সাদা আর লাল গোলাপ

মনটা খুব খারাপ। কিচ্ছু করতে ভালো লাগছে না। জানালার কাছে টেবিলের সামনে চেয়ার নিয়ে ল‍্যাপটপের সামনে বসে আছি। পুরনো একটা হত‍্যাকান্ডের উপরে একটা আর্টিকেল লিখব, পরে সেটা বসের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। ঘটনা টা এরকম……

শীতের সকালে একঝাঁক তরুণ তরুণী ব‍্যাগ কাধে নিয়ে কলেজে যাচ্ছে। সবার মধ‍্যে নীহা আর ফাইমকে হয়ত আলাদা করা যাবে না। তবে এদের নিয়েই ঘটনা। প্রতিদিন দুজন একসাথে আসে আবার বাড়ি ফিরে যায়। দুই ভাইবোন একসঙ্গে আসা যাওয়া করে। নিজেদের মধ‍্যে সারাক্ষণ ঝগড়া- খুনসুটি লেগেই থাকে। নীলা ছোট হলেও একে অপরকে নাম ধরে ডাকে। ঝগড়া – ঝাটি করলেও তারা সবসময় একসাথে থাকে। মা বাবা কখনো তাদের জন‍্য বিরক্ত হননি। তাদের মধ‍্যে অনেক মিল এবং তারা একে অপরকে ছাড়া থাকতেই পারত না। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন ফাইম কে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তারিই বোনকে হত‍্যা করার কারণে। কিন্তু কেন? কিভাবে ? তার কিছুই জানা যায় নি…..যে ভাইবোনের মধ‍্যে এত ভালোবাসা ছিল হঠাৎ করে কেন ভাই তার আদরের বোনকে হত‍্যা করবে…..?????

এই টুকু লেখার পর হঠাৎ করে কারেন্ট চলে যায়। আমি চমকে উঠি….
মোমবাতির বের করে মোমবাতি জালাই। জানালা খোলা। হালকা বাতাস মোমবাতির শিখা টাকে অস্থির করে তুলছে। হঠাৎ করে ভয় করতে শুরু করে…. অস্বস্তি লাগতে শুরু করে…..

গভীর একটা নিশ্বাস আমার ঘাড়ে যেন পড়ছে…..আমার গায়ের লোম গুলো যেন খাড়া হয়ে যাচ্ছে। ঘামতে শুরু করেছি…..চোখ পিছনে ফিরাবার সাহস পাচ্ছি না……. নাহ….আমি তাকাবই…বলে সাহস করে তাকাতেই…..চিৎকার করে……………..

তাকাতেই….মাথায় জোড়ে একটা থাপ্পড় খেলাম।
কিরে…আজ কি খেতে হবে না? সারাদিন খালি কাজ আর ল‍্যাপটপ….
তাড়াতাড়ি নিচে আয়…বলে মা চলে গেলেন।

একটু পর সুইচ অফ করে নিচে গেলাম। ডিনারটা সেরে সোফায় বসে টিভি অন করলাম….

হঠাৎ একটা শব্দ শুনলাম মনে হয়। টিভির সাউন্ড অফ করে কান পেতে রইলাম। না…ভুল না..ঠিক চেয়ার টানার শব্দ।
সাহস…করে উঠি…
একপা দুপা করে উঠতে থাকি সিড়ি দিয়ে। দরজার নবটা ঘুরিয়ে জোড়ে একটা টান দেই…..

তাহলে কি আমার কানে সমস্যা??? কই সবিই ত ঠিক আছে…
নিজের শোনার ভুল হবে।

একটু পর বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আস্তে আস্তে তলিয়ে গেলাম ঘুমে।


কেউ আমার চেয়ারে বসেছি। কি যেন লিখছে। একজন মেয়ে। ওড়না টা গলার এক পাশ থেকে ঝুলছে অন‍্য পাশ মেঝেতে। ল‍্যাপটপের কি এর আওয়াজ ভীষণ। অনেক দ্রুত টাইপ করছে।

হঠাৎ উঠে দাড়ায়। আমি শুয়ে আছি। আমার দিকে আসছে….আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন ভয়ে। মা কে চিৎকার করে ডাকছি। কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না।মেয়েটা আমার দিকে হাত বাড়াতে লাগল…….

নাহ……আ….প্রায় লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসি। শরীর ঘামছে। আস্তে আস্তে শান্ত হলাম। ভাবলাম স্বপ্নই ত এটা…উঠে পানি খেলাম। বাতাস আসতে লাগল। লক্ষ্য করলাম জানালাটা লাগাইনি। গিয়ে ঐখানে দাড়ালাম। টেবিলের সামনে। শরীর ঠান্ডা হয়ে আসল। ঘড়িতে ২:৩৮ বাজে।

ঘুম আসছে না। ভাবলাম ল‍্যাপটপ টা অন করি।
অন করলাম।

স্ক্রিনে যে সমস্ত MS word ফাইল ছিল সেখানে একটা “helpme” ফাইল একটা। কিন্তু এটাত আমি রাখি নি।
আবার আমি যে ঘুমানোর আগে একটা ডকুমেন্ট সেটা নেই। ওপেন করতেই দেখি এটাই আমার সেই ফাইল। তবে এখানে আরো অনেক কিছু লেখা আছে…..
আমি পড়তে লাগলাম….
” না…আমার ভাই আমায় মারে নি। ঐ শয়তানটা আমায় মেরেছে। প্রতিদিনকার মত ঐদিনই আমরা একসাথে কলেজ থেকে ফিরছিলাম। বাড়ির গেটের সামনে আসত‍েই আমার ভাইয়ের ফোনে কল আসে। কল কাটার পর ভাই আমায় বলল ব‍্যাগ নিয়ে ঘরে যেতে সে আসছে।
আমি ঘরে চলে আসি। আর মাকে বলি।
বিকেল হয়ে গেলেও তার কোনো খবর না দেখে আমি ফাইম ভাইকে কল দিই। কিন্তু ফোন ধরে তার বন্ধু। পরে অবশ‍্য ভাই কথা বলে। সে বলে সে আসতে রাত হবে। আটটায় চলে আসবে। মা শুনে রাগারাগি করেন। বাবা বাড়িতে ছিলেন না। মায়ের শরীর অসুস্থ ছিল তাই মাকে খাইয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে বলি। সাড়ে আটটায় ভাই ফোন দিয়ে বলে আসছে। কিন্তু তার কন্ঠটা কেমন জানি মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যে অনেক কষ্টে কথা বলছে। আমি ফোনে কিছু জানতে চাইনি।
নয়টা বাজে। করেন্টও চলে গেছে। কলিংবেলের আওয়াজে বুঝলাম ফাইম এসেছে। গিয়ে দরজা খুলতেই ভাইকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। নিস্তেজ দেহটা যেন পড়ে যাচ্ছিল তার। ঘরে এনে সোফায় বসাই। আমি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করি। আমায় বলল দরজা লাগাতে। আমি গিয়ে লাগাব ঠিক তখন জুড়ে কেউ দরজায় লাথি মারে আমি ছিটকে ভিতরে এসে পড়ি। চিৎকারে করার আগেই একটা ছেলে আমার মুখে কাপড় দিয়ে আটকে দেয়। আমার ভাই উঠতেই ভাই কে লাঠি দিয়ে মেরে অজ্ঞান করে দেয় আরেকজন।
তারপর একজন আমার পা দুটি শক্ত করে ধরে অন‍্যজন আমার মুখে সোফায় রাখা গামছা দিয়ে শ্বাসরোধ করতে থাকে। তখন পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছিল। প্রাণ ভরে একটিবার শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছিল। বাঁচতে ইচ্ছে করছিল খুব। অনেক স্বপ্ন ছিল মা বাবার।
একটু একটু করে সময় ফুরিয়ে যাচ্ছিল। একসময় হাত পা নড়া বন্ধ হয়ে যায়। নিথর দেহটা একপাশে রেখে। ওরা চলে যায়। কিন্তু ফাসিয়ে দিয়ে যায় আমার ভাইটাকে। আমার ভাই আমায় মারে নি। পুলিশ এসে ভাইটাকে ধরে নিয়ে যায়। ওর বন্ধুর সাক্ষী যে আমার ভাই নাকি আমার উপর খুব রেগে ছিল। আমায় নিয়ে এক ছেলের সাথে ঝগড়া করে। পরে রাগের মাথায় নাকি আমায় খুন করে। কিন্তু সব মিথ‍্যে।
শ্বাসরোধের সময় ওদের একজনের একটা মানিব‍্যাগ পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। যখন বুঝেছি মরে যাব তখন ঐটা হাত দিয়ে আমি সোফার তলায় ঠেলে দিয়েছি। দয়া করে আমার ভাইকে সাহায্য করুন”

মেয়েটার কথাগুলো পড়ার সময় মনে হচ্ছিল মেয়েটাই আমায় কেদেঁ কেদেঁ বলছে। আমার চোখটা অশ্রুতে ভরে উঠে। ফজরের আজান হচ্ছে। অজু করে নামাজ পড়ি।

আমার বন্ধু কে ফোন দেই। সে চলে আসে। রুমে বসে সব বলি তাকে। অবাক হলেও অবিশ্বাস করে না। কারণ জানে আমি কখনো কোনো বিষয়ে মিথ্যা বলি না। নাস্তা করে রওনা হলাম ঐ মেয়েটার বাড়ির দিকে।

বাড়িতে গিয়ে দেখি বাড়িতে কেউ নেই। প্রতিবেশির কাছ থেকে জানতে পারি যে মেয়েটা মরার একমাস পর তারা এখান থেকে চলে যায়। মা এখন সংসার চালান। বাপটা অসুস্থ। তারা ফাইমের মামার বাড়িতে থাকে। ঘরে ঢুকে প্রথমেই সোফার তলায় খুজতেই একটা মানিব‍্যাগ পাই। দুজনেই কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। কাপা হাতে বের করে আনি।
খুলে একখানা চিরকুট পেলাম। আর খোচরা টাকা কয়েকটা। চিরকুটে লেখা..’ রাত দশটায় দশ পিস ইয়াবার প‍্যাকেট আসবে গলির মফিজের দোকানে।’

এখন সব স্পষ্ট হলো। বন্ধু শান্ত বলল.. হুমম এই কথাগুলো নিশ্চয়ই ভাইবোন দুটো জেনে গিয়েছিল। আর পুলিশকে বলার আগেই এদের একজনকে মেরে আরেকজন কে ফাসিয়ে দেয়।

পুলিশ কে ফোন দিয়ে বলি যে… আমি একটা গোপন সূত্রে জানতে পেরেছি এই ইয়াবা ব‍্যবসার কথা আর মানিব‍্যাগের খোজের কথাও বললাম। আসল ঘটনা কেউ বিশ্বাস করবে না।

মানিব‍্যাগটা ভালো করে আমার বন্ধু লক্ষ্য করে বলে..এটাত মনে হচ্ছে অর্ডার দিয়ে বানানো। এই দেখ লোগো। চল বের করি কোথায় বানিয়েছিল।
খুনের আজ পাঁচ মাস পরেও খুজে পাবো কিনা জানিনা। তবু খুজতেই হবে। আসল অপরাধীকে বের না করলে ভাইবোনের মধুর সম্পর্কে যে একটা দাগ পড়ে যাবে। আর চিরকাল দুটি মানুষ বেঁচে থেকেও মরবে প্রতিদিন।

ঐদিন বিকেলেই ঐ গলির একপাশে এরকম মানিব‍্যাগ বানানোর অর্ডার নেয়া হয় এরকম দোকান পেলাম। একটু খোজ নিয়ে জানতে পারলাম ঠিকানা। সন্ধ্যার পর গেলাম মফিজের সেই দোকানে। একদল ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। সব কটা কে একিই রকম মনে হয়। কারণ সবাই ইয়াবা খায় হয়ত এজন্য। এদের একজনের কাছে ঐধরনের আরো একটা মানিব‍্যাগ দেখতে পেলাম। নিশ্চিত হলাম কারণ ঐ মানিব‍্যাগের দোকান থেকে জানতে পেরেছি যে এইরকম কয়েকটা আরো নিয়েছিল অর্ডার দিয়ে।
ব‍্যস এইটুকুই। সব খবর পুলিশের কাছে গিয়ে বললাম। তারাও তদন্ত শুরু করল।

তিনদিন পর সকালে আমার বন্ধু আমাকে ঘুম থেকে উঠালো। হাতে খবরের কাগজ। একটা নিউজ দেখলাম। সেই হত‍্যাকান্ডে ফাসিয়ে দেয়া ভাইকে মুক্তি দেয়া হয়েছে আর ঐ দুই ছেলে আর তাদের সাথের আরো পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছে। তার সব স্বীকারও করেছে।

যদিও নিউজটা আমার করার কথা ছিল। কিন্তু ঐ ঘটনার পর বসকে বলে অন‍্যজনকে দিয়েছিলাম। তবুও খুব ভালো লাগছে।

পরদিন নাস্তা করে চলে গেলাম ঐ বাড়িতে। দেখি বাবা মাকে নিয়ে ফাইম ফিরে এসেছে বাড়িতে। বাড়িতে ঢোকলাম। ফাইম আমাদের চেনে। কারণ তাকে জেলে গিয়ে দুজনে সব কথা খুলে বলেছিলাম। সেদিন খুব কেদেছিল।

বাড়ির পাশে ছোট্ট বাগান। নানাধরনের ফুল সেখানে। বিশেষ করে গোলাপ ফুল বেশি। সাদা লাল বেশি। আমাদের দেখে হাসল। কিন্তু সে হাসিতে যেন কিছু একটার অভাব। আমরা কাছে যাওয়ার পর বলল…. আমার বোনটা সাদা গোলাপ খুব পছন্দ করত। আর আমি লাল গোলাপ।

একটুদূরে হাত দিয়ে দেখালো। ঐযে দেখ ভাই..আমার বোনটা ঘুমিয়ে আছে। আমি চারদিকটা সাদা আর লাল গোলাপের গাছ লাগিয়েছি। এই দেখ কলিও এসেছে। খুব সুন্দর লাগছে তাইনা……..

Writer: Saiful Islam Robin

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
4
1
0
1
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Saiful Islam Robin
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!