বিশ্বাস

বড় ভাইয়ার সমস্যাটা খুব বেশি পুরোনো না। মাস দেড়েক হবে। রাতে জানালার পাশে পেয়ারা গাছে কাকে নাকি বসে থাকতে দেখেন!

পেয়ারা গাছটা ম্যাদা। ধ্যাড়ধ্যাড়িয়ে লম্বা হয়ে ডাল পালা গজিয়ে পশ্চিম দিকের পুরো জানালাটা আটকে দিয়েছে। অথচ কস্মিন কালে একটা পেয়ারা ধরেনি। নেহাৎই ভাইয়ার খুব প্রিয়, তাই বাবা কাটতে গিয়ে কাটতে পারেন নি। এখন অবশ্য সেই পেয়ারা গাছ নিয়েই ঝামেলা!

ভাইয়ার ভয় কাটানোর জন্য এখন প্রতিরাতে আমি শুই। প্রতিদিন মাঝরাতে ঝাকাতে ঝাকাতে ঘুম থেকে তুলে চেঁচান, “পান্থ , দেখ দেখ, এইযে বসে আছে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে!, দেখ, দেখ! পান্থ দেখনা!” অথচ আজ পর্যন্ত আমি সেই জ্বীন, ভূতের দেখা পেলাম না। বাধ্য হয়ে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখালাম। কি যেন একটা দাত ভাঙা ইংরেজি নাম বললেন, আর কিছু ঔষধ দিলেন। লাভের লাভ কিছুই হলোনা। উল্টো কয়েক হাজার টাকা জলে গেলো। ইদানিং নাকি আবার একটা চকচকে ছুড়ি হাতে বসে থাকে!

শেষ পর্যন্ত মসজিদের ইমামকে আনা হলো।নাভি সমান দাড়ির দশাসই ইমাম সাহেব এসে কি দোয়া দরুদ পড়ে গাছ বন্ধ করে দিলেন । দিন সাতেক একটু শান্তি ঘুমাচ্ছি এখন। ভাইয়াও রাত বিরাতে ঝাকাতে ঝাকাতে ঘুম থেকে তোলে না। পেয়ারা গাছেও এখন কোনো জ্বীন ভূত বসে না।

কিন্তু সুখ তো কপালে বেশিদিন থাকে না। আট দিনের মাথায় আবার সেই মাঝরাতে ভয়ার্ত চিৎকার। এবার একটু বেশি। এবার নাকি ছুরি হাতে গলায় পোচ দেয়ার ভয় দেখায়। অতি দুঃখে কান্না চলে আসে। আমার সাথে কেন এরকমটা হয় না! একটু গ্যাংনাম স্টাইলে নেচে দেখায় দিতাম। লকডাউনে সব বন্ধ, অনেক দিন বন্ধু বান্ধব মিলে পার্টিতে নাচানাচি করা হয় না! পকেটের ও খুব খারাপ অবস্থা, তাও ভাগ্য ভালো ভাইয়ার কাছ থেকে কিছু টাকা পাওয়া যায়। মজিদ মিয়ার টঙে সিগারেট হাতে ধরা খাবার পর থেকে হাতখরচ একদমই বন্ধ। ভাইয়ার টাকাই যা ভরসা!

আজকে বেশ সকালে ঘুমটা ভেঙে গেলো। অনেকদিন পর আজ রে কেউ ঘুম বাঙিয়ে ডেকে তোলেনি। আড়মোড়া ভেঙে উঠতেই ভাইয়ার সাথে ধাক্কা লাগলো। বরফের মতো ঠান্ডা শরীর, বিস্ফোরিত দুটো চোখ নিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর অনেক কিছু ঝাপসা! চিৎকার করে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার চিৎকার শুনে বাবা মার ঘুম ভাঙে। আমার মত তাদের কপালেও সকালের প্রথম দৃশ্য, বড় ভাইয়ার লাশ!!

প্রায় ৭-৮ দিন পর বাসা থেকে বের হয়েছি। মালিবাগের দোতলা জীর্ন বাড়িটার শোক এখনো কাটেনি। অভিশপ্ত সেই পেয়ারা গাছটাও আর নেই। বাবা রাগে দুঃখে কেটে ফেলেছেন। পশ্চিমের জানালায় এখন সুন্দর রোদ আসে। পড়ন্ত বিকালের মিষ্টি রোদ। মজিদ মিয়ার দোকানে বসে চা চাইলাম। সমবেদনা জানাতেই কিনা, মজিন মিয়া আজকে তার সেরা চা টা করলো। চুমুক দিয়েই বুঝলাম, অনেক দিন জিভে লেগে থাকবে। বিল দিয়ে উঠতেই কালু পাগলা এসে সামনে দাড়ালো।

-কিরে, মাঙ্গির পোলা। আমার মাল কই?

মুচকি হেসে পকেট থেকে সাদা পাউডারের একটা ছোট্ট পোটলা বের করে দিলাম। খুশিতো চোখ চকচক করে জিভ চাটলো কালু পাগলা। কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে সালাম ঠুকলো,
-এখন থেকে প্রতি সপ্তায় পাবো তো!

“পাবি, প্রতি সপ্তাহে পাবি, যতদিন বাচবি, ততদিন “

লোভাতুর চোখে তাকিয়ে কালু পাগলা বলতে লাগলো, “খুব কষ্ট হইছে, তবে কষ্ট সার্থক ভাইজান! জানালার স্ক্রু গুলা ঠিকমত টাইট দিছিলেন তো?”

মুচকি হেসে পিঠ চাপড়ে উল্টো দিকে হাটা ধরলাম। প্রান খুলে হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে!পোস্টমর্টেমে এসেছে হার্টএট্যাক এ মৃত্যু। কালু পাগলা এই তিন সাস অনেক খেটেছে। আজকে ওর ছুটি। হেরোইনের মধ্য মেশানো বিষটা জিভে লাগতেই কাজ শুরু করে দেবে। কয়েকঘন্টা পর যখন কোনো খুপচিতে লাশ পড়ে থাকবে, কেউ টের ও পাবেনা। কোনো প্রমান ও থাকবে না।

সরি ভাইয়া, মাফ করে দিও! রিহ্যাব ফেরত ভাইটাকে এত বিশ্বাস করাটা উচিত হয়নি তোমার! মালিবাগের এই সোনার হরিন জমিটা যে আমার খুব দরকার! তুমি থাকলে তো সেটা হতো না!

– Muhtasim

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
6
0
2
0
0
1
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Muhtasim
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!