সাউথ হ্যান্ড

এক

দুপুরের আলো  ম্লান হয়ে আসছে।  চারপাশ এখন অনেকটাই নিরব। মধ্যাহ্নের এই সময়টায় পুরো পৃথিবী যেন হঠাৎ করেই বেশ শান্ত হয়ে পড়ে। রাস্তার দুপাশের ব্যাস্ত দোকানদারেরা তাদের দোকানের ঝাপ বন্ধ করে  মধ্যাহ্ন ভোজে চলে যায়। চাকরিজীবীরা  তাদের কর্মস্থল ছেড়ে লাঞ্চ ব্রেকে পাশের কোন খাবার হোটেলের নোংরা বেঞ্চে বসে  হাঁক ছাড়ে, “মামা একটা ভাত দাও সাথে পাঙ্গাস মাছ।” কিংবা ঐ ফেরিওয়ালারা, যারা  নিজেদের কন্ঠশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে হাঁক ছেড়ে  সেবা পৌঁছে দেয় নগরবাসীর  দোরগোড়ায়, তারাও যেন হঠাৎ করেই খানিকটা ঝিমিয়ে পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেণীর সিটিজেন হয়ে সভ্যতার উল্টোপিঠে বসবাস করা বাঙালী  গৃহিনীরাও পতিসেবায় ক্ষান্ত দিয়ে এই সময়টায় নিজেদের ঘুমোবার আয়োজনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে,  কখনো বা সেই সময়টাও তাদের হয়ে উঠেনা।

এরকমই এক শান্ত স্বাভাবিক উদাস দুপুরে মহল্লার শেষ মাথায় পানের দোকানটার উল্টো দিকে দুজন যুবককে  দেখা, যাচ্ছে  নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন আলোচনায় মশগুল তারা।

যুবকদ্বয়ের একজনের হাতে দুটো প্লাস্টিকের বসার  টুল আর অন্যজনের হাতে ফোল্ডিং করা  একটি ছোট টেবিল। টুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক তার হাতের  বস্তুগুলো পাশের একটা ইলেকট্রিক পোলের সামনে নামিয়ে অপর যুবককে বলল,

“রাকিব,দোস্ত মালগুলা এইখানেই রাইখা দে। খাম্বাটার পাশে টেবিলটা বসাইলে দেখবি সব দিক থেকে মানুষের নজরে পড়বে। এই জায়গায় এর আগেও আমি কয়েকবার দোকান বসাইছিলাম।  জায়গাটা ভালো দোস্ত।”

রাকিব টেবিলটা না নামিয়েই খানিকটা ইতস্তত করে বলল,

“এইখানে? মাথা ঠিক আছে তোর? মিরাজ আমার মামা যদি দেখতে পায় কি কেলেংকারিটা হবে একবার চিন্তা করছিস?”

“তোর মামা? এই ঢাকা শহরে?” ধমকে উঠলো মিরাজ। “শালা এই শহরে কয় কোটি মানুষ আছে তোর কোন আইডিয়া আছে রে বোকাচোদা। এত মানুষের মধ্যে তোরে দেখবে কেমনে? আর তাছাড়া তোর মুখে তো মাস্ক পরা। মামায় দেখলেও তোরে চিনবেনা।”

“না না দোস্ত, তারপরেও যদি দেখতে পায়?” চিন্তিত গলায় বলল রাকিব,  “একবার যদি চিনে ফেলে নির্ঘাত আব্বুরে ফোন দিয়া বলবে, আপনার পোলারে দেখলাম ঢাকা শহরে  ফুটপাথের ধারে বসে মাস্ক বেচতাছে। কি কেলেংকারিটা হবে একবার চিন্তা করছিস? বাসায় এখনও জানে আমি ঢাকা শহরে আগের কোম্পানিটাতেই চাকরি করতেছি। মাসে মাসে বেতন পাই। করোনার কারণে চাকরিটা যে চলে গেছে এইটা তো আর কেউ জানেনা।” রাকিবের অসহায় ভঙির কথাগুলো শুনে হেসে দিলো  মিরাজ। চোখ ছোট করে বলল,

“তোর এই বালের ন্যাকামি বন্ধ করবি? তোর মামা দেখলে কি হইছে,  সমস্যা কি? তুই তো আর চুরি করতে আসিসনি। তুই পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করতেছিস, এতে লজ্জার কি আছে।” বলেই দম নিবার জন্য থামলো মিরাজ। রাকিব চুপ করে আছে দেখে সে  আবারও বলতে শুরু করলো , “আর তাছাড়া  ঐ চাকরি করে তুই কয় টাকাই বা মাসে বেতন পাইতি। বিশ হাজারও তো  পাইতিনা মনে হয়। অথচ এইখানে দেখ  তুই আর আমি মিলে যদি ঠিকঠাক পরিশ্রম করতে পারি,  দৈনিক কমপক্ষে দুই হাজার টাকা করে অনায়াসে কামাইতে পারবো, মানে মাসে ষাট হাজার টাকা। কল্পনা করছিস একবার?”

“না দোস্ত তারপরেও কেমন জানি লাগে।” মৃদু প্রতিবাদ করে বলল রাকিব। তার কথার খেই ধরেই মিরাজ তার পিঠে হালকা চাপড় মারলো,

” শুন দোস্ত, জীবনে বড় কিছু করতে চাইলে কোন কাজকেই ছোট ভাবা যাবেনা। এই যে আমি তিন মাস ধরে রাস্তার ধারে বসে মাস্ক বেচতেছি, কই আমার তো একবারও এরকম মনে হয়নি। যদিও প্রথম প্রথম তোর মত আমারও আনইজি লাগতো,  এখন দেখ সব সয়ে গেছে। তোরও দেখবি টাকা উপার্জন একবার শুরু হয়ে গেলে কয়দিন পরে আর ঐসব গায়ে লাগবেনা। নে এইবার টেবিলটা এইখানে রাখ। মালগুলা আমার ব্যাগের ভিতরে আছে, বাইর কর। একটু পরে ভিড় বাড়তে শুরু করবে, দেখবি তখন কি হারে বেচাবিক্রি শুরু  হয়।”

দুই

খালেক তার লেগুনাটা গ্যারেজের একটা ফাঁকা জায়গায়  রেখে পাশের গলিটায়  বেরিয়ে এলো। মন মেজাজ তিরিক্ষ হয়ে আছে তার। আজকে এই নিয়ে মোটে চারটা ট্রিপ মেরেছে।   এর মধ্যেই গিয়ার বক্সের সমস্যা শুরু হয়ে গেছে। 

গ্যারেজের মিস্ত্রী বদরুলকে একবার সামনে পেলে ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিতে হবে। কাল এতগুলা টাকা দিবার পরেও হারামজাদা দুই নাম্বার পার্টস দিয়ে দিছে।

রাস্তাটা পার হয়ে এপাশে আসতেই দেখা হয়ে গেলো ইবাদাতের সাথে। মেজাজটা আরও খারাপ হয়ে গেলো তার। চেঁচিয়ে উঠলো সে, ” ঐ খাংকির পোলা কই আছিলি এতক্ষণ?”

ইবাদাত হাফাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে এতক্ষণ দৌঁড়ে এসেছে, “খালেক ভাই ফারহান মামায়   আপনেরে খুঁজতাছে।  কইলো আইজকাও নাকি রাস্তার ঐ পাড়ে মাস্কের দোকানটা বসাইছে।  আপনেরে কইছে অক্ষোনি আইতে।”

খালেকের মুখটা সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে এলো। চট করে কি যেন চিন্তা করে জবাব দিলো, “হো খাড়া, আইতেছি।”

তিন

মিরাজ তার দোকান বসিয়েছে প্রায় ঘন্টা চারেক হলো। এর মধ্যেই বেচাকেনা বেশ জমিয়ে ফেলেছে । সঙ্গে বন্ধু রাকিবকে নিয়ে এসেছে আজ। প্রথম দিনে ভালোই পারফর্মেন্স দেখাচ্ছে ছেলেটা। ভবিষ্যতে উন্নতি করবে, বোঝা যায়।

মিরাজের সামনের টেবিলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নানান রঙের মাস্ক। একেক মাস্ক দেখতে একেক রকম।

দুপুরের বিশ্রাম সেরে  মানুষ এখন আবারও বেরিয়ে আসছে । বাড়ছে কোলাহল। এর মাঝেই মিরাজ হাঁক ছাড়তে শুরু করেছে,

“বাইছা লন, দেইখা লন…”

মিরাজের প্রত্যুত্তরে  রাকিবও হাঁক ছাড়ছে,

“পাঁচ পিছ মাস্ক দশ টাকা..ইয়ারফোন চল্লিশ টাকা..বাইছা লন দেইখা লন।”

মিরাজ কিছুক্ষণ পর পর হাঁক থামিয়ে রাকিবকে জিজ্ঞেস করছে,

“ইয়ারফোন  কয়টা বিক্রি হইলো রে, গোনা দে তো।”

“তেরোটা গেছে দোস্ত।”

“সবগুলার টাকা পাইছোস তো?”

“না। তিনটার  পাইনি। কালাম ভাইর পোলাপাইন আইসা হেডফোন নিয়া গেছে। টাকা চাইতে গেছি উল্টা ফাপর দিছে।”

মিরাজ  ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, “যত্তসব বাইনচোদের দল। বাপের সম্পত্তি পাইছে বেটারা। ফাও মাল লইতে চায়। শুন দোস্ত, আর কাউরে ফাও দিবার দরকার নাই। কালাম ভাইর পোলাপাইন হোক আর যেই হোক কাউরে ফাও মাল দিবিনা। বুঝছোস কি কইছি?”

রাকিব মাথা নাড়ে, ” আচ্ছা দোস্ত।”

চার.

ছেলেগুলোর আগমনের উদ্দেশ্য মিরাজের কাছে এখনও পরিস্কার না। সে আড়চোখে তাকালো একবার। সংখ্যায় তারা আট থেকে দশজন। তার টেবিলের চারদিকে অনেকটা ঘেরাও হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মধ্যে কেমন যেন উদ্ধত ভাব।

মিরাজকেই সম্ভবত উদ্দেশ্য করে বলল তাদের একজন,

“এ ভাই এ, তোমাগোরে হেনে বইতে দিছে কেডায়? হ্যাঁ? ঐদিন এত কাহিনী করার পরেও শিক্ষা হয়নি নাকি?”

কাষ্টমারের হাতে মাস্কগুলো ধরিয়ে দিয়ে ছেলেগুলোর দিকে  সরাসরি তাকালো মিরাজ। “কেন ভাই। কি সমস্যা। কে আপনারা?”

যুবকগুলোর মধ্যে সবথেকে উগ্র স্বভাবের ছেলেটা  আগের মতই ক্ষুদ্ধ কন্ঠে পাল্টা জিজ্ঞেস করলো,

“আমরা যেই হই, আগে কও তোমাগোরে হেনে বইতে দিছে কুন বান্দিরপুতে?”

ছেলেটার উগ্র আচরণে একটুও বিচলিত হলোনা মিরাজ। তাদের আগমনের কারণটা সে জানে। এরকম অভিজ্ঞতা এর আগেও হয়েছে তার। পূর্ব অভিজ্ঞতাই তাকে বলে দিচ্ছে এদের সামনে  যতই ভয় পাবে ততই তারা ঘাড়ে চেপে বসবে। তাদেরকে  সেই সুযোগটা না দিয়ে বরং  পাল্টা ধমকের সুরে বলল মিরাজ,

“ঐ মিঞা মুখ খারাপ করেন কেন? সমস্যা কি? ফাপর মারাইতে আসছেন নাকি, কার লোক আপনারা?”

মিরাজের চওড়া গলা শুনে আরও উদ্ধত হয়ে উঠল লোকটার আচরণ,

“কার লোক চোদাও মিঞা? লোক তোমাগো পুটকি দিয়া ভরে দিমু।” ছেলেটার আচরণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে  পাশ থেকে  হাফপ্যার্ট পরা তার আরেকজন সঙ্গী বলে উঠলো, “খালেক মামা, আপনে থামেন। আমি  কথা কইতেছি হেগো লগে।” বলেই মিরাজের দিকে তাকালো সে, “ভাইজান আপনারা যে হেনে ব্যবস্যা করতে বইছেন, কারো কি অনুমতি নিছেন?”

“হু নিছি তো” সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো মিরাজ।  তার কথা শুনে খালেক নামের লোকটা আবারও ক্ষেপে উঠল,

“কুন বাপে তোমাগোরে  বইতে দিছে রে মাদারচোদ? ফারহান ভাইর পুলাপাইন যে রাস্তার ঐ পাড়ে মাস্ক বেচে, চোক্ষে দেখোনা? তোমরা আবার এই পাড়ে মাস্ক বেচতে আইছো কুন আক্কেলে? পুটকির মধ্যে মাইর না খাইতে চাইলে টেবিল চেয়ার নিয়া হেনে থেইকা ভাগো কইলাম।  এইদিকে আর ভুলেও আইবানা। নাইলে কইলাম পুটকির চামড়া কিন্তু একটাও থাকবোনা।”

লোকটার উদ্ধত আচরণে দমে না গিয়ে উল্টো জবাব দিলো মিরাজ,

“ভাই দেখেন আমরা কিন্তু এই জায়গায়  আজকে নতুন বসিনাই। প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেলো এইখানেই বসে মাস্ক আর হেডফোন বেচতেছি, কেউ কিচ্ছু বলেনাই। পুলিশ আসে দৈনিক দুইশো টাকা করে চাদা নিয়ে যায়। তার উপর   কালাম ভাইর লোকও  মাঝেমধ্যে তিনশো চারশো    করে টাকা নেয়। বিনিময়ে কালাম ভাই নিজের মুখে বলছে, তোমরা এইখানে যতখুশি বেচা বিক্রি কইরো, কেউ কিছু বলবেনা।” বলেই খানিকটা থামলো মিরাজ। পরক্ষণেই আবারও বলতে শুরু করলো, “কালাম ভাই যেইখানে নিজে অনুমতি দিছে সেইখানে আপনারা কোন চ্যাটের বাল।  কই থেকে উড়ে আসে দুই চারটা ফাপড় দিয়া গেলেই আমরা উঠে যাব নাকি? এত সোজা ভাইবেন না ভাই।”

মিরাজের জবাবে আচমকা খালেকের চেলা টাইপের ছেলেটা গর্জে উঠলো,

 “ঐ মিঞা ঐ, এত কথা চোদাও ক্যা?  আমাগোরে কালাম ভাইর ভয় দেখাও? কালাম ভাইর বাপ আমরা। আমাগোরে শিখাইতে আইছে কালাম ভাইর নাম। যাউক গা অত কথা কওনের টাইম নাই, তোমাগোরে আধাঘন্টা টাইম দিতেছি, আধাঘন্টার মধ্যে মালপাতি গুটায় রাস্তা মাপবা নাইলে কইলাম….”

রাকিব এতক্ষণ চুপচাপ পাশ থেকে তাদের চেঁচামেচি দেখছিল। নিজের ক্রোধটাকে ভালোই দমন করে রেখেছিলো সে। এবার মনে হয় ভেঙে গেলো সেই বাধ।  আচমকা সে মিরাজের পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল,

“এ ভাই  আপনারা এরকম আচরণ করতেছেন কেন? বাংলা কথা বুঝেন না? আমরা তো বললামই এখান থেকে যাবোনা। তাইলে এতো কথা বাড়াচ্ছেন কেন?” 

রাকিবের আচমকা প্রতিবাদের জন্য হয়ত প্রস্তুত ছিলোনা খালেক। সে খানিকটা দমে গিয়ে আড়চোখে তাকালো তার মুখের  দিকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য নিরবতা নেমে এলো।  রাকিবের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে  হঠাৎ নিজের গলাটা অনেকটা নিচে নামিয়ে  শীতল কন্ঠে বলে   উঠল খালেক,

“তারমানে আপনেরা কইতেছেন হেনে থেইকা যাইবেননা”

“না রে ভাই।” বিরক্তির সুরে জবাবটা দিলো রাকিব। সাহস পেয়ে মিরাজও  এবার খানিকটা ব্যাস্ততা দেখিয়ে বলল, “ভাই  যান তো আপনারা এইখান থেকে। খামোকা ভিড় কইরেন না। কাস্টমার আসতে দেন। আপনারা পরে অন্য সময় আইসেন।”

মিরাজর স্পর্ধা দেখে  লোকটা সরাসরি তাকালো তার  চোখের দিকে । খুব ঠান্ডা গলায় বলে উঠল,

“যা কইতেছেন চিন্তা ভাবনা করে কইতেছেন তো? পরে কিন্তু পস্তাইবেন কইলাম। সজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাকা করার লাগবো বইলা দিলাম।”

লোকটার কথা শেষ না হতেই মিরাজ খেঁকিয়ে উঠল, “আরে যান তো, কত বাইনচোদ দেখলাম জীববে।”

লোকটা আর কোন কথা বাড়ালো না। শুধু তার চেলা টাইপের ছেলেটাকে একবার বলে উঠল, “আয়রে মতি। হেগো বাংলা কথায় কাম হইবোনা। বুস্টার ডোজ দেওন লাগবো। হেরা কেমনে এই জায়গায় ব্যাবসা করে আমি দেখমু। এক ঘন্টার মধ্যে যদি তাগোরে না তুলছি রে। আয় তো মতি, আমার লগে আয়। পুলাপাইন সবটিরে আনার লাগবো।

পাঁচ

“এরা যদি  এখন সত্যি সত্যি ঝামেলা করে দোস্ত? কি করবি ভাবছোস কিছু?”

খালেকের দলটা চলে যেতেই কথাটা জিজ্ঞেস করলো রাকিব। তার প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললো মিরাজ,

“আরে ধুর বাল, এই রকম কত খাংকির পোলা আসে আর যায়। হুদাই আইসা দুই চারটা ফাপড় নিবে, তারপর বলবে পয়সা ফালাও। এইগুলারে চোদার টাইম আছে মিরাজের? এইসব বাইনচোদরে নিয়া  ওত মাথা ঘামানের দরকার নাই। তুই তোর কাম করে যা। কয়টা ইয়ারফোন সেল করলি এখন পর্যন্ত?”

“সাতাইশটা।” জবাব দেয় রাকিব। 

“ভালোই তো দাইন মারলি  প্রথম দিন। দেখছোস দুই ঘন্টা কাম করেই তোর তিনশো টাকা কামাই হয়ে গেছে। আর তুই ব্যাটা  এতদিন মরতাছিলি চাকরির পিছনে।  আগের চাকরিটায় বারো ঘন্টা ডিউটি করে কত জানি পাইতি? আঠারো হাজার না? কথা কস না ক্যা? আঠারো হাজার  পাইতি না? এই আঠারো হাজার টাকা তোর দশ দিনে কামাই হবে লেইখা রাখ।”

রাকিব মাথা নাড়ে। জবাব দেয়না। মিরাজ বলে চলে, “এই কাম করতে গেলে কিন্তু ভাইয়া লজ্জা সরমের বালাই থাকলে চলবেনা। তোর ভার্সিটির ঐ মাইয়াটা যারে তুই চল্লিশ টাকার হেডফোন  বিশ টাকায় দিলি, ঐ মাইয়া আবার ফেরত আইছিলো কেন?”

আচমকা এরকম প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলোনা রাকিব। সে খানিকটা থতমত খেয়ে জবাব দিলো,

“ইয়ে মানে দোস্ত ঐ মাইয়া কয় তার নাকি  হেডফোন পছন্দ হয়নাই। ঐজন্যে ঐটা পাল্টায় আরেকটা নিছে।” 

মিরাজ খেঁকিয়ে উঠল, “এই জন্যেই তোরে কইছি কম দামে কোন বাইনচোদরেও মাল দিবিনা। হোক তোর বান্ধবী আর তোর প্রেমিকা। সস্তার কাস্টমার এরকমই করে। বইতে দিলে শুইতে চায়।”

মিরাজের ক্রোধ থেকে বাঁচতেই হয়ত রাকিব চট করে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জিজ্ঞেস করলো

“আর শুইতে দিলে কি করতে চায়?” রাকিবের এরকম অবান্তর প্রশ্নে   মিরাজ ফিক করে হেসে দিলো। তার হাসিতে মিশে আছে ভিন্ন ইঙ্গিত। 

“বাইনচোদ। তুই হালা জাউরা আছোস। তোরে ভালো পোলা ভাবছিলাম।”

মিরাজের অশ্লীলতা ধরে ফেলে রাকিবও।  পাল্টা জবাব দেয় সে, “হো জাউরা তো খালি তুই একাই আছোস, নাকি?”

মিরাজ আর প্রসঙ্গ বাড়ায়না। টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা মাস্কের বক্সগুলো ঝাড়ামোছ করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে সে। আর ঠিক তখনই শুনতে পায় কন্ঠটা, 

“ব্যাবসা পাতি তো ভালোই জমায় ফালাইছেন ভাই। কালাম ভাইয়ে কি হয় আপনাগো?”

আচমকা প্রশ্নটা শুনে ঘুরে তাকালো মিরাজ। দেখতে পেলো ছেলেগুলোকে।নিজের মনেই হেসে ফেললো সে। তারা  আবারও ফিরে এসেছে।

ছেলেগুলোর মুখোমুখি হবার আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে  কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো মিরাজ। আড়চোখে দেখে নিলো তাদের। সংখ্যায় তারা এখনও আট থেকে দশজন।  প্রত্যেকের  হাতে সোভা পাচ্ছে দেশীয় অস্ত্র। 

একটুও দমে গেলোনা মিরাজ। নিজের সবটুকু সাহস একত্র করে সরাসরি তাকালো তাদের লিডার খালেকের  দিকে,

“সমস্যা কি ভাই আপনাদের?  আমরা তো তখনই বলে দিছি এখান থেকে যাবোনা। তাহলে আবার আসছেন কেন?”

ছেলেগুলোর মধ্যে সবথেকে ষন্ডামার্কা ছেলেটা মিরাজকে  প্রায় অগ্রাহ্য করে চোখমুখ শক্ত করে জবাব দিলো,

“কালাম ভাইয়ে আমাগোরে নির্দেশ দিছে দশ মিনিটের মধ্যে যেমনে হোক তোমাগো দোকান তুলে ফেলার লাগবো।”

“কে নির্দেশ দিছে বললেন?” চোখ কপালে তুলে বলল মিরাজ।

ছেলেটা আগের মতই নির্লিপ্ত ভঙিতে বলল, “কালাম ভাই।”

মিরাজ  কিছু একটা বলতে যাবার আগেই পাশ থেকে আচমকা রাকিব ক্ষ্যাপা ষাড়ের মত এগিয়ে এলো, “ফাইজলামি চোদান মিঞারা? চাপা মারার জায়গা পাননা? কালাম ভাই এই নির্দেশ দিতে যাবে কোন দুঃক্ষে? মিঞা কালাম ভাইর ডান হাত রকি ভাইরে ডেইলি দুইশো টাকা করে চাঁদা দেই আমরা। রকি ভাইর সাথে আমাদের কিরকম সম্পর্ক কোন আইডিয়া আছে আপনার?  মিঞা হুদাহুদি আইছেন ফাপর মারাইতে? যান আগে খোঁজ নিয়া আসেন রকি ভাই কি হয় আমাগো, তারপরে ফাপর মারাইতে আইসেন।” 

রাকিবের এরকম রুদ্রমূর্তিতে একটুও বিচলিত হলোনা ছেলেটা। সে আগের মতই দাঁতগুলো মেলে  যেন কৌতুক করছে এরকম ভঙিতে জিজ্ঞেস করলো, “কারে টেকা দিছেন কইলেন?”

“রকি ভাইকে।” জবাব দিলো রাকিব।

ছেলেটা দাঁত মেলে হেসে উঠল।  যেন মজার কোন কৌতুক দেখছে। আঙ্গুল দেখালো ওভারব্রিজের ঐদিকে, “ঐ যে দেখেন কেডায় আইতেছে। আপনাগো রকি ভাই।  দেহেন হে আপনাগোরে বইতে দে কিনা। ” বলেই আবারও দাঁতগুলো মেলে হেসে উঠলো সে। 

রকি ভাই ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে। জটলাটার ভিতরে খালেককে দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠল, “কিরে খালেক,তুই এতবার ফোন দেশ ক্যা? কি হইছে হেনে কো তো। 

“আরে ভাই কি আর কমু” জবাব দিলো খালেক, “এগো লাইগা কি আর ব্যবস্যা পাতি করন যাইবো? সব কাস্টমার তো হেগো দোকানেই আইসাই ভিড় লাগাইছে। আমরা তো সব বানের জলে ভাইসা আইছি, নাকি ভাই? হেই বাইনচোদে আবার কয় আপনে নাকি তাগোরে এই জায়গায় বসার অনুমতি দিছেন। এটি শুনলে কার মন মেজাজ ভালো থাকে আপনেই কন?”

ছেলেটার অভিযোগ মনযোগ দিয়ে শুনলেন  রকি ভাই। আশ্বাসের ভঙিতে বললেন, “টেনশন লইসনা। খাড়া দেখতাছি আমি।” বলেই চট করে কি যেন চিন্তা করে নিলেন রকি। তারপর হঠাৎ মিরাজের দিকে ফিরে বললেন,

“ভাই আপনেরা কতক্ষণ হইলো হেনে বইছেন?” 

“এই তো ভাই দুপুরের পর থেকে।” জবাব দিলো মিরাজ।

“তাইলে তো মিঞা অনেক ব্যাবসা করে ফালাইছেন” চোখ বড় করে বলল রকি ভাই “এইবার তাইলে আমাগো পুলাপানটিরেও একটু ব্যাবসা করবার দেন। নাকি আপনেরাই সব একা সাবাড় করবেন?”

 রকি ভাইর চতুর মুখের দিকে তাকিয়ে আচমকা চোখমুখ কালো হয়ে গেলো মিরাজের, “এইগুলা কি বলেন ভাই? আমি তো আজকে সকালেই আপনাকে দুইশো টাকা চাদা দিয়ে দিছি। এখন তাহলে উঠতে বলতেছেন কেন, পল্টি মারতেছেন নাকি ভাই?”

মিরাজের কথার জবাব না দিয়ে হেসে ফেললো রকি ভাই।  তার কাধে হাত রেখে অনেকটা স্নেহের সুরে বলল “আরে ছোটভাই  সব কিছু কি টেকা দিয়া হয়? এই যে আপনেরা হেনে একচেটিয়া ব্যবস্যা করতাছেন। বস্তা বস্তা টেকা পকেটে তুলতাছেন। অথচ রাস্তার ঐ পাড়ে চায়া দেখেন, পুলাপানটি হারাদিন না খায়া আছে। তাগো দোকানে একটা মাচ্ছিও বহেনা। এইডা কি সঠিক ইনসাফ? আপনেরাই কন? আপনেরা তো মুসলমান। মুসলমান হয়া আরেক মুসলমানের পেটের ভিতর লাথি মারতাছেন। আরেকজনের হক মারতাছেন, এইডা কি ঠিক? আপনেরাই কন, এইডা কি ঠিক?”

বলেই থামলো রকি ভাই। মনে মনে নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা নিজেই করলো। জায়গা মত কোপটা দিতে পেরেছে। এইবার নিশ্চয় ফায়দা হাসিল হবে।

তবে রকির ধারণাটা যে ভুল একটু পরেই টের পেলো সে। তাকে  চমকে দিয়ে খানিকটা দূরে দাঁড়ানো রাকিব আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো, “ঠিক বেঠিক কাকে শিখাচ্ছেন ভাই? আমাদেরকে? মিঞা আপনার নিজেরই তো কথার ঠিক নাই। আর আসছেন মিঞা আমাদেরকে ঠিক বেঠিক শিখাইতে।”

রাকিবের আচমকা বাক্যবানে তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালেন রকি ভাই। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আবারও চেঁচাতে লাগলো রাকিব, “ওদের দোকানগুলাতে কাস্টমার থাকেনা কে বললো। ঐ দেখেন এখনও তিন চারটা করে কাস্টমার দাঁড়ায় আছে  ঐগুলাতে।  কে কার হক মারতেছে এইটা তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছেন। এর পরেও ভাওতাবাজি চোদান কেন?” 

রাকিবের চেঁচামেচি শেষ হতেই ধৈর্য্যের সীমা হারিয়ে ফেললেন রকি ভাই। নিজেকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণে এনে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলেন, “খালেক এই খাংকির পুলাডা কেডা রে?”

“কি জানি ভাই। এই পোলার বন্ধু মনে হয়।” রাকিবকে ইঙ্গিত করে জবাব দিলো খালেক। পরক্ষণেই রকি ভাইর কানের কাছে মুখ এনে  ফিসফিসিয়ে  বলে উঠল খালেক, “আপনে পারমিশন দেন তো দুইটারেই বুড়িগঙ্গার কালাপানিতে পুতে আসি।”

রকি ভাই সে কথা কানে তুললেন না। সোজা মিরাজের দিকে তাকিয়ে বললেন,

শুনেন ভাই, আপনাগোরে একটা কথা কয়া দেই। আমি কিন্তু মিঞা বেশি কথার মানুষ না। বেশি কথা পছন্দও করিনা।  আমার সময় কম।  কেউ আমার কথা না শুনলে  তাগোরে সরায় দেই।” বলেই  পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করলেন তিনি।লাইটার জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন, “আপনেরা হইতেছেন এই এলাকার ছোট ভাই। আপনাগো প্রতি আমার একটা সফ্ট কর্ণার আছে।  এই জন্যেই কইতেছি,আমাগো লগে আপোসে আসেন মিঞা। আপনেরাও খুশি থাকেন, আমরাও থাকি।”

“কিরকম আপোস?” থমথমে মুখে জানতে চাইলো মিরাজ।  রকি ভাই বলে চললেন,

“আপোসটা হইতেছে গিয়া, আপনেরা হেনে বইবেন মাসে পনেরো দিন আর হেরা বইবো পনেরো দিন। মানে একদিন পর পর বইবেন আরকি। বুঝছেন? তাইলেই তো আর ঝামেলা থাকেনা। কিরে খালেক তোরা এই শর্তে রাজি আছোস না?”

“হো ভাই রাজি আছি।”

“তাইলে তো মিটেই গেলো।” মিরাজের দিকে তাকালেন রকি ভাই, “আপনেরাও তো রাজি আছেন, নাকি?”

মিরাজ চুপ করে আছে দেখে তিনি আবারও বলে চললেন, “এখুনি সিদ্ধান্ত না জানাইলেও চলবে। আগে বাড়ি যান। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কইরেন। তারপরে আইসা জানাইয়েন।  বুঝছেন?”

মিরাজ মৃদুভাবে মাথা দোলালো। মুখে কোন জবাব দিলোনা।

রকি ভাইর দলটা চলে যাবার আগে একটা অদ্ভুত কান্ড করে বসলো দলপতি রকি। কি মনে করে যেন তিনি  কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন ক্ষিপ্ত হয়ে থাকা রাকিবের দিকে।  তারপর আচমকা তার  কাধে  হাত রেখে খুব শান্ত গলায় বললেন, “মিঞা বেশি পাইকোনা কিন্তু। কার এলাকায় আছো এইটা মাথায় রাইখো।”

বলেই তিনি জবাবের অপেক্ষা না করেই দলবল নিয়ে হাঁটা ধরলেন ওভারব্রিজের দিকে।

ছয়।

“কিরে হারামজাদা, কি হইছে তোর? এমন করোস ক্যা? তরকারিতে লবন দেয়নাই খালায়?”

ফুসতে থাকা রাকিবের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় মিরাজ। সিলিং ফ্যানটা পূর্ণ গতিতে ঘুরছে। রেগুলেটর কমিয়ে দিয়ে  মুখে ভাত পুরা অবস্থাতেই  খেঁকিয়ে উঠল রাকিব,

“তোর লবনের খেতা পুরি হালারপো? বাল ঐ রকি না কি জানি নাম, ঐ চেটের বালটা দুই চারটা কি ফাপর দিয়া গেলো আর তুইও ওর কথায় রাজি হয়ে গেলি কেন? মাসে মাত্র ১৫ দিন কাজ করলে ব্যাবসা হবে কেমনে? এর থেকে তো এখন মনে হচ্ছে আমার চাকরিটাই ভালো ছিলো।” 

রাকিবের ফুসতে থাকা অবয়বের দিকে তাকিয়ে হাসলো মিরাজ। মানিব্যাগটা রেখে দিলো ট্রাংকের উপর।  “ও আচ্ছা এই কারণে তুই এতক্ষণ চেতছোস। খাঁড়া, দুইটা মিনিট পরে বলতেছি, হিসাবটা করে নেই।” বলেই আবারও আগের মত ট্রাংকের পাশে রাখা বালিশে হেলান দিয়ে টাকাগুলো গুনতে শুরু করলো মিরাজ। সাথে মৃদু গলায় উচ্চারণ করলো, “সাতাইশ.. সাতাইশ আর পাঁচে কত..বত্রিশ..আর তিনে…?” 

গোনা শেষ করে টাকাগুলো মানিব্যাগে রেখে আবারও রাকিবের দিকে ফিরলো সে, “এইবার কো, কি হইছে তোর? এত চেতছোস কেন?”

রাকিবের খাওয়া ততক্ষণে শেষ হয়ে এসেছে। সে রান্নাঘরে গিয়ে থালাটা রেখে আসলো। তারপর চোখমুখ বিকৃত করে বলল, “রকি ভাই লোকটা কোন চ্যাটের বাল কো তো। ওর কথায় এত নাচার কি আছে। আইসা দুই চারটা কিসের ফাপর দিয়া গেলো আর তুই ওমনি ব্যাবসা পাতি গুটায় হাঁটা ধরলি। ওরে তো সকালেও দুইশো টাকা ধরায় দিছিলি। তাইলে আবার এই কাহিনী করে কেন?”

একটা রেজিস্টার্ড খাতায় লাভের অংকটা লিখে ফেললো মিরাজ। তারপর ওটা বন্ধ করে খুব শান্ত ভঙিতে বলল, “ভাইরে যেই জিনিস তুই বুঝোস না সেইটা নিয়া হুদাই লাফাইতে যাইস কেন? তোর কি মনে হয় আমি এমনি এমনি রাজি হইছি?”

গামছা দিয়ে মুখটা ভালোমত মুছে আবারও আগের জায়গায় রাখলো রাকিব। তার অবয়বে ফুটে উঠেছে কৌতুহল। মিরাজ বলে চলল, “রকি ভাই যে কি জিনিস তোর কোন আইডিয়াও নাই দোস্ত। এই লোক হচ্ছে সরাসরি কালাম ভাইর ডান হাত। তুই চিন্তাও করতে পারবিনা তার নামে এখনও চারটা মার্ডার কেস চলমান আছে। কেউ তার বালটা পর্যন্ত ছিড়তে পারেনা। আর তুই কস তার লগে লাগতে? ব্যাটা জান নিয়াও পালাইতে পারবিনা।” বলেই দম দিবার জন্য থামলো মিরাজ।  চোখ বড় করে তাকালো রাকিব, “চারটা মার্ডার কেস?”

“হু। কেন, তোর মনে নাই কয়দিন আগে  ঐ যে গলির মোড়ে সেলুনের পোলাটার চোখের ভিতর টেস্টার ঢুকায় দিছিলো, ঐটাও তো করছিলো রকি ভাইর চেলাগুলাই। একটারও কি বিচার হইছে?” বলেই রাকিবের মুখের দিকে তাকালো মিরাজ। রাকিব মাথা নাড়লো, “কি জানি দোস্ত। অত খবর কে রাখে।”

“এই রকি ভাইরে সরাসরি প্রটেক্ট করে  কালাম ভাই। আর কালাম ভাই যে কার ডান হাত তা তো তুই জানোসই।” 

রাকিব অমনোযোগীর মত মাথা নাড়ে। জবাব দেয়না। ইউটিউবে কি যেন একটা ভিডিও দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।  মিরাজও আর কথা না বাড়িয়ে  ট্রাংক থেকে বের করে আনে ল্যাপটপটা। নতুন কি যেন একটা মুভি এসেছে। নামাতে হবে ওটা।

সাত।

এই নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বেজে উঠলো মোবাইলের এলার্মটা। মিরাজ স্লাইড করে বন্ধ করলো ওটা। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো নয়টা দশ বাজে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লো সে। পাশেই তাকিয়ে দেখলো রাকিব এখনও মরার মত ঘুমাচ্ছে।

“কিরে বোকাচোদা এখনো ঘুমাস কেন?  কয়টা বাজে কোন হুস আছে তোর? কামে যাওয়ার লাগবেনা। উঠ হালারপো?” বলেই রাকিবকে জোড়ে একটা ধাক্কা দিলো সে। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো, জেগে আছে রাকিব।

“বাল, নয়টাও  মনে হয় বাজেনাই।” আড়মোরা ভেঙে বলল রাকিব, “আধাঘন্টা পরে যাই দোস্ত। ঘুমটা খালি লাগতেছে চোখে।”

“হো রে জমিদারের পোলা, সারাদিন খালি ঘুমা। সকালে বুয়া আসেনাই,  আজকে বাইরে খাওয়ার লাগবে। উঠে  রেডি হো। তাড়াতাড়ি কর হালার পো। দেরি করে গেলে রকি ভাইর লোকজন আসে জায়গা দখল করে নিবে।”

মিরাজের তাড়া খেয়ে  উঠে পড়ে রাকিব। আড়মোরা ভেঙে এগিয়ে যায় বাথরুমের দিকে। দ্রুত প্রাতকার্য সেরে এসে দেখে মিরাজ ততক্ষণে মালপত্রগুলো সব গুছিয়ে ফেলেছে।

“কই রে জমিদারের পোলা কাম হইলো তোর?” 

“হো দোস্ত আমি রেডি।” শার্টটা গায়ে দিয়ে বলে রাকিব।

মিরাজ চেঁচিয়ে উঠে, “ওমনে খাঁড়ায় আছিস কেন। এইদিক আয়। হাত লাগা, তাড়াতাড়ি এই দড়িটায় একটা গিট দে।”

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে জিনিসপত্র সব গুছিয়ে  বেড়িয়ে পড়ে রাকিব আর মিরাজ। নিচে নেমেই পাশের একটা খাবার হোটেলে ঢুকে পড়ে প্রাতরাশ সারার জন্য।

আট

“আপনেরা কি বেচেন হেনে?”

কাস্টমারের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে লোকটার দিকে তাকালো মিরাজ। নতুন আরেকজন কাষ্টমার এসেছে। নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলো, “মাস্ক বেচি, পাঁচ পিছ মাস্ক দশ টাকা। নিবেন?”

লোকটা জবাব না দিয়ে মাস্কগুলো এদিক সেদিক নেড়ে দেখলো। মিরাজ ব্যাস্ত হয়ে পড়লো অন্য কাস্টমারদের নিয়ে।  লোকটা ততক্ষণে বেশ কিছু মাস্ক  নেড়ে  চেড়ে আবারও  মিরাজের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো,

“খালি কি মাস্কই বেচেন। লগে আর কিছু রাখেন না?”

“কি লাগবে আপনার?” বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো মিরাজ। পরক্ষণেই অবশ্য নিজেই সাজেস্ট করলো, “হেডফোন লাগবে? ঐ পাশে আছে হেডফোন। ঐ রাকিব, হেরে হেডফোন দেখা তো ভালো দেইখা। স্যামস্যাংয়ের গুলা দিস।”  লোকটা সঙ্গে সঙ্গে ব্যাস্ত হয়ে বললো,

“না না ভাই হেডফোন লাগবেনা আমার। মানে বলতেছিলাম কি ” গলাটা খানিকটা নিচু করলো সে। প্রায় ফিসফিসে গলায় বলল, “এইগুলা  ছাড়া আর কিছু বেচেন না? গুটি   রাখেন না সাথে গুটি?”

“কি রাখি বললেন?” প্রায় চেঁচিয়ে বলল মিরাজ। লোকটা ফ্যাক করে হেসে দিলো, “ইয়াবা বেচেন না?”

 মিরাজ সরাসরি তাকালো লোকটার দিকে।  খেকিয়ে উঠলো সে, “ভাই আপনি যান তো। বিরক্ত কইরেন না। গাঞ্জাগুঞ্জা ঐসব বেচিনা  আমরা। আপনি অন্য কোথাও যান।”

“আরে ভাই চেতেন ক্যা? খাড়ান না কথা আছে  আপনাগো লগে।” ব্যাস্ত হয়ে বলল লোকটা।  একটা হেডফোনের প্যাকেট  তুলে নিলো হাতে। “এডি বেচে কয় টেকা লাভ হয় দিনে?”

মিরাজ জবাব দিলোনা। সে মনযোগ দিলো অন্য কাস্টমারের দিকে। লোকটা তবুও  বলে চলল, “একটা বেইচা সর্বোচ্চ পঞ্চাশ টেকাও তো মনে হয় লাভ হয়না। এডি বেচে চলে কেমনে আপনাগো? আরে মিঞা ব্যাবসা করবেন ব্যাবসার মত। হুনেন মিঞা  আপনাগোরে একটা জিনিস দিতেছি, বেইচেন ঐটা। দেখবেন দৈনিক কম করে হইলেও  পাঁচ হাজার টেকা করে কামাইতে পারবেন। বুঝছেন কি কইছি?”

মিরাজ তাকালো লোকটার দিকে।  তার চোখে সন্দেহের দৃষ্টি। 

“কি জিনিস?” চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করলো সে। 

লোকটার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। পকেট থেকে কিছু একটা বের করে দেখালো মিরাজকে “এই দেখেন জিনিস। পারবেন বেচতে? মিঞা এই জিনিস  বেচতে পারলে  লাভ আছে। এক পিছ বেচবেন  পাঁচশ টেকা করে কমিশন পাবেন।”

মিরাজ হাতে নেয় জিনিসটা। রাকিবও কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে আসে। 

“আরে মিঞা বোকাচোদা হয়ে আর কয়দিন থাকবেন। দেখেন না বেইচা।   মাত্র ছয় মাস বেচবেন, আমি লেইখা দিতেছি ছয় মাস পর ঢাকা শহরে আপনাগো বাড়ি গাড়ি সব হইবো। বুঝছেন কি কইছি?” জিনিসটা আবারও নিজের কাছে ফেরত  নেয় লোকটা। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে খুব দ্রুত ওটা নিজের পকেটে পুরে রাখে। 

মিরাজ কি যেন চিন্তা করে ফট করে বলে বসলো,

“হুর মিঞা। এডি বেচলে পুলিশে যদি ঝামেলা করে?”

লোকটা খ্যাক করে হেসে দিলো। “পুলিশ কি আপনেগো সতীন  লাগে? আর কোন কাম নাই পুলিশের? আরে মিঞা পুলিশের বাপ আমরা।  এই মহল্লার যত পুলাপাইন  আছে সব আমাগো ভাই ব্রাদার । ঐযে কালাম ভাই, রকি ভাই হেরা তো সব আমাগো কাছেই মাল নেয়। কালাম ভাইর তো নিজেই ডিলার। আর আপনে  আছেন মিঞা পুলিশ নিয়া।”

মিরাজ দ্বিধা আর শঙ্কা নিয়ে তাকায় রাকিবের দিকে। রাকিব চট করে বলে বসে, “না না ভাই ঐসব মাদকদ্রব্য আমরা বেচতে পারবোনা। এই রিস্কি কাজের মধ্যে আমরা নাই।”

লোকটা তাকালো রাকিবের দিকে। চট করে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলো। তার পিঠে আলতো করে একটা চাপড় মেরে বলল ” সুযোগ হারাইয়েননা বড় ভাই। লুইফা নেন। টাকা কামানের তো এইটাই বয়স। এই বয়সে না কামাইলে কখন কামাইবেন? বুইড়া বয়সে? বুইড়া বয়সে গিয়া আল্লা বিল্লার নাম নিবেন।” 

লোকটার কথার মাঝেই পাশ দিয়ে একটা পাজেরো গাড়ি বেপরোয়া গতিতে ছুটে গেলো। লোকটা সেদিকেই ইঙ্গিত করে বলল, “এই যে দেখতাছেন গাড়িটা, এই রকম একটা দামি গাড়িতে করে কয়দিন পর গোটা ঢাকা শহর ঘুরবেন। কপালে থাকলে এক সময় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নির্বাচনেও খাড়াইবেন মিঞা।” বলেই  মিরাজের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিলো সে। “এই সুযোগ হারাইলে পরে কিন্তু পস্তাইবেন কইলাম।”

মিরাজ আড়চোখে তাকলো রাকিবের দিকে। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে রাকিব চট করে জিজ্ঞেস করলো, “ভাই আমরা চিন্তা ভাবনা করে কয়দিন পরে জানাই?”

লোকটা  হেসে ফেললো, ” এই তো লাইনে আইছেন।   সমস্যা নাই, বাসায় গিয়া আপনেরা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কইরেন। ভাবনা চিন্তা কইরা ডিশিসন নিয়েন। এই যে নেন আমার কার্ড।” বলেই মানিব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের বরে এগিয়ে দিলো রাকিবের দিকে, “সিদ্ধান্ত নিয়া আমারে এই নাস্বারে ফোন দিয়েন। খালি কইয়েন, গোলাপ ভাই আমরা ওভার ব্রিজের নিচে মাস্ক বেচি। তাইলেই আমি চিনতে পারমু।”  রাকিব ইতস্তত করে হাতে নিলো কার্ডটা। লিখাগুলো মনযোগ দিয়ে পড়লো।  এই সুযোগে লোকটা  টেবিলের উপর থেকে একটা হেডফোন তুলে নিলো। “ভাইজান এই হেডফোনটা কিন্তু আমার পছন্দ হইছে । নিলাম আমি।” বলেই হেডফোনটা পকেটে ঢুকালো। যাবার আগে আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিলো, “চিন্তা ভাবনা কইরা ফোন দিয়েন কিন্তু। আপনাগো ফোনের অপেক্ষায় থাকমু আমি।” বলেই হাঁটা দিলো সে। দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতেই মিরাজ বিড়বিড় করে বলে উঠলো, “সালা মাদারচোদ।  আইছে আমাগো কাছে গাঞ্জা বেচতে। লোক চিনেনা হালায়। কি কস রাকিব?”

রাকিব সম্মতি জানালো, “হো দোস্ত। ঠিক কইছোস।”

নয়

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রাস্তার দুপাশে ল্যামপোষ্টের বাতিগুলো সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। চারদিকে লোকজনের কোলাহল বাড়ছে।  মিরাজ একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ল্যামপোস্টে হেলান দিয়ে সারাদিনের উপার্জিত টাকাগুলো গুনতে শুরু করেছে। ভালোই বিক্রি হয়েছে আজ। অন্তত হাজার দুয়েক  লাভ তো থাকবেই। টাকাগুলো টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে রাকিবের উদ্দেশ্যে হাক ছাড়লো,

“কিরে হালারপো, সারাদিনে কয়টা মাল বেচলি?” 

রাকিব তার পুরোনো গেঞ্জিটা দিয়ে হেডফোনগুলো ঝাড়া দিতে ব্যাস্ত। মিরাজের ডাক শুনে  জবাব দিলো,

“এখন পর্যন্ত উনিশটা গেছে দোস্ত।”

মিরাজ লম্বা একটা টান দিলো সিগারেটে। ধোয়ার কুন্ডলী বাক খেয়ে উড়ে গেলো ট্রোপোস্ফিয়ারে। সেই ধোয়ার দিকে তাকিয়েই উৎসাহ দিয়ে বলল,

“আরো যাবে দোস্ত। টেনশন লইসনা। খালি সন্ধ্যাটা নামতে দে ।”

“হো দোস্ত ঐটাই ভাবতাছি..” বাক্যটা পুরোটা শেষ করতে পারলোনা রাকিব। আচমকা তার তার দৃষ্টি আটকে গেলো  ওভারব্রিজের উপরে। তড়িঘড়ি করে বলে উঠল, “দোস্ত দেখ তো ঐটা রকি ভাই না? আরে তাকা না এইদিকে। ঐটা দোস্ত কালাম ভাইর চেলা টা  রকি ভাই না?”

চট করে ওদিকে তাকালো মিরাজ,

“হো দোস্ত রকি ভাই  তো মনে হইতাছে। লগে ঐটা কে? সকালের ঐ লোকটা…”

“হো গাঞ্জা বিক্রেতা গোলাপ ভাই। সকাল বেলা যেই লোকটা গাঁজা বিক্রির জন্য কার্ড দিয়া গেছিলো।” মিরাজের কাছ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে উত্তরটা দিলো রাকিব। পরক্ষণেই চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কাহিনী কিরে দোস্ত। রকি ভাইর লগে ঐ বাইনচোদে আবার আসে কেন? দেখ তো  কি কয়?”

দশ

“কি অবস্থা ভাইজানেরা। বেচাকেনা কেমন চলতাছে?” হাসিটা চওড়া করে বলল রকি ভাই। রহস্যময় সেই হাসির দিকে তাকিয়ে মিরাজ সংক্ষেপে জবাব দিলো,

“এই তো ভাই। চলতেছে আরকি। হঠাৎ গরিবের দাওয়ায় পা দিলেন। ব্যাপার কি ভাই?”

মিরাজের টেবিলে সাজিয়ে রাখা লাইটারটা তুলে নিলেন রকি ভাই। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে বললেন, “আপনাগো লাইগা তো মিঞা  ভালো খবর আছে।”

বলেই আয়েসি ভঙিতে সিগারেটে টান দিলেন তিনি। পরক্ষণেই  মিরাজের কৌতুহলী চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুনেন মিঞারা, আইজকা থেইকা আপনাগো আর চান্দা দেওন লাগবোনা।  কালাম ভাইর নির্দেশ, এহন থেইকা আপনেরা প্রত্যেকদিন এইখানে বইবেন, কেউ কিচ্ছু কইবোনা, বুঝছেন?” বলেই রহস্যময় ভঙিতে হাসলেন তিনি। 

মিরাজ কয়েক মুহূর্ত  সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকলো রকি ভাইর দিকে। খুটিয়ে খুটিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো নতুন করে আবার কোন চালটা দিচ্ছে ধুরন্ধর এই লোকটা।

“কি মিঞারা খুশি হননাই?” চওড়া হাসিটা হেসে জিজ্ঞেস করলেন রকি ভাই। মিরাজ খুব সন্তর্পণে জবাব দিলো, “হু ভাই খুশি হইছি।”

রকি ভাই পকেট থেকে নতুন কেনা স্মার্টফোনটা বের করলেন,

“এই লন কালাম ভাই নিজে আপনাগো লগে কথা কইবে। লন মিঞা কথা কন।” বলেই মোবাইল ফোনটা এগিয়ে দিলেন রকি। 

ফোনটা কানে লাগালো মিরাজ

“ভাই স্লামালিকুম।” 

ওপাশ থেকে ভরাট কন্ঠস্বরটা শোনা গেলো,

“ওয়ালাইকুম। তোমাগো ব্যাবসা পাতি ঠিকঠাক চলতাছে তো?”

“হু ভাই।”

“তোমাগো চান্দা মাফ কইরা দিছি, শুনছো তো রকির কাছে।”

“হু ভাই। আপনাকে ধন্যবাদ।”

“থাক থাক ধন্যবাদ দিতে হবেনা। আরে মিঞা তোমাগো স্বার্থই তো আমি দেখমু তাই না? বিনিময়ে আমার স্বার্থটাও তোমরা দেখবা, ঠিক কিনা?”

“হু ভাই।”

“শুনো তাইলে, এইবার কামের কথা কই। তোমাগো কাছে গোলাপ নামে একটা লোকরে পাঠাইছি, দেখছো তো?”

“হু ভাই দেখছি।”

“হে তোমাগোরে কিছু  মাল দিবে। এইগুলা রাইখা দাও। ব্যাবসার পাশাপাশি এইগুলাও বেইচো বুঝলা।  ভালো কমিশন পাবা।”

কালাম ভাইর কথা শুনে চমকে উঠলো। কি বলবে ভেবে পেলোনা।   ওপাশ থেকে কালাম ভাই ধমক দিলেন,

“অত কি ভাবো মিঞা। নিশ্চিতে ব্যাবসা করো। থানা পুলিশ সব আমি দেখমু বুঝছো?”

“হু ভাই বুঝছি। কিন্তু ভাই…।”  বাক্যটা শেষ করতে পারলোনা মিরাজ।  তার আগেই ওপাশ থেকে কালাম ভাই ফোন রেখে দিলেন। মিরাজ অসহায়ের মত ফোনটা এগিয়ে দিলো রকি ভাইর দিকে। তাদের চোখে মুখে তখন খেলা করছে বিজয়ের হাসি।

এগারো

“তার মানে শেষ পর্যন্ত আমরা এখন মাদক বেচবো?” চোখ বড় বড় করে জানতে চাইলো  রাকিব। মিরাজ তার মাস্কগুলো ঝাড়া দিয়ে বলল,

“কিচ্ছু করার নাই দোস্ত। বেচতেই হবে। কালাম ভাই স্বয়ং নির্দেশ দিছে। তার কথা না শুনলে ব্যবসা তো দূরের কথা তুই এই এলাকাতেও থাকতে পারবিনা ।” 

রাকিব চেঁচিয়ে উঠলো, “থাকলাম না নাহয় এলাকাতে। অন্য কোথাও গিয়ে ব্যাবসা করতে পারবোনা নাকি?”

রাকিবের কথা শুনে চোখ মুখ বিকৃত করলো মিরাজ, ” এলাকা ছাড়ে যাবি কই? দেশের যেখানেই যাস কালাম ভাইর পার্টির পোলাপাইন তোরে ঠিকই  খুঁজে বাইর করবে। আর একবার যদি তোরে পায় তাইলে সোজা পেটের ভিতর স্ক্র ড্রাইভার ঢুকায় দিবে । তার থেকে বরং কালাম ভাই যা কইতাছে সব মানে নে? একটা কথা মনে রাখবি দোস্ত, এই ধরণের লোকগুলার সাথে কখনো লাগতে যাবিনা। এদেরকে যত পারবি  খুশি রাখে চলবি,  দেখবি জীবনে কিছু করতে পারবি। বুঝছোস কি কইছি?”

“তাই বলে ওরা যা বলবে তাই শুনতে হবে?” 

মিরাজ বিরক্ত মাখানো গলায় ধমক দিলো, “না শুনতে চাইলে ব্যাবসা বাদ দিয়া অন্য কিছু করে খা। এই ব্যাবসা করতে চাইলে কালাম ভাইর কথা শুনতেই হবে।”

রাকিব হাল ছাড়লো। পরক্ষণেই বিমর্ষ বদনে হাক ছাড়তে লাগলো। “ঐ হেডফোন লাগে চল্লিশ  টাকা..ব্র্যান্ডের দামি দামি হেডফোন মাত্র চল্লিশ টাকা…।”

পাশ থেকে মিরাজ বলল, “ঐ একটু চুপ কর।  রকি ভাই আবার ফোন দিছে, দেখি কি কয়।”

“হ্যালো ভাই স্লামালিকুম…জ্বি ভাই…আচ্ছা ঠিক আছে ভাই… না না সমস্যা নাই…..।”

মিরাজ ফোন রাখতেই রাকিব জিজ্ঞেস করলো,

“কি কইলো হেই লোক?”

“কি আর বলবে বাল” দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মিরাজ, “বাইনচোদে কয় আজকে সন্ধ্যায় নাকি গোলাপ ভাইর পোলাপাইন আইসা মাল দিয়া যাবে। কালকে থেকে ব্যাবসা শুরু করার লাগবে।

রাকিব বিমর্ষ মুখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পরক্ষণেই আবারও হাক ছাড়তে লাগলো” “বাইছা নেন..দেইখা নেন…হেডফোন চল্লিশ টাকা..”

বারো।

সকালের তীব্র রোদ এসে পড়ছে মিরাজের চোখেমুখে। জানালার পর্দাটা একটানে সরিয়ে ফেললো সে। ঘুমটা কেটে গেছে। বিরক্তিতে  চোখমুখ কুচকে উঠেছে তার, “ঐ হালারপো  রাকিবের  বাচ্চা, এত সকালে জানালা খুলছোস কেন?”

বলেই খেয়াল করলো সে  রাকিব  ঘরে নেই। এক লাফে উঠে পড়লো মিরাজ । মোবাইলটা টেনে নিয়ে সময় দেখলো, সাড়ে আটটার মত বাজছে। বিছানার পাশে হাতড়ে গেঞ্জিটা খুঁজে নিলো। ওটা গায়ে চাপাতে গিয়েই চোখ গেলো দরজার দিকে। রাকিব প্রবেশ করছে রুমে।

“কিরে এত সকালে কই গেছিলি?”

“একটু নিচে গেছিলাম দোস্ত। চা খাইতে।” কৈফিয়ত দিলো রাকিব, “কালকে রাতে বুঝছোস টেনশনে আমার একফোটা ঘুম হয়নাই।  সারারাত খালি এইপাশ ঐপাশ করছি। গোলাপ ভাইর কথা শুনার পর থেকে বাল আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে।”

“ক্যান কি হইছে?”  হাই তুলে জিজ্ঞেস করলো মিরাজ । রাকিব বিরক্ত মুখে বলল,

“কালকে রাতে মালগুলা দিবার সময় গোলাপ ভাই কি বলে গেলো মনে নাই তোর?”

“হু মনে আছে তো। চার লাখ টাকার মাল আছে এইখানে। সাবধানে রাখতে বলছে।”

“এই জন্যেই তো বাল টেনশনটা।” খেঁকিয়ে বলল রাকিব। “এতগুলা টাকা জীবনে একসাথে চোখে দেখছিস কখনো? মালগুলা যদি নষ্ট হয়ে যায়, পুলিশ  আসে যদি নিয়ে যায়। কি বিপদটায় না পড়ব, চিন্তা করছিস?”

“হু করছি।” মুখ তুলে বলল মিরাজ। 

“তাইলে তুই বল, টেনশন করবোনা কেনো?”

“টেনশন তুই এই জন্যই করবিনা কারণ  কালাম ভাই আমাদের পাশে আছেন। কোন ধরণের সমস্যা সৃষ্টি হইলে   কালাম ভাই নিজে আসে ট্যাকেল দিবেন।”  ভরসা দিবার ভঙিতে কথাগুলো বললো মিরাজ। রাকিব অন্যমনষ্ক গলায় বলল, “কি জানি দোস্ত, কি করে।” 

পরক্ষণেই সে তাড়া দিলো, “নে এইবার রেডি হো। কাজে যাওয়ার লাগবে।”

“হো খাড়া। রেডি হচ্ছি।” বলেই উঠে পড়লো মিরাজ। টেবিল থেকে টুথপেষ্টটা নিয়ে এগিয়ে গেলো বেসিনের দিকে।

তেরো

“সূর্য তখন  মাথার ঠিক উপরে অবস্থান করছে। দিনের সর্বোচ্চ উত্তাপটুকু উদার ভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীতে। কড়া রোদে রাস্তার পিচ পর্যন্ত গলে যায় এরকম অবস্থা। 

রাকিব উদাস ভঙিতে তার দোকানের সামনে বসে একটার পর একটা সিগারেট টেনে যাচ্ছে। কাস্টমারের চাপ এখন নাই বললেই চলে।   মিরাজের প্রোডাক্টগুলোও এখন তাকেই সামলাতে হচ্ছে। মিরাজকে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ওপারে একটা চায়ের দোকানে বসে  কলা  আর রুটি দিয়ে কি যেন খাচ্ছে। 

রাকিব একটা ইয়ারফোন তুলে নিলো টেবিল থেকে। স্মার্টফোনটা বের করে ওটা কানেক্ট করলো। টিকটক এপসটা চালু করে সবে স্ক্রল   শুরু করলো আর ঠিক তখনই  দুজন কাস্টমার একসাথে এসে হাজির হলো তার দোকানে।

“ভাই কত করে বেচেন  হেডফোন?”

“চল্লিশ টাকা।” মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে জবাব দিলো রাকিব।

“কম নাই?” মোবাইল বের করে একটা হেডফোন কানেক্ট করলো কাস্টমার। রাকিব গলাটা উচিয়ে বললো,

“কম হবেনা ভাই, এক দাম।” 

পাশের ভদ্রলোক একটা হেডফোন তুলে নিয়ে খানিকটা ঝুকে আসলেন সামনে। গলাটা যতটা সম্ভব নিচে নামিয়ে রাকিবের চোখের দিকে তাকিয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে প্রশ্নটা করলেন, “গুটি বেচেন নাকি ভাই, গুটি?”

রাকিব সোজাসুজি তাকলো লোকটার দিকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য দ্রুত কি যেন চিন্তা করে নিলো। তারপর লোকটার দিকে তাকিয়েই নির্লিপ্ত ভঙিতে জবাব দিলো, “না ভাই, ঐগুলা বেচিনা।”

ভদ্রলোক প্রায় ফিসফিসে গলায় বললেন, “আরে মিঞা থাকলে দেও না। কাস্টমার তো আমরা।”

রাকিব আবারও বলল, “না ভাই, বললাম তো ঐসব নাই।”

ভদ্রলোক মনে হয় খানিকটা হতাশ হলেন। হেডফোনটা আগের জায়গাতেই রেখে দিলেন। মুখ বেজার করে  হাঁটা ধরলেন অন্যদিকে। কয়েক কদম দূরে যেতেই আচমকা রাকিব  পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠলো,

“এই যে ভাই। ঐ হ্যালো ভাই, আসেন নিয়া যান।”

লোকগুলো পিছনে তাকালো। তাদের মুখে  ফুটে উঠলো নির্মল হাসি। 

“বসেন ভাই। এইখানে বসেন। কতগুলা লাগবে?  বসেন একটু।” বলেই মিরাজকে ফোন দিলো রাকিব।

চৌদ্দ

মিরাজ দুই কাপ চা খেয়ে দোকানের অতিকায় টিভিটাতে  সবে বাংলাদেশ জিম্বাবুইয়ে সিরিজের  টি২০ দেখতে শুরু করেছে। এরকম সময় ফোনটা বেজে উঠায় বেশ বিরক্তই মনে হলো তাকে।  অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা বের করলো পকেট থেকে,

“হ্যাঁ রাকিব বল…হো আমি একটু পাশেই আছি..খেলাটা দেখতেছি দোস্ত…কাস্টমার আসছে নাকি..কিসের?…বলিস কি?..সত্যি?..দাঁড়া দাঁড়া আমি এক্ষুণি আসতেছি।”

মিরাজ চায়ের বিলটা দিয়ে উঠে পড়ল। পাশের একটা পাবলিক টয়েলেটে গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সেরে দ্রুত হাঁটা ধরলো ওভারব্রিজের দিকে। তখনও কি সে জানতো তার জন্য  কত বড় চমক অপেক্ষা করছে রাস্তার ওপারে?

পনেরো

ওভারব্রিজের উপর থেকেই লোকগুলোকে দেখতে পেলো মিরাজ। খটকাটা তখনই লাগতে শুরু করেছিলো। নিশ্চিত হলো দোকানের সামনে এসে। তাদের দুজনকেই চিনে ফেলেছে সে। কয়েক মুহূর্তের জন্য হুৎপিন্ডটা কেঁপে উঠেলো তার। বুঝে ফেলেছে মিরাজ,  এখন আর পালিয়ে যাবার কোন উপায় নেই। বড় দেরি করে ফেলেছে সে। 

রাকিব তখনও কিছুই বুঝতে পারেনি। সরল বিশ্বাসে সে  নেশাদ্রব্যগুলো বের করে আনছে টেবিলে নিচে থাকা গোপন ড্রয়ার থেকে।

উল্টোপাশে দাঁড়িয়ে মিরাজ তড়িঘড়ি করে কি  যেন ইশারা করলো তাকে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপই করলোনা রাকিব। ওগুলো বের করে তুলে দিলো লোকদুটোর হাতে। আর ঠিক তখনই নিজের ভুলটা বুঝে ফেললো রাকিব।

কাস্টমার দুটো খুব সাবলিল ভঙিতে কোর্টের পকেট থেকে বের করে আনলো রিভলবার দুটো। রাকিবের দিকে তুলে ধরে ঠান্ডা মাথায় বলল, “এখান থেকে একটুও পালাবার চেষ্টা করবেনা। আমরা আইন শূঙ্খলা বাহিনীর লোক। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এখানে অভিযানে চালাতে এসেছি। মাদকদ্রব্য বিক্রীর অপরাধে তোমাদের দুজনকে অ্যারেস্ট করা হলো।”

বোকার মত লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলো রাকিব। চোখে বিস্ময়, আতঙ্ক। ততক্ষণে মিরাজকেও ধরে ফেলেছে তারা। তার চোখেমুখে নেমে এসেছে রাজ্যের হতাশা।

ষোল

রাকিব বিমর্ষ মুখে বসে আছে পুলিশের প্রিজন ভ্যানে। তার পাশেই বসেছে মিরাজ। দুজনের কোমর দরি দিয়ে বাধা। তাদের ঠিক সামনের বেঞ্চে বসে আছে কয়েকজন পুলিশ কন্সটেবল। রাকিব সেদিকেই তাকিয়ে গলাটা খানিকটা নিচু করে বলে বলল,

“দোস্ত আরেকবার ফোন দে না কালাম ভাইরে। দেখ না  ধরে কিনা।”

“আরে বললাম তো কালাম ভাই ধরতেছেনা। ঐ পুলিশটারে দিয়া তিনবার ফোন দেওয়াইলাম। না ধরলে এখন কি করার।” অনেকটা রেগে গিয়ে কথাটা বলল মিরাজ। তবে পরক্ষণেই শান্ত হয়ে আসলো গলা, “শুন দোস্ত, এত টেনশন নিবার কিছু হয়নাই। রকি ভাইর সাথে  একটু আগেই ফোনে কথা হইছে আমার। ভাইয়ে বলল আধাঘন্টার মধ্যে নাকি দলবল নিয়ে থানায় আসতেছে।” 

রাকিব মাথা নাড়লো। বিড়বিড় করে কি যেন বলল শোনা গেলোনা। প্রিজন ভ্যানে আবারও নেমে এলো নিরবতা। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই  নিরবতা ভেঙ্গে রাকিব আবারও মুখ খুললো,

“আচ্ছা দোস্ত আমাদের মালগুলা কই আছে বলতে পারিস? পুলিশ কি নিয়ে গেছে নাকি?”

“হু।  জব্দ করছে।” জবাব দিলো মিরাজ,  “তবে রকি ভাই বলছে ঐগুলার জন্য টেনশন করার দরকার নাই। সে নাকি সব ব্যবস্থা করে দিবে।”

রাকিব উদাস চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললো,

“করলেই ভালো।” 

সতেরো

“কি মিঞারা পরথম দিনেই ধরা খাইলেন? কইছিলাম একটু বুইঝা শুইনা বেচতে।  অহন ঠেলাটা বুঝতাছেন না?”

কটাক্ষের সুরে কথাগুলো বললেন রকি ভাই। রাকিবের সম্ভবত পছন্দ হলোনা কথাগুলো। সে চেঁচিয়ে উঠলো,

“ঠেলা বুঝবো মানে? কি উল্টাপাল্টা বলেন? এখন বিপদে পড়ছি দেখে ফাপড় লইতেছেন মিঞা?” রাকিব রেগে যাচ্ছা দেখে পাশ থেকে তাকে ইশারায়  থামিয়ে দিলো মিরাজ। সে নিজেই  অনুনয় করে বলল,

” যাই হোক ভাই, আমাদেরকে এইখান থেকে বাইর করার একটা ব্যবস্থা করেন এখন। হাজতের  ভিতরে থাকার পরিবেশ নাই। বাংলাদেশের হাজত, বুঝেনই তো কি অবস্থা।”

“আরে মিঞারা টেনশন লইতাছেন কেন? আমরা আছি না?” অভয় দিয়ে বলল রকি ভাই, “আমরা তো মিঞা আপনাগো পাশেই আছি। কালাম ভাইও পাশে আছে আপনাগো।  ভাইয়ে নিজে  থানায় আইতেছে  মিঞারা। একটু আগেই  কথা হইছে ভাইর লগে। কইলো আধা ঘন্টার মধ্যে নাকি থানায় আইবো।”

“থানায় আসতেছে কালাম ভাই?” চোখ কপালে তুলে কথাটা বললো মিরাজ। রকি ভাই কাধ নাড়লো। তার চোখ মুখ চকচক করছে।

“হো মিঞারা। আপনাগো লাইগা কালাম ভাইয়ে থানায় পর্যন্ত আইতেছে। কালাম ভাইর জায়গায় অন্য  কেউ হইলে জীবনে থানায় আইতো?  ভাইয়ে হইতেছে মাটির মানুষ বুঝলেন মিঞারা। কালাম ভাই আমাগো প্রাণের নেতা, এই মহল্লার জনমানুষের  নেতা। ঠিক কিনা কন?”

“হু ভাই ঠিক।” জবাব দিলো মিরাজ।

আঠারো

“সিরিয়াসলি দোস্ত।” গলাটা অনেকটা নিচে নামিয়ে  লোহার শিকগুলো আকড়ে ধরে বললো রাকিব, “এইটাই কি তোর সেই বিখ্যাত কালাম ভাই?”

“হো রে ব্যাটা। কেন কি হইছে? প্রথম দেখলি নাকি?” বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো মিরাজ। রাকিব সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো “হু  দোস্ত।  আমি তো ভাবছিলাম বাইনচোদে মনে হয় দেখতে  বিরাট গাঞ্জাখোরের মত হবে। এখন তো  দেখি পুরাই উল্টা। এই লোকের দেখতাছি মুখ ভর্তি দাড়ি, মাথায় টুপি দেখতে লাগে বিরাট বুজুর্গ।”

টেনশনের মাঝেও হেসে ফেললো মিরাজ। সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই রকি ভাই হন্তদন্ত হয়ে গারদের কাছে ছুটে এলো,

” ভাইজান। এইদিক আহেন।  কালাম ভাই আইসা পড়ছে আর চিন্তা নাই। আপনাগো লাইগা কালাম ভাই অন্তর কাঁনতাছে। কালাম ভাই অন্তত শিশুর মত, বুঝলেন? আহেন মিঞারা কালাম ভাইর পায়ের ধুলা নিয়া যান।”

কালাম ভাই নিজেই এগিয়ে এলেন গারদের কাছে। মিরাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো কালাম ভাইর চোখের নিচে পানি  চিকচিক করছে। সে বিস্ময় থ বনে গেছে। পাশে দাঁড়ানো রাকিবের চোখেও খেলে যাচ্ছে বিস্ময়।

“তোমার নাম তো মিরাজ তাই না?” রাকিবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কালাম ভাই। পাশ থেকে  রকি ভাই  মিরাজের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে ভুল সংশোধন করে বলল, “ভাই হে না তো, ঐ যে হের নাম মিরাজ।”

“ও আচ্ছা তুমি মিরাজ।” মিরাজের কাধে হাত রেখে বলল কালাম ভাই। “শোন মিরাজ তোমার কাছে যে আমি কত লজ্জিত তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবোনা। আমার কারণেই আজ তোমাদের এই দশা। আমার অন্তর ফেটে যাচ্ছে বুঝলে।  তোমাদের কথা ভেবে  আমার অন্তর কাঁদছে।” বলেই কালাম ভাই খানিকটা ডুকরে উঠলেন। “আমি কথা দিচ্ছি  তোমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধারের জন্য যা কিছু করার দরকার আমি করবো।  এখান থেকে বের  করেই তোমাদের দুজনকে আমি আমার দলের পদ দিয়ে দিব। তোমরা হবে আমার কর্মী।” বলেই তাদের দুজনের দিকে উচ্ছাসপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন কালাম। পাশে দাঁড়ানো রকির দিকে ফিরে বললেন, “শুনো রকি, এরা এখান থেকে  ছাড়া পেলেই তুমি কিন্তু সোজা এদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। বুঝেছো?”

রকি মাথা নাড়লো। পরক্ষণেই কালাম ভাইর কানের কাছে মুখ এনে  কিছু একটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলল, “ভাই ঐ কথাটা কইবেন না? ঐ যে টেকার কথাটা।”

কালাম ভাই  কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে চেয়ে থাকলেন রকির দিকে। তারপর আবারও বলতে শুরু করলেন, “শোন মিরাজ,  একটা কথা বলছি একটু মনযোগ দিয়ে শোন।  আমি তোমাদেরকে এখান থেকে বের করার জন্য যত রকম চেষ্টা করার  সব চেষ্টাই  করে যাব। তবে একটা ব্যাপার জানো কি,আমি খোলাখুলি ভাবেই বলছি।” বলেই একটু কেশে নিলেন কালাম ভাই,  “তোমাদের এখান থেকে উদ্ধারের জন্য আমার চেষ্টার কোন ত্রুটি থাকবেনা এটা ঠিক, তবে এটাও তো সত্য যে এই চেষ্টা করতে গিয়ে আমার বেশ কিছু অর্থ খরচ হয়ে যাবে। এই যে এখন  কত জায়গায় কত  পয়সা খাওয়াতে হচ্ছে তোমাদের জামিনের জন্য তা তো তোমরা জানোনা। এত খরচ তো আর আমার একার পক্ষে চালানো   সম্ভব না। আমি হতে পারি জনমানুষের নেতা, কিন্তু আমি তো আর বিত্তশালী না। তাই না?”

এটুকু বলেই থামলেন কালাম ভাই। অপেক্ষা করলেন মিরাজের উত্তর শেনার জন্য। মিরাজ চোখ তুলে তাকালো। সংশয় মাখানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কিরকম খরচ লাগতে পারে ভাই?”

কালাম ভাই একটু চিন্তা করলেন। পাশে দাঁড়ানো তার চেলা রকি ভাইর সাথে চোখাচোখি হলো একবার। পরক্ষণেই তিনি মিরাজের উদ্দেশ্যে বললেন, “এই ধরো লাখ দশেক তো লাগবেই। আপাতত তোমরা পাঁচ লাখ ম্যানেজ করে দাও বাকিটা আমরা দেখে নিচ্ছি।”

“দশলাখ টাকা!” চোখ বড়বড় করে চেঁচিয়ে বলল মিরাজ। তার দিকে তাকিয়ে  রকি ভাই  ধমক দিয়ে বললেন, “দশলাখ টাকা আইজকাইল কোন টাকা হইলো নাকি? দেশগেরামের জমি বেইচা টাকা  দিবেন মিঞারা।  কালাম ভাইর মত এতবড় নেতা আপনাগো লাইগা লড়াই করতাছে, আর আপনেরা মিঞা এই সামান্য কয়টা টেকা দিবার পারবেননা? আবার চেঁচায় কইতেছেন দশ লাখ টাকা। আরে মিঞারা ফোন লাগান গেরামে। যত তাড়াতাড়ি টেকা যোগার করবেন তত তাড়াতাড়ি বাইর হইবেন হেনে থেইকা।”

মিরাজ বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো রকি ভাইর দিকে। মুখের কথা হারিয়ে ফেলেছে সে। তার বিমর্ষ  দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করেই কালাম ভাই রকির দিকে ফিরে নিচু গলায় বললেন,

“আমার আসরের নামাজের টাইম হয়ে যাচ্ছে রকি। আর কতক্ষণ থাকবা এইখানে? চলো এখন।”

উনিশ

কালাম ভাইকে বেশ হাস্যজ্জল দেখা যাচ্ছে। সমবয়সী কয়েকজনকে সাথে নিয়ে কি নিয়ে যেন তুমুল আলোচনায় মশগুল তিনি। আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে একটা সিগারেটের এসট্রে। তাতে জমছে গুড়ো গুড়ো ছাই। 

কালাম ভাইর বাড়ির ছাদটা বেশ গোছানো। চারদিকে তাকালেই শিল্পের এক নিপুন ছোঁয়া লক্ষ করা যায়। ঐ যে সিড়িঘরের দেওয়ালে অপার্থিব সুন্দর চিত্রকর্মটা। ওটার দিকেই ইঙ্গিত করে বলছিলেন কালাম ভাই, “বুঝলেন সাদেক মিঞা, এই জিনিসগুলা আনাইছিলাম আমি আগের বছর জার্মানি থেইকা।  আপনে তো মিঞা গুলশানে বাড়ি করতাছেন শুনলাম। জার্মানি থেইকা আমার শালায় এই জিনিস ইমপোর্ট করে। লাগলে বইলেন। আরে মিয়া বাড়ি বানাইবেন একেবারে বাড়ির মত। মাল ঢালবেন, বাড়ি হইবো রাজ প্রাসাদ। এই বাড়ির পিছে কই কোটি টাকা খরচ করছি আইডিয়া করেন তো?”

সাদেক মিঞা কি যেন বলতে যাচ্ছিলো তাতে বাঁধা পড়লো রকি ভাইর অযাচিত প্রবেশে। কালাম ভাইর কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিসিয়ে বললো সে,

“ভাই একটা ভালো খবর আছে।” 

“বাব্বা তুমি দেখি মিঞা ভালো খবরও শুনাইতেছো ইদানিং। আমি তো আবার ভাবলাম কার পুটকির মধ্যে স্ক্র ড্রাইভার ঢুকায় দিয়া এখন আইছো রিপোর্ট জানাইতে। তা কও দেখি তোমার ভালো খবর।” ফূর্তির মেজাজে  বললেন কালাম ভাই। 

রকি তার গলাটা খানিকটা নিচে নামিয়ে বলল, “মুরগী দুইটা  তো ভাই  টেকা দিয়া দিছে ভাই।”

“কোন মুরগী?” জিজ্ঞেস করলেন কালাম ভাই।

“ঐ যে হেডফোন বেচে, মিরাজ আর কি জানি নাম।”

“ও আচ্ছা।” নিরাসক্ত গলায় উচ্চারণ করলো কালাম ভাই। রকি জিজ্ঞেস করলো, “ওগোরে কি হাজত থেইকা বাইর করে আনমু?”

“পুটকি মার ওটিরে।” বিশ্রী শব্দটা উচ্চারণ করলেন কালাম ভাই। পর মুহূর্তেই শান্ত গলায় বললেন, ” দুইটা মাস থাক না জেলের ভিতর। এত তাড়া কিসের। ওগোরে বইলা দাও যে প্রসেসিং হইতে দেরি হইতেছে। দুই মাস লাগবো বাইর করতে।”

“আচ্ছা ভাই।” জবাব দিলো রকি। কালাম ভাই আগের প্রসঙ্গ ধরেই বলে চললেন, “আর দেখো এর মধ্যে নতুন কোন মুরগী পাও কিনা।”

“জি আচ্ছা ভাই।” মাথা নেড়ে বলল রকি।  কালাম ভাই সেদিকে না তাকিয়েই আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন, “বুঝলেন সাদেক মিঞা, বাড়ি বানাইবেন কিন্তু মাল ঢালবেননা তা কিন্তু কইরেন না। আপনি হইতেছেন এই অঞ্চলের মানী লোক। আপনার বাড়ি হবে রাজপ্রাসাদের মতন…”  

কালাম ভাইর কথার মাঝখানে আবার বাধা দিলো রকি, “আরেকটা কথা ছিলো ভাই।”

রকির দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালেন কালাম ভাই। রকি  সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই বলে চলল, “দুইটা নতুন মাইয়া আইছিলো ভাই। কইলো ইউনিভার্সিটিতে নাকি নতুন  ভর্তি হইছে। গরীব ঘরের মাইয়া। ঢাকা শহরে খরচ চালাইবার পারেনা। আপনের দোয়া চায়।”

কালাম ভাই আচমকা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন। রকির  কানের কাছে মুখ এনে ধমকে উঠলেন, “খাংকির পোলা, কোন জায়গায় কি বলার লাগে হুশ থাকেনা? এত ভরা মজলিসে তোরে এই বালের খবর কইতে কইছে কেডায়?”

ধমক খেয়ে দমে গেলো রকি । ফিসফিসে গলায় বললো, “তাইলে মাইয়া দুইটারে  চইলা যাইতে কমু?”

কালাম ভাই নরম হলেন এবার। নিচু গলায় বললেন, “আসছে যেহেতু, থাক না। রাতে আমার সাথে দেখা করতে বইলো।”

রকির মুখে হাসি ফুটলো এবার। সাহস পেয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো, ” সাথে আর কোন ব্যবস্থা রাখবো নাকি ভাই? পানি পুনি কিছু?”

কালাম ভাইর মুখেও ফুটে উঠলো রক্তিম হাসি। রকির দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো, “আচ্ছা রাইখো।” বলেই পরমুহূর্তে তার চেলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি যাও তো এখন। আর ডিসটার্ব কইরো না। ভাইগো লগে একটা গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করতাছি। পরে আইসো তুমি।”

বলেই আবারও পুরোনো আলোচনায় মশগুল হয়ে উঠলেন কালাম ভাই। রকিও ইঙ্গিত পেয়ে ওখানে আর থাকলোনা। নিঃশব্দে নেমে এলো সিড়ি বেয়ে। তার এখন অনেক কাজ। দামি ব্রান্ডের হুইস্কি যোগাড় করতে হবে। মেয়ে দুটোকেও সব বুঝিয়ে  রেডি করতে হবে। কত কাজ। হাতে সময় বেশি নেই। একদম নেই।

Aneek Rashid (অনীক রশিদ)

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
0
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!