“আহা, খেতে বসেছ এখন। ওসব কথা নাহয় পরে বলবে। এখন চুপচাপ খেয়ে নাও তো।” ডালের বাটিটা স্বামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন খাদিজা বেগম।
মনসুর সাহেব খাওয়া থামিয়ে তাকালেন সেদিকে। গম্ভীর গলায় বললেন, “শুনো রিমির মা, ঐসব ফালতু কথা বলে আমাকে নয় ছয় বুঝ দিতে আসিওনা। তোমার মেয়ে যথেষ্ট বড় হইছে। আর কত বসায় খাওয়াবা তাকে?
“কিন্ত তাই বলে তুমি যার তার সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবা নাকি?” বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করলেন খাদিজা বেগম।
মনসুর সাহেব রেগে গিয়ে বললেন, “যার তার সাথে মানে? ছেলের বাবার নিজস্ব মার্কেট আছে রংপুর শহরে। ঐখান থেকে তাদের মাসিক আয় কত তোমার কোন আইডিয়া আছে? আর তাছাড়া জব্বার ভাই লোকটাও তো মাশাল্লাহ ভাল মানুষ। দুই বার হজ্ব করে আসছেন। প্রথমবার হজ্বে গেছিলেন বড় বিবিকে নিয়ে আর দ্বিতীয়বার গেলেন ছোট বিবিকে নিয়ে। উনার প্রথম পক্ষের ছেলে জাহিদ মানে যার সাথে রিমির বিয়ে ঠিক করছি সেই ছেলেও কি কম নাকি? দেখতে শুনতে একেবারে মাশাল্লাহ। এরকম ঘরের বউ হয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? তোমার মেয়ের সাত জনমের ভাগ্য যে এরকম একটা পরিবারে বউ হয়ে যাবে।”
খাদিজা বেগম চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়লেন। আরও দুই চামচ ভাত স্বামীর থালায় তুলে দিয়ে বললেন, “এই ছেলের নামে তো শুনছি নাকি অনেক খারাপ খারাপ কথা শুনা যায়। রাত বিরাতে নাকি বন্ধু বান্ধব সহ মদ খায় ফুর্তি করে বাড়ি ফিরে। কয়দিন আগে একটা মেয়ের সাথেও শুনছি কি নিয়ে নাকি ঝামেলা হইছিল। জেলও নাকি খাটছে কয়েকদিন। পরে ওর বাবা পয়সা দিয়ে ছাড়ায় আনছে। এইগুলা কি সত্যি নাকি?”
“ঐসব বাজে কথা আমার সামনে বলিওনা।” ধমক দিয়ে বলেন মনসুর সাহেব, “এরকম বড়লোকের ঘরে জন্মালে ওরকম একটু আধটু অভ্যাস থাকবেই। আর তাছাড়া এই ছেলে কি খারাপ নাকি? মাস্টার্স পাস করেই নিজের ব্যবসায় ঢুকে গেছে। জব্বার ভাই তো বলছে ছেলেকে তিনি বিয়ে দিয়েই লন্ডনে পাঠায় দিবেন।”
“কিন্তু তাই বলে……”
“আরে রাখো তোমার কিন্তু।” ধমকে উঠলেন মনসুর সাহেব। “শুনো, তোমার মেয়েকে এখন থেকে পারলে একটু হাদিস কালামও শিখাইও। ওরা কিন্তু পরহেজগার পাত্রী খুঁজতেছে। তোমার মেয়ের তো আবার বেলাল্লাপনার জুড়ি নাই। এখন থেকে বোরকা হিজার ছাড়া ওর বাইরে বের হওয়া বন্ধ। কালকেই ওর জন্য নতুন বোরকা কিনে আনবা।”
খাদিজা বেগম অবাক হলেন, “এই ব্যাপারে তোমার মেয়ের সাথে একবার কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন ছিল না? আর তাছাড়া তার তো এখনো পড়াশোনাও শেষ হয়নি।”
“আরে রাখো তোমার পড়াশুনা। ঐসব পড়াশুনার গুল্লি মারি।” চেঁচিয়ে বলেন মনসুর সাহেব “এরকম একটা ডাঙ্গর মেয়ে এতদিন ঘরের মধ্যে বসায় রাখে আমি কি নিজে গুনার ভাগীদার হব নাকি? মেয়ে বড় হইছে এখন বিয়ে দিয়ে দাও, ব্যাস ঝামেলা চুকে গেল। বিয়ের পর জামাই যদি অনুমতি দেয় তাহলে পড়াশুনা করবে, চাকরি করবে, ক্ষতি কি?“
“আর যদি অনুমতি না দেয়?” জানতে চায় খাদিজা বেগম।
মনসুর সাহেব বিরক্তি মাখানো গলায় জবাব দেন, “অনুমতি না দিলে নাই। মেয়ে তখন ঘর সংসার করবে। বাচ্চা পালন করবে। আল্লা খোদার নাম নিবে। মেয়ে মানুষের আবার অত কিসের শখ? বলেই তিনি হাত ধুতে উঠে গেলেন। পেছন থেকে খাদিজা বেগম ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“সত্যি করে আমাকে একটা কথা বলো তো, তুমি হঠাৎ মেয়ে বিয়ে দিবার জন্য এত অস্থির হয়ে গেছ কেন?”
“অস্থির হব না মানে? মেয়ে কত বড় হইছে দেখছ? এরকম মেয়ে ঘরে রাখাও তো গুনাহের কাজ।” জবাব দেন মনসুর সাহেব। খাদিজা বেগম অবাক হয়ে বলেন,
“তোমাকে তো কোনদিন নামাজ কালামও পড়তে দেখলাম না। উল্টো সারা জীবন মানুষের ক্ষতি করে পয়সা কামাইছো। এখন আবার হঠাৎ তোমার মুখে পাপ পুণ্যের এত তাড়া কেন?”
মনসুর সাহেব চড়া গলায় বললেন, “তুমি বেশি কথা বলতেছ। বেশি কথা বলাও গুনাহের কাজ। আমি সারাজীবন অন্যায় করছি। একারণে এবার একটা পরহেজগার পরিবারে মেয়ের বিয়ে দিয়ে পুণ্য অর্জন করতে চাই। পাপ পুণ্যে হয়ে যাবে কাটাকাটি।”
খাদিজা বেগম কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকলেন। মনসুর সাহেব হাত ধুয়ে আসতেই তিনি ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“খায়রুল ভাইর কাছে যেই কথাগুলা শুনলাম এইগুলা কি সত্যি?”
“কোন কথা?” জিজ্ঞেস করে মনসুর সাহেব। তার চোখে খানিকটা সংশয়।
খাদিজা বেগম সাবলীল ভঙ্গিতে বললেন, “জব্বার হাজি নাকি তোমার কাছে কথা দিছে তার নেশাখোর ছেলের সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে দিলে তার বালিয়াপুরের চার বিঘা জমি নাকি তোমার নামে লিখে দিবে। কথা কি সত্য? এই লোভে পড়ে তুমি শেষ পর্যন্ত মেয়ের সর্বনাশ করতে বসছ?”
মনসুর সাহেব চমকে উঠলেন। তবে পরমুহূর্তেই সামলে নিলেন নিজেকে। প্রকাণ্ড একটা হুংকার ছেড়ে বললেন, “তুমি মেয়ে মানুষ মেয়ে মানুষের মত থাকো। এইসব বিষয়ে নাক গলাইতে আসিওনা। এই জন্যই হাদিস কুরআনে বলছে মেয়ে মানুষের মাথা হচ্ছে শয়তানের কারখানা।”
খাদিজা বেগম ঝামটা দিয়ে উঠলেন, “তুমি কোন হাদিসের বইয়ে পাইছো এইসব কথা, দেখাইতে পারবা আমাকে?”
মনসুর সাহেব ক্রোধে ফেটে গিয়ে বললেন, “অত হাদিস কুরআনের মোটা মোটা বই কে পড়তে যাবে। আমার অত সময় আছে নাকি। এইসব কথা আমি ওয়াজে শুনছি। তুমি গিয়ে ইউটিউবে দেখে আসতে পারো।”
হোয়াটসঅ্যাপে পর পর কয়েকবার ডায়াল করল রিমি। ওপাশে রিং হচ্ছে কিন্তু ফোনটা কেউ ধরছেনা। বিরক্ত হয়ে রিমি হোয়াটসঅ্যাপ ছেড়ে মুল ফোনেই ডায়াল করল। এবার কাজ হল। ওপাশ থেকে সাদিয়া রিসিভ করতেই চেঁচিয়ে বলল রিমি, “ফোন কই রাখোস তুই? এত বার ফোন দিলাম জাহান্নামে গিয়ে মরছোস নাকি?”
ওপাশ থেকে সাদিয়া কি যেন এক্সপ্লেইন করতে লাগলো। রিমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“শুন, কাজের কথা বলি। আজকে বিকালে ফ্রি আছিস নাকি?”
“কেন রে?” জিজ্ঞেস করে সাদিয়া।
“ফ্রি আছিস কিনা বল। তোকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব। ঐ যে ওয়াপদা কোয়াটার আছে না? ঐ জায়গায় একটা কাঠগোলাপের গাছ আছে দেখছিস? ঐখানে গেলে দেখবি জোস জোস ছবি আসে।”
সাদিয়া অবাক হয়, “তোর মাথা ঠিক আছে? দেশে লকডাউন চলতেছে, করোনায় কি হারে লোক মরতেছে কোন আইডিয়া আছে তোর? এর মধ্যে কোন আক্কেলে তুই ঘুরতে যাইতে চাস?”
“আরে বাল” ধমকে উঠে রিমি, “বাড়িতে যে কি ঝামেলা চলতেছে তুই জানিস না। আব্বুকে তো জানিস কেমন জেদি লোক। সেইদিন বলতেছে কোন এক ফাউল ছেলের সাথে নাকি আমার বিয়ে দিয়ে দিবে। কয়দিন ধরে এইসব নিয়ে বাসায় কি যে চলতেছে। আমার এখন দম বন্ধ লাগে ।নরক মনে হয় বাসাটা। আর এক ঘণ্টা আমি ঘরে আটকে থাকলে নিশ্চিত দম বন্ধ হয়ে মরে যাব। তুই দোস্ত প্লিজ একটু আয় না। আমরা শুধু যাব আর চলে আসব।”
অগত্যা রাজি হয় সাদিয়া। তবে শর্ত দেয়, “শুন আমাকে কিন্তু সন্ধার আগেই বাসায় চলে আসতে হবে। আমার বাসার মানুষ কীরকম কনজারভেটিভ তুই তো জানিসই। সন্ধ্যার পর মেয়ে মানুষ বাইরে থাকলে বাসায় হুলস্থূল কাণ্ড ঘটে যাবে।”
“আচ্ছা সে দেখা যাবে। তুই টেনশন নিস না। আয় তুই। আমি রেডি হচ্ছি।” বলেই ফোন রেখে দিল রিমি। ওয়ারড্রব খুলে নতুন কেনা জামাটা বের করে নিয়ে আসলো সে।
“হ্যালো সাদিয়া আসছিস?…হ্যাঁ দেখছি তোকে…এইদিকে তাকা…এই যে ব্রিজের এইপাশে দাঁড়ায় আছি আমি দেখ।”
রিমি দেখতে পায় সাদিয়াকে। রাস্তা পার হয়ে এপাশে আসে সে। একটা রিকশা ডেকে নেয়।
“মামা কোয়াটারের সামনে যাবা? ওয়াপদা কোয়াটার। কত নিবা?”
ভাড়া ঠিক করে রিকশায় উঠে পড়ে দুজনে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কোয়াটারের সামনে পৌঁছে যায় তারা।
রিকশা থেকে নেমেই সাদিয়া বলে উঠে, “তুই কি এই কাঠগোলাপ গাছটার কথা বলছিলি নাকি?”
রিমি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, ঐ যে মাঠের মাঝখানে যেই গাছটা দেখতেছিস, ঐ গাছ গাছটার কথাই বলছিলাম। অনেক সুন্দর না জায়গাটা?” জিজ্ঞেস করেই রিকশা থেকে নেমে আসে রিমি। জবাবের প্রতীক্ষা না করে আবারও সে আনমনে বলে উঠে, “জানিস আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এই গাছটার নিচে পড়ে থাকা ফুলগুলো কুড়িয়ে চুলে গুঁজবো। তারপর অনেক অনেক ছবি তুলব।”
সাদিয়া হাসে, “চল।”
কাঠগোলাপ গাছের নিচে পুরো ক্যানভাস জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেকগুলো হলদে সাদা রঙের ফুল। কয়েকটি ফুল কুড়িয়ে রিমি তার চুলে গুঁজলো।
“শুন এই গাছটাকে পিছনে রেখে এইদিক থেকে ছবিটা তুলবি। এই যে দেখ এই এঙ্গেলে। আমার তোলা হয়ে গেলে তোরও ছবি তুলে দিচ্ছি।” বলেই সাদিয়ার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিল রিমি। পর পর কয়েকটা ছবি তুলল সে। তারপর ছবিগুলো রিমিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“রাহাত ভাইর আসতে আর কতক্ষণ লাগবে?”
“এই তো বলল কাছাকাছি নাকি চলে আসছে।” বলল রিমি, “আর মিনিট দশেক হয়ত সময় লাগবে। আমাদেরকে এখানেই থাকতে বলছে। এখান থেকে এসে নিয়ে যাবে। ওর কয়েকজন বন্ধুও নাকি আসতেছে সাথে। আমার দিক থেকে তুই আর ওর দিক থেকে ওর বন্ধুরা থাকবে সাক্ষী।”
সাদিয়া কি যেন চিন্তা করে বলল, “তোর কি মনে হয় না দোস্ত এইগুলা তুই পাগলামি করতেছিস? ঝোঁকের মাথায় এই ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া কি আদৌ ঠিক হচ্ছে?”
রিমি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল,“দেখ সাদিয়া, আমি অনেক ভেবে চিন্তেই এই ধরণের সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। তুই তো জানিস বাসা থেকে যার সাথে বিয়ে ঠিক করছে ঐ ছেলেটাকে আমি কোন অবস্থাতেই বিয়ে করতে পারবোনা। শুধু মাত্র পয়সার লোভে ওরা আমার সাথে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। সব জেনে বুঝে আমি নিজেকে কিভাবে এরকম একটা অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেই তুই বল? আর তাছাড়া রাহাত কিন্তু ছেলে হিসেবে খারাপ না। তোকে তো আগেই বলছি আমাকে অসম্ভব কেয়ার করে সে।”
“কিন্তু তাই বলে মাত্র কয়েকদিনের পরিচয় এরকম একটা ছেলেকে তুই বিয়ে করে ফেলবি? তোর কি মনে হয়না আরেকটু সময় নেওয়া তোর উচিত ছিল?” জিজ্ঞেস করল সাদিয়া।
রিমি উদাস হয়ে বলল, “আমার হাতে একদমই সময় নাই রে দোস্ত।”
রাহাতের সাথে মাত্রই ফোনে কথা হয়েছে রিমির। বাস স্ট্যান্ডে চলে এসেছে সে। একটা রিকশা নিয়ে হয়ত আর মিনিট দশেকের মধ্যেই চলে আসবে এখানে। রিমি দ্রুত নিজের হ্যান্ড ব্যাগটা গুছিয়ে নিল। মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরায় একবার দেখে নিল নিজেকে। চুল গুলো ঠিক করল। পাশেই কিছু বখাটে ছেলে মোটরসাইকেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। গাঁজার বিশ্রী গন্ধ ভেসে আসছে সেখান থেকে। ওদিকে তাকিয়েই সাদিয়া বলল,
“চল ঐ রাস্তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। রাহাত ভাই ঐখান থেকে আমাদের সহজে খুঁজে পাবে।”
রিমি সায় দিল, “হ্যাঁ দোস্ত, এই জায়গাটায় আমারও ভাল লাগতেছেনা। এই ছেলেগুলার গতিবিধি সুবিধার না। ঐ দেখ না আমাদেরকে নিয়ে কি কি সব উল্টাপাল্টা বলতেছে। মেজাজটা খারাপ হচ্ছে শুনে। দিব নাকি ওদেরকে দুইটা কথা শুনায়?”
সাদিয়া বাধা দিয়ে বলল, “বাদ দে দোস্ত। এরা এখানকার স্থানীয়। এদের সাথে ঝামেলা করলে পারবিনা, খামকা বিপদে পড়ে যাবি। তার থেকে বরং চল এই জায়গা থেকে বের হই। রাহাত ভাইকে ফোন দিয়ে বল রাস্তার সামনে আসতে।”
রিমি সায় দিয়ে বলল, “চল।”
তারা পা বাড়ায় মাঠ থেকে বের হবার জন্য। রাহাতকে ফোন দিবার জন্য রিমি ব্যাগ থেকে স্মার্টফোনটা বের করল। আর ঠিক তখনি দেখতে পেল রাহাতকে। রিকশা থেকে নেমে মাঠের দিকে এগিয়ে আসছে সে।
রিমির ভেতরটা কেমন যেন একটা অজানা অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। একটু ভয়, একটু আনন্দ, আর কি যেন সব অজানা শঙ্কা কিংবা অজানা সব সুখানভুতি।
“সরি একটু দেরি করে ফেললাম। তোমরা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলে বুঝি।” স্নিগ্ধ একটা হাসি দিয়ে বলল রাহাত।
রিমি কপালে খানিকটা ভাঁজ তুলে বলল, “তোমার সাথে না আরেকজন বন্ধু আসবে বলেছিলে। সে কই?”
রাহাত বিরক্তির সুরে বলল, “আরে ধুর। ওর কথা বইলোনা। ও হচ্ছে একটা আস্ত ভীতুর ডিম। এই বিয়েতে নাকি সে সাক্ষী থাকতে পারবেনা। অথচ দেখো কালকেও আমাদের বিয়ে নিয়ে ও লাফাচ্ছিলো। আজকে কি হইলো কে জানে। যাই হোক ওর কথা বাদ দাও। কাজী অফিসে গেলে এমনিতেই সাক্ষী জুটে যাবে।”
বলেই থামল রাহাত। পাশ থেকে সাদিয়া বলে উঠলো, “দুলাভাই চলেন আপনাদের বিয়ের আগের ফটোসেশনটা সেরে নেন। ব্যাচেলর লাইফের লাস্ট ছবি। এইটা বাঁধাই করে রাখবেন কিন্তু।” বলেই ব্যাগ থেকে ছবি তোলার জন্য স্মার্টফোন বের করল সাদিয়া।
“আপনি রিমির হাত ধরেন। এই যে এদিকে দাঁড়ান আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।”
কাঠগোলাপ গাছের নিচে রিমিকে নিয়ে দাঁড়ালো রাহাত। সাদিয়া পর পর কয়েকটা ছবি তুলল। তাদের ছবি তোলা দেখেই হয়ত পাশের ছেলেগুলোর হল্লার পরিমাণ আগের তুলনায় আরও বেড়ে গেল। ওদের মধ্য থেকেই কেউ একজন রাহাতের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
” এই যে ভাই। এই যে হ্যালো। কি হচ্ছে এখানে?”
রাহাত তাকালো ওদিকে, “আমাদেরকে বলছেন?”
“হ্যাঁ আপনাদেরকেই। কোথা থেকে আসছেন আপনারা?”
রাহাত কিছু জবাব দিবার আগেই পাশ থেকে রিমি বলে উঠল, “কেন ভাইয়া? কি সমস্যা?”
“সমস্যা অনেক কিছু।” বলে উঠল ছেলেটা, “এই জায়গায় ছেলে মেয়ে এক সাথে আসা নিষেধ। বেহায়াপনা করার জায়গা এইটা না। ঐসব কাজ হোটেলে গিয়ে করিয়েন।”
রাহাত অবাক হয়। “কি বলতেছেন ভাই এইগুলা। আমরা তো শুধু ছবি তুলতেছি মাত্র। বেহায়াপনা কোথায় করলাম?”
“আরে ভাই এত কথা বলেন কেন?” উঠে দাঁড়িয়ে বলল ছেলেটা। তার সাথে বাকিরাও উঠে দাঁড়িয়েছে।
“বাংলা কথা কানে যায়না আপনাদের? এইটা মাগী নিয়ে ফূর্তি করার জায়গা না। এইটা ভদ্রলোকের জায়গা।” শাসিয়ে বলল ছেলেটা। পাশ থেকে রিমি ক্ষেপে গিয়ে বলল, “এইটা ভদ্রলোকের জায়গা তো আপনারা এইখানে দলবল নিয়ে গাঁজা খাচ্ছেন কেন? বারে গিয়ে খাইতে পারেন না?”
আচমকা ক্ষেপে যাওয়ায় রিমিকে খানকিটা নিবৃত করল রাহাত, “বাদ দাও রিমি। এদের সাথে ঝামেলা করে পারবানা। চলো এখান থেকে বের হই।”
রিমি তখনও ক্ষেপে আছে, “বাদ দিব মানে। তুমি জানোনা এই জানোয়ারগুলা তখন থেকে আমাদেরকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলতেছিলো। এদের একটা বিহীত আমি করেই ছাড়ব।”
“ঐ মেয়ে কি হইছে? এত দেমাগ কিসের? বেহায়াপনা করতে আসে মাগী আবার তেজ দেখায়। ভালো কথা বললে কি কানে যায়না নাকি? ভদ্রভাবে বলতেছি এইখান থেকে চলে যান নাইলে কিন্তু ভালো হবেনা।” ক্ষিপ্ত হয়ে বলল যুবকদের একজন। ততক্ষণে আরও দুটো মটরসাইকেল এসে যোগ দিয়েছে তাদের সাথে। মটরসাইকেল আরোহীদের একজন চেঁচিয়ে বলল,
“এইগুলাকে ভদ্রভাবে বললে শুনবেননা। ধরে মাইর লাগা দেখবি ঠিকই বাপ বাপ করে পালাবে।”
রাহাত খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বলল, “দেখেন ভাই আমরা তো এখানে শুধু ছবি তুলতেছিলাম মাত্র। অন্যায় কোন কিছু তো করিনি। আপনারা অযথা আমাদের সাথে এরকম আচরণ করতেছেন কেন?”
মটরসাইকেল থেকে ছেলেটা নেমে এলো রাহাতের সামনে। শান্ত ভঙ্গিতে বলল সে, ” ভাই, আপনারা ছবি তুলতেছেন না কি করতেছেন তা তো আমরা জানিনা। আমরা দেখতেছি আপনারা ছেলে মেয়ে একসাথে এইখানে যুবসমাজকে নষ্ট করতেছেন। এই যে এইখানে এতগুলা ভদ্র ছেলে আড্ডা দিচ্ছে, এরা কিন্তু এইখানে এই গাছটার নিচেই প্রতিদিন আড্ডা দেয়। এই ছেলেগুলা আপনাদের দেখে কি শিখবে বলুন তো? এইসব দেখেই তো এই বয়েসি ছেলেগুলা উচ্ছন্নে যাচ্ছে।”
রাহাতের আচমকা মনে হলো এদের সাথে অহেতুক তর্ক করা অর্থহীন। সময়টা এখানে নষ্ট না করে বরং চলে যাওয়াই সমুচিত। সে সাতপাঁচ ভেবে খানিকটা বিনয়ী ভঙ্গীতে বলে বসল,
“ভাই আমাদের ভুল হয়ে গেছে । আমাদের কার্যকলাপের জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি ভাই, আপনাদের আর ডিস্টার্ব করবনা।”
ছেলেটা বাধা দিয়ে বলল, “চলে যাইতে চাইলেই তো আর যাওয়া যাবেনা। আমাদের ছেলেগুলাকে যে আপনারা ক্ষেপায় দিলেন, এদেরকে শান্ত না করলে তো এরা আপনাদেরকে যাইতে দিবেনা।”
“কিভাবে শান্ত করতে হবে বলুন?” জিজ্ঞেস করলো রাহাত।
ছেলেটা নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বলল, “মাল পানি থাকলে হাজার দশেক দিয়ে দেন। বাকিটা আমরা সামলে নিচ্ছি।”
রাহাত অবাক হয়, “এত টাকা কোথায় পাব ভাই? আমার কাছে তো আছেই সামান্য কিছু টাকা।”
“কোথায় টাকা পাবেন এটা কি আমরা বলে দিব?” বলে উঠল ছেলেটা। “আধা ঘণ্টার মধ্যে দেখেন যদি টাকা যোগার করতে পারেন তো ভালো নতুবা আমরা লোকজন ডাকবো। আপনি নিজেও বিপদে পড়বেন মেয়ে গুলাকেও বিপদে ফেলে দিবেন। তার চাইতে বরং দেখেন বন্ধু বান্ধবকে ফোনটোন দিয়ে টাকা পয়সা কিছু যোগাড় করতে পারেন কিনা। তাহলে আপনারাও সসম্মানে বের হবেন আমাদেরকেও কোন ঝামেলা করতে হবেনা।”
কিছুক্ষণের জন্য দোটানায় পড়ে গেল রাহাত। সে ভেবে পেলনা এত গুলো টাকা এত কম সময়ের মধ্যে কেমন করে যোগাড় হবে। তবে এও বুঝে গেল রাহাত এই ছেলেগুলোও মনে হয়না টাকা পাবার আগে তাদের ছেড়ে দিবে।
মনসুর সাহেবের চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে এলেন খাদিজা বেগম,
“কি হয়েছে, ওভাবে চেঁচাচ্ছ কেন?” জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
মনসুর সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, “চেঁচাবোনা মানে? তোমার মেয়ে কি করছে শুনছো? দুধ কলা খাইয়ে এতদিন কালসাপ পুষছ তুমি। আমাদের মান সম্মান আর কিচ্ছু বাকি রাখেনি সে। আমি আর মানুষের সামনে মুখ দেখাইতে পারবোনা।”
খাদিজা বেগমের বুকটা ধক করে উঠল। তিনি কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কি করেছে রিমি?”
মনসুর সাহেব চেঁচিয়ে বললেন, “কি করেনাই সেইটা বলো। করার আর কিছু বাকি রাখছে সে? তোমার মেয়ে একটা ছেলের সাথে অসামাজিক কার্যকলাপ করতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা খাইছে। তাদেরকে কাঁঠাল গাছের সাথে বাঁধে রাখা হইছে।”
অরূপের অ্যাসাইনমেন্ট প্রায় শেষের দিকে। আর দুটো অংক মিলে গেলেই কমপ্লিট হয়ে যাবে পুরোটা। শেষ অংকটায় গিয়ে অবশ্য একটা ভেজাল লেগে গেছে। ডানপক্ষ মিলছেনা। জাহিদকে একটা ফোন করা দরকার।
সদ্য কেনা স্মার্টফোনটা হাতে নিল অরুপ। জাহিদের নাম্বারে একটা মিসকল দিতে গিয়েই ধরা খেলো। ওপাশ থেকে ফট করে কলটা রিসিভ করে ফেলল জাহিদ।
“কিরে সালা পাবজি খেলতেছি এই সময় ফোন দিচ্ছিস কেন?”
“দোস্ত একটু আমাদের বাসার সামনে আয় না। তোর অ্যাসাইনমেন্ট তো শেষ তাই না? তিন নাম্বার অধ্যায়ের ঐ অংকটা কিভাবে করছিস একটু দেখা না।”
জাহিদ বিরক্তি মাখানো গলায় বলল, “আরে ধুর বাল, এখন পারবোনা। আমি একটু কোয়াটারের দিকে যাচ্ছি । হাসান ভাই বলল ঐ জায়গায় নাকি কি একটা কাহিনী হইছে। একটা ছেলে আর দুইটা মেয়ে নাকি ধরা পড়ছে। যাবি নাকি? চল দেখে আসি। তোর অ্যান্ড্রোয়েড মোবাইলটা আছে না? ঐটা নিয়ে আসিস। ওদের ছবি তুলে আনব। ”
“বলিস কি দোস্ত?” উত্তেজিত গলায় বলল অরুপ। “তুই একটু দাঁড়া, আমি এক্ষুনি আসতেছি।”
সবার আগে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছলেন সাদিয়ার আপন চাচা জনাব খাইরুল মৌলবি। জীবনে কখনই তিনি এতটা অপদস্ত হননি। এ জায়গায় আসার পর থেকে তার নিজেকে অপরাধী অপরাধী লাগছে। চারদিকে তিনি চোরের মত তাকাচ্ছেন। ভয় হচ্ছে, পরিচিত কেউ দেখে ফেলল কিনা?
কোয়াটারের সামনের জায়গাটা তখন লোকে লোকারণ্য । দূর দূরান্ত থেকে মানুষ সাইকেলে মোটরসাইকেলে চেপে ছুটে আসছে তামাশা দেখতে। সবার চোখেই খেলা করছে অশ্লীল কৌতূহল। বিপরীত দিক থেকে পরিচিত কাউকে আসতে দেখলেই তারা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করছে, “কিরে মাংয়ের ব্যাটা,কি দেখলি?”
“হো দেখছি, মাগী দুইটা একেবারে খাসা, সেক্সি। মোবাইলে ছবি তুলে আনছি।”
খাইরুল মৌলবি ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগোতে লাগলেন। তার বুক দুরুদুরু করছে। এমনটা কেন হচ্ছে তিনি জানেন না।ভিড় ঠেলে তিনি একেবারে সামনে চলে আসলেন। দেখতে পেলেন কাঠগোলাপ গাছের নিচে রাখা পাশাপাশি তিনটে চেয়ারে তিনজন ছেলে মেয়েকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের দৃষ্টি মাটির দিকে নিবদ্ধ। মৌলবি চিনতে পারলেন সাদিয়াকে। ভয়ে চুপসে যাওয়া সাদিয়ার চেহারায় খেলা করছে লজ্জা, অপমান, আতংক।
নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন না মৌলবি। কষে একটা চর বসিয়ে দিলেন সাদিয়ার গালে।
“কুত্তার বাচ্চা এই জন্যে তোর বাপ মা তোকে পড়াশুনা শিখাইছে? গোটা বংশের মুখে তুই চুনকালি মাখায় দিলি রে কুত্তার বাচ্চা। তোর জন্য সমাজে আর মুখ দেখাইতে পারবোনা আমরা।”
সাদিয়া মাথা তুলল। আমতা আমতা গলায় বলল,
“চাচা আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করেন। আমাদের সাথে এইখানে অন্যায় করা হইছে চাচা। আমাদের কারও কোন দোষ ছিলনা। বরং ওরাই অন্যায় ভাবে আমাদেরকে…” পুরো বাক্যটা শেষ করতে পারলোনা সাদিয়া। তার আগেই খাইরুল মৌলবি তীব্র ক্রোধে চেঁচিয়ে বললেন, “শুয়ারের বাচ্চা তুই এখনও গর্ব করে কথা বলিস কোন মুখে? তুই জানিস তোর বাপ এই খবর শুনে একটু আগে স্ট্রোক করছে।”
চমকে উঠল সাদিয়া। “কি বললেন আপনি?”
“তোর জন্য তোর বাপ স্ট্রোক করছে রে শুয়ারের বাচ্চা।”
একটা তীব্র শূন্যতা যেন হঠাৎ আচ্ছন্ন করে ফেলল সাদিয়াকে। আর কোন শব্দ, আর কোন বাক্য স্পর্শ করছেনা তাকে। চারপাশে যেন শুধুই এক বিরাট শূন্যতা। তীব্র অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল সাদিয়া। জ্ঞান হারাবার ঠিক আগ মুহূর্তে পাশ থেকে সাদিয়াকে ধরে ফেলল রিমি। সে মৌলবির চোখের দিবে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “সাদিয়ার এখানে কোন দোষ নেই আঙ্কেল। ওকে আমিই জোর করে এখানে ডেকে এনেছি।”
খাইরুল মৌলবি এবার ভালোভাবে তাকালেন পাশের মেয়েটার দিকে। তার পুরো ক্রোধ গিয়ে পড়ল এই ছেলে মেয়ে দুটোর উপরে । রিমি তখনও বলে যাচ্ছে, “দেখেন আঙ্কেল সাদিয়া অনেক ভালো মেয়ে। ও সরল বিশ্বাসে আমার সাথে এখানে এসেছে….” বাক্যটা শেষ করতে পারলনা রিমি। তার আগেই একটা প্রকাণ্ড চর তার গালে এসে পড়ল। খাইরুল মৌলবি হুংকার দিয়ে বললেন, “তোমাকে আর ওর হয়ে সাফাই হাইতে হবেনা। নিজে তো হইছ একটা নষ্টা মাগী, আমাদের মেয়েটাকেও নষ্টের পথে নিয়ে গেছো।” বলেই তিনি তামাশা দেখতে আসা কয়েকজনকে সাদিয়ার দিকে নির্দেশ করে বললেন, “এই মাগীটাকে ধরেন তো, ধরেন এইটাকে। হাত পায় ধরে রিকশায় তুলে দেন।”
দুই একজন মহা উৎসাহে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো। ঠিক এরকম সময় ভীড় ঠেলে একেবারে সামনে সামনে চলে আসলেন রিমির বাবা জনাব মনসুর সাহেব।
জাকির এবার ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠেছে। আপাতত করোনা মহামারীর কারণে তার স্কুল বন্ধ। একারণে সে পেয়ে গেছে অফুরন্ত অবসর। সারাদিনে তার তেমন কোন কাজ নেই। দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাদল মিয়ার চায়ের দোকানে বসে বন্ধুদের সাথে পাড়ার সুন্দরীদের নিয়ে অশ্লীল আলাপ করতে তার ভাল লাগে। কিংবা বন্ধুদের সাথে নদীর পাড়ে গিয়ে গাঁজা টানতেও তার ভাল লাগে। সব থেকে ভাল লাগে প্রতিপক্ষ গ্রুপের কারও সাথে গ্যাঞ্জাম লাগলে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে তাদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে।
আজ অবশ্য এগুলোর কোনটাই করছেনা সে। বরং উদাস নয়নে বসে আছে বাদল মিয়ার চায়ের দোকানে। হাতের স্মার্টফোনটায় টিকটক স্ক্রল করে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে রবিন এসে যোগ দিল তার সাথে।
“কিরে সালা,একা একা কি করিস?”
“বাল ফালাই।” জবাব দিল জাকির।
এই ধরণের জবাব অগ্রাহ্য করল রবিন। সে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ঘটনা শুনছিস নাকি?”
“কোনটা, ঐ পাড়ার সাদিয়া?” মোবাইল থেকে চোখ তুলে জানতে চাইলো জাকির।
“ হ্যাঁ, সুন্দর ছিল না মেয়েটা? এরকম একটা মেয়ে আমাদের মাঝে থেকে চলে গেল, আহারে।” বলেই দোকানের বেঞ্চে হেলান দিল রবিন।
“মরছে ভালই হইছে। এই ধরণের মেয়েদের সুইসাইড করাই উচিত।” টিকটক স্ক্রল করতে করতে বলল জাকির, “এই ধরণের মেয়েগুলার জন্যই তো আমাদের যুব সমাজটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একটু পাখনা গজাইলেই এরা শুরু করে দেয় প্রেম করা আর বেহায়াপনা।”
“ঠিক বলছিস দোস্ত।” সায় দেয় রবিন, “এইসব মেয়েদের একেকটার হায় রে সেকি দেমাগ। এই সাদিয়া মেয়েটাকেই তো সেইদিন আমাদের ছাত্রনেতা কালাম ভাই মাঠের মাঝখানে প্রপোজ করছিল। ওমা এই মেয়ে দেখি সেইদিন মুখের উপর তাকে না করে দিল। নে দেখি এইবার খাইলো না পুটকিটা মারা। একেবারে ঠিক কাজ হইছে। এইসব মেয়ে মরলেও জাহান্নামে যাবে।”
জাকির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। এগিয়ে দিল রবিনের দিকে।
“এই টাইপের আরও কয়েকটা মেয়ে আছে আমাদের পাড়ায় বুঝলি।” বলল জাকির, “ঐ যে পান দোকানী জয়নাল মিয়ার মেয়ে কানিজ আছে না? চিনিস তো। ঐ মেয়ে টিকটকে হায় রে কি যে সব ভিডিও দেয়। পর্দা কালামের তো কোন বালাইও নাই। এইসব মেয়েকে রাস্তায় দেখলেই আমার রাগে গা জ্বলে যায়। মন চায় তাকে ধরে নিয়ে যায় ধর্ষণ করি। তাহলেই এগুলার উচিত শিক্ষা হবে।”
রবিন সায় দেয়, “ঠিক বলছিস দোস্ত। আমারও এরকম মন চায়।” বলেই সে জাকিরের পকেট থেকে আরও একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে ছোঁয়াল।
মনসুর সাহেবের হাতে একটা মস্ত বড় কাঁচের বোতল। তিনি ওটা নিজের ঠোঁটে ঠেকিয়ে রেখেছেন। রিমি ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে সেদিকে। গত দুটো দিন সে একটানা এই রুমের মধ্যে বন্দি ছিলো। তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বাইরের পৃথিবীর সাথে তার কোন যোগাযোগ নেই। রাহাত এখন কোথায় আছে সে জানেনা। সেদিন যখন কাঠগোলাপ গাছের নিচে লোকগুলো মিলে রাহাতকে পেটাচ্ছিল রিমি সেই দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। জ্ঞান ফিরে নিজেকে এই ঘরে আবিষ্কার করেছে সে।
মনসুর সাহেব তার হাতের বোতলটা ঠোঁটের আরও কাছে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“জানো এই বোতলের মধ্যে কি আছে?”
রিমি জবাব দিল না। তার দৃষ্টি নির্বিকার। মনসুর সাহেব নিজেই জবাব দিলেন,
“এই বোতলে প্রায় আধা লিটার বিষ আছে। যা আমি আর কিছুক্ষণের মধ্যে গলায় ঢেলে দিব। এই মুহূর্তে আমার বাঁচা মরা নির্ভর করছে তোমার হাতে। তুমি কি শুনছ আমার কথা?”
রিমি এবার মুখ খুলল। সরাসরি মনসুর সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রাহাত কোথায়?”
মনসুর সাহেব গর্জে উঠলেন, “আর একবার ঐ নাম নিবা তো আমি বিষের বোতল পুরোটাই মুখের মধ্যে ঢালে দিব। তুমি জানো তোমার এত সব কাণ্ড কীর্তির পরেও জব্বার ভাই তার ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দিতে রাজি হইছে শুধুমাত্র আমার রিস্পেক্টের কথা ভেবে। তোমার মনে হয় এত সব ঘটে যাবার পরেও আর কোন মানুষ তার ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দিতে রাজি হবে? জব্বার ভাই নেহায়েত ভাল মানুষ বলেই তিনি রাজি হইছেন। নাহলে তোমার মত মেয়ে আজকে গাঙের জলে ভাসে যাইত।”
রিমি নির্বিকার। সে আবারও জিজ্ঞেস করল, “রাহাত কোথায়?”
মনসুর সাহেব এগিয়ে এসে কষে একটা চর বসিয়ে দিলেন মেয়ের গালে, “খাংকি মাগী, তোর কি মনে হয় ওই ছেলের সাথে তোকে আমরা দেখা করতে দিব? তোর মনে কি নরকে যাবার ভয় নাই রে মাগী? খোদার ভয় নাই তোর মনে? তুই যে কত বড় পাপ করতেছিস তোর কোন আইডিয়া আছে? ভালই ভালই বলতেছি ঐ ঘরে পাত্রপক্ষ বসে আছে, কাজী সাহেবও ডাকা হইছে। তুমি শাড়িটা পরে ভাল মেয়ের মত ঐ ঘরে চলে আসো।”
রিমি জবাব দেয়না। তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। মনসুর সাহেব এবার খানিকটা নরম গলায় বললেন,
“দেখো সাদিয়া তোমাকে আমরা ছোট থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করছি। অথচ এখন তোমার কাছে ঐ কোথাকার কোন ছেলে দুই দিনও হয়নি যার সাথে পরিচয় হইল সে কিনা বড় হয়ে গেল? তোমাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি তোমার যদি ঐ ছেলেকে বিয়ে করার এতই সাধ থাকে তাহলে আগে আমরা বিষ খাব তারপরে তুমি যাবা। এখন ডিসিশন নাও কোনটা করবা। ঐ ঘরে গেস্ট বসে আছে, হাতে বেশি সময় নাই। আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনবো তার মধ্যে তোমাকে ডিসিশন নিতে হবে কোনটা করবা।” বলেই তিনি বোতলটা আবারও ঠোঁটের সামনে ছোঁয়ালেন। তারপরে গুণতে শুরু করলেন, “এক……দুই………”
টিভিতে কিসের যেন খেলা চলছে। বাদল মিয়ার দোকানের সামনে ভালই ভিড় জমেছে। জনতা একটু পর পর চিৎকার করে উঠছে। এত ভিড়ের মধ্যেও রবিন, জাকির, তন্ময়, গোবিন্দ সহ আরও কয়েকজন বন্ধু মিলে আড্ডা বসিয়েছে। আড্ডার টপিকটা অবশ্য বেশ চটকদার। রবিনই তুলল প্রসঙ্গটা, “বুঝছিস জাকির আমি বলছিলাম না ঐ পাড়ার রিমি মেয়েটার চরিত্রে সমস্যা আছে। দেখলি তো একটা ছেলের লাইফ নষ্ট করে ঠিকই বিয়ে করে ফেললো অন্য আরেকটা ছেলেকে। ঐ যে সেইদিন গাছ তলায় এই মেয়ের প্রেমিককে সবাই মিলে ধরে পিটাইলাম মনে আছে না? ঐ ছেলে নাকি তিন ধরে নিখোঁজ। আর এদিকে প্রেমিকা দিব্যি বিয়ে করে বসে আছে আরেকজনকে। কোন লেভেলের পল্টিবাজ মেয়ে হইলে মানুষ এই ধরণের কাজ করতে পারে?”
রবিনের কথায় সায় দিল বাকিরাও, “ঠিক বলছিস দোস্ত। এই টাইপের মেয়েগুলা এরকমই হয়। এরা হচ্ছে বেশ্যা মাগী।”
পাশ থেকে অবশ্য মিজান বলে উঠল, “কিন্তু এই মেয়ে তো শুনছি বাধ্য হয়েই নাকি এই বিয়েটা করছে। ওর বাবা নাকি বিষের বোতল মুখের সামনে নিয়ে বলছে তুই বিয়ে না করলে আমরাও বিষ খাবো সাথে তোকেও জবাই করে পুতে রাখব।”
“তাই বলে বিয়ে করে নিতে হবে?” পাশ থেকে ধমকে উঠল জাকির। “এই মেয়ে তো সুইসাইড করলেও পারত। গলায় দড়ি দেওয়া উচিত ছিল তার। তা না করে এখন বিয়ে করে সুখের সংসার করবে? তুই ঠিক বলছিস রবিন এই ধরণের মেয়েগুলা হচ্ছে একেকটা বেশ্যা মাগী। ঠিক কিনা?”
বাকি বন্ধুরাও সায় দিল এবার, “ঠিক বলছিস।”
অনীক রশিদ (Aneek Rashid)
Send private message to author



