- লেখকঃ মেহরুবা মুনিরা
“এই যে শুনুন! আর একটা গান শোনা যাবে প্লিজ?” এতোটা অনুনয় করে কেউ তুবার গান শুনতে চাইবে ভাবতেই পারেনি কখনো; তাই ট্রেনের জানালা থেকে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো মানুষটা কে সেটা দেখার জন্য। সাথে সাথেই হাস্যোজ্জ্বল এক ছেলে বলল,”আমি নিশান। মাইক্রোবায়োলজি ফার্স্ট ইয়ার, আপনার গান শুনতে শুনতে কাটা পাহাড় এর রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাচ্ছিল। আরেকটা গান শোনান না প্লিজ।” তুবা হেসে দিয়ে বলল,
” একটু ভেতরের দিকে ভাইয়ারা কিন্তু বেশ জমিয়ে দিয়েছে গান গেয়ে, উনাদের মাঝে আপনি আমার গান এর শব্দ কেমন করে পেলেন?”
দ্বিধায় পড়ল নিশান, কি করে বলবে গত কয়েকদিন ধরেই ক্যাম্পাসে সে তুবার আশেপাশে ঘুরছে গান শোনার নেশায় আর ওকে দেখার নেশায়। নাম, কোন ডিপার্টমেন্ট বা কোন ইয়ার কিছুই এখনো জানেনা। শুধু একদিন জারুলতলায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময় মায়ের ফোন এসেছিল। একটু শান্ত পরিবেশে কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করেছিল তুবাকে। একা একা একটা মেয়ে বসে গুনগুন করে অদ্ভুত সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গাইছিল। যত শুনে ততোই যেন কেমন এক আবেশে চোখ জড়িয়ে আসে। আজ অনেক খুঁজে খুঁজে তুবা যেই বগিতে উঠেছে সেই বগিতেই উঠেছে। নিশান এর উত্তর দেয়ার ইতস্তত ভঙ্গী দেখে তুবা আর কিছু বলেনি, শুধু গাইলো—
“যখন আমার প্রশ্নের ঝড়
ভেঙ্গে দেয় যুক্তির খেলাঘর
তখন বাতাস অন্য কোথাও
শোনায় তার উত্তর…. ”
আবারও নিশান চোখ বন্ধ করে গান শুনতে লাগলো। তুবা তার কন্ঠের ভারসাম্য বজায় রেখে চোখের জল গোপন করে গাইতে লাগলো। শেষ স্টেশনে এসে তুবা নেমে পড়ার আগে নিশান পরিচয় জানতে চাইলে তুবা এড়িয়ে গেল।
তুবার শৈশব কেটেছে স্বপ্নের মত। মা-বাবা আর তুবা। একদিন স্কুল থেকে এসে দেখলো মায়ের পাশে শুয়ে আছে ছোট্ট একটা পুতুল। তুবা কোলে নিতে চাইলে তুবার চাচী এসে ওকে বসিয়ে পুতুলটাকে ওর কোলে তুলে দিল। তুবা জানলো এই পুতুল এখন থেকে ওর ভাই। কিন্তু ঘরে সবাই বেশ গম্ভীর হয়ে আছে কেন বুঝতে পারেনি। কিছুদিন যাওয়ার পর বুঝলো ওর ভাই জন্মান্ধ। তুবা তখন আরো বেশি করে ভাইয়ের খেয়াল রাখা শুরু করলো।
বছর চারেক পরেই তুবার জীবন ওলটপালট হয়ে গেল। তুবার বাবা রোড এক্সিডেন্টে দুই পা হারালেন। পঙ্গু স্বামী আর দৃষ্টিশক্তিহীন ছেলে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তুবার মা। বেশি চাপ সইতে না পেরে দুম করে একদিন না ফেরার দেশে চলে গেলেন তুবাকে একা রেখে। তুবার বয়স তখন ১৫ বছর।
আত্মীয়স্বজনেরা সবাই দূরে সরে গেল। বড় খালা শুধু পাশে রইলেন। বাবা ভাইকে আগলে রাখার জীবনযুদ্ধে তুবা হেরে যেতে চায়নি। সারাদিন শেষে রাতে যখন সবার বিশ্রামের সময় হতো, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে তুবা তখন পড়তে বসতো। এস.এস.সি তে মোটামুটি একটা রেজাল্ট করে কলেজে ভর্তি হল৷ কলেজের এক অনুষ্ঠানে গান গাইলো আর সেটাই তুবার জন্য কাল হল।
অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসা এক বড় ব্যবসায়ী তুবার গান শুনে তুবার সব খবর নিয়ে তার একমাত্র ছেলের জন্য তুবার বড় খালার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিল। তুবা প্রথমে রাজী না হলেও বড় খালার কথায় পঙ্গু বাবা আর অন্ধ ছোট ভাইয়ের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য রাজী হয়ে গেল। কিন্তু ভাগ্য সেদিন মুচকি হেসেছিল, ভাগ্যকে যারা আগে থেকেই জেনে নিতে চায় তাদের জন্য ভাগ্য কখনোই সদয় হয়না, আর তাই বিয়ের পরদিন থেকেই তুবার জীবনে নেমে এলো অমানিশার ঘোর অন্ধকার।
শশুরবাড়ি যাওয়ার পর সব আত্মীয়স্বজন তুবাকে ঘিরে নানারকম অনুষ্ঠান হাসি তামাশার মাঝে কাটিয়ে দিল পুরো রাত, এটাই নাকি এই বাড়ির নিয়ম। এক মিনিটের জন্যেও একা ছাড়েনি তুবাকে। পরদিনই তুবার বর মিনহাজ তুবাকে নিয়ে চলে যায় চট্টগ্রাম। তুবা ভেবেছিল মধুচন্দ্রিমায় যাচ্ছে ওরা, পুরো রাস্তায় মিনহাজ তেমন কোন কথা বলেনি, তুবা ভেবেছে ওর বর লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু ভুল ভাঙলো যখন দেখলো তুবাকে বড় একটা ফ্ল্যাটে সেদিন একা রেখে মিনহাজ ব্যবসায়িক ঝামেলা আছে বলে ঠিক সন্ধ্যায় চলে গেল। সেদিন রাতে মিনহাজ আর ফেরেনি। তুবার কাছে কোন মোবাইল ছিলনা। অচেনা জায়গায় নববিবাহিতা একটি মেয়ের সারারাত কেটেছে উৎকন্ঠা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে। শেষ রাতের দিকে কি মনে করে সাজানো ফ্ল্যাটের আসবাব দেখতে দেখতে এক আলমিরার দরজা খুলে দেখলো ভেতরে কিছু আগ্নেয়াস্ত্র। ভয়ে তুবা কেঁপে উঠলো। সকাল পর্যন্ত নির্ঘুম কাটিয়ে দিলো। সামান্য চোখ লেগে আসতেই দরজা খোলার শব্দে চোখ খুলে দেখে মিনহাজ। পরম নির্ভরতা নিয়ে দৌড়ে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মিনহাজ বিরক্ত হয়ে এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। তুবা বলে উঠে
– আপনি সারারাত কোথায় ছিলেন? আমাকে এভাবে একা রেখে চলে গেলেন কেন? আমার ভীষণ ভয় করছিল।
– এ্যাহ! ন্যাকা, বিয়ে করার সময় মনে ছিলনা ভয়ের কথা? দূর হ আমার সামনে থেকে। তোর মত মেয়েগুলোকে দেখলেই বমি পায়।
তুবা বজ্রাহতের মত তাকিয়ে রইলো। মিনহাজ পাশের রুমে গিয়ে কাউকে ফোন করল–
– সুইটহার্ট তুমি এখনও ঘুমাওনি কেন? আমি এখনই একটা শাওয়ার নিয়ে ঘুমিয়ে যাব। তাছাড়া বিকেলে ক্লায়েন্ট আসবে একটু ফ্রেশ মুডে থাকতে হবে, সাথে ওই মেয়েটাও থাকবে।
মিনহাজ শাওয়ার নেয়ার আগেই ফ্ল্যাটে দু’জন কাজের লোক নিয়োগ করল। রান্নাবান্না, বাজার, ঘর ধোয়া মোছাসহ যাবতীয় সব সামলানোর দায়িত্ব ওদের। ল্যান্ডফোনের সংযোগ দেয়া হল। ওদের কথায় বুঝতে পারলো এরা পুরনো লোক। ঢাকা থেকে শশুরের নির্দেশে এরা এসেছে।
দুপুরের খাবারের পর তুবা ল্যান্ড ফোন থেকে বড় খালার কাছে ফোন করতে গিয়ে দেখে সেখানেও লক করা। বাবা আর ছোট ভাইটার জন্য বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা শুরু হল। কিছুক্ষণ পরই মিনহাজের বাবা ফোন করেন।
-হ্যালো তুবা
– জি আব্বা আসসালামু আলাইকুম
– ওয়ালাইকুম আসসালাম,তুবা শোন, আজ সন্ধ্যায় আমার দু’জন ক্লায়েন্ট যাবে তোমাদের ফ্ল্যাটে। তুমি উনাদের খেয়াল রেখো।
– জি রাখবো। একটা কথা বলার ছিল।
– বলো
– গতকাল থেকে বাবা ভাইয়ের সাথে কোন কথা হয়নি, আপনার ছেলে গতকাল সন্ধ্যায় বের হয়ে আজ সকালে এসেছে। সারারাত আমি একা ছিলাম।
– মিনহাজের সাথে নিজেকে মানিয়ে নাও। তোমার বাবা ভাই দুজনেই ভাল আছে। আমাদের কথা মেনে চললে ওরা সবসময়ই ভাল থাকবে। কথাটা মনে রেখো।
তুবা বুঝে নেয় জীবন যতোটা সুন্দর হবে ভেবে এই পথে পা রেখেছিল তার চেয়ে বেশি কদর্য হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
*****
বাসায় ফিরে তুবা জানতে পারলো মিনহাজ এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে গেছে। স্পাই দু’জন তাই কিছু জানাতে পারেনি। তুবা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে আবারও নিশানের মুখোমুখি হয়। তুবা আজও এড়িয়ে যায়। বাসায় ফিরে তুবা এইবার ভাবে একবারের জন্য কি চেষ্টা করে দেখবে এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যায় কিনা? নিশান ছেলেটাকে সব খুলে বলবে? কিন্তু কিভাবে? দুজন লোক সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখে ওকে। তাই সবসময় ক্লাস করা যায়না। এই সপ্তাহে মিনহাজ নেই তাই ক্লাসে যাচ্ছে। কী ভেবে একটা টাকার উপর লিখলো— আমার অনেক বিপদ। যোগাযোগের উপায় নেই। সারাক্ষণ দু’,জন লোক আমাকে পাহারা দেয়।
পরদিন ক্যাম্পাসে সারাদিন নিশানকে খুঁজে তুবা কিন্তু পায়নি। ফেরার সময় স্টেশনের একটা দোকানে দাঁড়ায় পানি কেনার জন্য। তখনই ভেতর থেকে নিশান এসে পাশে দাঁড়ায়। তুবা সহসাই বুদ্ধি করে লেখাওয়ালা টাকাটা নিশানের হাতে দিয়ে বলে “একটু দোকানিকে দামটা দিয়ে দেবেন ভাই।”
তুবা চলে যায়। নিশান টাকার উপর লেখা পড়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। কৌশলে টাকাটা নিজের কাছে রেখে পানির দাম মিটিয়ে বের হয়ে যায়। সেদিন থেকে পরের টানা কয়েকটাদিন তুবা আসার পর থেকে যাওয়া পর্যন্ত, স্টেশনে নামার পরেও কোন দুটো’ পরিচিত মুখ বারবার চোখে পড়ে তা খেয়াল রাখে। অনুমান করে নেয় দুজনকে। বন্ধুদের সাহায্যে একদিন কৌশলে তুবাকে ওদের চোখের আড়াল করে একটা মোবাইল দেয়। তুবা বাসায় এসে মোবাইল অন করেই নিশানের নাম্বার পায়। মোবাইল সাইলেন্ট করে ম্যাসেজে যতটা পারে সব লিখে জানায়, ফোন করলে ঘরের কাজের লোকেরা শুনতে পাবে তাই। তুবার ভাগ্য ভাল হওয়ায় মিনহাজের দেশে ফিরতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে জানায়। এর মাঝে নিশানের সাথে ম্যাসেজে তুবা তার সমস্ত ঘটনা জানায়। তুবার শৈশব, বেড়ে ওঠা, পারিবারিক বিপর্যয়, তুবার জীবনযুদ্ধ এবং সবশেষে মিনহাজদের পরিবারে এসে বিভিন্নরকম অবৈধ ব্যবসায় নিজের তুরুপের তাস হওয়ার কথাও জানায়।
নিশান কথা দেয় তুবাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করবেই।
নিশান তার বন্ধুদের সাথে তুবার ব্যাপার নিয়ে আলাপ করে। সবার মতামতের ভিত্তিতে খন্দকার পরিবার যেমন চাইছিল তুবা এখানে ওদের ব্যবসার একটা ক্ষেত্র তৈরী করুক সেভাবেই তুবা কাজ করে যায়। এর মাঝে মিনহাজ ফিরে আসে। তুবার কিছু বন্ধু হয়েছে এবং এরা রাজনীতির সাথে যুক্ত তা জানার পর তুবাকে আর মার খেতে হয়নি। ধীরে ধীরে তুবার ফ্ল্যাটে ওদের আসা যাওয়া বাড়তে থাকে। নিশানদের উদ্দেশ্য হয় এই পরিবারের মুখোশ সবার সামনে খুলে দেয়া।
দিন যায়, তুবার গানে মুগ্ধতা বাড়তে থাকে সবার মনে। তুবাকে ইদানীং মিনহাজ একটা মোবাইল দিয়েছে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের জন্য। তবে এর সাথেই একটা অডিও চিপ লাগানো আছে যেন সব কথা মিনহাজ শুনতে পারে। নিশান ততোদিনে তুবার মনেও জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু বিশাল এক কালো থাবার ভয়ে নিশ্চুপ থাকে ওরা। প্রথম দূর্বলতা তুবার বাবা আর ভাই। তাই সবার প্রথমে ওদেরকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার প্ল্যান করে নিশান। তুবার বাসায় এসে মিনহাজের সাথে কথা বলে
– স্লামালিকুম ভাই, কেমন চলছে?
– ওয়ালাইকুম সালাম, এইতী ভালোই। তোমাদের কী খবর? সামনের ইলেকশনের প্রস্তুতি নিচ্ছ তো?
– জি ভাই, প্রস্তুতি চলছে। বিরোধী দল অবশ্য আমাদের চেয়েও শক্ত অবস্থানে আছে। সারা বছর এতো খাটাখাটুনি করলাম এখন শেষে এসে চিন্তায় পড়ে গিয়েছি।
– আরে, ভোটের দিন কয়টা ঠুস ঠাস করে সরে যাবে, দেখবা আর সমস্যা নাই।
– না ভাই, ওই কাজ করার যন্ত্রের একটু আকাল যাচ্ছে। তাই ওই পথে আপাতত যাবনা।
– কী বল না বল? তোমার লীডারের সাথে আমার একটু কথা বলিয়ে দিও, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
– সত্যি বলছেন?
– এই মিনহাজ খন্দকার যা পারবনা তা নিয়ে কখনো কথা বলতে যায়না।
– সিরিয়াসলি ভাই? লীডারের সাথে একটা ইনফরমাল আলাপ করার ব্যবস্থা করব?
– আমি ইনফরমাল আলাপই করব। কারণ আমাদের পারিবারিক ব্যবসার একটা রেপুটেশন আছে।
– ভাইয়া এই রেপুটেশন নিয়ে আবার পরে সমস্যা হবে না?
– না না, আমি তো বৈধ ব্যবসা করি। তোমার কাছে কিছু জিনিস কম আছে আমি তাই সাহায্য করব এইটুকু আলাপই শুধু।
তুবা বুঝতে পারছেনা কিভাবে কোন স্টেপ নিয়ে বাবা আর ভাইকে বিপদমুক্ত করবে। নিশান যদিও একটা প্ল্যান করা হয়েছে বলেছে কিন্তু কতোটা সফল হবে সে ব্যাপারে সন্দিহান ও নিজেই। এই তুবার জন্য নিশান রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছে। ও বলছে ওদের দলের বড় ভাইয়ের সাথে তুবার ব্যাপারে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করেছে। উনি তুবার অবস্থা বুঝতে পেরেছেন, যেমন করে হোক এই খন্দকার পরিবারকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু তুবা বিশ্বাস করতে পারছেনা। বাইরের সম্পর্কে সব খবর না রাখলেও রাজনৈতিক অঙ্গন সম্পর্কে ওর ভালোই ধারণা আছে।
বিকেলে মিনহাজের কাছে নিশান ফোন করলো। জানালো আগামীকাল সকালে একটা মিটিং এর ব্যবস্থা করেছে ওর বড় ভাইয়ের সাথে। মিনহাজ সময় এবং লোকেশন জেনে নিল।
পরদিন সকালে ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে মিনহাজ দেখে সেখানে নিশান এর সাথে ওদের আরও কয়েকজন বন্ধু এবং একজন অপরিচিত ছেলে আছে। নিশান জানালো এই হল তাদের বড় ভাই। মিনহাজ একটু ধাক্কা খেল। কেননা নিশান যাকে বড় ভাই ডাকে তাকে মিনহাজ নিজেও চেনে, বেশ পরিচিত মুখের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। মিনহাজ সেই লোক পর্যন্ত যাওয়ার কোন রাস্তা খুঁজছিল ভেবেছিল পেয়ে গেছে। কিন্তু আজ আশায় গুড়ে বালি। কথা শুরু করলো আগে মিনহাজ,—
– কি ব্যাপার নিশান ইনি কে?
– কেন ভাইয়া বলেছিলামনা বড় ভাই আসবেন? ইনি সেই ভাই।
– আমি তো উনার সাথে দেখা করতে চাইনি তোমাদের এই এলাকার মূল নেতা যিনি, তোমরা যার হয়ে কাজ করছো তাকে খুঁজেছি।
– ভাইয়া, সেই নেতা পর্যন্ত যেতে হলে আগে এই ভাইকে লাগবে। উনার নাম ইমরুল কায়েস। আমরা বড় ভাই ডাকি। আপনারা আলাপ সেরে নেন।
ইমরুল শুরু করলো এবার,
– সালাম ভাই। শরীর কেমন?
– সালাম, আছি ভাল। আমি তুমি করেই বলি? অনেক ছোট হবে।
– জি বলেন সমস্যা নাই। সিনিয়রদের সম্মান না দিলে দেশের সম্মান কীভাবে রাখবো?
– হুম, এটা ভাল বলেছো। তা সামনে যেই ইলেকশন আছে তার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানার পর ভেবেছিলাম তোমাদের সাহায্য করব। এখন তুমি কি এই ব্যাপারে আলোচনা করবে নাকি তোমাদের নেতা করবে?
– না ভাই, নিশানদের সাইড আমি দেখছিতো, আমিই আগে আলাপ করব। আমাদের একটা প্ল্যান আছে যদি সফল হই তাহলে নেতার সাথে আপনার একটা মিটিং ফিক্সড করা যাবে। আপনি এই প্ল্যান শুনে ভেবে দেখেন সাহায্য করতে পারবেন কিনা?
– প্রচারণার শেষ দিনে আমাদের মিছিলে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে হবে, সেই গুলিতে দলের একজন আহত হবে আরেকজন সাধারণ মানুষ নিহত হবে। এখন ব্যাপার হল আপাতত দলের কোন ছেলের ক্ষতি করা যাবেনা। দলের আহত ছেলেকে মূলত সাধারণ মানুষ হতে হবে। যে কিনা পরে বিবৃতি দিয়ে বলবে সে মিছিলে ছিল, হঠাৎ দেখে বিরোধী দল থেকে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। এখন পাবলিক খুব চালাক তাই সাবধানে এবং কৌশলে এই ঘটনা সাজাতে হবে। আর আপনার কিছু লোককে গুলি ছোঁড়ার দায়িত্বটা নিতে হবে। আপনি ভেবে দেখেন পারবেন কিনা।
– আমার লাভ?
– আপনার নতুন ক্লাবে সীসা এখন বন্ধ না? ওইটা চালু হবে ঝামেলা ছাড়াই।
– আমি নেতার কাছ থেকে শুনতে চাই।
– নেতাই বলেছেন। ডিল ফাইনাল হলে কাজ হবার আগে থেকেই চালু করে দিতে পারবেন।
– ওকে, ডিল ডান। সাথে আরেকটা হেল্পও করতে পারি।
– কী হেল্প?
– সাধারণ জনতা এবং একজন ছাত্র যে তোমাদের দলের কেউনা এমন দুজনকে দিতে পারি।
– ফ্যান্টাস্টিক! আমি অবশ্যই নেতাকে আপনার কথা বলব। ইলেকশনের পর যত দ্রুত সম্ভব একটা মিটিং যেন হয়।
সেদিনের পর খুব সহজে প্ল্যান ফাইনাল হল। প্রচারণার শেষ দিনে মিছিলে মিনহাজের কয়েকজন লোক মুখ ঢেকে গুলি চালায়। তুবার অজান্তে মিনহাজ তুবার বাবা আর ভাইকে আগে থেকেই সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। মিনহাজের লোকেদের উপর নির্দেশ ছিল এদের দুজনকে স্পট ডেড করে দেয়া। নিশান আর তার বড় ভাইকে এই ব্যাপারে জানানো হয়েছিল। তবে আসল পরিচয় গোপন ছিল। তবে নিশান সবটাই জানতো, তাই মিছিলে যখন কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে মিনহাজের লোকজন দৌড় ঝাপ শুরু করে তখন নিশানের একটা দল তুবার বাবা আর ভাইকে সরিয়ে নেয়। ওদের মেরে ফেলার কাজে নিয়োগ দেয়া লোক দু’টোকে মেরে ফেলা হয়।
মিনহাজ কয়দিন ধরে পাগলের মত হয়ে আছে। তুবার বাবা আর ভাইয়ের খবর মিলছেনা কোনভাবেই। নিজের লোক দুটোও মাঝখান থেকে মারা পড়লো। তুবাকে এখনো তার পরিবারের কথা কিছু জানানো হয়নি। কিভাবে কি বলবে তাও বুঝতে পারছেনা। মিনহাজের বাবা দেশে ফিরবে আগামীকাল। এসে সোজা এখানেই চলে আসবেন। ব্যবসা বাড়াতে গিয়ে এখন নিজেদের সুখ্যাতি না আবার তোপের মুঝে পড়ে সেই নিয়েও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে খন্দকার পরিবারের কোন বিরোধী পক্ষের কাজ। এসব ভাবতে ভাবতেই মিনহাজের বাবার ফোন এলো।
– হ্যালো বাবা
– মিনহাজ যতটা শুনেছি আমি আসা পর্যন্ত তোমাকেই তা সামলে নিতে হবে। এইবার অন্তত তুবার সাথে বাজে ব্যবহার করা বন্ধ কর। তোমার বাজে ব্যবহারের জন্য আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ওকে একটু ওর পরিবারের কথা ভুলিয়ে রাখ।
– চেষ্টা করব, আসলে বাবা আপনিতো সবই জানেন।
– জানি বলেই বাবা হয়েও শিখিয়ে দিতে হচ্ছে, গাধা কোথাকার, সামলে নাও আর কয়েকদিন।
সবগুলো কথাই অডিও রেকর্ড হয়ে তুবার কানে যাচ্ছিল। মিনহাজের সাথে নাম মাত্রই বিয়ে হয়েছে। মিনহাজের গার্লফ্রেন্ড আছে একজন মিনহাজ তাকেই বিয়ে করবে বলে তুবাকে জানিয়েছে। হয়তো এতোদিনে করেছে। এসব নিয়ে তুবার মাথাব্যথা ছিলনা। কিন্ত আজ বাবা ছেলের কথোপকথনে তুবার বুক কেঁপে উঠলো। দ্রুত নিশানকে ম্যাসেজ দিয়ে জানালো।
নিশান তার কয়েকজন বন্ধু সহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকাতেই একটা কটেজে আছে। এই এলাকার মেসগুলোকে কটেজ বলে, ক্যাম্পাসের কটেজে মিনহাজদের মত লোকেদের আধিপত্য থাকেনা। এখানে ছাত্ররা নিজেদের মত করে থাকে রাজনৈতিক ছায়ায়। তাই তুবার বাবা আর নভভাইকে নিয়ে ওরা এখানেই আছে। তুবার ম্যাসেজ পেয়ে নিশানও চিন্তায় পড়ে যায়। কোন উপায় না পেয়ে বন্ধুদের সাথে তুবার ব্যক্তিগত বিষয় জানাতে বাধ্য হয়। বন্ধুরা সবাই প্ল্যান করে তুবাকে রক্ষা করার। ফোন করে মিনহাজকে–
– হ্যালো মিনহাজ ভাই একটা খবর আছে
– কী?
– আপনি যে দুজন মানুষের খোঁজ করছিলেন তাদের পাওয়া গেছে।
– কোথায়? কেমন আছে?
– কেমন আছে জানিনা, তবে এদেরকে পঞ্চগড় পাওয়া গেছে। আমরা দুজন যাব আজকে,ইলেকশন শেষ, দল জিতে গেছে তাই হাতে কিছুদিন সময় আছে। আপনি চাইলে যেতে পারেন।
– ওকে, আমি আসছি।
– দেরী করবেননা। শেষ বাস আর ঘন্টাখানেক পরেই।
– বাস লাগবেনা, আমার গাড়ি নিব।
– ভাই, নিজের গাড়ি নিয়ে আবার বিপদ বাড়ানোর দরকার কি? এমনিতেই আপনার সাথে যোগাযোগ রাখি তা বিরোধী পক্ষ খেয়াল করছে, আজ নয়তো কাল কোন বিপদে ফেলে দিবে।
– ঠিক আছে আমি আসছি।
তুবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। গত কয়েকদিন হল ওর উপর নজরদারি কমেছে। নিশান জানালো খুব দ্রুত খন্দকার পরিবারের অস্ত্র ব্যবসার খবর সবার সামনে উঠে আসবে। কয়েকদিন আরো গভীরভাবে ওদের আলাপ শুনে সব আপডেট যেন নিশানকে জানায় এবং রেকর্ড রাখে। মিনহাজকে নিয়ে পঞ্চগড় যাওয়ার নাম করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে সিলেট রাজশাহী সহ বেশ কয়েক জায়গায় ওরা যায়। খুব কৌশলে মিনহাজ থেজে অস্ত্র আসার কিছু সীমান্ত ওরা চিনে নেয়। শেষ মুহুর্তে এসে ওরা জানায় ওই মানুষ দুজন এখন মংলা বন্দরে। এভাবেই সারা বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে কয়েকদিন পার করে।
বর্তমান রাজনীতিতে যেমন কলুষতা আছে পাশাপাশি কিছু স্বচ্ছ্ব ইমেজের নেতারাও আছেন। তাই দেশের স্বার্থে উনারাও কৌশল অবলম্বন করে কিছু মুখোশধারীদের মুখোশ উন্মোচন করেন। নিশান, ইমরুল এই রকম একজন রাজনৈতিক নেতার হয়ে কাজ করে। ইলেকশনে বিরোধী পক্ষের সম্পর্কে বলা সব কথা বানোয়াট ছিল। মূলত মিনহাজদের সাথে সম্পর্ক গভীর করার জন্যই গোলাগুলির নাটক করতে হয়।
প্ল্যান অনুযায়ী মিনহাজের বাবা আসার আগের দিন মিনহাজকে নিয়ে দুই তিনদিন ঘোরাঘুরি করে নিশানরা ফিরে আসে। তুবা মিনহাজের অফিসিয়াল কিছু ফাইল দেখে সন্দেহজনক কিছু পায়নি। তবু সেগুলোর ছবি তুলে রাখে আর একদিকে সরিয়ে রাখে। মিনহাজকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মোবাইল থেকে সমস্ত ডকুমেন্ট কপি করে নিশানকে পাঠায়। সেখানেই জানা যায় ওদের অস্ত্র চোরাচালানের একটা ডিল হবে মিনহাজের বাবা আসার পরেই।
দেশের আন্তঃদেশীয় চক্র অস্ত্র চোরাচালানের জন্য সিলেটের এক সীমান্ত-হাট বেছে নিলেও ইদানীং সিলেটের গোয়াইনঘাট দিয়েই বেশি চোরাচালান হচ্ছে বলে নিশানদের প্ল্যান সেভাবেই তৈরি করা হয়। মিনহাজের ডকুমেন্ট থেকে জানা যায় এইবার প্রথমবারের মত ১২ চেম্বারের রিভলবার আনা হবে। এতোদিন ভারত থেকে বাংলাদেশে ৬ চেম্বারের রিভলবার আর ১২ চেম্বারের শটগান আসলেও এই প্রথম ১২ চেম্বারের রিভলবার আসবে। এটা প্রথম চালানেই মিনহাজরা নিতে চায়। সমস্ত তথ্য একসাথে করে নিশান আর ইমরুল যায় তাদের নেতার কাছে। তিনি শীঘ্রই সব ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান।
মিনহাজের বাবা আসার পর তুবার বাবা আর ভাইকে নিয়ে এধরনের কাজে ব্যবহার করার জন্য গালিগালাজ করে সমস্ত ডকুমেন্ট নিয়ে মিনহাজকে বাসায় রেখেই বের হন। জানান সিলেটে যাচ্ছেন। প্রয়োজনে মিনহাজকে ডেকে নিবেন সিলেটে। তুবার দিকে খেয়াল রাখতে বলে যান। তুবা আবারও নিশানকে জানায়। নিশান সেদিন রাতেই হুট করে চলে আসে তুবার ফ্ল্যাটে। আজ কিছু হতে পারে তা নিশানের জানা ছিল। সারারাত তিনজন মিলে আড্ডা দিতে দিতে ভোরের দিকে যখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে তখনই খবর পায় মিনহাজের বাবা গোয়াইনঘাটে গ্রেফতার হয়েছে। মিনহাজ উদ্ভ্রান্তের মত নিজের প্রয়োজনীয় সব গোছাতে থাকে। তুবাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে
– আমি বের হব তুই তোর পথ দেখ
– মানে?
– বাবাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তুই কিছু জানিস?
– না, আমি কিভাবে জানবো?
– এই তথ্য কে ফাঁস করে দিল আমিও বুঝতে পারছিনা। এই তোর সঙ্গীদের সাথে ব্যবসা করতে গিয়ে শুধু খারাপ খবর আসছে। সব তোর দোষ।
এরই মাঝে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। জানালা দিয়ে দেখলো পুরো বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। মিনহাজ ভাবতে লাগলো ওর ঠিকানা দিল কে? বাবা কখনোই দিবেনা। পরিবারের অন্য কেউ জানেনা মিনহাজের ঠিকানা। হঠাৎ চোখ পড়লো নিশানের উপর, ও তুবার সাথে চোখে চোখ রেখে হাসছে।
এক ঝটকায় যেন মিনহাজ অনেক কিছু বুঝে ফেলে। সাথে সাথে রিভলবার বের করে তুবার দিকে তাক করলো। তুবা ভয়ে কেঁপে উঠে। নিশান মনে করিয়ে দেয় চারিদিক থেকে পুলিশ ঘিরে রেখেছে, পিস্তল যেন নামিয়ে রাখে। মিনহাজ আরো ক্ষেপে গিয়ে গুলি চালায়, নিশান তুবাকে সরিয়ে নেয়, কিন্তু তিনটা গুলি লাগে ওর পিঠে পায়ে এবং ঘাড়ে। ততক্ষণে পুলিশ ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে এসে মিনহাজকে অস্ত্র সহ গ্রেফতার করে নিশানকে হাসপাতালে নেয়। তবে নিশান আর ফেরেনি। ভালোবাসার দাম দিয়েছিল জীবন দিয়ে।
দশ বছর পর তুবা একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে উঁচু পদে কর্মরত। তার বাবার কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে। ভাইকে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ানো হচ্ছে। আর খন্দকার পরিবার থেকে ওর প্রাপ্য যেসব সম্পত্তি ছিল সেগুলো দিয়ে নিশান এর নামে একটি ট্রাস্টি চালায় এখন তুবা। এখানে অসহায় মেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখানোর পাশাপাশি কারিগরী শিক্ষা দেয়া হয় যেন জীবনযুদ্ধে কখনো হেরে যেতে না হয়। তুবা কর্মব্যস্তময় দিন শেষে রাতের আঁধারে নিশানকে খুঁজে ফিরে। কাটা পাহাড়ের রাস্তায় ফেলে আসা ক্লান্তিকে খুঁজে ফিরে। তবে কখনোই আর গুনগুন করে কোন গান গেয়ে উঠেনা। তুবার গানগুলো সব কারাবন্দী হয়ে গেছে দশ বছর আগেই।
সমাপ্ত।
-Mehruba Munira
Send private message to author


