নতুন জীবন

ঢাকার মধ্যে বনানী রেলস্টেশনটা মনে হয় একমাত্র স্টেশন যেটা খুব নিরিবিলি থাকে। এখানে শুধু কয়েকটা লোকাল ট্রেন থামে, আন্তঃনগর ট্রেনগুলো এখনে থামে না। বনানী থেকে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পর্যন্ত এমনিতেই মানুষের ভীড় কম, আশেপাশের বসতিও অনেক দূরে। মারুফ ঠিক এমনই একটা জায়গায় খুঁজছিল, নাহ, জায়গাটা পছন্দ হয়েছে। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে যতগুলো ট্রেন ছাড়ে সবগুলো এই পথেই যায়, তাই এই পথে একটু পর পরই ট্রেন আসে। মারুফ রেললাইনের পাশে একটা বড় পাথরের উপর মাথা নিচু করে বসে আছে, মাঝে মাঝে মাথা তুলে দেখছে কোনো ট্রেন আসছে কি না। মনটা ভীষণ হালকা লাগছে আজ, গত কয়েকদিনের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া কষ্টগুলো এখন আর নেই। এতক্ষণে বিনিতার হয়ত বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাও শেষ, কবুল বলে এখন আরেকজনের বউ হয়ে গেছে সে। আচ্ছা যাক, কেউ চলে গেলে তো আর তাকে আটকে রাখা যায় না। শুধু মারুফ মেনে নিতে পারছে না, একটু বেশি ভালো থাকার আশায় এতদিনের সম্পর্কটা অস্বীকার করে বিনিতা চলে যেতে পারে ও ভাবতেই পারে নাই। অনেকবার চেষ্টা করেছে ভুলে থাকতে কিন্তু পারেনি। আর একটু পরেই হয়ত সব ভুলে থাকার উর্ধ্বে ও চলে যাবে।

নতুন জীবন

এই যখন ভাবছে ঠিক তখনই দূর থেকে একটা ট্রেনের হুইশেল ভেসে আসে যেন মারুফের শেষযাত্রার বিউগল বেজে উঠল। চোখের কোনে জমে থাকা জলটা মুছে ফেলে উঠে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে চেয়ে দেখে একটা মেয়ে রেললাইন ধরে আনমনে হেঁটে চলছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে কলেজে পড়ে। এই মেয়ে এখন কোথা থেকে আসল, আর এমন ভাবে হাঁটছে রেললাইন দিয়ে যে সামনে থেকে আসা ট্রেনটা যেন খেয়ালই করছে না। মারুফের মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায়, শান্তিতে মরতেও পারবে না। নাহ, একে এখান থেকে ভাগানো দরকার, সুইসাইডটা পরে করা যাবে। কিন্তু, এমন নির্জন এই জায়গাটায় এই মেয়েটা কি করছে। ট্রেনটা দেখা যাচ্ছে এখন, দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। মারুফ পেছন থেকে ‘এই’ ‘এই মেয়ে’ বলে কয়েকবার ডাকে কিন্তু মেয়েটা ফিরেও তাকায় না। হঠাৎ করেই মারুফের মনে বিদ্যুৎ ঝিলেকের মতো একটা কথা মনে হয়, আচ্ছা মেয়েটা ওর মতো সুইসাইড করতে আসেনি তো। এতো অল্প বয়সে এই মেয়েটা মরে যাবে? মেয়েটা কি ওর মতোই কষ্ট নিয়ে মরে যাচ্ছে? একটা মায়া অনুভব করে মারুফ। ট্রেনটা বিপদজনকভাবে কাছে চলে আসছে, মারুফ আর দেরী করে না বিদ্যুৎ বেগে এক দৌড়ে মেয়েটার কাছে চলে আসে। হ্যাঁচকা একটা টানে মেয়েটাকে রেললাইন থেকে নামিয়ে আনে। আর মুহুর্তেই ট্রেনটা হুশ করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে। মারুফ শক্ত করে মেয়েটার হাত ধরে আছে।

ট্রেনটা পার হয়ে যেতেই মারুফ আস্তে করে হাতটা ছেড়ে দেয়। তারপর মেয়েটার দিকে আগুনঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “এই মেয়ে, এখনো বয়স নিশ্চয়ই আঠারোই হয় নাই, কলেজে পড়ছ মাত্র, এখনি মরার এতো সাধ হয়েছে কেন?”

মেয়েটা একটু আগে মারুফের ধরে থাকা জায়গাটায় ডলতে ডলতে বলে, “আপনার যে আঠারো হয়েছে তা বোঝা যায়, এতো জোরে কেউ হাত চেপে ধরে? আর কে বলল আপনাকে যে আমার আঠারো হয়নি? আমি ভার্সিটিতে পড়ি, সেকেন্ড ইয়ারে।”

মারুফ এবার ভালো করে তাকায় মেয়েটার দিকে, ছিপছিপে গড়নের, চোখ দুটোতে দারুণ মায়া। এমন মায়া নিয়ে কেউ মরতে পারে, কেমন যেন একটা মায়া হয় মারুফের, বলে, “শুনুন, আপনি যে কারণেই সুইসাইড করতে চেয়েছিলেন সেটা ভুলে যান। জীবনে কষ্ট আসে, কিন্তু সেটা ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়।”
কথাগুলো নিজের কানেই কেমন বেখাপ্পা লাগে, ও নিজেই তো এই কাজ করতে এসেছে। তারপরও ও চোখের সামনে এই মেয়েটার মরে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না।

মেয়েটা নির্লিপ্ত ভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে, তারপর হেঁটে একটু আগে মারুফ যে পাথরটায় বসে ছিল তাতে আয়েস করে পা মুড়ে বসে। মারুফ বুঝতে পারে না, মেয়েটার মতলবটা কি। মারুফ এবার কাছে এসে বলে, “কি ব্যাপার, আপনি এখানে এসে বসলেন কেন? বাসায় চলে যান, আপনার মা বাবা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে।”

আসলে মারুফ চাচ্ছে মেয়েটা চলে গেলে ও ওর কাজটা আরাম করে করতে পারে।

মেয়েটা মারুফের দিকে তাকিয়ে পাত্তা না দেবার ভংগীতে বলে, “আপনি চলে যান। ইচ্ছে হলে থাকতেও পারেন। তবে এর পরেরবার আর এমন হিরোর মতো আমাকে বাঁচাতে আসবেন না।”

মারুফ অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে, মাথায় নিশ্চয়ই গন্ডগোল আছে। মারুফ ভালো করে মেয়েটার চোখের দিকে তাকায়, কেমন একটা ঠান্ডা দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মারুফ পাশেই একটা পড়ে থাকা গাছের গুড়িতে বসে পড়ে।

মেয়েটা এবার ঘুরে মারুফের দিকে তাকায়, তারপর তীক্ষ্ণ গলায় বলে, “কি ব্যাপার, বসে পড়লেন যে, আপনি চলে যাচ্ছেন না কেন। আচ্ছা, আপনি এই নির্জন জায়গায় একা কি করছিলেন? আমার মতো সুইসাইড করতে আসেননি তো আবার?”

মারুফ একটু ইতস্তত করে, এই পিচ্চি মেয়ের কাছে এগুলো বলতে ইচ্ছে করছে না। কোনোমতে বলে, “আমার একজন বন্ধু আসবে তাই।”

মেয়েটা এবার উদাস হয়ে বলে, “ছেলে বন্ধু না মেয়ে বন্ধু? মেয়ে বন্ধু হলে আসবে না। পৃথিবীতে বিশ্বাস বলে কিছু নেই। তার চেয়ে আপনি চলে যান, আমি আমার কাজটা করি।”

মারুফ কিছু বলে না, আনমনা হয়ে বসে থাকে। এখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। মারুফকে অমন বসে থাকতে দেখে মেয়েটা এবার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “আপনি তাহলে যাবেন না?”

মারুফ শান্ত গলায় বলে, “নাহ, আপনি যতক্ষণ আছেন আমিও আছি।”

মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকায়, বলে, “আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে আর কি করা। আজ তাহলে চলেই যাই।”

মেয়েটা আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করে। কি মনে করে মারুফও পিছু পিছু হাঁটতে থাকে, এই মেয়েকে বিশ্বাস নেই। একটু পর মেয়েটা পিছন ফিরে তাকায়, একটু থেমে বলে, “আপনি কি আমার বাসা পর্যন্ত যাবেন?”

মারুফ আমতা আমতা করে বলে, “নাহ, এই সামনের রাস্তা পর্যন্ত। “

মেয়েটা বিষন্ন একটা হাসি হেসে বলে, “বাসা পর্যন্ত আসতে পারেন, আমার আপত্তি নেই বরং সুবিধেই হয়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখন একটু ভয় ভয় লাগছে। মরতে ভয় নেই কিন্তু আপনাদের মতো পুরুষ হায়েনাদের ভীষণ ভয় লাগে।”

মারুফ মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। জায়গাটা নিরাপদ না। চলেন আমি এগিয়ে দিচ্ছি।”

মারুফের নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে না ও একটা মেয়েকে সুইসাইডের হাত থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। একবার ভাবে সুইসাইড করার আগে একটা মানুষের উপকার করতে পারলে তো ভালো। এই মেয়েটাকে বাঁচাতে পেরে অনেক শান্তি লাগছে।

রাস্তায় উঠে মেয়েটা একটা রিক্সায় ওঠে, মারুফকেও ইশারা করতেই ও উঠে পড়ে। মারুফ যেন একটা ঘোরের মাঝে আছে। অন্য সময় হলে হয়ত এটা বেমানান ঠেকত। কিন্তু এখন যেন সব ঠিকঠাক লাগছে। খুব বেশিদূর যেতে হয় না, একটা আবাসিক এলাকায় রিক্সাটা ঢুকে পড়ে। একটা সাজানো গুছানো ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে রিক্সাটা দাঁড়ায়। মেয়েটা নেমে ভাড়া দিয়ে চলে যাবার আগে বলে, “আমার নাম রিনতি। আপনার সাথে তো পরিচয়ই হলো না।”

মারুফ নিজের নামটা বলে, তারপর একটু ইতস্তত করে বলে, “কিছু যদি মনে না করেন, আপনার ফোন নম্বরটা দেওয়া যাবে?”

রিনতি মাথা নেড়ে বলে, “অবশ্যই পেতে পারেন। তবে এই নম্বর কতদিন খোলা থাকবে বলতে পারছি না।”

মারুফ মোবাইল নম্বরটা টুকে নেয়। তারপর মেয়েটা চলে যেতেই হঠাৎ মারুফের মনে হয় আচ্ছা মেয়েটার বাবা মাকে অন্তত ব্যাপারটা জানিয়ে রাখলে ভালো হতো, চোখে চোখে রাখতে পারত। কিন্তু মেয়েটা যে কয় তলায় গেল, আর হুট করে তো বলাও যায় না, ওকে কেউ চেনেও না। কিছুক্ষণ রিনতিদের বাসার সামনে পায়চারি করে, তারপর মারুফ বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

বাসায় ফিরতেই মা ভীষণ চিন্তিত গলায় বলে, “কি রে, তোর মোবাইল সেই কখন থেকে বন্ধ। কি হয়েছিল, একটা খবর জানাবি না।”

মারুফ একটু ক্লান্ত গলায় বলে, “মা, মোবাইলে চার্জ ছিল না।”

মারুফ ভাবে মা যদি জানত আজ তার ছেলের ফিরে আসার কথা না। বিনিতা ওর সাথে এমন করল! আবার মন খারাপ ভাবটা চলে আসতেছে, এতক্ষণ ওই পাগল মেয়েটারে নিয়ে ব্যস্ত ছিল ভালোই ছিল। এখন বিনিতার কথা যত মনে হচ্ছে ততো অশান্তি হচ্ছে। হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, রিনতিও হয়তো ওর মতোই কষ্ট পেয়েছে। তার মানে এই পৃথিবীতে ও একা না, ওর মতো কষ্ট বুকে নিয়ে অনেকেই ঘুরছে। কেউ সহ্য করতে পারে কেউ পারে না। কি মনে হতে মারুফ একটা ফোন দেয় রিনতির নম্বরে।

রিং হয়ে যাচ্ছে, ধরছে না কেউ। বুকটা ঢিপঢিপ করে ওঠে মারুফের, মেয়েটা আবার কিছু করে বসল না তো। কিন্তু এখন তো মোটে রাত নয়টা বাজে, বাসার সবাই তো জেগে। মারুফ ভাবে আরেকবার ফোন দেবে কি না। উম, নাহ, একটা মেসেজ দিয়ে দেখি কি হয়। মারুফ এবার সুন্দর করে একটা মেসেজ লিখে, ‘আমি মারুফ, ওই যে আজ রেললাইনে দেখা হলো। আপনি ভালো আছেন তো?’

এরপর মারুফ অধীর আগ্রহে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে কোনো মেসেজ বা ফোন আসে কিনা। সাথে টেনশনটাও বাড়তে থাকে। ঠিক তখন মারুফের মোবাইলে একটা মেসেজ আসে, ‘এখনো মরিনি, আপনাকে জানাব মরার আগে।’

ছোট্ট একটা ধাক্কা খায় মারুফ মেসেজটা পড়ে। নাহ, মেয়েটাতো মনে হচ্ছে সুইসাইডের চিন্তা থেকে বের হতে পারেনি। আহারে, ওর মতোই কষ্ট পেয়েছে মনে হচ্ছে মেয়েটা। একটা মায়া হয় মেয়েটার জন্য।

সেদিন রাতে মারুফ খেয়ে বিছানায় যেতে যেতে রাত প্রায় বারোটা বেজে যায়। জানে ঘুম আসবে না, তাও লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। লাইট অফ করতেই বিনিতার কথা মনে পড়ে যায়, আজ বিনিতার ফুলশয্যা। বুকটা কেমন যেন করে উঠে মারুফের। চোখটা ভিজে আসতে চায়। নাহ, কাল কাজটা করে ফেলতেই হবে। এই কষ্ট মেনে নেওয়া যায় না। এমন যখন ভাবছে ঠিক তখন মারুফের ফোনটা বেজে ওঠে, ফোনের স্ক্রিনে রিনতি নামটা দেখে মারুফের ঘুম ছুটে যায়। তাহলে কি মেয়েটা সত্যিই সুইসাইড করতে যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে ফোনটা রিসিভ করে মারুফ, কোনোমতে বলে, “হ্যালো, রিনতি, কোনো সমস্যা?”

রিনতি গম্ভীর গলায় বলে, “আপনি একটু আসতে পারবেন, ঘরের সিলিংটা বেশ উঁচু, দড়িটা বাঁধতে পারছি না।”

মারুফের গলাটা শুকিয়ে আসে, মোবাইলটা কানের কাছে আরো জোরে চেপে ধরে বলে, “রিনতি, এটা করবেন না, আমি আসছি।”

ওপাশে ফোনটা কেটে যায়। মারুফ আর দেরি করে না, মাকে বলে একটা বন্ধু অসুস্থ হাসপাতালে যেতে হবে। রাস্তায় নেমে ও প্রাণপণে একটা সিএনজি খোঁজে। রাত প্রায় একটা বাজে। কিছুক্ষণ হাঁটতেই একটা সিএনজি পেয়ে যায় মারুফ। রিনতিদের বাসাটা বেশি দূরে না, বিশ মিনিটেই পৌঁছে যায় মারুফ। নেমেই ফোন দেয় মারুফ, ফোনে রিং হচ্ছে, রিনতি ধরছে না কেন! একেবারে শেষ মুহূর্তে রিনতি ফোনটা ধরে, ঘুম ঘুম গলায় বলে, “কি চাই মারুফ সাহেব। এত রাতে একজন মেয়েকে ফোন দিলেন।”

মারুফ পুরোই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, মেয়েটা ওর সাথে মশকরা করছে? মারুফ তাও নরম সুরে বলে, “আমি আপনার বাসার নিচে। আপনি ভালো আছেন তো।”

ওপাশ থেকে রিনতি অবাক গলায় বলে, “আপনি আমাদের বাসার নিচে?? কই দেখি।”

তিনতলার একটা জানালা খুলে যায়, আবছা আলোয় একটা মুখ দেখা যায়, মোবাইলের আলো জ্বলছে। মারুফ এবার একটু শান্তি পায়। রিনতি ফিসফিস করে বলে, “আপনি সত্যিই এসেছেন?”

মারুফ এবার বিরক্তির সাথে বলে, “আপনিই তো ফোন করে আসতে বললেন। আপনাকে আমি তো বললামও যে আসছি। “

রিনতি নরম গলায় বলে,”মানুষ বুঝি এখনো কথা দিয়ে কথা রাখে? আর আমি ডাকলেই আপনি আসবেন কেন?”

মারুফ একটু চুপ থাকে, তারপর বলে, “আপনার এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। আজ আমার ভীষণ মন খারাপের একটা দিন। আমি জানি মানুষ কত কষ্ট পেলে মরে যেতে চায়। আপনার ব্যথাটা বুঝি, তাই হয়ত ছুটে এসেছি।”

রিনতি এবার একটু জোরে বলে উঠে, “ও, তার মানে আপনিও আজ আমার মতো সুইসাইড করতে গিয়েছিলেন? হুম, সেক্ষেত্রে অবশ্য ঠিক আছে এই রাতে আপনার চলে আসা। আচ্ছা, এখন চলে যান। আজ আর মরতে ইচ্ছে করছে না। অন্তত এটা জেনে ভালো লাগছে যে আমার মতোই আরো একজন এমন কষ্ট পেয়ে মরতে চাচ্ছে। যদিও জানিনা আপনার কষ্টটা কি। বাসায় যান, এরপর মরতে ইচ্ছে করলে আপনাকেই ডাকব, একসাথেই না হয় মরব।”

মারুফ এই মেয়েটাকে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, কি সব উল্টো পাল্টা বলছে। মেয়েটা এবার হাত নাড়ছে, মারুফও মনের অজান্তেই হাত নাড়ে।

পরদিন সকালে মারুফের ঘুম ভাংতে ভাংতে সকাল এগারোটা বেজে যায়। মোবাইলটা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিল তাই একটানা ঘুমোতে পেরেছে। মোবাইলটা খুলতেই একটা নম্বর থেকে অনেকগুলো মিসড কল এলার্ট। আরেকটা রিনতির মেসেজ, “আমি ভালো আছি।”

মারুফ একটু হাসে মেসেজটা পড়ে। তারপর মুখটা ধুয়ে নাস্তা করে। নাস্তা শেষে মোবাইলটা হাতে নিয়ে এবার মিসড কল এলার্টে যেয়ে অচেনা নম্বরটায় ফোন দিতেই ভারী গলায় একজন বলে, “আপনি কি মি. মারুফ বলছেন?”

মারুফ উত্তরে বলে, “হ্যাঁ, মারুফ বলছি। আপনি কে বলছেন?”

ওপাশের ভদ্রলোক বলেন, “আমি হারমোনি গ্রুপের এইচ আর থেকে বলছি। কংগ্রাচুলেশনস মি. মারুফ, আপনি এখন থেকে আমাদের পরিবারের একজন সদস্য। আগামী মাসের এক তারিখ থেকেই জয়েন করতে পারবেন। আর এক সময় এসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে যাবেন।”

মারুফের এখন মনে পড়ে এই কোম্পানিতে বেশ কিছুদিন আগে ভাইবা দিয়েছিল। বিনিতাকে বলেওছিল চাকরিটা হয়ে যাবে, কিন্তু ও আর দেরি করেনি। আসলে বিনিতারও দোষ নেই, অনেক দিন ধরেই ওর চাকরির জন্য বিনিতার বিয়েটা আটকে ছিল। শেষ পর্যন্ত বাড়ির লোক আর শোনেনি ওর কথা।

চাকরিটা পেয়ে কেন জানি মন ভালো হবার পরিবর্তে মারুফের মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়। আর কটা দিন আগে হলেও আজ হয়ত অন্য রকম হতো ওর জীবনটা। পৃথিবী আসলে খুব স্বার্থপর একটা জায়গা।

এর কিছুদিন পর এক দুপুরে মারুফের মোবাইলে রিনতির একটা মেসেজ আসে, “শুনুন, আজ আমার মরতে ইচ্ছে করছে, আপনি বিকেলে ওই রেললাইনের পাশে আসবেন?”

মারুফ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে মেসেজটার দিকে, নাহ, আজ মেয়েটাকে কয়েকটা কড়া কথা বলতে হবে। মারুফ শুধু প্রতি উত্তরে লিখে, “আচ্ছা।”

মারুফ এক ঘন্টা ধরে বসে আছে রেললাইনের পাশে, মেয়েটার আসার খবর নেই। মারুফের মেজাজটা খারাপ হচ্ছে, নাহ, এই পাগল মেয়েটার পাল্লায় পড়া ঠিক হয়নি। নিশ্চয়ই মশকারা করেছে আবার। কিন্তু মেয়েটা তো গতকাল মরতেই এসেছিল। ভাবতে ভাবতে সামনে তাকাতেই দেখে একটা নীল শাড়ি পরা মেয়ে, রেললাইন ধরে হেঁটে আসছে।

মারুফ চোখ কুঁচকে ভাবে, এটা আবার নতুন কে, এই মেয়েও কি মরতে এসেছে?

মেয়েটা কাছে আসতেই মারুফ অবাক হয়ে দেখে আরে এটা তো রিনতি। শাড়ি পরাতে চেনাই যাচ্ছে না, বেশ বড় বড় লাগছে মেয়েটাকে আজ। সুন্দরও লাগছে।

রিনতি কাছে এসেই বলে, “আহা, আপনি এমন নরমাল টি-শার্ট পরে চলে এসেছেন। একটা পাঞ্জাবী পরে তো আসবেন। মরব বলে কি স্বাদ আহ্লাদ নেই।”

মারুফ রিনতির মশকরাটা নিতে পারে না, বলে, “শুনুন, মানুষ ভীষণ কষ্ট পেয়েই মরতে আসে। তাই এটা নিয়ে রসিকতার সুযোগ নেই। মানুষের উপর আমার বিশ্বাস উঠে গেছে তাই আমি মরতে এসেছিলাম।”

রিনতি একটা বিষন্ন হাসি হেসে বলে, “না রসিকতা করছি না। আসলে আমারো বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কাল আপনি আমার জন্য রাতে ছুটে এলেন, আবার নতুন করে বিশ্বাস ফিরে পেলাম। আর এখন তো জানলাম আপনিও আমার মতো কষ্ট পাওয়া একজন মানুষ। মনটা ভীষণই খারাপ হয়ে ছিল, কাল মা বাবা অনেক কেঁদেছে আমার খোঁজ না পেয়ে। উনাদের ভালোবাসাটুকু আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনাকে ধন্যবাদ জানাতেই আজ এখানে ডেকেছি। আর একটা কথা, আসলে হয়ত আজ মনটা ভালো আছে তাই বাঁচতে ইচ্ছে করছে। যদি মন খারাপের দিনে আপনাকে আসতে বলি আসবেন তো?”

মারুফ মনের কোণে কোথায় যেন এই মেয়েটার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়। আসলেই, মনটা ইদানীং হুট করেই খারাপ হয়ে যায়। তখন পৃথিবীর সবকিছু অবান্তর মনে হয়, কিছুতেই মন ভালো হয় না।

মারুফ মাথা নেড়ে বলে, “হ্যাঁ আসব। কিন্তু আমারো যদি মন খারাপের দিন আসে আপনি আসবেন তো?”

রিনতি বাচ্চাদের মতো হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় বলে, “অবশ্যই আসব স্যার।”

মারুফ হাত বাড়িয়ে রিনতির হাতটা ধরে, কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটা যেন ভরসা পেল। মারুফ নিজেও যে ভরসা পেলে সেটা কি রিনতি বুঝল?

সূর্যাস্তের শেষ আলোয় দু’জন কষ্ট পাওয়া মানুষ নিজেদের আবার খুঁজে পাবার চেষ্টা করে, আবার নতুন করে বাঁচার আশায় হাত ধরে থাকে।

#গল্প
#নতুন_জীবন

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৩/০২/২০২১

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
0
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!