আজও এলো না বুয়া। টানা পাঁচ দিন। মোবাইলটাও অফ। অসুখ বিসুখ যে করে নি তা অন্তত নিশ্চিত। নইলে রিং হবার সাথে সাথে বুয়া ফোনটা ধরতো। আর কোঁকানোর সুরে মিনমিনে কৈফিয়ত দিতে দিতে বলতো—- মাথার বিষ ওঠসে খালাম্মা। মাথা তুলতে পারতেসি না। চক্ষে আন্ধার দেখতাছি। বিষ না কমলে কামে যাওন যাইবো না।”
রেবেকা বেগম প্রতিবারই ছুটি মন্জুরের আবেদন গলাধকরণ করেন নিরুপায় মনে।
দু’চারদিন শর্টকাটে চালিয়ে নেন একার সংসার।
আসলে শরীরের চেয়ে মনটাই আজকাল দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নিজের জন্য দু’ খানা রুটি বেলতেও যেন আলসেমি লাগে। অথচ এইতো ক’ বছর আগেও তিন ছেলে আর স্বামীর জন্য কাক ডাকা ভোরে ওঠে একা হাতেই হটপট ভরে রুটি বেলেছেন সেঁকেছেন। ধোঁয়া ওঠা সব্জির পেয়ালা আর রাতে আগে ভাগে তৈরি করে রাখা ঘন দুধের পায়েশের বাটিতে টেবিল সাজিয়েছেন। নাস্তার সাজিয়ে চটজলদি শুরু করতেন রান্নার আয়োজন। দুই চুলাতে রান্নার ফাঁকে ফাঁকে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে সেরে নিতেন খাওয়া।
ছেলেদের পোশাক আশাক এগিয়ে, বই খাতা গুছিয়ে স্বামীর অফিসের খাবার হট ক্যারিয়ারে সাজিয়ে যে সময়টুকু পেতেন নিজের জন্য তার প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগাতেন দৌড় ঝাঁপের উপর।
নিত্য নৈমত্তিক এভাবেই একটা একটা করে দিন পেরিয়ে চাকুরী জীবন শেষ করলেন রেবেকা বেগম। ছেলেরা বড় হলো, নিজের পায়েও দাঁড়ালো। ওদের বাবার বড় সাধ ছেলে বৌ দেখার। রেবেকা বেগম উৎসাহ দেখান না। বলেন, কটা বছর নিজেকে গড়ে নিক। তাছাড়া ছেলের বৌ আনতে গেলে যে বাড়ি লাগবে। নইলে শ্বশুরবাড়ি সে আসবে কেন? ভাড়া বাড়িতে নিজেদের জীবন কাটালাম, বৌরা কাটাবে ভেবেছো?
—– তুমিওতো বৌ হয়েই এসেছিলে একদিন।
—– ভুলে গেলে? এসেছিলাম আমার শ্বশুর বাড়ির বৌ হয়ে। কিন্তু আজতো আর সেটি নেই। বহু শরীকের ভাগে টুকরো টুকরো হয়ে বিলীন এখন অন্যের মালিকানায়।
রেবেকা বেগম মনে মনে একটা ছক এঁকে রেখেছেন নিজের মত করে। ছোট বড় মিলিয়ে তিন ছেলেই রোজগেরে। ওরা বাঁধাধরা কিছু দিক আর নাই দিক, ওদের খরচ অন্তত বহন করার দায়টা নেই আর। স্বামী স্ত্রী মিলে এ ফান্ড ওফান্ড যা জমিয়েছেন আর গ্রামের ফসলি জমির যেটুকু আছে বছরান্তে ফসলের যৎসামান্য আশায় না থেকে বিক্রি করে শহরতলীতে দু’ কাঠা জমি নিতে পারলেই ছেলেদের উপর দায় বর্তাবেন একেক জনকে একেক ফ্লোরের।
ভাবনার সাথে কাজের মিল রেবেকা বেগমের জীবনে খুব কমই হয়েছে। এটাও তাই হলো। বলা নেই কওয়া নেই দুরারোগ্য রোগে একটা বছরের মধ্যেই স্বামী জোড় ভেংগে পরপারে পাড়ি জমালেন। চিকিৎসার ব্যয়ভারে শুন্যের কোঠায় সঞ্চয়। জীবন ধারনের অবলম্বন বলতে পেনশন আর তিন সন্তানের উপর নির্ভরতা।
এ নির্ভরতা যে কতটা অকল্পনীয় , কতটা কঠিন আর কতটা বাস্তবতার চিরন্তন চিত্র- তা আগে থেকে অনুমান করা কোন স্নেহময়ী মায়ের পক্ষে অসম্ভব। বড় দুজন দু চার বছর অতিক্রম করলেও ছোটটা সবে রোজগেরে হয়েছে।
মেজোর নিজ পছন্দের মেয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছেন রেবেকা খুব অল্প সময়ের নোটিশে। হ্যা নোটিশইতো। একসাথে লেখাপড়া শেষ করেছে ওরা। স্বভাবতই মেয়ের বাবা মা মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ভালো প্রপোজালগুলি ঠেলে ফেলার সময় নয় এটা। মেয়েকে চাপ দেন। সে চাপ মেজোর মাধ্যমে মায়ের উপর বর্তায়।
রেবেকা বেগম বড় ছেলের আগে মেজোর বিয়ে দিতে ইতস্তত করেন নি যে তা নয়। কিন্তু ধোপে টেকে নি। আর টিকবেই বা কেন। বড়লোক বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। সুন্দরী এবং শিক্ষিতা। সবচেয়ে বড় কথা, দুজন দুজনকে পছন্দ করে রেখেছে ভার্সিটি জীবনের শুরু থেকেই।
রীতি অনুযায়ী রেবেকা বেগম প্রস্তাব নিয়ে গেলেন
মেয়ের বাড়ি। অনামিকায় আংটি পরিয়ে এনগেজমেন্ট টাও সেরে নিলেন। সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবার পর মেয়ের বাবা উত্থাপন করলেন একটি মাত্র আবদার। আর আবদারটা নেহাৎ অযৌক্তিকও নয়। রেবেকা বেগম তাই মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। তিন তিনটি পুত্র রত্ন তাঁর। একটি যদি শ্বশুরালয়ের বাসিন্দা হয়ে ভবিষ্যতের আখেরটা গুছাতে পারে মন্দ কি। অর্ধেক রাজত্ব নয়, পুরো রাজত্ব সহ রাজকণ্যা লাভ।
অমত করে নিজস্ব কোন ঠিকানাটায় তিনি এমন রাজকন্যাকে যত্ন আত্তিতে রাখতে পারবেন।
অতঃপর বড় ছেলে। মাস দুয়েকের মধ্যে চটজলদি মেয়ে দেখে দুই ছেলের বিবাহত্তোর সংবর্ধনা এক আয়োজনেই সেরে ফেললেন রেবেকা।
মেজো বৌ ফিরানিতে বাবার বাড়ি গিয়ে আর এলো না। ছেলেও নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একটা দুটো করে নিয়ে যেতে যেতে শ্বশুরালয়ের সদস্য পদ নিয়েই ফেললো।
বড় বৌমা চাকুরীজীবী মেয়ে। মাস দুই কাটতে না কাটতে বদলীর অর্ডার এলো অন্য শহরে। যথারীতি মাস ছয়েকের মধ্যে বড় ছেলেও চেষ্টা তদবীর করে নিজের বদলীটা নিয়ে জয়েন করলো এবং ওদের নতুন সংসারটা পাতলো অন্য শহরেই।
ছোট ছেলের বিয়ে দেবার সাধ অন্তত ক’বছর নেই রেবেকা বেগমের। ঈদে উৎসবে দুই ছেলে ছেলেবৌরা আসে, আবার যায়। ছোট ছেলেকে নিয়ে রেবেকা বেগমও ছেলেদের সংসারে বেড়াতে যান। দেখে শুনে ফিরে আসেন।
মনের মধ্যে দুঃখবোধটা তখনও গেঁথে বসেনি। কিন্তু বলা নেই, কওয়া নেই হুট করে যখন ছোট ছেলেটা কোর্ট ম্যারেজ করে বৌ নিয়ে এসে হাজির হলো সমস্যার শুরুটা হলো তখন থেকেই।
সংসারের নিত্য অশান্তিতে রেবেকা বেগম হাঁপিয়ে ওঠলেন রীতিমত। সেদিন ছেলেও যখন বৌকে শাসন করা বাদ দিয়ে মাকেই বুঝাতে এলো “আর একটু সহ্য করো মা”। রেবেকার সহ্যের সীমা লংঘিত হলো সেদিনই। ফুঁসে ওঠে তর্জনি তুলে বললেন, বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা এক্ষুনি বৌকে নিয়ে।
শেষতক সমাধান হলো। তিন ছেলেই যেহেতু স্বনির্ভর জীবন এবং জীবিকায়। তাই আপন আপন আবাসই অধিক শ্রেয়। অবসর জীবনে রেবেকা বেগমের একা একটি বাড়ির ভাড়া টেনে বেড়াবার কোন যুক্তি নেই। চার মাস করে করে তিন ছেলের কাছেই উনি ঘুরবেন ফিরবেন, থাকবেন।নিশ্চিন্ত, নির্ঝন্ঝাট জীবন।
সারাটা জীবন কষ্ট সয়ে যাওয়া স্বনির্ভর স্বাধীনচেতা মা প্রথম ক’দিনেই বুঝে নিলেন চারমাস কতটা দীর্ঘ কঠিন সময় তার জন্য।
বছর ঘুরা পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর গোনা সম্ভব হলো না আর। তিন পুত্রের প্রত্যেকের আশ্রয়ের ছায়া যে তার জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত, হাড়ে হাড়ে অনুভব করলেন তিনি অল্প ক’দিনেই।
ফিরলেন নিজ কর্মজীবন কাটানো পরিচিত মুখগুলোর শহরে। কর্ম ব্যস্ততার পায়ে পায়ে যে শহরে কাটিয়েছেন তিনি জীবনের অনেকগুলো সময়। আটশো স্কয়ার ফুটের ভাড়াবাড়ির ছোট্ট গন্ডিতে একার সংসার পাতলেন। বাতাসে মিশে গেলো দীর্ঘশ্বাস —এই একটি গর্ভে তিন জনের ভার বহন করলেও , এক মায়ের ভার তিন জনে বইতে পারলো না। কি বিচিত্র সময়ের চাকা।কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যায়, কেউ জানে না। শুধু জানে,সময়ের কাছে বড় অসহায় মানুষ। ছেলেরা যে যার প্রয়োজনে আসে। মায়ের পেনশন, বোনাস যেমন আছে দিব্যি চলতে পারেন মা। ভাবনা ওদের মায়ের পুরো কর্মজীবনের আগলে রাখা ধন গুটিকতক সঞ্চয় পত্রের দিকে। প্রয়োজন পড়লেই বড্ড বেশি মনে পড়ে যায় একমাত্র সহায়ক হিসেবে।
কলিং বেলের আওয়াজে চিন্তা ছিন্ন হলো রেবেকা বেগমের। তিনতলার ব্যালকনি থেকে মুখ বাড়াতেই দেখলেন বুয়াকে।
যাক এসেছে তাহলে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন রেবেকা। রশি বাঁধা চাবির থলেটা গ্রিলের ফাঁকে নামিয়ে দিলেন।
বাড়িতে ঢুকেই চাবিটা টেবিলে রেখে ডাইনিং এর মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসলো বুয়া।
রেবেকা বেগম সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন,
—– মাথা ব্যাথা সারলো?
—– মাতা ব্যাথার চাইতেও বড় ব্যাথা আম্মা। এক্কেরে দিলে চোট পাইসি, অন্তরে চোট , বহুত কষ্ট পাইসি আম্মা, কমুনে।
বিকেলটার একাকীত্বটা বুয়াকে দেখেই যেন কেটে গেছে রেবেকা বেগমের। গল্প করার আয়েশি ইচ্ছে নিয়ে বসলেন জানালা লাগোয়া মোড়াটায়।
—– তোমার অন্তরে আবার কে চোট দিলো বুয়া?
—– কে আবার? ঘরের মাইনষেই দিছে, নিজের পুতেই দিছে। খায়া না খায়া যাগোরে মানুষ করলাম তারাই আজ বোবা কালা সাইজা বইসা মজা দেহে, মায়েরে চিনে না।
আঁচলের খুঁটে দু’ চোখের কোন মুছে বুয়া বলে চলে অবিরাম,
——-গত মাসে বড় পুতে মোবাইল কইরা কইলো, মা এক হাজার ট্যাকা বিকাশে পাঠায়ে দাও,বিপদে আছি। সামনে মাসে দিমুনে।
ক’দিন থাইক্যা বাড়িওয়ালি ঘর ভাড়ার জন্যি চাপ দিতাছে। কি আর করা,পোলারে ফোন দেই, পাই না। দুই পোলার কেউ মোবাইল ধরে না। মনে কু ডাকলো। হ্যারা ভালা আছেতো? সকালের আলো ফুটতে না ফুটতে বাসে চাইপ্যা গাঁয়ের বাড়ি গ্যালাম। গিয়া দেহি সব ভালাই আছে। পোলারে ট্যাকার কথা তুলতেই বড় বৌ মুখ ঝামটা দিয়া কইলো,” মা হইয়া কয়ডা ট্যাহা না হয় দিছেনই, তয় হেইডা আবার দিতে হইবো।
বুঝায়া কইলাম, শহরে ঘর ভাড়া দিয়া থাকতে হয়। খাওয়া পরায় লাগে। নিজেরটা নিজেই করি। তোমাগো কাছে এক পয়সাওতো কখনো চাই না। নিজের রক্ত পানি করা পয়সা টাই চাইতেছি।
বৌ অমনি মুখ ঝামটা দিয়া কইলো, পোলাতো আপনেরই। না হয় মায়েরটাই নিছে একবার, তয় কি হইছে? ফ্যারত দেওনই লাগবো?তাজ্জিব কথা।
আমার রাগ উডলো মাথায়,কইলাম— ব্যাদ্দপের ঘরের ব্যাদ্দপ চুপ থাক্। আমার পোলার দায় রইছে আমারে দেখ ভাল করার। কি করে আমার জন্যি তারা, কি করে?
ছোড বৌটা ফাল দিয়া আইসা কয়, ওরে আমার দরদের মারে, পোলার কামাই খাউনের সখ কত। পোলার কামাই খাইতে গ্যালে পোলারে লেহাপড়া শিখাইয়া মানুষ করন লাগে। করছোনি মানুষ। বিদ্যা দিছো প্যাডে? আবার কামাই খাওনের হাউস।
আম্মাগো বিশ্বাস যান আমি একটা কথাও কই নাই আর। সোজা বাইর হইয়া আইস্যা পড়সি। গাড়িতে উঠছি। ভাবছিলাম পোলারা আমারে ডাইকা নিবো। বৌগো বকা দিয়া কইবো মার লগে ব্যাদ্দপি করছো, মাফ চাও। পিছন চ্যায়া চ্যায়া দেহি, নাহ্ কোন পোলাই আইলো না। একবার’ মা’ কইয়া আটকাইতেও আইলো না।
আম্মা, আপনিই কন, আমাগো মতন গরীব মাইনষে কেমনে পড়ালেহা শিখামু। নিজে না খাইয়া ওগো মুখে খাবার তুইলা দিছি, নিজে ছিড়া কাপড় পিন্দা ওগো নতুন কাপড় পিন্দাইছি আর ওগো সামনে ওগো বৌরা কয় মানুষ না কইরা পোলার রোজগার খাওনের হাউস করছি। এই কথা শোনার আগে আমার মরণ হইলো না ক্যান আম্মা।
বুয়ার দু’চোখ ভেসে যাচ্ছে অঝোর ধারায়। ভিজে ওঠছে রেবেকা বেগমের চোখও। অন্তরে বইছে ঝড় প্রবলবেগে। সে ঝড়ে নিজের অবস্হান আবিষ্কার করেন রেবেকা নতুন করে। স্পষ্ট দেখতে পান একই সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন দুই অবহেলিত” মা”। যেখানে শিক্ষিত অশিক্ষিতর কোন ভেদাভেদ নাই। দুই মা চলেছেন আপন আপন গন্তব্যে। যে পথ সমান্তরাল, পাশাপাশি।
-ফাহমিদা রিআ (Fahmida Reea)
Send private message to author



