই রকম উপযুক্ত পাত্র কয় জনের ভাগ্যে জোটে।
- পুরুষ মানুষের আবার বয়স কি?
- জামাইয়ের যেই পরিমাণ সহায় সম্পত্তি তা দিয়ে মেয়ে তো সারা জীবন পায়ের উপর পা তুলে খেতে পারবে।
- কয়দিন পর সুমিইতো এই বিশাল সহায় সম্পত্তির মালিক হবে। বড়ই ভাগ্যবতী মেয়ে সুমি।
- সারা জীবন রাজরানীর মত থাকবে। কি কপাল মেয়েটার?
- এই রকম ভালো সম্বন্ধ কিন্তু আর পাওয়া যাবে না।
- সুমিকে আমি রাজী করাবো যে ভাবেই হোক।
- বেশী বাছলে পরে কিন্তু আর ভালো সম্বন্ধ আসবে না।
- শুভ কাজে দেরী করতে নেই।
- হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেললে পরে পস্তাতে হবে।
- সুমিকে বুঝানোর দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিন।
- চলেন বিসমিল্লাহ বলে শুরু করে দেই শুভ বিবাহের কাজ।
এবার সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা বিয়ের দিন তারিখের। দুইজন মহিলা মুরুব্বীকে দায়িত্ব দেয়া হলো সুমির সাথে আলাপ করতে আর তাকে রাজি করাতে। সুমি ফিরে এলো আত্মীয় বাড়ী থেকে। এবার শুরু হলো দুই মুরুব্বী মহিলার সুমিকে বুঝানো। সুমি বিয়েতে মত দেয় না। তার বক্তব্য বিয়ের আগে তাকে অন্তত ডিগ্রী পাস করতে হবে। কথাটা এক কান দুই কান করতে করতে কলেজ শিক্ষকদের কানে ও গেল। শিক্ষকদের কেউ কেউ সুমির বাবা মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। বুঝালেন। অনুরোধ করলেন কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না।
এবার শুরু হলো মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতির প্রয়োগ। দুনিয়া, আখেরাত, সওয়াব এই বিষয় গুলো উঠে আসলো এই দৃশ্যপটে। সুমিকে বোঝানো হলো অসুস্থ বাবা মায়ের শেষ ইচ্ছার কথা। অসুস্থ বাবা মায়ের শেষ ইচ্ছা সুমিকে বিয়ে দিয়ে যাওয়ার। আর এটা করতে পারলে তাদের মরে ও আর কোন কষ্ট থাকবে না। তাকে আরো বুঝানো হলো বাবা মা যদি মারা যায় বা আরো গুরুতর অসুস্থ হয়ে যায়, তখন ভাইয়েরা বা অন্য মুরুব্বীরা তার বিয়ে নিয়ে ততটা মাথা ঘামাবে না। মা বাবার কথা না শুনলে, তাদের মনে কষ্ট দিলে বদ দোয়ার প্রসঙ্গটি ও উল্লেখ করা হলো এই পর্যায়ে। সম্ভাব্য আরো কিছু কিছু মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে শেষ অব্দি সুমিকে বিয়েতে রাজী করানো হলো। মনে অনেক কষ্ট নিয়ে আর দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শেষ পর্যন্ত বিয়েতে সম্মতি দেয় সুমি।
ঠিক হয়ে গেল সুমির বিয়ের দিন তারিখ। দাওয়াত পাঠানো হলো চারিদিকে। কোন এক শুক্রবার সুমির বিয়ে হয়ে গেলো। লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে ঘোমটা মাথায় সুমি এখন নববধূ। সন্ধ্যা সমাগত। বিয়েতে আগত অতিথিদের অনেকেই চলে গেছেন এরই মধ্যে। সুমির বাড়ীতে চলছে বধূ বিদায়ের আয়োজন। এই সময়টায় যে কিশোরীর সারা উঠোন জুড়ে সম বয়সী বান্ধবীদের নিয়ে ওপেয়েন্টি বাইস্কোপ খেলে ছুটে বেড়ানোর কথা, সে সময়টাতেই সুমি প্রস্তুতি নিচ্ছে শশুর বাড়ি যাবার। যে সময়টায় সেই কিশোরীর পুতুল বিয়ে দেবার কথা, পুতুলের বিয়ের বিদায়ের সময় কাঁদার কথা, সেই সময় সেই কিশোরী নিজেই আজ একজন নববধূ। খানিক ক্ষণ পরেই সে যাত্রা করবে এক অজানা, অচেনা ভুবনের উদ্দেশ্যে। খাটের উপর নববধূর সাজে বসে আছে সুমি। চারিদিকে ঘিরে আছে কাছের মানুষ গুলো, আপন জন আর খুবই প্রিয় কয়েক জন বান্ধবী আর ছোট বেলার সাথী। সবার চোখ অশ্রু সজল। বিদায়ের করুন সুর তখন সবার হৃদয়ের গহীনে। চোখ মুছতে মুছতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সুমি। ঘরের কোনায় রাখা আলমিরাটা খুলে বের করে আনে ছোট্ট একটি পোটলা। এখানে রাখা আছে সুমির যত সব পুতুল পুতুলী। প্রচন্ড আবেগ তখন ভর করে সুমির মনে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে তখন। প্রিয় বান্ধবী মুন্নীর কাছে সযত্নে তুলে দেয় তার সেই পুতুলের পোটলাটি। অস্ফুট স্বরে তার মুখ থেকে বের হয় “আমার পুতুল গুলোকে তুই যত্ন করে রাখিস মুন্নী”। সুমির শিশুর মতো ডুকরে ডুকরে এই কান্না দেখে উপস্থিত সবার চোখ ও ভিজে ওঠে।
বিদায়ের সব প্রস্তুতি শেষ। উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি রিক্সা আর একটি বেবি ট্যাক্সি। ট্যাক্সির চারিদিক সাজানো হয়েছে ছোট ছোট লাল নীল কাগজ কেটে। বর কনে বসবে এটাতে। বর পক্ষের মুরুব্বীরা তাড়া দিচ্ছেন তাদের হাতে আর সময় নেই বলে। বাড়ীর ভিতরে তখন জোরে শোরে প্রস্তুতি চলছে বধু বিদায়ের। বধুর নাম সুমি, আমাদের আদরের ছোট্ট সুমি। সারা বাড়ী, উঠোন আর আশপাশ মাতিয়ে রাখা আমাদের সুমি আজ নববধূ সাজে। আজ সে আজ পুতুল সাজাবেনা বিয়ে দেয়ার জন্য। তাকেই আজ সবাই সাজিয়ে দিয়েছে বিয়ের পুতুল হিসেবে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে প্রায়। ধীরে ধীরে চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসে সুমি। তার পিছনে পিছনে আসে আপন জন আর ছোট বেলার খেলার সাথীরা। সবার চোখে পানি। ধীরে লয়ে পা বাড়িয়ে সুমি এসে দাঁড়ায় বেবি টেক্সির সামনে। জড়িয়ে ধরে মাকে। জড়িয়ে ধরে বাবাকে। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বাবা, মা আর মেয়ে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবার চোখই তখন অশ্রু সজল। মা বাবাকে পায়ে ধরে সালাম করে ধীরে ধীরে উঠে বসে টেক্সিতে। এরপর তার স্বামী ও সালাম করে শ্বশুর শাশুড়িকে। উঠে বসে টেক্সিতে। সুমির পাশে।
টেক্সি চলতে শুরু করে ধীরে ধীরে। পিছনে পড়ে থাকে সুমির শৈশব কৈশোরের হাজারো স্মৃতি। পাশে বসে প্রায় দ্বিগুণ বয়সী স্বামী, যাকে সে দেখেনি কখনোই, যার সম্পর্কে নেই কোনো বিন্দুমাত্র ধারণা। একেবারেই অজানা, অচেনা আর অদেখা কারো সাথে আজ শুরু হবে সুমির নতুন জীবন। হাজারো ভাবনা তখন সুমির মনে। কতটুকুই আর বয়স। পরদিন সকালে বই খাতা হাতে, চুলে বিনুনি আর লাল নীল ফিতায় চুল বেঁধে, খোঁপায় একটি সতেজ লাল গোলাপ গুঁজে মায়ের হাতে রান্না গরম ভাত খেয়ে ওর খুশীতে কলেজে যাবার কথা, সেই সকালেই নতুন পরিবেশে, নব বধূ হিসেবে তার যাত্রা শুরু এক নতুন জীবনের। যে স্বপ্ন গুলো এতদিন মনে লালন করছিল সুমি সেই স্বপ্ন গুলোর আজ এক নির্মম সলিল সমাধি ঘটলো। এক অজানা পথ যাত্রার এক নিঃসঙ্গ যাত্রী আজ সুমি। জানেনা সে আগামী প্রতিটা দিনটা তার কেমন কাটবে।
বিদায় সুমি, আমাদের প্রিয় সুমি, সবার আদরের সুমি। বড় আগেই আমরা তোমাকে পর করে দিলাম, সরিয়ে দিলাম দূরে, বহু দূরে, দৃষ্টির অন্তরালে। বড়ই স্বার্থপর আমরা। আমাদের স্বার্থপরতার বলি হলে তুমি আজ। পারলে আমাদের ক্ষমা করে দিও প্রিয় আদরের ছোট্ট সুমি, আমাদের সুমি।
আওরঙ্গজেব চৌধুরী
টরন্টো, কানাডা।
০৯ জুলাই ২০২১।




