ভবানীর মাকফাঁসনা আর চারআনার জানোয়ার

১৭৫০ এর পর থেকে আমাদের বংশে প্রথমবারের মতন সুদিন আসতে শুরু করে । অর্থকড়ির ঝনঝনানি বলতে যে একটা ব্যাপার আছে সেটা প্রথমবারের মতন আমাদের পূর্বপুরুষেরা অনুভব করতে পারেন । প্রথাগত দিনমজুরি করা আমাদের পূর্বপুরুষগণ হঠাৎ করে সমাজের উঁচুস্তরে চলে আসেন । কোন জায়গা থেকে হুট করে গুপ্তধন পেয়েছিল এমন না আসলে । ভাগ্য সন্ধানে দাদাজান অল্প বয়সে দেশ ছাড়েন । দেশ ছাড়েন বললে ভুল হবে । তিনি বাড়ি ছেড়ে পালান । প্রতিদিন হাড়ভাঙা কষ্ট সহ্য করার মানুষ তিনি ছিলেন না । সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খাটনি খেঁটে , দিন শেষে কয়েক আনার প্রশান্তি নিয়ে ঘুমানোর ইচ্ছে তার ছিল না । নিজের পরিবারের দুরবস্থা আর অন্য লোকদের খিস্তি – খেঁউড় শুনেই তিনি বাড়ি ছাড়েন । বাড়ি ছাড়ার পর তার মা শয্যাশায়ী হন ; দিন পনেরোতে গত হন । কিন্তু মন্দের ভালো বলে একটা কথা আছে – দাদাজান সেই মন্দের ভালো হিসেবে বেশ ফুলেফেঁপে বাড়ি ফেরেন এক সময় । আমাদের অবস্থা ফেরে । আমরা গ্রামে যে কয়েক ঘর মিলে থাকতাম সেই ঘরগুলোতে ধনদেবীর ছায়া পরে অবশেষে । সমাজের লোকেরা যখন কানাঘুষা শুরু করে হঠাৎ এইসব অর্থ কোথা থেকে এসেছে , সমাজে আমাদের উপর চাপ বাড়ে । প্রথমে গাইগুই করলেও দাদাজান তার কাপড়ের ব্যবসার ফিরিস্তি দিয়ে বসেন সবাইকে । একেবারে শুন্য হাতে বাড়ি ছেড়ে তিনি আজ রীতিমতো বণিক বনে গেছেন – এই নিয়ে ধন্যি ধন্যি পড়ে গেলো আশেপাশে । দিনমজুর থেকে ব্যবসায়ী হয়ে একেবারে আসমানে উঠে গেলেন । আচমকা বিয়ে থা করে মাস ছয়েক বাড়ি থেকে তিনি আবারো তার অজানা গন্তব্যে ছুটে যান । তবে এবার সাথে নিয়ে যান তার আরও দুই ভাইকে । প্রতি মাসে লোক মারফত যখন ভালো পরিমাণ অর্থ আসতে শুরু হয় , আমাদের চালচলন , চলাফেরা , আচার- ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন আসে । আমরা তখন আর খালি গায়ে ঘুরি না , মাটির ভাঙা পাত্রে ভাত খাই না । পান্তা ভাত তো লোকমায় ধরে না , মুখে রুচবে কি ! বাড়ির বউদের গলায় , কানে অলংকার উঠতে শুরু করে , আজীবন খালি পায়ে হাঁটা আমরা এখন খড়ম না পড়লে পায়ে ফোস্কা ধরে । কি এক মধুর যন্ত্রণা ! অর্থের প্রভাব এতই যে – আমাদের আগের পেশা মানুষ মনেই রাখল না । সমাজে এখন আমাদের ঠাট আছে । দুটো কথা মন দিয়ে শোনে অন্য লোকে । আগ বাড়িয়ে দুচারটা ধমক দেয়া যায় কাউকে ।


টগবগে তরুণ আমি । ধমনীতে দৌড়ায় গরম রক্ত । নতুন নতুন যৌবনে পা দেয়া অশান্ত এক শরীর । ছোট থেকে ঘুরে ঘুরেই বড় হয়েছি । কয়েকবছর কিছু পড়ালেখা করলেও , পড়ালেখার পাট চুকানো শেষ অনেক আগেই । আদরের সন্তান হলে যা হয় , সব রকম শাসন থেকে মুক্ত সবার থেকে । জীবন টা সুন্দর , কোন কাজ করা লাগে না । উচ্ছনে যাওয়া কিছু বন্ধু নিয়ে ঘুরি । বয়স ষোলতে পতিতাগমন ও শেষ আমার । ভাঙা পোড়া মন্দিরের এক কোনায় বসে সবাই মিলে নস্যি নেই সন্ধ্যায় । আজকাল ছুরি চালানো শিখে গেছি । হাত পাকাতে বেশিদিন লাগেনি অবশ্য । ছোট থেকেই হাতে একটা সোনার বালা পড়ি , কোন সময় না জানি কেউ ডাকাতি করে বসে । এই জন্য হলেও সাথে সবসময় ছুরি রাখতাম । সাহেবদের জমানা , কোন বিশ্বাস নেই । কালো চামড়ার মানুষদের জন্য কোন দয়া- মায়াই নেই হাড় বজ্জাদদের । কিছু একটা হলেও কোন বিচার নেই । এই তো কয়েকদিন আগে রবিকে মেরে ফেললো ধানের জমিতে কুপিয়ে কুপিয়ে । কিছুই হল না বিচার । খুনিকে ধরে বড় সাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়া হল , ১০০ ঘা চাবুক আর অতিরিক্ত খাজনা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হল । সাথে বলে দিল – নিজেদের ঝগড়া নিজেরা মিটমাট করতে । এদের আসলে বলে লাভ নেই । শুধুমাত্র নিজেদের লোক আর নিজেদের সৈন্যের কিছু হলে এদের বুলি বেরোয়, এছাড়া না । গ্রীষ্মের শেষের দিক ; বর্ষা আসবে আসবে করছে । আব্বার বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে সাথে কাকাদের ও । বর্ষার প্রথমে তারা বাড়ি ফিরে । এসময় আর বাহিরে বাহিরে থাকে না । বর্ষা শেষ হলে আবার বেরোয় । আব্বার বয়স বাড়ছে । মা বলছিলেন – আমি আব্বার সাথে এবার যাবো কিনা কাজে । এই কথার কোন উত্তর নেই আমার কাছে । আমার রোজগারের বয়স হয়েছে আমি জানি তবে কাজ করার কোন আগ্রহ নেই আমার । কিন্তু মা মানতে নারাজ । মতের অনৈক্য নিয়ে কয়েক দফা ভালো ঝগড়া লেগেছে আমাদের । লাভের লাভ কিছু হয়নি । সময়মাফিক আব্বাও ফিরে এলেন । নৌকা নিয়ে দলবল বেধে গাঙ্গে ঘুরেছি আমরা । পানি উপচে যখন ডাঙ্গায় এসে গেলো , সাথে ভেসে আসা মাছ কুড়িয়ে পুড়িয়ে খেয়েছি । আব্বার কাছ থেকে কাঁচা পয়সা নিয়ে দেদারসে উরালাম , বাজারের ঘরগুলোতে আরও কয়েকদফা ঘুরে , নেশা করে , মোরগ লড়াই এ বাজি ধরে ১০ দিনের মধ্যে সব টাকা শেষ ! আব্বা আমার অবস্থা দেখে হতবাক । সেবার আমার কাণ্ডজ্ঞানহীনতা নিয়ে কম কথা শুনিনি তার কাছে । সিদ্ধান্ত হল আমি আব্বা আর কাকাদের সাথে ব্যবসায় যাবো । আব্বার মুখের উপর কথা বলার সাহস কোন কালেই ছিল না । তাই না চাইতেও আমার তল্পিতল্পা গুঁটিয়ে সবার সাথে যেতে হল । এখান থেকে শুরু হল আমার নতুন জীবন ।


আব্বা আর কাকাদের সাথে তারাকান্দায় যেতে যেতে ৩ দিন লেগে গেলো । সেখানে পৌঁছে দেখি প্রায় বিশ জনের একটা দল সবমিলিয়ে । একেকজন একেক অঞ্চলের মানুষ । কেউ এসেছে উত্তরবঙ্গ থেকে , কেউ এসেছে সুন্দরবন এর ওদিক থেকে । একটা জঙ্গল এর একটু ভিতরে তাঁবু টানিয়ে সবাই থাকছে । আব্বা সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন । লোকগুলো কেমন যেন গম্ভীর আর চাপা স্বভাবের । প্রথম দর্শনেই আমার কাছে ভালো লাগেনি কাউকে । সে যাই হোক । আমাকে আব্বা কাজে লাগিয়ে দিলেন । প্রথমে জঙ্গল এর ভিতর থেকে লাকড়ি খুঁজতে হবে , ভাঙা ডালপালা এগুলো লাগবে । রাত হওয়ার আগে আগুন জ্বালাতে হবে নাহলে খাবারও জুটবে না , আর অন্ধকারে বসে থাকতে হবে । কোনরকমে আমার প্রথম রাত পেরুলো । পরের দিন সকাল সকাল আমরা তাঁবু গুঁটিয়ে বের হলাম আমাদের যাত্রায় । সেই সকাল থেকে চলেই যাচ্ছি আমরা । কোথায় যেতে হবে সেটা জানি না আমি । আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম কোন উত্তর দিলেন না । মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে খালি । পথিমদ্ধে দুটো গ্রাম দেখেছি । ভেবেছিলাম গ্রামে ঢুকে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেয়া যাবে । কিন্তু সবাই সাফ মানা করে দিল । ছোট করে একটাই উত্তর এলো – অচেনা মানুষদের ওরা আশ্রয় দেয় না । কেন দেয় না ?! সেটা কেউ বলেনি । শেষ দুপুরে আমরা অবশেষে থামলাম একটা বড় বটগাছের নিচে । পাতায় মোড়ানো শক্ত রুটি কোনরকমে চিবিয়ে শেষ করেছি সে সময় আরেকটা সফরকারী দলের দেখা পেলাম আমরা । প্রথমে তারা আমাদের একটু দূর থেকে পরখ করে নিল । এরপর তাদের একজন আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো কই থেকে এসেছি আমরা , কোন দিকে যাচ্ছি । উত্তর শুনে মনে হয় তাদের পছন্দ হল , প্রস্তাব দিল এক সাথে যাওয়ার । দল যত ভারী হবে তত সবার জন্য ভালো । যেকোনো সময় ডাকাত পড়তে পারে । বাংলায় কোন আইন নেই । সন্ধ্যে নামলেই বিপদ । মুহূর্তে লুটের দল হামলে পড়ে সব নিঃশেষ করে দিতে পারে । তাই তো সযত্নে মূল্যবান সামগ্রী অতি সতর্কতার সাথে রাখে । আমরা আবারো রওনা দিলাম । আমাদের সাথের দলটায় একটা পরিবার আছে ; ২ টা বাচ্চা আছে ওখানে । চলার পথে সবাই চুপচাপ । কেন যেন সবাই নিষ্প্রাণ । শেষ বিকেল প্রায় । তাঁবু গাড়তে হবে ; আমাদের দলের কিছু লোক সামনে এগিয়ে গেলো জায়গা খুঁজতে । আমরা পিছে রয়ে গেলাম । জায়গা ঠিকঠাক পাওয়া গেলো । খোলা প্রান্তরে তাঁবু টানিয়ে ফেলেছে এর মধ্যে আমরা যেতে যেতেই । একেবারে সন্ধ্যে সন্ধ্যে হবে হবে । সবাই গাড়ি থেকে নেমে মালপত্র ঠিকঠাক করছে । আমি এক কোনায় এর মধ্যে বসে গেছি আগুন এর পাশে । খেয়াল করলাম আমার থেকে একটু দুরেই আমাদের একটা কোদাল ফেলে রাখা । কাঁচা মাটি লাগানো তাতে । এই বিরান জায়গায় কোদাল দিয়ে কি করলো বুঝে উঠতে পারলাম না ঠিক । তাঁবু টানাতে তো কোদাল লাগার কথাও না । হঠাৎ কি যেন হল , দেখলাম আমাদের দলের একজন একটা সংকেত দিল । সাথে সাথে প্রত্যেকে একটা লম্বা রুমাল বের করে আমাদের সাথের দলের প্রত্যেকের গলায় ফাঁস দিয়ে দিল ! আমি ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলাম । কি হল এটা ?! জলজ্যান্ত মানুষগুলো ধড়ফড় করতে লাগলো । একেজনের চোখমুখ লাল হয়ে গেলো দম আটকিয়ে । শক্তসামর্থ্য কয়েকজন তখনো মারা যায়নি । তাদেরকে শুইয়ে পিঠের উপর ২ জন বসে বুকে চাপ দিয়ে মেরে ফেললো । মৃত্যু নিশ্চিত হতেই লাশগুলোকে টেনে তাঁবুর পিছনে নিয়ে যাওয়া হল । সেখানে কতোগুলো বড় গর্ত খোঁড়া । এতক্ষণ চোখে পরেনি আমার কারণ গর্তগুলো বড় গাছের পাতা দিয়ে ঢাকা ছিল উপরে । পাতা সরিয়ে লাশগুলোকে মাটি চাপা দিয়ে ফেললো খুব দ্রুত । কাজ শেষ করে হাতমুখ ধুয়ে সেই লাশগুলোর কবরের উপরেই সবাই চাদর বিছিয়ে বসে পড়লো । খুব সহজে , খুব সহজেই পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেলো কতোগুলো মানুষ !


সে রাতে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম । আমার বলার ভাষা হারিয়ে গিয়েছিল । আব্বা এসে খালি পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন । আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম বাড়িতে । যেতে পারিনি । রাস্তা চিনি না , নিজের টাকাও নেই । একা গেলে নির্ঘাত মারা পরবো । তাই মুখ বন্ধ করে তাদের সাথেই পথ চলতে হল । সারাদিন কিছু হয়নি । শুধু গতরাতের যাত্রীদের মালসামানগুলো আমাদের সাথে নিয়ে আসা হল । সারাদিন পথ চলার পরে একটা ছোট গ্রামে সবাই ঢুকল । আমাকে বলা হয়েছিল হুটহাট কোন অচেনা গ্রামে আশ্রয় নেয় না কেউ । কিন্তু কেন আমরা ঢুকলাম সেটার উত্তর পেলাম একটু পরেই । গ্রামটায় সব পরিচিত লোক । আমাদের দলের লোকদের চেনা আশ্রয় । যাদের কোন ঘর- বাড়ি নেই তারা এখানেই থাকে বাকি সময় বছরের । এমনকি আমাদের জন্য আলাদা ঘরের ব্যবস্থাও আছে । আচ্ছা ওরা কি জানে না যে আমার সাথের লোকগুলো খুনি ? নাকি জেনেও কোন ভ্রক্ষেপ নেই । কিছুই বুঝলাম না । এখানকার বাসিন্দারা সবাই আমাদের খাতির যত্ন করতে লাগলো । বেশ কয়েকদিন পর তাদের কল্যাণে ভালো খাবার মুখে উঠলো । খাওয়া শেষে এক ঘরের দাওয়ায় সবাই বসলাম । পুঁথি পাঠ হবে , গান হবে । আমার ইচ্ছে ছিল না , তাও বসতে হল । আব্বার আদেশের বাহিরে যাওয়ার উপায় কোন কালেই ছিল না । কিছু সময় যেতে না যেতেই একজন বয়স্ক লোক সবার মনোযোগ কেড়ে নিল মুহূর্তেই । পুঁথি পাঠ করে সে । টানা টানা স্বরে সাবলীল ভঙ্গিমায় পুঁথি পাঠ শেষে পৌরাণিক কাহিনী শুনাতে শুরু করলেন । শুরু করার আগে আব্বা কানে কানে কি যেন বললেন উনাকে । উনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন তারা কি ,তারা কেন আসলে এইসব করেছে গতকালকে । ” আমরা আজ যারা এখানে আছি , আমরা যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি সবাই আমরা দেবী ভবানীর সন্তান । ভবানী ; কালী । পুরাকালে যখন অসুর রক্তবীজের সাথে কালীর লড়াই চলছে তখন রক্তবীজের প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে জন্ম নিচ্ছে একটা রাক্ষস । এতো গুলো রাক্ষস ! কালী আর কয়টাকে শেষ করবেন । তখন দুটি লোক এগিয়ে যান কালীর দিকে । সাহায্য করতে চেয়েছেন কালীকে । কালী তাদের এক টুকরো রুমাল ( গামছা ) দিয়ে বলেছিলেন , বাছা এই তোমাদের অস্ত্র । তারা ওই রুমালে ফাঁস পরিয়ে কিছু মানুষ হত্যা করে । ফলে নতুন করে আর রক্তবীজের রক্ত ঝরে না । তাই আর রাক্ষস জন্মাতে পারে না ; কালীর জন্ম হয় । আমরা এই দুইজনের বংশধর । আমরা শুধু শুধু মানুষ মারি না । আমরা যাদের মারি তাদের অদৃশ্যভাবে মা ভবানী ঠিক করে দেন কে আমাদের হাতে মরবে । আমরা যদি তাদের না মারি তাহলে মায়ের আদেশ অমান্য হবে যে ! “


আপনি বিশ্বাস করতে পারেন ? এই যে আমি প্রথম দিনে আমাদের দলের লোকের খুন করা দেখে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম , তাদের থেকে পালিয়ে যাওয়ার একটা পরিকল্পনা করার চিন্তা করেছিলাম সেগুলো আর মাথায় কাজ করছে না । আমি এখন তাদের নিজেদের লোক ! গলায় গলায় ভাব সকলের । রাস্তার পর রাস্তা ছুটে বেড়াই সকলে মিলে । একই সাথে খাই , একই সাথে নাইতে যাই , একই সাথে সুখ দুঃখের কথা আওড়াই । যেই মানুষটা গ্রামের বাজারে আফিম খেতাম , মদে চুর হয়ে যেতাম , হুক্কায় দম টান দিয়ে শুয়ে পড়তাম ;কিন্তু কখনো কারো কোন ক্ষতি করিনি কোনএকদিন সেই আমি আজকে অনেক কিছু আমার চিন্তা চেতনার বাহিরে করে ফেলেছি ; করছি এবং মনে হয় সামনেও করবো । আমরা ছদ্মবেশী । ছদ্মবেশ ধরে মিশে যাই জনপদে । ছুটে বেড়াই অঞ্চলের পর অঞ্চল । কখনো বণিক , কখনো যাত্রী , কখনো সাহেবদের কর্মচারী । সুযোগ বুঝে লাফ দেই হিংস্র হায়নার মতন । খুবলে নেই কষ্টে জমানো সম্পদ । খুব কি কঠিন এগুলো ? না তোহ ! দল ধরে কাজ করি । কিছু লোক আলাদা হয়ে শিকারের খোঁজ করে । কিছু লোক শিকারের সাথে মিশে যায় । ঠিক কতদুর সামনে গেলে শিকারকে বাগে পাওয়া যাবে সেটা ঠিক করা হয় । নির্জন জায়গায় আগে থেকে কবর খোঁড়া চলতে থাকে । শক্ত হাতে খুব দ্রুত অল্প কয়েকজন কবর খোঁড়ে । আমরা কখনো কোদাল সাথে রাখি না । বয়ে নেয়া কষ্ট আর অনেক খানি জায়গা নেয় ; সাথে অন্যের চোখে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায় । তাই তো শুধু কোদাল এর মাথাটাই সাথে রাখা হয় । আমাদের কোদালে হাতল থাকে না । জঙ্গলের বাঁশ কিংবা কাঠ দিয়ে হাতল তৈরি করি আমরা । শিকার ধরার আগে আগে বানিয়ে ফেলি । জায়গা মতন শিকারকে পেলেই অতর্কিত রুমাল দিয়ে ফাঁস দেই গলায় । রুমালের শেষ মাথায় ছোট নুরি পাথর বেঁধে নেই । মাঝে মাঝে রশি ও ব্যবহার করি । গলায় ফাঁস দিয়ে মাটিতে শুইয়ে ফেলি , শিকারের উপরে চার – পাঁচজন বসে মৃত্যু নিশ্চিত করি । এরপর শিকারের হাঁটু আর ঘাড় ভেঙে মাটি চাপা দেই । হাঁটু আর ঘাড় ভাঙ্গার কারণে লাশ পচে মাটি ফুলে উঠে না । ফলে ধরা পড়ার কোন উপায় নেই । একেবারে মাটির সাথে মিশে যায় লাশ । রাতারাতি গায়েব হয়ে যায় জলজ্যান্ত প্রাণ । আমরা আসলেই মা ভবানীর ভক্ত ; একনিষ্ঠ অনুসারী । কত সুন্দর আমাদের একতা । আমাদের সাথে হিন্দু মুসলমান সবাই কাজ করে । সবাই মা ভবানীকে মানে । এই বাংলায় মুসলমান শুধুই নামে মাত্র মুসলমান । অন্য দেবদেবীর দিকে আকর্ষণ তাদের কোন অংশে কম নেই । আমরা খুন করে অর্থ নেই ঠিকই , কিন্তু সেটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করি না । নিজেদের মধ্যে কখনো ভেদাভেদ করি না । যারা শিকার ধরতে গিয়েছে, যারা মাটি খুঁড়েছে , যারা রাস্তা ঠিক করেছে সবাই সমান ভাগ পায় । কেউ কম পায় না , কেউ বেশি পায় না । খুব অল্প পয়সা পেলেও সবাই ভাগ করে নেই আমরা । কার কাছে বেশি টাকা আছে , কার কাছে কম টাকা আছে এই ভেবে আমরা শিকার ধরি না । ৪ আনা থাকলেও আমরা মানুষ মারি , বস্তা ভরা সোনাদানা থাকলেও মারি । ওই যে বিশ্বাস ! ওই এক বিশ্বাসে আমরা সব এক সুতোয় বাঁধা । আমরা কে আসলে ?হ্যাঁ, আমরা । আমরা যে ঠগি !


ভারতবর্ষের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো মূর্তমান আতঙ্ক আমরা । আমাদের কেউ চিনে না , কেউ ভাবেও না । আমাদের অস্তিত্ব সবার অজানা । বাংলার ময়মনসিংহ , সিরাজগঞ্জ , ঢাকা , ফরিদপুর , মুর্শিদাবাদ এ আমাদের রাজ । আমাদের দেখে কেউ বুঝেও না আমরা ঠগি । সম্পূর্ণ শান্ত , অবুঝ ভালো মানুষের চেহারার মধ্যে কি শয়তানের ছায়া লুকিয়ে আছে কে জানবে সেটা । অঞ্চলভেদে ঠগিদের অনেক নাম আছে । ভাগিনা , মাকফাঁসনা , তুমসবাজ , ঢ্যাঙাড়ে । বাংলায় ঠগিদের ঢ্যাঙাড়ে বলা হত বেশি । তবে আমরা ছিলাম মাকফাঁসনা । ঠগি আমরা সবাই শুধু নামে একটু ভিন্নতা । শুধু স্থলপথে ঠগি আছে এমন না । জলেও ঠগি আছে । এদের নাম পাঙ্গু । জেলে সমাজের মধ্যের লোকেরাই পাঙ্গু ছিল । দেখা যায় এক খেয়া ঘাটের সবগুলো মাঝি ঠগি । নৌকা ভর্তি করে যাত্রী উঠে , ওইসব যাত্রীদের মধ্যে মিশে গিয়ে আলাদা করে কিছু ঠগিও উঠে । মাঝ নদীতে নিয়ে গিয়ে নৌকা থামিয়ে গলায় ফাঁস পড়ানো হয় সবার । কিছু বুঝে উঠার আগেই সব লাশ পানিতে ডুবিয়ে ফেলা হয় । কিছু আলাদা গ্রাম থাকে । অইসব গ্রামের সবাই ঠগি । ছেলে , মেয়ে , বুড়ো সব মানে সব । জন্ম থেকেই ঠগি হয়ে জন্মায় ওরা । কোন যাত্রীদল ওই গ্রামে রাত্রিযাপনে আশ্রয় নিলেই হল । রাতের আঁধারে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া হয় সবাইকে । আরেকদল ঠগি আছে ; ধুতুরিয়া । এরা কম্বল চুরি করে বেশি । পথে চলা যাত্রীদের সাথে ভাব করে হুক্কা খাওয়ায় । হুক্কার তামাকে ধুতরার বিষ মিশিয়ে দেয় । এরপর হুক্কায় টান দিলেই শেষ ; ফেনা তুলে মারা যায় শিকার । আমরা সব এক । সব একটা জালের মতন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরো ভারতবর্ষ ছেঁকে ধরেছি । আমাদের হাত ধরেই গত একশো বছর ধরে বছরপ্রতি বিশ হাজার মানুষ লাপাত্তা হয়ে যায় । না এদের খুঁজে পাওয়া যায় , না এদের টিকিটাও ছোঁয়া যায় । তবু কোনদিন কারো সন্দেহ জাগেনি , এরা কোথায় যায় । মানুষ তো ধরেই বসেছে হয় এরা বাঘের পেটে যায় নাহলে সাপের বিষে মরে । নৌকায় ডুবে যায় নাহলে ডাকাতের কোপে প্রাণ হারায় । এই তো জীবন , চলছে । মানুষ আসবে আর যাবে , কে কোথায় হারাল কেইবা খবর রাখে ! আমরা একবার একটা ভয়ংকর কাজ করেছিলাম । ব্রিটিশ সরকারের বিপুল পরিমাণ সোনা আর অর্থ পাঠানো হচ্ছিল সৈন্য দিয়ে । খবর আসলো সৈন্য দলের মধ্য থেকেই । প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলো । মাইল এর মাইল পর গুপ্তচর বসলো । কোথায় কোথায় সোনা থামছে , কোথায় কখন পৌঁছাবে সব খবর আসছিল । ৩০ জনের সৈন্য দল । প্রত্যেকের রাইফেল আর অর্থ সহ সমূলে গায়েব করে দিয়েছিলাম দিন দুপুরে আমরা । এটা ছিল আমাদের জীবনের সবথেকে বড় ভুল । সাধারণ মানুষ হারিয়ে গেলে কেউ খুঁজে না । কিন্তু সম্পদ সহ ব্রিটিশ সৈন্য গায়েব হওয়ায় ব্রিটিশ মহলের টনক নড়ে । কোথায় হারিয়ে গেলো ৩০ জন সৈন্য , এই প্রশ্নের উত্তরে পুরো বাংলা ছারখার শুরু হল । কর্নেল স্লিম্যান ১৮৯৪ সালে এসে প্রথম ধরলেন প্রথম ঠগিদের একটা দল । ভবানী মায়ের বিশ্বাসঘাতক এর হাত ধরেই আমাদের সর্বনাশ শুরু ; কল্যাণ সিং – প্রথম রাজসাক্ষী । ঠগিরা সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও , সব এক সুতোয় বাঁধা । সুতার এক মাথায় টান পড়লে সব এক জায়গায় এসে যায় । এই কারণে একের পর ঠগির দল ধরা পরেই যাচ্ছে । আমাদের ময়মনসিংহ এর দুটো ঠগির দল ধরা পড়েছে , সামনে আছি আমরা । হয়তো আমরা আর থাকবো না । হয়তো আর কখনো বাড়ি ফেরা হবে না । কখনো আর ভবানীর পুজো দেয়া হবে না । শুনছি ঠগিদের ধরে ফাঁসি দেয়া হয় । জানি না কেমন লাগে গলায় ফাঁস পরলে । কখনো জানা হয়নি । আমি নিজ হাতে ২ হাজার মানুষ মেরেছি গত ৫ বছরে । ঘাড় ভেঙ্গেছি । বাচ্চাদের নরম গলায় রুমাল পেঁচিয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়েছি । কান্না ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে মেরেছি বহু প্রাণ । শিশুর সামনে মাকে মেরেছি , মায়ের সামনে নিষ্পাপ বাচ্চাকেও ছাড়িনি । আহাজারি শুনে খারাপ লাগে না তেমন । গর্ভবতী মহিলাদের আর বুড়োদের মেরে ফেলা ছিল সবথেকে সহজ কাজ । মাঝে মাঝে জোয়ান পুরুষদের মারতে কষ্ট হত । তবে পাকা শিকারির হাত থেকে বাঁচা এতো সোজা ছিল না । আজ পর্যন্ত আমাদের হাত থেকে কেউ বেঁচে ফিরেনি , পারবেও না । যুবতী মেয়েদের ফর্সা গলা লাল বানিয়ে দিয়েছি । কামনার দৃষ্টিতে উর্বর জমিনে বহুবার চাষ করেছি । আমাদের রক্তে ঢুকে গেছে এই কাজ । টাকা পাই আর না পাই , কাউকে না মারা পর্যন্ত আমাদের শান্তি হয় না । মানুষ আফিম খেয়ে নেশা করে, মদ খায় , মাগি নিয়ে ফুর্তি করে । এইসব নেশা আমাদের টানে না । আমাদের নেশা ওই একটাই । মারো , আরও মারো । যত পারো মারো । মানুষ মারার আলাদা একটা স্বাদ আছে , এই স্বাদ যে একবার পায় সে ছাড়তে চায় না । বয়স হয়ে গেলেও , গায়ে শক্তি কমে গেলেও কেউ ঠগিগিরি ছেড়ে দেয় না । দলের লোক মারে , সাথে থেকে দেখে , ঘ্রাণ নেয় মৃত্যুর । বড় প্রশান্তিদায়ক এই ঘ্রাণ ! এই যে হিংস্র জীবন , এই বর্বর মন কখনো গলেনি । কিন্তু আজ নিজেদের ধরা পরবার আশঙ্কায় আজ অপরাধবোধ জাগছে । মাঝে মাঝে নিজের গলায় রশি পেঁচিয়ে বোঝার চেষ্টা করি গলায় ফাঁস পড়লে কীরকম লাগতে পারে । ভয় হয় খুব , খুব ভয় । চার আনার জন্য খুন করা জানোয়ারও মৃত্যু ভয়ে শঙ্কিত । কিন্তু আমি যে বেঁচে থাকতে চাই অনন্তকাল , জাগতে চাই প্রতিটি সকাল । অনন্তর জীবনআয়ুর ইচ্ছায় ভাটা পরবে বোধহয় তাহলে । নাকি পরবে না ? ভবানী কি বাঁচাবে না তার সন্তানদের ? উদ্দাম প্রান্তরে শুয়ে থাকা এক মাকফাঁসনার অনুনয় দেবীর কাছে পৌছাতে ক্ষতি কি !

” সে শাণিত তরবারির আখ্যান ,
যুদ্ধদিনের জবাফুল ,
আর যুদ্ধবানের শোহরত !
মাকফাঁসনার মৃত্যু পাতায় মোড়া নরভোজের বিনীত এক অপন্যাস!
বিথারে ছুটে চলা আগুনের গোলা আর তার তপ্ত ভাপে ভাঁজা ঘোড়ার খুঁড়,
নিয়তির অখণ্ডনে খণ্ডিত বুনোট মগজের চার আনার জানোয়ার ! “



( ১ম পর্বের সমাপ্তি – পরবর্তী পর্ব কিছুটা ধোঁয়াশায় থাকুক । একটু দেরি হলে ক্ষতি নেই )

Writer : Omore Faruk Raul

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
2
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Omore Faruk Raul
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!