মালাবী, একটি দেশের নাম!

আমি যে দেশে থাকি দেশটার নাম মালাবি (Malawi) । ইস্ট আফ্রিকার ছোট্ট একটা দেশ। বিয়ের ১২ দিন পর আমি চলে আসি। যেদিন আমার ফ্লাইট ছিল তার ২ দিন আগে চাকুরীতে রিজাইন দিয়ে তারপর ধুম করে মরাকান্না কেদে, চলে এলাম এই দেশে।

বিয়ের আগে হবু হাজবেন্ড নিয়ে গুগল করায় এত ব্যাস্ত ছিলাম যে দেশ নিয়ে চিন্তার এত সময় পাইনি! কোথায় যাচ্ছি, কেমন হবে দেশটা, কি কি আছে – যাই হোক ছেলেটা ভালো হলে হইছে ! এভাবেই শুরু আমার জীবনের প্রথম বিদেশ যাত্রা।

আমি মালাবি থাকি শুনে অনেকেই ভেবে নেন হয়ত মালায়শিয়া কিংবা মালি, আবার অনেকেই ভাবেন সাউথ আফ্রিকা। আপনি আমার সামনে বসে থাকলে আমি যেভাবে আপনাকে দেশটার গল্প শোনাতাম আজ সেভাবেই বলব।

মালাবি হচ্ছে আফ্রিকার ছোট্ট একটা দেশ, আয়তনে প্রায় বাংলাদেশের সমান। লোকসংখ্যা ২ কোটির মত। অত্যন্ত গরীব দেশ। সারাবিশে গরিব দেশের মধ্যে টপ টেনে এর অবস্থান৷ এখানকার মানুষজন অনেক সরল এবং বিনয়ী। দেখা হলে হোক না আপনি অপরিচিত আপনার দিকে তাকিয়ে মিস্টি হাসি দিবে। দারিদ্র্যের দুস্টুচক্রে ছোটখাট চুরি তাদের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। কালোদের দেশ হলেও এখানে ইন্ডিয়ানদের প্রভাব বেশি। বেশিরভাগ উন্নত বড় দোকান, রেস্তোরাঁ কিংবা সুপার শপে ওউনার হচ্ছে ইন্ডিয়ানরা আর সেখানে কাজ করছে এ দেশের লোকাল মানুষেরা।

গরীব দেশ বলে এখানে কাজের লোক এভেলেবল। আমাদের বাসায় এক দম্পতী ও তাদের ৪ ছেলে মেয়ে পারমানেটলি কাজ করতেন। পুরুষ লোকটির কাজ হচ্ছে বাগান করা, গাড়ি আসলে গেট খোলা আর মহিলাটি বাসার ভিতরে কাজ করেন। প্রতি সপ্তাহেই ২/৩ জন মানুষ আসেন কাজের খোজে। আমি প্রায়ই আম্মাকে বলি ইশ এখান থেকে যদি তোমার জন্য কোন হেল্পিং হ্যান্ড নিয়ে যেতে পারতাম, সারাজীবন বসে খেতে করতে পারতে! শুনেছি, অনেককাল আগে ইন্ডিয়ানরা ন্যানি হিসেবে এদেশের মানুষদের নিয়ে যেত কিন্তু তারা আর ফিরে আসেননি। আস্তে আস্তে প্রশাসন সেই নিয়ম বাতিল করেন।
ওরা ভীষণ বিনয়ী, পরিশ্রমী আর পরিস্কার। আমি যখন নতুন আসি দেখতাম আমাদের সাথে কথা বলার সময় কিংবা কিছু জিগেস করতে বাসার কাজের লোকেরা মাটিতে হাটু গেড়ে বসে!! এই ব্যাপারটি সত্যি আমাকে অনেক কস্ট দেয়। এই যুগে এমন! আমার মনে পরে “আংকল টমস কেবিন” বইয়ের দাসপ্রথার কথা! যাইহোক ওনাকে বলেছিলাম আমার সাথে কথা বলতে বসতে হবেনা, আপনি যেভাবে আছেন সেভাবেই বলবেন। উত্তরে মহিলাটি বলেছিলেন “পে পানি”(মাফ করবেন)।

এই দেশের মানুষ অনেক সৌখিন। গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আপনার চোখে পরবে সারি সারি মাটির ঘর। আর প্রতিটি বাসার সামনে রয়েছে বিভিন্ন ফুলের গাছ। দরজা, জানালায় দেখবেন নেটের পরদা। বাসার সামনে পরিস্কার উঠোন। উঠোনে দড়িতে কাপড় শুকাতে দেওয়া। মালাবির মানুষজন মনে হয় কাপর ধুতে খুব পছন্দ করে! প্রতিটা বাড়ির উঠোনে কাপড় শুকাতে দেওয়া দেখে আপনার মনে আসতেই পারে এত গরিব মানুষ,খাবার ই পায়না আবার কাপড় ধোয়! সত্যিই তাই! রাস্তায় যাওয়ার সময় শুনবেন পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চারা চিল্লায় চিল্লায় বলছে “গিভ মি ডলার” তাকে যদি জিগ্যেস করা হয় ডলার দিয়ে কি করবে? উত্তর আসবে খাবার খাবে কিংবা সাবান কিনবে!

মালাবিরা শরীর ঠিকমত ধুক না ধুক পা কিন্তু ঘসে মেজে সাদা করে ফেলে! আমাদের বাসায় যিনি কাজ করেন উনাকে দেখি ঘন্টায় ঘন্টায় পায়ের তলা ঘষতে! এই ঘষা যেন শিরিশ কাগজ কেও হার মানাবে! আবার অনেকের কাছে শুনেছি, কেউ কেউ আছেন গোসল শেষ হলে গায়ে সাবান দেন! মানে আপনার গোসল শেষে আপনি যেখানে লোশন বা তেল দিবেন তার পরিবর্তে সেখানে সাবান দেয় তাতে শরীর থেকে সুন্দর ঘ্রাণ আসবে!

বাংলাদেশে বিয়ে বাড়িতে প্রথম ব্যাচে যাদের খাওয়ার খুব তারাহুড়া থাকে মালাবিতে আসলে তারা আর বিয়েই খেতে যাবেন না- এটা আমি শিওর! এখানে বিয়েতে যাওয়া মানে অনুষ্ঠানে খেতে দেওয়া হোক না হোক আপনাকে সাথে কিছু কোয়াচা (মালাবির কারেন্সি) নিয়ে যেতে হবে। বর – বউ একটা ঝুড়ি নিয়ে পুরো অনুষ্ঠানে নেচে গেয়ে বেড়াবে আর উপস্থিত অতিথিরা সেই ঝুড়িতে কোয়াচা দিবে!! আর আপনার ভাগ্য যদি খুব ভাল হয় তাহলে বিয়ে বাড়ির খাবার পেয়েও যেতে পারেন! একটা সমুচা, কেক সাথে হয়ত কোন সফট ড্রিংকস!! কি মালাবিতে বিয়ে করবেন? অল্প খরচে বিয়ে কম্পলিট!

এখানে রাস্তাঘাট গুলো ফাকা ফাকা। তার উপর ৩/৪ টা গাড়ি একসাথে দাড়ালেই বলবে জ্যাম লেগেছে! কোন মালাবিয়ানের কাছে যখন শুনি জ্যামে ছিল আসতে দেরি হয়েছে, আমার হাসি পায়! আমার দেশে গেলে বুঝবা জ্যাম কত প্রকার ও কি কি!

আমাদের দেশে যেমন পুলিশ ধরলে কিংবা ফাইল ছাড়ার জন্য “চা “খাওয়ার টাকা দিতে হয়, এখানে তেমনি ” ফান্টা “। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ খুব দায়িত্বের সাথে ডিউটি করে, এমনকি এনাদের ” বানা” (স্যার) বলে ও সম্বোধন করা হয়। যখন তখন গাড়ি থামায় বলবে ফান্টা খাব। আমার বর কে কখন ও ফান্টা খাওয়ার জন্য কিছু দিতে দেখিনি উলটা এক মহিলা পুলিশ বিনা কারনে গাড়ি থামিয়ে খুব আহ্লাদ করে বলেছিল আজকে আমার খুব পিজ্জা খেতে ইচ্ছা করছে, আমার বর ঠাস করে উত্তর দিলো আচ্ছা, তুমি যখন খাবে আমার জন্য ও রেখে দিও একটু!

মালাবীর মানুষজন আবহাওয়া বোঝেনা! অনুভূতি মনে হয় ভোতা! খুব গরম পরেছে আপনার ইচ্ছে করছে ঠান্ডা কষকষে এক গ্লাস পানি খাবেন সেই মুহূর্তে হয়তো চোখে পড়তে পারে দু তিনটা সোয়েটার কিংবা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে পথযাত্রীরা হেটে যাচ্ছে। আবার কনকনে শীতের মধ্যে মহিলারা স্লিভলেস টপ্স আর মিনি স্কার্ট পরা! মাঝেমাঝে ঝুম বৃষ্টি হলে তুষারপাতের পোশাক- কানটুপি, হ্যান্ড গ্লাভস, বুটজুতা পায়ে অবলীলায় বাইরে বের হচ্ছেন!

এই শান্তশিষ্ট দেশটার প্রধান খাবার হচ্ছে ‘সিমা’। আমরা যেমন রুটির আটা সিদ্ধ করে ‘ডো’ তৈরি করি ঠিক ওভাবেই ভুট্টার আটাকে সিদ্ধ করে হাতের মুঠোতে টিপতে টিপতে ছোট ছোট বল বানিয়ে যেকোন তরকারির ঝোলের সাথে খায়। ভুট্টা এখানকার প্রধান শস্য। তাই এখানকার বেশিরভাগ খাবার ভুট্টার তৈরি।

মালাবী, হাজব্যান্ডদের জন্য স্বপ্নের জায়গা হতে পারে! এখানে কোন উন্নত শপিং মল নেই! বউয়ের শপিং এর হাতখরচ থেকে বেচে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ! কিন্তু আমি অবশ্য এতটা উদার নই, দেশে গেলে ১/২ বছরের সব শপিং উসুল করে নেই! তাই দেশে যাওয়ার আগে আমি এখান থেকে নেওয়ার মত কিছুই পাইনা। খালি হাতেও যাওয়া যায়না, বিদেশ থেকে যাচ্ছি বলে কথা! কিন্তু কাকে বুঝাই যেদেশে থাকি সেটা আমার বাংলাদেশ থেকেও গরীব!

প্রথম যখন এই দেশে পা রাখলাম,পিচ্চি এয়ারপোর্টটা দেখেই আমার দেশের গাবতলি কিংবা সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের কথা মনে পরেছিল! আমাদের বাসস্ট্যান্ড গুলা কত্ত বড়! মালাবীর এয়ারপোর্ট অনেক ছোট কিন্তু পরিষ্কার, পরিপাটি।

বিয়ের পর আমার বর আমাকে নিয়ে প্রথম বাইরে বেড়াতে যাবেন, ঠিক হলো উনি আমাকে ‘সালিমা লেক’ দেখাবেন। শহর থেকে ১৫০ কিমি দূরে। পুরা রাস্তা আমি আমাদের কাপ্তাই লেক আর ধানমন্ডি লেকের কথা ভাবতে ভাবতে গেছি। যখন আমরা পৌছালাম আমার চোখ ছানাবড়া! এটা লেক?! সেই ছোট্ট এয়ারপোর্টকে যেভাবে ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিয়েছি এবার সেই লেক দেখে আমিই হতভম্ব! এটা লেক না সমুদ্র?! আপনি দেখলে বিশ্বাস করবেন না লেক এত বড় আর সুন্দর হয় কিভাবে!? মালাবীর লেক বিশ্ববিখ্যাত। বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ স্বচ্ছ লেক। লেকের চারিদিকে মোজাম্বিক, জাম্বিয়া, তাঞ্জানিয়ার বর্ডার। সালিমা লেক বীচে আমরা সেদিন টেন্টিং করেছিলাম। আমার জীবনে প্রথম তাবুতে থাকা।

মালাবী প্রধানত টুরিস্ট প্লেস। বড় বড় সাফারি পার্ক,পাহাড়,বিচ সবসময়ই দর্শনার্থীসমৃদ্ধ। আর বেশিরভাগ পর্যটন সাদা ত্বকের মানুষ। মালাবীতে পারমানেন্টলি না আসুন, কিন্তু ঘুড়ে যান। ফ্রী গাইড হিসেবে আমরা বাংগালীরা তো আছিই!
ভাল থাকবেন!

– Khadiza Tul Kobra Kabbyo

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
2
0
0
0
1
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Khadiza tul kobra kabbyo
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!