শেষ বিকেলে

ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ।
সাভার ।

নিখিল বাস থেকে নামলো । রাস্তাটি আর আগের মত নেই। ডেইরী গেটে দাড়িয়ে এখন আর রাস্তা, আকাশ আর গাছগাছালির মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া দেখা যায় না। রাস্তার সাইডে অসংখ্য বিলবোর্ড। বেশীরভাগ বিলবোর্ডেই রাজনীতিবিদ বারেক ভাইয়ের ছবি। সেই ছবিগুলোয় অনেকেই নিজেদের কবি প্রতিভা প্রকাশ করেছেন- সাভার বাসীর, সুখ-পিয়াসা;বারেক ভাইয়ের, ভালোবাসা ।

নিখিল ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলো । প্রায় ৭ বছর পর এই ক্যাম্পাসে আসা নিখিলের ।
ডেইরী গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই একটা দমকা বাতাস গায়ে এসে লাগতো নিখিলের । আজও তেমনটাই হলো। সেন্ট্রাল ফিল্ডে ছাত্ররা ফুটবল খেলছে। চারদিকে সবুজ গাছে ঘেরা মাঠটা , মাঝের একটা মাত্র গাছে লাল পাতা। ক্যাফেটেরিয়ার কোনাটায় সূর্য লুকানোর চেষ্টা করছে । কথা ছিল সকালে আসবার অথচ নিখিল এসে পৌছালো শেষ বিকেলে ।
ট্রান্সপোর্টের দিকে হাটছে নিখিল । সবার যখন চলে যাবার পালা তখন নিখিল এলো । কাম্পাস্টা ঠিক আগের মতই আছে, সমাজবিজ্ঞান ভবন, জহির রায়হান অডিটোরিয়াম, শহীদ মিনার, পিঠা চত্বর সবকিছু।এই ক্যাম্পাস কখনই পুড়নো হয় না, হয়ে যায় এখানের মানুষগুলো – মনে মনে ভাবলো নিখিল।

সন্ধ্যা হয়ে পড়লো প্রায়, ট্রান্সপোর্টের এদিকটায় মানুষজনের সমাগম। এক ঝাঁক তরুণতরুণীর সমাগম এখানটায়। কেউ চা চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে, কাউকে দেখা যাচ্ছে হাসতে হাসতে পড়ে যেতে, বাঁধনের ঐ কোনাটায় অনেকেই জটলা বেধে সিরিয়াস ভঙ্গিমায় কথা বলছে; মনে হয় কোন পলিটিক্যাল আলোচনা চলছে । কেউ কেউ এখানে দাদুর খোঁজ করছে । আর এতো শত মানুষের ভিড়েও কেউ কেউ সময় কাটাচ্ছে নিঃসঙ্গতায় ।
নিখিলের মনে পড়ে গেলো তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষটা অনেকটা একলাই পার করেছে । মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় সে ক্যাম্পাসে একলা ঘুরে বেড়াতো আর বেলা নামলে ট্রান্সপোর্টে বসে চা খেতো ।দূর থেকে একটা ছেলে দৌড়ে এসে নিখিলের উপর লাফ দিয়ে পড়লো।
নিখিল চমকে উঠলো কিছুটা
– রাজীব
– শালা এতক্ষনে আসছিস? তোর এই দেরি করে আসার স্বভাব গেলো না ।ভয় পেয়ে যাওয়া নিখিল কিছুটা স্বাভাবিক হলো ।
বেশ কিছুটা আনন্দিত রাজীবকে দেখে সে। কিন্তু এই আনন্দ প্রকাশের ভাষা তার নেই । পছন্দের মানুষগুলোকে কাছে পাবার আনন্দ কিভাবে প্রকাশ করতে হয় তা কখনই জানতে পারে নি সে ।
– যাক তাও ভালো যে আসছিস । আমরা তো ভেবেছিলাম আসবিই না ।
– আসলাম তো ।
– চল পরান দা’র দোকানে। সবাই ওখানে বসে চা খাচ্ছে, অবশ্য বাড়ি চলে গেছে অনেকেই।

একে একে সকলের সাথেই দেখা হলো। নিয়াজ, সুমন, টুম্পা, অথৈ , আবির । নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর কথা জিজ্ঞেস করা হলে নিখিল হয়তো এদের নামই বলবে । অথচ এদের সাথে দেখা প্রায় বছর খানেক পর। এই সকলের মাঝে আরও একজন মানুষকে খুঁজছে নিখিল। সচেতন মস্তিষ্কে নিজের কাছে স্বীকার করতে না চাইলেও নিখিল জানে- এই মেয়েটার জন্যই অবচেতন মন তাকে এতো দূর নিয়ে এসেছে।তুলি কিছুটা দূরেই দাড়িয়ে ছিলো । নিখিল ঠিক বুঝতে পারছে না নিজে গিয়ে কথা বলবে কিনা । তুলি নিজেই কাছে এসে বললো
– কেমন আছো?
কতো সহজেই না কথা শুরু করলো তুলি, কতো স্বাভাবিক ভঙ্গি । নিখিলের গলা ভার হয়ে আসছে। অথচ এই মুহূর্তের জন্য নিখিল অপেক্ষা করেছে প্রায় গত ১ মাস ।
– ভালো আছি, তুমি ??
– আছি কোনরকম ।
এতো দেরী করে আসলে যে ?নিখিল কি বলবে খুঁজে পেলো না । অথচ সে জানে তার কেন দেরী হয়েছে। সকাল ৭ টায় বান্দরবান থেকে বাসে উঠেছে সে। সেখান থেকে সাভার এসে পৌঁছাতে সময় লেগেছে ১১ ঘন্টা । কিন্তু এগুলো কিছুই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না নিখিলের।
– পূরানো অভ্যাস
– তাহলে আগের মতই আছো ?
– মনে হয়। কেন, তুমি বদলে গেছো ?
– সময়ের সাথে আমরা সবাই বদলে যাই নিখিল ।
কথার মাঝেই আবির এসে চা দিয়ে গেলো ।
– সিগারেট খাবি ( আবির)
– না ( নিখিল)
– ছেড়ে দিয়েছিস নাকি ? ( আবির)
– হ্যাঁ । আলসারের সমস্যা দেখা দিলো। না ছেড়ে উপায় নেই ।
– তুই খাবি তুলি, সিগারেট ? (আবির)
– একটা চড় দিবো তোরে, তোর ফাজলামো আর গেলো না , ইতর । ( তুলি )…

আবির, তূলি আর নিখিল এক সময়ের ৩ বেস্ট ফ্রেন্ড । ফার্স্ট ইয়ারে এই ৩ জন প্রতি রাতে এডভেঞ্চারে বের হতো। সেবার গ্রীষ্ম কাল, ক্যাম্পাসে শুরু আম চুড়ির প্রতিযোগিতা । সবাই যে যেখান থেকে পাড়ে আম কুড়োয়। তবে টিচার্স কোয়াটারের ওদিকটায় কেউ যায় না। ঐ গুলো শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু আবির ঠিক করলো এবার সে শিক্ষকদেরও ছাড় দেবে না।
রাত বাজে তখন ৯ টা । টিচার্স কোয়ার্টারে একটি সি টাইপ বাড়ির পিছনের দিকটায় আমরা। আম কুড়োতে গিয়ে আবির কি মনে করে গাছেই উঠে গেলো । ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান স্যার থাকেন এই বাসায় । এখানে ধরা পড়লে মান সম্মান থাকবে না। যখনি আমরা এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় তখনই বাসার ভেতর থেকে কে যেন চোর বলে বলে চিল্লানো শুরু করলো। আবিরকে ফেলেই আমি আর তুলি দিলাম দৌড় । প্রায় ৪৫ মিনিট পর আবিরের ফোন পাই। সে মেডিকেলে। গাছ থেকে নামতে গিয়ে পরে হাত ভেঙ্গে ফেলেছে । তবে চুরির অভিযোগ থেকে সে কিভাবে নিজেকে দায়মুক্ত করলো তা জিজ্ঞেস করার সাহস করিনি।নিখিল যখন এসব ভাবছিলো তখনই আবিরের কথায় ও সম্বিত ফিরে পেলো ।
– আচ্ছা শোন , আমরা সবাই ঠিক করেছি ৮ টার বাসে করে ঢাকায় যাবো । অনেক দিন এই বাসে চড়া হয় না । তুইও যাচ্ছিস আমাদের সাথে ।
– আমি যাচ্ছি না অবশ্য । আমার গাড়িতে যেতে হবে । চটজলদিই বলে উঠলো তুলি
– আমিও মনে হয় যাচ্ছি না ৮ টার বাসে। মাত্র আসলাম। একটু ঘুরে দেখবো ক্যাম্পাসটা ( নিখিল)
– কেন যে দেরী করে আসিস আবিরকে খুব হতাশ দেখালো ।
– এর পর থেকে আর দেরী হবে না ।
এর পর বলতে নিখিল কি বুঝালো তা আবিরের বোধগম্য হলো না। পরবর্তী ৩০ মিনিট তাদের কাটলো এলোমেলো গল্প করে। সবাই কতো ভিন্ন রকম হয়ে গেছে। কেউ কেউ পরিবার নিয়ে, কেউ ক্যারিয়ার নিয়ে, কেউ হতাশায় আশা নিয়ে জীবন পার করে দিচ্ছে । সবাই যখন ৮ টার বাসে উঠে যাচ্ছিল নিখিল আর তুলি তখন বিদায় জানাচ্ছিল ওদের । ঠিক ৮ টায় বাস ছাড়লো । একমাত্র সরকারি জিনিস যা সময় মতো কাজ করে এই দেশে। এই বাসের সাথে চলে যাবে এক দল মানুষ। আবার কবে এদের দেখা পাবে জানা নেই নিখিল-তুলির ।

সবাই চলে যাবার পর কেমন ইতস্তত বোধ জেঁকে বসলো দুইজনের মনে। অথচ কতো সময় এই ক্যাম্পাসে একইসাথে পার করেছে এই ২জন।
– তোমার গাড়ি কোথায় ?
– সমাজবিজ্ঞানের ওদিকে ।
– চলো তোমাকে এগিয়ে দেই ।নিখিল আর তূলি যখন হাঁটছিল তখন মেঘ ডাকা শুরু করলো , বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন, কালবৈশাখীর আগমনী । ক্যাম্পাসটাকে অনেক উৎফুল্ল মনে হচ্ছে, নিজের মাঝে পুরানো পথিক খুঁজে পেয়ে সে বোধ হয় আনন্দিত ।- আজকের weather টা বেশ ভালো ।
– Yes, the sun is out and the wind is chill.
– এখনও ইংলিশ কবিতা পড় ?
– হ্যাঁ পড়ি । আমার এখনো মনে হয় ইংলিশে মনের ভাব প্রকাশ করা অঙ্কের থেকে সোজা ।
নিখিল হাসলো।
– তো তোমার সাথে তোমার ম্যাথের সম্পর্কটা টিকে আছে? (তুলি)
– হ্যাঁ এই একটা সম্পর্কই এখন পর্যন্ত টিকে আছে , নিখিল হাসতে হাসতে জবাব দিলো ।
– ভালোই , তোমার মনে আছে যেবার প্রথম তোমার আর আমার কথা হল, তুমি কি জিজ্ঞেস করেছিলে?
– হ্যাঁ মনে আছে ।
– তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে তোমার প্রিয় সংখ্যা কি । আর আমি যখন বললাম প্রিয় সংখ্যা ১ তখন তুমি কেমন লাফ দিয়ে উঠলে, যেন এর থেকে আশ্চর্যজনক ঘটনা তুমি আগে শুননি।
– হ্যাঁ, কারন ১ আমারও প্রিয় সংখ্যা ।
– হুম। সংখ্যাটাই প্রিয় রয়ে গেলো, আমি আর থাকতে পারলাম না।
নিখিল চুপ করে রইলো ।
– তো, কি করছো এখন ?
– একটা স্কুলে পড়াই।
– কোথায় ?
– বান্দরবনে, ছোট্ট একটা গ্রাম, নাম থুইসাপাড়া ।
– বান্দরবন !!
– হ্যাঁ । বান্দরবনে। তুমি দেখছি দেশেই রয়ে গেলে।
– আর বেশীদিন নেই। ৪ মাস ।
– কই যাচ্ছো ?
– অস্ট্রেলিয়া
– পার্মানেন্টলি?
– চেষ্টা করবো ।
– ভালোই, তোমার ইচ্ছা তাহলে পূরণ হচ্ছে ।
– হুম তা হচ্ছে।
– মাঝে মাঝে আমার অবাক লাগে আমরা ২ জন কতো আলাদা ২টা মানুষ, অথচ আমারা একে অপরকে পছন্দ করেছিলাম ।
– Opposite Attracts
– তাহলে সেই আকর্ষণ কমে গেলো কিভাবে?
নিখিল আবারো চুপ করে রইলো, উত্তরগুলো তার জানা নেই ।
– হয়তো আমাদের মাঝে দূরত্বটা এতোই বেড়ে গিয়েছিল যে আকর্ষণটা আর কাজ করেনি। ( নিখিল)
– কতো জল্পনা-কল্পনার পর আমাদের সম্পর্ক হলো, অথচ টিকলো না অর্ধ বছরও ।
– হ্যাঁ তা টিকেনি ।
– তো? এর পর তোমার জীবনে আর কোনও মেয়ে আসেনি ?
– এসেছে । কিন্তু সম্পর্কে জড়াই নি ।
– কেন?
– মনে হলো সম্পর্কে জড়ানোর জন্য আমি উপযুক্ত নই।
– বুঝেছি
– তোমার? তোমার জীবনে কেউ আসেনি?
তুলি চুপ করে রইলো । এই নিশ্চুপ থাকার অর্থ নিখিল জানে ।
– অর্ক ?
তূলি নীরবতা ভাঙলো না ।
– অর্কর সাথে সম্পর্কটা হয়েছিলো । তবে এখন আর নেই ।
– ভাঙলে কেন?
– সম্পর্কের শুরুগুলো হয় অনেক সুন্দরভাবে। কিন্তু কিছুদিন পর সবই বদলে যায়। কেউই আর আগের মতো থাকে না। শুরুতে যা দেখে আমাদের ভালো লাগা কাজ করে তার সবই নাই হয়ে যায় একসময়।
– অথবা কিছু সময় পার হলে একে অন্যের ভালো দিকগুলোকে আমরা ‘’ taken for granted ‘’ হিসেবে ধরে নেই। এর পর যা আমাদের চোখে পরে তার সবটাই নেগেটিভ ।
– আমাদের বেলায়ও কি সেটাই হয়েছে ?
– ঠিক জানি না। তবে আমাদের ইচ্ছের পার্থক্যগুলো আমাদেরকে অনেক দূরে ঠেলে দেয় ।
– হ্যাঁ। মনে আছে আমাদের প্রথম মতের বিরোধিতা হলো দেশের বাইরে যাওয়া নিয়ে। আমার ইচ্ছে ছিল দেশের বাইরে যাবার কিন্তু তুমি রাজি হলে না ।
– আমি আমার পরিবার ছাড়তে চাইনি কখনও
– কিন্ত এখন? এখন তো একলাই থাকছো। তাহলে কি লাভ হল ?
– তুমি চলে যাবার পরে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়ছে , হয়তো তুমি থাকলে সেগুলো হতো না ।
– তোমার সবার থেকে দূরে চলে যাওয়ায় তুমি আমাকে দোষ দিচ্ছো ?
– আমি সেরকম কিছু বলিনি ।
– আমার মনে হয় তুমি এসবের জন্য মনে মনে আমাকে দায়ী করো। অথচ আমার অনেক ইচ্ছাও তুমি পূরণ করনি কখনও।
– যেমন?
– একটা মেয়ে হয়ে আমার ছোট ছোট কিছু ভালো লাগবার জায়গা আছে, কিছু কিছু মন ভালো লাগার কথা শুনবার ইচ্ছে জাগে; সেই জায়গাগুলো কখনও কি তুমি পূরণ করেছো নিখিল ?
– না করিনি । আমার মনে হয়েছে আমাদের সম্পর্কগুলো গতানুগতিক সম্পর্কগুলোর মতো না। সব কিছুই আমাদের একে অপরকে বলে বুঝাতে হয় না ।
– এছাড়াও আমার কথা, কোন কাজই তোমার যুক্তিসংগত মনে হতো না। তুমি সবসময়ই মনে করতে আমি সবসময়ই খোঁড়া অজুহাত দেই । এমনকি অর্ককে নিয়ে তুমি আমাকে কতো সন্দেহ করতে ।
– কিন্তু আমার পর সেই অর্কর সাথেই তুমি সম্পর্কে জড়ালে ।
তুলি চুপ করে রইলো । অর্কের সাথে সম্পর্কটা যাওয়া নিয়ে সে এখনো অনুশুচনায় ভুগে। যদিও অর্কের সাথে তার প্রেমের সম্পর্কটা হয়েছিল নিখিলের সাথে সম্পর্ক ভাঙার প্রায় ১ বছর পরে। নিখিলের সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় কখনই অর্ককে অন্য কোন নজরে দেখেনি তুলি। তবে সে কথা নিখিলকে বিশ্বাস করানো দায়।
– থাক, পূরানো কথা। ওগুলো মনে করে আর কষ্ট পাবার দরকার কি ? ( নিখিল )
তুলি চুপ করে রইলো ।
– দেখেছো ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় আবার সোডিয়াম লাইট লাগানো হয়েছে। সোডিয়াম আলোয় ক্যাম্পাসকে অন্য এক জগতে পরিণত হয়। অন্ধাকারের এই সোনালি ক্যাম্পাস কতটা সুন্দর। ( নিখিল)
– হ্যাঁ, ক্যাম্পাসে হাঁটলেই তুমি এই সোডিয়াম বাতি নিয়ে আফসোস করতে। অথচ তুমি চলে যাবার পরে ক্যাম্পাস তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ করলো ।
নিখিল হাসলো খানেক । – জগতের নিয়মটাই বোধ হয় এরকমই। আমাদের ইচ্ছে গুলো এমন সময়ে এসে আমাদের কাছে ধরা দেয় যখন আর সেই ইচ্ছের কোন মূল্য আমাদের কাছে থাকে না ।

হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে চলে এসেছে দুই জন। চলে যেতে হবে এখনই। তবে বিদায় জানানোর ইচ্ছে নেই কারোরই। খানিকটা সময় কাটলো নীরবতায় । চারদিকটা প্রচণ্ড থমথমে । ঝড়ের ঠিক আগের মুহূর্তের মতো। পুরো বিশ্ব-ভ্রম্মান্ড যেন এই নীরবতা ভাঙার অপেক্ষায় ।
– নিখিল, আমাদের কি আবার এক হবার সুযোগ আছে ?
নিখিল চেয়ে রইলো তুলির দিকে। সেই বহুল প্রত্যাশিত প্রশ্ন, যেন এই প্রশ্নই শোনার অপেক্ষায় নিখিল পার করেছে জীবনের বড় একটা অংশ। এই প্রশ্ন, কতবার শুনেছে সে কল্পনায় ।
– তুমি কি কিছু বলবে না?
নিখিল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো ,
– তোমার আমার সামান্য কৌণিক দূরত্ব, আজ পথ চলতে চলতে অনেক বড় রৈখিক দূরত্বে পরিণত হয়েছে তুলি । এই পথ চলায় পিছে ফেরবার সুযোগ নেই আর ।


কিছু না বলেই গাড়িতে উঠলো তুলি । তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু এই আবছা আলোয় দেখা গেলো না ।
নিখিলকে পিছে রেখে সেই গাড়ি চলতে শুরু করেছে; ঠিক ৬ বছর আগের ঐ দিনটার মতো।ক্যাম্পাসে শেষ দিন ছিলো তাদের। সকলকে বিদায় জানিয়ে তূলি নিজ গাড়ি করে ক্যাম্পাস ছাড়ছিল, দূরে দাড়িয়ে শেষ বারের মতো নিজের প্রাক্তন প্রেমিকাকে দেখার চেষ্টা করছিলো নিখিল ।সেদিনের মতো আজও ঝর শুরু হয়েছে, সবাই ছোটাছুটি শুরু করেছে চারিদিকে, খুঁজে বেড়াচ্ছে একটুকু মাথা গোঁজার ঠাই, অনেক ছেলেরাই দল বেঁধে গান গাওয়া শুরু করে দিয়েছে, কিছু প্রেমিক-প্রেমিকা প্রস্তুতি নিচ্ছে বৈশাখ উজ্জাপন করার।এই ঝরের মাঝেই ডেইরীর বড় গেট গুলো শব্দ করে খুলতে শুরু করেছে। জলদি ই এই পথে গাড়ি করে বেরিয়ে যাবে তুলি, মিলিয়ে যাবে কোলাহলে; ঠিক যেভাবে ক্যাম্পাস থেকে বেড় হওয়া প্রতিটা দীর্ঘশ্বাস মিলায় – ঢাকা-আরিচায় ।

[ ” তোমার আমার সামান্য কৌণিক দূরত্ব, আজ পথ চলতে চলতে অনেক বড় রৈখিক দূরত্বে পরিণত হয়েছে ”- এই লাইনটা বন্ধু আসিফ-এর লিখা একটি স্ট্যাটাস । এই লাইনকে কেন্দ্র করেই এই গল্পটা সাজানো ]

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
2
0
0
1
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Ishmam Nur
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
9 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Daibi
Guest
Daibi
4 years ago

Sundor lekhoni …tor bondhur status ta khub sundor akta ganitik bekkha – manoshik durotter .

1
শমী
Guest
শমী
4 years ago
Reply to  Ishmam Nur

Well written…. এরকম কত গল্প যে আছে ক্যাম্পাসের কোণে কোণে

শমী
Guest
শমী
4 years ago

Well written…. এরকম কত গল্প যে আছে ক্যাম্পাসের কোণে কোণে

1
আলভী
Guest
4 years ago

ভাল লিখেছো ভাইয়া।

1
Nadim Satej
Member
4 years ago

কী আশ্চর্য জাদুকরী শব্দের জটলা! মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে পড়ছে দেহের শিরা উপশিরায়। নস্টালজিক হয়ে গেলাম। পুরোটা পড়ে মনে হচ্ছে, এ গল্প তো আমার চেনা, এই গল্প আরো হাজার আমির চেনা,শুধু হয়তো এই গল্প অপরিচিত হয়ে পড়ে থাকে মনের এক কোণায়।সামনে আসে না, বা আমরা ভাবি না।
অনবদ্য!
লেখক বেশ এক্সপেরিমেন্টাল ভাবে গল্পটি গড়ে তুলেছেন। উপমার প্র‍য়োগ একে যথার্থ করেছে আরো। এর গঠনশৈলী এমন যে পাঠককে নস্টালজিক করে দিতে বাধ্য।
অনেকদিন পর এমন সুন্দর লেখনী পড়লাম। চালিয়ে যাও,লেখক ভাইয়া!❤️❤️❤️

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!