হিসেবের শেষে……

প্রথমটায় নয়ন চমকে গেলেও  সেখান থেকে চলে গেলো না। শ্রীমঙ্গলের এই রিসোর্টটায় এসে পৌঁচেছে তারা গতরাতে। সকালে ঘুম ভাঙতেই খানিক এপাশ ওপাশ  করে  ওঠে পড়ে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেঘাকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না। কি জানি ঘুম ভাঙিয়ে দিলে যদি এই অসুস্হ শরীরে আরও অস্বস্তি বোধ করে।
মোবাইলটা পকেটে নিয়ে দরজার লকটা টেনে টানা লনটা ধরে হাঁটতে গিয়েই ঘটলো বিপত্তি। সবুজে ঘেরা চারপাশের উঁচু নীচু টিলার অপরূপ সৌন্দর্য আর তারই মাঝে সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে অবিরাম কথার ঢেউ তুলে এগিয়ে আসছে অবন্তি। পাশে পাশে নীরব শ্রোতা হয়ে চলা সুদর্শন যুবকটি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তা শুনছে। যথেষ্ট কেয়ারিংও। পাথর টপকাতে কিংবা নিচু ভূমিতে পা মাড়াতে গেলেই টুপ করে ধরে ফেলছে সে অবন্তির হাত। অবন্তি কথার তোড়ে সে হাত তক্ষুনি ছাড়িয়ে নিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কথার বয়ানের উচ্ছলতায় আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠছে একটু পর পর।

নয়ন ঘুম জড়ানো চোখ দুটি রগড়ে আবার দেখে। হ্যাঁ অবন্তিইতো। সেই চোখ সেই হাসি। কাজিনের বিয়ের এক অনুষ্ঠানে এমন উচ্ছলতা দেখেইতো নয়ন ওদের বাড়ির ঠিকানাটা জোগাড় করে ঘটক পাঠিয়েছিল।

অবন্তি অবশ্য এসবের কিছুই জানতো না। শুধু সেদিন যখন বাবা বললেন, অবন আজ বিকেলে কজন মেহমান আসবেন তোর সাথে পরিচিত হতে।
মাকে সহযোগিতা করিস একটু।

বাবাকে মাথা কাত করে সায় দিলেও দুপদাপ পা ফেলে অবন্তি মার রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
—— এসব কি হচ্ছে মা?
——  তোর বাবা বলেছে বুঝি। এটাই জীবনের ধারারে মা। মানতে ইচ্ছে না করলেও মানতে হবে।
—– কিন্ত আমার রেজাল্ট? বিসিএস প্রস্তুতি?
—– হবে, সব হবে। ওরাতো জেনে শুনেই আসছে।
তাছাড়া এলেইতো আর সব হয়ে যাচ্ছে না। ওদের পছন্দ অপছন্দ আছে, তোরও মতামত আছে। আজ শুধু পরিচয় পর্বের মত…..
অবন্তী আর কথা বাড়ায় না। বাবা মা যে তাকে না বলেই অনেক দূর এগিয়েছে সে অনুমান করতে পারছে,  এখানে নিজের মত প্রকাশ অর্থহীন। বাবা মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলতেতো সে শিখে নি আজোবধি।

দ্রুত সময়ের মধ্যেই বিষয়টা এগিয়ে গেলো।
বাবা মা ঘোরের মধ্যে দিয়েই যেন অবন্তিকে নিয়ে অজানা লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
ছেলেপক্ষ তিন কবুলের পর পরই প্রসংগক্রমে জানিয়ে দিলেন, ছেলের উচ্চ শিক্ষার্থে দেশের বাইরে যাওয়ার কথা চলছে। পারিবারিক একটা অসুবিধায় আটকে পড়ায় নির্দিষ্ট অংকটা ম্যানেজ করা যাচ্ছে না। তাই  মেয়ের বাবা যদি এই আশীর্বাদটুকু জামাইকে করতেন তবে পরবর্তীতে  মেয়েরও প্রবাসে যাওয়ার ব্যাপারটা সহজ হতো।

অবন্তির বাবা মা আত্মীয়তার শুরুতেই এমন দেন দরবারে একটু অস্বস্তি বোধ করলেও  বিষয়টায় সম্মত হলেন, মনকে স্বান্তনা দিলেন, খালি হাতেতো আর মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেন না। কাজেই ওদের প্রয়োজন সাপেক্ষেই না হয় কিছু দিলেন। সম্মতি জানিয়ে  অবন্তিকে সাধ আহ্লাদ মত সাজিয়ে গুছিয়ে সঁপে দিলেন ছেলের হাতে।
কিন্তু গন্ডগোলটা বাঁধলো গাড়িতে ওঠবার ঠিক আগ মুহুর্তে। ছেলের মামা মুখ ভার করে ছেলের বাবার কাছে এসে বললেন,
—— দুলাভাই, পাই পয়সার হিসেবে তো পুরো ঠগে গেলেন।  কনে পক্ষতো আমাকে হাইকোর্ট দেখিয়ে দিলো, আপনি কি অনুমান করতে পারেন বিষয়টা?
—— কি বলো এসব আবোল তাবোল? যা বলবার স্পষ্ট করে বলো।

—–স্পষ্ট আর কি বলবো দুলাভাই। দেখতেইতো পাচ্ছেন। সবই পরিস্কার।
শ’ য়ে শ’য়ে অতিথি এলো, ব্যাচের পর ব্যাচ খেয়ে গেলো। খালি হাতে তো অতিথিরা আসেনি নিশ্চয়ই।
অথচ কনের বাবা কোন উপহার সামগ্রী বরের সাথে দিবে না। আরে, অতিথিরাতো বর কনেকে দোআ করে যেসব এনেছে তাতো বর কনেরই। বাবার বাড়িতে রাখবার জন্য নয়।
কনে পক্ষ কি বলে জানেন, তাদের পরিবারের নাকি  রেওয়াজ,  যে কোন অনুষ্ঠানেই তারা  উপহার আনার ব্যাপারে  নিষেধাজ্ঞা  দিয়ে থাকেন। অতিথিদের বিনীতভাবে অনুরোধ করা হয়, উপহারবিহীন দোআ করে যেতে।
পাত্রের বাবা নির্লজ্জের মত কনের বাবার মুখোমুখি হয়ে  ঘটনার সত্যতা যাঁচাই করে শালাবাবুকে মুখাবয়াব শক্ত করে বললেন,
—–  যাওয়ার ব্যাবস্হা কর চটজলদি। সময় নষ্ট করার আর কোন মানে হয় না। দুনিয়াশুদ্ধ মানুষ এক নিয়মে চলে, আর উনারা দেখাচ্ছেন আরেক নিয়ম। কোর্ট ম্যারেজ করালেই পারতো। এত ঝামেলা করে গাড়ি ভাড়া করে এত লোক নিয়ে আসবার দরকার হতো না। যত্তসব।

বিদায়ের আগেই নিজ পিতৃগৃহে অবন্তি ধাক্কাটা অনুভব করলো প্রচন্ডতার সাথেই। পাত্রপক্ষের তাড়াহুড়োয় বরের সাজানো গাড়িতে জল ছল ছল চোখে পৌঁছে গেলো  শ্বশুরবাড়ি। শুরুতেই এক বুক হতাশা, বিস্ময় আর মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যত কল্পনা করে শিউরে ওঠলেন অবন্তির মা বাবাও।
আর অবন্তী শ্বশুরবাড়ির চৌকাঠ মাড়াতে না মাড়াতে কঠিন বাস্তবতার সাথে ঠোক্কর খেতে লাগলো সম্পুর্ন অন্য রকম অপরিচিত ভিন্ন মনোভাবাপন্ন মানসিকতার মানুষগুলোর সাথে।
অবন্তির বিস্মিত অপেক্ষার বাকি ছিলো তখনও। 
দুদিন বাদে নয়নকে নিয়ে যখন ফিরানিতে বাবার বাড়িতে এলো, দুবেলা পার হতে না হতেই নয়ন শক্ত কঠিন মুখ করে জানালো অবন্তিকে ,
—– তোমাদের বাড়ির নিয়ম কানুনেতো নিশ্চয়তা পাচ্ছি না বিদেশ যাবার টাকাটা সত্যি পাবো কিনা।
অবন্তী বাঁধ ভাঙ্গা ধৈর্য আড়াল করে বললো,
—– যদি না পাও তবে কি হবে?
—– মানে? কথার খেলাপ করবে নাকি তোমার বাবা?
—– না, আমি ভাবছি কথা খেলাপের সুযোগটাই দেবো না।
—– হুম জানি,  যথেষ্ট ম্যাচিউড তুমিও, নিজের ভবিষ্যত নিয়ে তোমার ভাবনা হওয়াটাই স্বাভাবিক।
—- ঠিক তাই।  আমিও বাবা মায়ের সুচিন্তিত মতামতের দিকেই চেয়ে আছি। হয়তো এ পর্যন্ত এসে আমাকেই এবার আমার ভবিষ্যতের জন্য কথা বলতে হবে।
নয়ন চোখে মুখে উচ্ছলতা ঝরিয়ে বললো,
—– তুমি তাঁদের একমাত্র সন্তান।  প্রতিটি জিনিষের উত্তরাধিকারের একমাত্র দাবীদার।
অবন্তি নয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে ঘৃনা মিশ্রিত কথাকটি ছুঁড়তে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে করুনা করলো এই ভেবে যে
—— হায়রে শিক্ষিত মানুষ। তার আবার উচ্চ শিক্ষা। নাকি অবমাননা। নিজের ব্যক্তিত্ব বিকিয়ে অন্যের মুখাপেক্ষী  হবার কি নিদারুন লোভী মানসিকতা।
এ কার সাথে সে জুটি বাঁধলো জীবন সাজাতে?  অসম্ভব অপূর্ণ জীবন। সংশোধন হয় ভুলের। অন্যায়ের নয়। আর তাই অন্যায়ের সাথে আপোষ নয় আর। নয় এ মুহুর্ত  থেকেই।

  অবন্তির বাবা মা অপ্রত্যাশিত ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মনুষ্যত্বহীন এমন পরিবারে অবন্তির জীবন যাপন অসম্ভব। নিজেদের হঠাৎ সিদ্ধান্তের কর্মফলে অবন্তিকে  নিঃশেষ করতে চান না আর। শুরুতেই মিটে যাক যা শোধরাবার নয়।  নয়নের বাবা মার সাথে খোলাখুলি মত বিনিময় করলেন। অনুধাবন করলেন বাস্তবতা। সম্পর্কের শিকড় এখানেই গুটিয়ে নেয়াই উত্তম। কিন্তু  অবন্তির গর্ভে নতুনের আগমনীর অস্তিত্ব জানান দিয়েছে ততদিনেই। সমুলে উপড়ে ফেলা সেতো আরও অসম্ভব।
একটু খানি থমকে গেলো অবন্তিও। নিজ সুখের জন্য অনাগত  সন্তানের জীবনকে বঞ্চিত করবে স্বাভাবিকতা থেকে?
মনকে স্হির করে সুখবরটা জানালো নয়নকে। ভীষন অবাক হলো নয়ন। যেন এমন খবর হতে নেই, হওয়ার কথা ছিল না।
নিজ ক্যারিয়ারে এখন এসব ভাববার অবকাশ তার নেই।

মন্দের ভালোই হলো। আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করার ইচ্ছে হয় নি অবন্তি বা তার বাবা মায়ের। যে নিজ সন্তানের টান অনুভব করে না, সে অন্যের সন্তানের দায় কতটা যত্নের সাথে নিবে এটা সহজেই অনুমান হয়।
সহজে মিটেও গেলো।  দেনা পাওনার হিসেবের গরমিলে ছেলেপক্ষ ভীষন রকম আপোষহীন। তাদের অকাট্য যুক্তি, ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছেন লাভের আশায়,  লোকসানের জন্য নয়।

মুক্তির কাগজটা হাতে পাবার পর অবন্তির আবারো মনে হলো, স্বল্প সময়ের বেড়িটা ভীষন এঁটে বসেছিলো কদিনে।
কি ভীষন হাল্কা লাগছে নিজেকে।   
কিন্তু সারাক্ষনই মনে হতে লাগলো, বাবা মায়ের চাপানো একটা ভুলের মাশুল তাকে টেনে বেড়াতে হবে আজীবন। অতীতের বোঝা বয়ে বেড়ানোর দায়ভার থেকে যেন মুক্তি নেই তার।

কিন্তু কি আশ্চর্য,  জয়ীর জন্মের পর অবন্তির মনে অদ্ভুত এক মুক্তির শীতলতা ছুঁয়ে দিল। ফিরে এলো শক্তি,উদ্যম। জগতটা  আগের মতই আলোকিত হয়ে ওঠলো ।   বাবা মা ব্যস্ত হলেন জয়ীকে নিয়ে। আর অবন্তি ব্যস্ত হলো জয়ীর ভবিতব্য নিয়ে।  দিন রাত মনোনিবেশ করলো লেখাপড়ায়। বি সি এস কমপ্লিট করে ট্রেনিং শেষে যখন স্বপ্নের আসনটায় আসীন হলো জয়ী, জয়ী হল তার প্রাণের দোসর । কর্মজীবনের কর্তব্য কর্মের দায় দায়িত্ব ছাড়াএক দন্ডও চোখের আড়াল করে না কন্যাকে।  কর্মক্ষেত্রেই অবন্তির বন্ধুত্ব হলো  রাজুর সাথে। এই মুক্তমনের  মানুষটি তাকে ক্রমেই  বুঝাতে সক্ষম হলো অতীতটা বিপদের সংকেত ছিল। সচেতন না হলে ভবিষ্যৎ এক্কেবারে গভীর খাদে । আরও বললো, মনীষার কথা। যার সাথে দীর্ঘ সময়ের সম্পর্ক।  লেখাপড়া শেষ করে ঘর বাঁধার প্রস্তুতি যখন, উড়াল দিলো মনীষা পকেট ভারী পাত্রে মোহাচ্ছন্ন হয়ে। রাজু আদৌ বি সি এস উত্তীর্ণ হয়ে ভালো চাকরী জুটাতে পারবে কিনা ভরসাটা ঠিক করতে পারে নি হয়তোবা। তবে প্রবাসীকে বিয়ের কবুল পড়া পর্যন্ত আভাস না দিলেও প্রবাসে যাবার আগ মুহুর্তে ফোন করতে ভুলে নি মনীষা।
সোজা সাপটাভাবেই বলেছে,
—– বাস্তবতা এটাই রাজু। ভালো চাকরী জুটে গেলে তুমিও সংসারী হয়ে যেও।দেবদাস হয়ে থেকো না আমাকে মনে গেঁথে।
রাজু অবাক বিস্ময়ে মুক হয়ে থেকেছে। মনীষার বিরহে নাকি মনীষার সুযোগ সন্ধানী মনটাকে বুঝতে না পারার অক্ষমতাকে ভেবে।

অবন্তিশ্বশুরবাড়ি  যেদিন নিজের অতীতটাকে মেলে ধরেছিলো রাজুর পছন্দের আহ্বানে, সেদিনই রাজু মনীষার ভালোবাসার খেলাটা নিঃসংকোচেই বলেছে অবন্তীকে।
আরও বলেছে
—– দেখো অবন্তী, নয়ন বা মনীষারা অর্থের পিছনে নিজেকে লেলিয়ে দিয়ে কতটুকু সুখী হয় আমি জানিনা। কিন্তু আমি বা তুমি যে সত্যিকারের মনের কাঙাল এটাও কিন্তু ঠিক। অবন্তির মনও সায় দিয়েছে,এটাই ঠিক।
একসময় ঘর বেঁধেছে ওরা। ছোট্ট জয়ী হয়ে ওঠেছে ওদের  মধ্যমনি।

সেবার জাফলঙ এ গিয়ে মনীষার সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিলো রাজুর।
প্রবাস থেকে ছুটি কাটাতে দেশে এসেছিলো মনীষা।
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে  যখন  ছবি তোলায় মত্ত  রাজু অবন্তী,  ঠিক তখুনি মনীষার উপস্হিতিতে একটু যেন তাল কেটে যায়।
প্রথম ঘোর কাটতেই যেটুকু সময় ক্ষেপন, উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠলো রাজু।
—– আরে মনীষা যে।
আলাপ করিয়ে দিলো অবন্তীর সাথে।
—– আমার প্রতি মুহুর্তের সাথী। আর অবন্তী এ হলো মনীষা।
অবন্তী মাথা দুলিয়ে হাসলো।
মনীষা এগিয়ে এলো অবন্তীর কাছাকাছি
—— আমি আর রাজু ক্লাশমেট ছিলাম
হাসে অবন্তী
—– জানি। আপনাদের মিষ্টি খুনসুটিগুলো রাজু আর আমার  অবসরের বিনোদন  জোগায় প্রায়। খুব ছেলেমানুষি করতেন দুজনেই।
মনীষার শুকনো হাসিতে বিস্ময় ঝরে পড়ে।বলে,
—– সব বলেছে বুঝি?  অতীতটা কারো কারো বিনোদন হলেও কারো কারো জন্য কষ্টেরও।
রাজু হঠাৎ তাড়া দেয় অবন্তীকে,
—— অবন্তি আমরা কিন্তু আনন্দ ভ্রমনে বেরিয়েছি, শোকগাঁথা শুনতে নয়।
বাই মনীষা।

অবন্তি রাজুর শক্ত করতলে নিজের হাতের বন্ধনটাকে দৃঢ় করতে করতে এগিয়ে যায় দূরে, মনীষার দৃষ্টির সামনে থেকে অনেক দূরে।
আর বিস্ময়ে অভিভুত হতে হতে বড্ড সাধ জাগে,নয়নের অনুশোচনা দগ্ধ মুখটার দেখা পেতো যদি সেও কোনদিন।
না, অবন্তির সাধটা অপুরণই রয়ে গেছে।
দিনে দিনে বড় হয়েছে জয়ী। পড়ালেখা শেষ করে যখন রাজু আর অবন্তি জয়ীকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবার জন্য ওঠে পড়ে লেগেছে ঠিক তখুনি দুচোখ ভরা সুখের সম্ভাবনা নিয়ে জয়ীকে ঘরনী করার ইচ্ছেটা সরাসরি উপস্হাপন করলো নেহাল। মুগ্ধ চোখে মেনে নিলো রাজু আর অবন্তি।  ঘটা করে তুলে দিলো প্রিয় কণ্যাটিকে নেহালের বাবা মায়ের অভিভাবকত্বে। তার আগে সম্পন্ন করলেন বুকের মাঝে চাপা দেয়া সেই চরম সত্যটাকে। জয়ী প্রথমটায় প্রচন্ড আঘাত পেলেও নেহাল তার অন্তর চক্ষুকে জাগিয়ে দিলো। সত্যিইতো, নয়নের মত অর্থলোভী পিতার পরিচয়টা রাজুর পিতৃত্বের প্রলেপে ঢাকা পড়েছিলো বলেইতো জয়ী এত আনন্দের আর নির্মল পৃথিবীতে বেড়ে ওঠেছে। ওর ভাগ্যতো ওকে সুন্দরের মাঝে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে। সত্যিই পরমকরুনাময়ের করুনা অশেষ।

কাকতালীয় ব্যাপারটা শেষতক ঘটেই গেলো জয়ী নেহালের বিয়ের পরপরই।  শ্রীমঙ্গলের রিসোর্টে র খোলা লনে এভাবে যে জয়ী সারপ্রাইজড হবে ভাবে নি স্বপ্নেও।
দূর থেকে জয়ী একটুও অনুমান করতে পারে নি তাকে কেউ এক দৃষ্টে বিস্ময়াভিভুত হয়ে দেখছে। কিন্তু কাছাকাছি আসতেই বিষয়টা আঁচ করে।
নয়নও চোখে চোখ পড়াতে কিছুটা নিজের অজান্তেই যেন মুখ ফসকে বলে ওঠে,
——অবন্তি…………
—– আপনি?
…… চিনতে পারছো না অবন্তি, আমি নয়ন, জীবন নগরের নয়ন।
জয়ী কিছু বলতে যাবার আগেই নেহাল হাত বাড়ায় নয়নের দিকে
……. আমি নেহাল। যদি ভুল করে না থাকি তবে আপনি মির্জা বাড়ির নয়ন মির্জা।
কাঁপা কাঁপা হাত বাড়ায় নয়ন,মাথা ঝাঁকিয়ে বলে
…… ঠিক তাই। কিন্তু…
…… ও জয়ী। অবন্তি কন্যা। তাই অদেখা আপনাকে চিনতে পারে নি।
জয়ী কথার মাঝে নেহাল কে থামিয়ে দিয়ে  বলে,
……ব্যস যথেষ্ট হয়েছে। অযথা এতগুলো বাক্যব্যয় অপচয় নয় কি?
অবন্তিকে হিসেবের খাতায় ফেলে সেই কবেইতো ছুঁড়ে দিয়েছেন। তার ছবিটা মুছে ফেলতে পারেন নি কেন? হ্যাঁ আমি মায়ের চেহারা, মনন, মেধা নিয়ে জন্মানো এক ভাগ্যবতী কন্যা। তবে একটু দুর্ভাগ্যও আছে বৈকি। জন্মের পঁচিশ বছর পরে জন্মদাতার সামনে নিজের পরিচয় দিতে বাধ্য হচ্ছি নিতান্তই নিরুপায় হয়ে।
হতে পারে জন্মের ঋন শোধ এটুকু।
আপনারাতো লাভ ক্ষতি হিসেব কষে জীবন সাজান, তাই হয়তো এই হিসেবটুকু আমার রক্তেও ছিলো। নিংড়ে দিয়ে গেলাম মন থেকে। আর এক বিন্দুও এক মুহুর্ত  বয়ে বেড়ানোর ইচ্ছে নেই। ঘৃনা করি, শুধুই ঘৃনা…..

উত্তেজিত জয়ীকে নিজের কাঁধে মাথা রেখে সেখান থেকে এক প্রকার টেনেই সামনে এগোতে থাকে নেহাল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
…….জয়ী শান্ত হও প্লিজ। শরীর খারাপ করবেতো।

নয়ন ঝাপসা চোখে তাকায় সামনে। দুই যুগেরও বেশি সময় পরে অবন্তির সেই ছবিতো সে একটুও মুছতে পারে নি এতদিনে। দীর্ঘ অদর্শনেও সেদিনের অবন্তি সেভাবেই তার মন জুড়ে।  অবন্তি জয় করেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে ,  হয়েছে চমৎকার এক কন্যার মা, জয়ীর মা।

কিন্তু জয়ীতো তারও।  জয়ীর চলে যাওয়া পথ অনুসরন করে এগোতে থাকে পায়ে পায়ে। যদিও অনিশ্চিত দেখা পাবে কিনা। বুকের বাঁপাশটায় হঠাৎ তীব্র ব্যাথা অনুভব করে নয়ন। এতটাই তীব্র সে ব্যাথা যে পদক্ষেপ ফেলে পৌঁছুতে পারবেতো তার আত্মজার কাছে?…….


Fahmida Reea (ফাহমিদা রিআ)


Send private message to author
What’s your Reaction?
0
0
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!