প্রিয় সুতপা,
তুমি আমার কাছে অর্ধেক আনন্দ, অর্ধেক বেদনা। অর্ধেক কষ্ট, অর্ধেক সুখ। অর্ধেক নারী, অর্ধেক ঈশ্বরী। তুমি আমার কাছে ছিলে জোছনার মতো, টগর কি কাঁঠালচাপা ফুলের মতো, মেঘের ফাঁকে চাঁদ কিংবা পাতার ফাঁকে হালকা হলদেটে ফুল। কিন্তু আমি তোমাকে গ্রহণ করতে পারিনি সুতপা। যে দেশের নরনারীর হৃদয় জয় করে বিয়ের রীতি নেই সে দেশে বিয়ে কেবল একটি চুক্তিপত্র। শারীরিক সম্পর্কের বৈধতা প্রদানের চুক্তিপত্র। সেই চুক্তিপত্রে আমি তোমায় চাইতে পারিনি, সুতপা।
সুতপা, অনেকেই বলে চুক্তিপত্রের বিনিময়ে পাশাপাশি থাকলে একদিন না-কি ভালোবাসা জন্ম নেয়। তাহলে তুমিই বলো, এই শহরে যে এতগুলো মানুষ আমরা পাশাপাশি বাস করছি কারো মাঝে কি ভালোবাসা সম্পর্কটা আছে? কেউ কি কাউকে ভালোবাসে? যদি ভালোবাসতো তবে পত্রিকার পাতায় খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, দুর্নীতি, প্রতারণার মতো খবরগুলোর জায়গাতে এক রাশ মুগ্ধতা ছড়ানো খবর ছাপা হতো।
অনেক বছর পাশাপাশি ঘর করার পরেও মনের সন্ধান পাওয়ার মতো সম্পর্কটুকু দিপার সাথে আমার তৈরি হয়নি কখনও। কেবল নিয়ম রক্ষা আর দায়িত্ব পালনের নাম করেই সংসার ধর্ম পালন করে এক যোগী পুরুষ হয়ে বেঁচে আছি।
আমার স্ত্রী দিপা কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে গেল। আজকাল দিপা আর ঘুমের আগে বুকে জড়াতে বলে না, আগের মতো চুমুতে ঘুম পাড়াতে বলে না, আগের মতো ঘুমের মাঝে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে না।
সংসার জীবন সত্যি ভিন্ন সুতপা, এখানে প্রেমের চেয়ে বেশি থাকে দায়িত্ব। একটা সময় হয়তো আমিও তোমার মতো করে তোমাকে চাইতে পারতাম না। তুমিও পাল্টে যেতে। হয়তো আমিও দিনশেষে রাতটুকু তোমাকে কাছে পেতে চাইতাম। তোমার বুকে প্রেমের চেয়ে মাংসের গন্ধই আমাকে বেশি আকৃষ্ট করতো। আমার প্রতি তোমার মুগ্ধতা হ্রাস পেতো, ক্রমশ আমি হয়ে যেতাম একজন অচেনা মানুষ, অচেনা পুরুষ কিংবা একটি পুরুষ দেহ।
দিপার সাথে কখনও পূর্ণিমা দেখা হয়নি আমার, কখনও শোনানো হয়নি কোন গান, কখনও দিপাকে কাছে টেনে বলা হয়নি ভালোবাসার কথা। অথচ এইসবকিছুই করা হয়েছে আমাদের। একসাথে পূর্ণিমা দেখেছি, টং দোকানে চা খেয়েছি, ব্যস্ত শহরে তোমার হাত ধরে কিছু সময় হেঁটে গিয়েছি। আজ আমার নিজের সব আছে কিন্তু কোথাও একটা তুমি থেকেও নেই।
সুতপা, ধর্ম আমাদের আলাদা করেনি তবুও ধর্ম যে আমাদের এক হতেও দিলো না। সোহেলী চৌধুরী কি কখনও পারতো হিজাবের নিচে এক ফোঁটা সিঁদুর পরে নিতে? পারতো আরতি দিতে কিংবা কালী পুজোতে উপোস করতে? অষ্টমির অঞ্জলি কিংবা সরস্বতীর স্তুতি অথবা লক্ষ্মীর পাচালি পাঠ করতে? অনেক বছর পর আমি ধর্ম নিয়ে অভিযোগ করলাম বললে রাগ করলে?
ধর্ম বলতে আসলে কী সুতপা? যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথাকে আঁকড়ে ধরে দিনাতিপাত করাটা কি ধর্ম? কখনও সত্যের সন্ধান করে দেখি আমরা?
আমার বাবা ব্রাহ্মণ; আমার গলায় তুলসির মালা আর পৈতা পরিয়ে দিয়ে আমাকেও দিক্ষা দিলো; আমি কি জানতে চেয়েছিলাম কেন এসব করলে? আজ আমার বাবা মুসলমান হলে আমার মাথায় টুপি পরিয়ে দিতো; ধূতি পরার বদলে আমি পরতাম পাজামা; বাবার দেখাদেখি মন্দিরে যাওয়ার বদলে আমি যেতাম মসজিদে।
তোমার পূর্ব পুরুষেরা যদি মসজিদ ডিঙ্গিয়ে মন্দিরে ভিড়তেন তবে তোমারও হয়তো নামের শেষে চক্রবর্তী, ভট্টাচার্য্য, কোনো একটা পদবী লাগিয়ে দিতো। মানুষের বড় ধর্ম হলো মানব ধর্ম, এই ধর্মে আমাদের কারো পার্থক্য নেই। তবুও সমাজ রক্ষা করার জন্যেই সেদিন তুমিও পারোনি হিজাব আর সিঁদুরের হিসাব মিলাতে।
ভালোবেসেছিলাম তোমাকে তাই বলে পরিবার পরিজন ত্যাগ করার সাহসটুকু সত্যি ছিল না। তুমিও বলেছিলে, “সুব্রত, যদি পরিবার ছাড়ো তবে বুঝবো কোনো একদিন তুমি আমাকেও ছাড়তে দ্বিধা করবে না, তারচেয়ে চলো দুজনে বুকের ভেতর আজন্ম ভালোবাসা পুষে রাখি, ডাল ভাতের হিসাব নাই বা করলাম আমরা।”
তারপর নয়টা ছয়টা অফিসের পর আর অবসর পাই না ভালোবাসার, অবসর পাই না চাঁদের দিকে তাকাবার, অবসর পাই না দিপার কপালের টিপটা ঠিকঠাক বসে কি না সেটা দেখার।
সুতপা, বিয়ে কেবল দুটি মানুষের হয় না, বিয়ের সাথে জড়িয়ে যায় আরো অনেকগুলো পরিবার, অনেকগুলো সম্পর্ক। তাই আমরা চাইলেও পারি না বিয়ের সম্পর্ক ভেঙ্গে দিতে। যুগের পর যুগ আমাদের নিয়ম রক্ষার জন্যেই সংসার করে যেতে হয়। তাই হয়তো অনেক অনেক নারী পুরুষেরা অন্যের প্রেম বুকে নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ।
বাঙালির বিষ যে সাপের বিষের চেয়েও ভয়ংকর, তাই বাঙালি সমাজ তোমাকে সতীসাধ্বী স্ত্রী হয়ে দায়িত্ব পালনেই বেশি বাহবা দিবে। দ্বিচারিণী হয়ে স্বামীর সংসার ধর্ম পালন করে গেলেও কারও বোঝার ক্ষমতা নেই। বাইরে থেকে যতটুকু দেখা যায় ততটুকুই তুমি, একজন সাধারণ নারী, একজন সাধারণ স্ত্রী।
সুতপা, এক যুগ পর যদি বলি ভালোবাসি, তবে বিশ্বাস করবে? জানো, তোমার ফেলে দেওয়া কাচের চুড়ি, তোমার শুকনো বকুলের মালা, তোমার টিপের পাতাগুলো আজও রেখে দিয়েছি। খুব অন্ধকার রাতে যখন আমার ঘুম আসে না, যখন বুকের ভেতর উতালপাতাল ঝড় উঠে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে তখন তোমার সবকিছু বড়ো প্রশান্তি দেয়। দিপা কিছুই বুঝে না পাশ ফিরে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমোতে থাকে, বড্ড মায়া হয় দিপার জন্য।
গঙ্গার জল ঘরে আনা গেলেও গঙ্গাকে কখনও ঘরে আনা যায় কি? কিংবা ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, ইহা দূরেও ঠেলিয়া দেয়’।
পাওয়া না পাওয়ার মাঝে যেটুকু অবশিষ্ট সেটুকুই তোমার কিংবা আমাদের।
ভালো আছি কিংবা ভালো থাকি অথবা ভালো থাকার অভিনয় করি, কাউকে ভালো রাখি কিংবা দায়িত্ব পালনের নাম করে যুগের পর যুগ কাটিয়ে দিচ্ছি,মনের যোগটুকু বোধহয় এই জন্মে আর হবে না সুতপা।
এই সমাজে প্রচলিত অনেক দিবস আছে; মা দিবস, বাবা দিবস, ভালোবাসা দিবস! কিন্তু একটা “মানুষ দিবস” নেই; যেদিন আমরা মানুষের কথা বলতে পারতাম, মানুষকে ভালোবাসার কথা বলতাম, সেই দিবসে আমরা সবাই জাত-ধর্ম ভুলে কেবল মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে পারতাম। জানো সুতপা, আমার ভীষণ ইচ্ছে করে পরের জন্মে মানুষ হয়েই জন্মাতে, যে মানুষের নামের সাথে কিছু পদবি দিয়ে আলাদা ধর্ম বলে পরিচয় দেওয়া হবে না, সেই মানুষের ধর্ম হবে কেবলই মনুষ্যত্ব। সেই জন্মে আমি তুমি ভিন্ন শব্দ না হয়ে আমরা হবো।
এক ছাদের নিচে সারাজীবন কাটানোর চেয়ে একই আকাশের নিচে আজন্ম কাটানোটাই বেশ ভালো তাই না? হাড়ি পাতিলের ঠুকাঠুকি হচ্ছে না, মনোমালিন্য হচ্ছে না, ঝগড়া হচ্ছে না, তেল নুনের হিসাব করতে হচ্ছে না।
আকাশের কোন একটা তারার দিকে তাকিয়ে তুমিও ভাবতে পারো এই আকাশের কোন এক তারার দিকে তোমার সুব্রতও রাতের পর রাত তাকিয়ে থাকে। আমরা পাশাপাশি না থাকি, মনের দিক থেকে আমরা সবটুকু কাছে আছি।
আজ রাতে হয়তো আর ঘুম হবে না। অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করছিল; কিছু কথা অব্যক্ত রেখেই চিঠি শেষ করলাম।
ইতি
তোমার প্রেমিক, শুধু তোমার সুব্রত।
লেখা : Esrat Emu.
Send private message to author




