বাসর রাতে সবাই কত কিছু করে আর আমি? কি ভেবেছিলাম আর কি করছি?
রুমের মধ্যে ইনডাকশন চুলায় চা বানাচ্ছি জামাই এর জন্য। তাও এটা নিয়ে ঘন্টা তিনেকের মধ্যে সপ্তমবার। তার চায়ের নেশা খুব। আর টেনশন হলে নাকি নেশাও চড়ে যায় বহুগুণে। সবাই মিলে ঘরে ঢুকিয়ে দেবার পর থেকেই দরদর করে ঘামছে আর সারা ঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছে।
আমি বৃষ্টি আর উনি মেঘ। বিশ্বাস করবেন? আমি ওনাকে না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়েছি শুধুমাত্র নাম শুনে। মেঘ-বৃষ্টি কি দারুন এক জুটি হবে! আপনারাই বলুন।
অনার্স শেষ করে আর পড়ালেখা করিনি। আমার পরীক্ষার পড়া ভালো লাগে না৷ তবে গল্পের বই পড়তে শুধু ভালোই লাগে না, প্রচন্ড ভালো লাগে। সবাই আমাকে বই পোকা ডাকে৷ আমি সারাদিন কখনো নীরা, কখনো লাবন্য আবার কখনো হিমুর প্রেমিকা হিসেবে নিজেকে ভাবি। আমার মধ্যে উপন্যাসের সব চরিত্ররা এসে ভর করে। জেগে জেগেও স্বপ্ন দেখি। মনে মনে ভাবতাম আমার স্বামী হবে কানাবাবা শুভ্রর মতো আবার হিমুর মতোই ঘুরঘুরিয়া, কখনো আবার ফেলুদার মতো ব্যক্তিত্বের কিংবা বুদ্ধিমান। আমার উনি কাজ যাই করুক সমস্যা নাই শুধু বই প্রেমি হলেই হবে। বিয়ের পর অবশ্য বুঝেছি উনি বিশাল বই প্রেমি তবে গল্প কবিতার বইয়ের না, সংখ্যার বইয়ের। উনি পরিসংখ্যানবিদ, সারাদিন ডাটা আর ডিজিটেই ডুবে থাকেন।
যাক যা বলছিলাম, বিয়ের আগে আমাদের দেখা তো দূরের কথা, ঠিকমত কথাও হয়নি। দু-দিন ফোনে কথা হয়েছে৷ তাও কেমন আছেন? কি করছেন? আর চা খেয়েছি কিনা এই প্রশ্ন-উত্তর এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমি নামেই বিভোর ছিলাম আর উনি চায়ে! আমার বাসার সবাই ওনার প্রশংসায় পঞ্চ না অষ্টমুখ। আজকের যুগে এমন মানুষ পাওয়াই যায় না৷ দশটা কথা বললে একটা জবাব দেয় তাও দুই তিন শব্দের চেয়ে বেশী পাওয়া যাবে না নিশ্চিত। এদিকে আমি হচ্ছি মোটামুটি দুই ধরনের৷ কখনো বইয়ে ডুবে আছি তো নিশ্চুপ, আবার কখনো মৌমাছির মতো গুনগুনাচ্ছি। কথা বলা ছাড়া শুধু একটা সময়ই থাকি যখন বই পড়ি। এমনকি আমি নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও অনর্গল কথা বলে যাই। এতো কথা বলি যে, কি নিয়ে কথা বলছিলাম তাও মাঝে মাঝে ভুলে যাই। এই এখন যেমন বাসর রাতের কথা বলতে গিয়ে কিসব বলেই যাচ্ছি!
আমাদের বিয়েটা খুব অল্প সময়েই হয়ে গেল। আমরা তিন বোন আমি বড়৷ বাবা কলেজে বাংলা পড়ান, আম্মাও একই কলেজের ইতিহাস পড়ান। ছোট বোন সৃষ্টি মেডিক্যাল কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ে আর পুচ্চি কৃষ্টি এবার কলেজ পরীক্ষা দেবে। অন্যদিকে মেঘ আমার শশুড় শাশুড়ির একমাত্র সন্তান। ওনাদের প্রথম তিন সন্তান জন্মের পর মারা গেছে। অনেক কষ্টের বাচ্চা মেঘ। জন্মের পর থেকে এক মূহুর্ত মা ওকে চোখের আড়াল করেননি। আদর আর যত্নে মানুষ হয়েছে। বিয়ের আগে মেঘের সাথে তেমন কথা না হলেও আমার শাশুড়ি মায়ের সাথে প্রতিদিন এক দুই ঘন্টা ফোনে আলাপ হয়েছে। দুজনে চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছি, মেঘের ছোট বেলার গল্প শুনেছি আর আমার হাজার লাখ কাহিনী বলা শেষ। মা বলে দিয়েছেন আমাকে, তাদের ছেলেটা একটু বেশী ভালো ছেলে আর নরম সরম, লাজুক প্রকৃতির। দুনিয়াদারির কিছুই বুঝে না৷ আলাভোলা টাইপের সাথে আবার চোখেও কম দেখে, ভারী চশনা পরে। সবমিলিয়ে তার মায়ের কথায়, পুরাই আতেল। আমাকেই নাকি তাকে মানুষ বানাতে হবে। এখন কি বন মানুষ? জিজ্ঞেস করায় মায়ের সে কি হাসি! থামতেই চায় না। উনি বললেন তুমিই পারবে ওকে সাইজ করতে। মা আমাকে অনেক টিপস দিয়েছেন তার ছেলেকে লাইনে আনার জন্য।
বিয়ের রাতে মেঘের ঘরে ঢুকে আমি তাজ্জব। একটা খুব সিম্পল খাট, একটা আলমিরা, একটা পড়ার টেবিল (অনেক বই আর একটা ল্যাপটপ রাখা), একপাশে একটা টেবিলে ইনডাকশন চুলা, সসপ্যান, চিনি, চাপাতার কৌটা। পাশে একটা ছোট্ট ফ্রিজ (হোটেল রুমে যেমন থাকে)। সব মিলিয়ে আমার কাছে অফিস কাম বেডরুম মনে হলো। ও পিএইচডি করছে, একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াচ্ছে। ক্লাস, আর বই এর মাঝেই ওর জীবন বাঁধা।
আমার শাশুড়ি মা আগেই বলে দিয়েছেন, আমাকেই ওকে মেশাতে হবে, ফ্রি করাতে হবে৷ আমি কত স্বপ্ন দেখতাম, বাসর রাতে আমার জামাই আমাকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাবে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাতে হাত নিয়ে গুনগুনাবে, চাঁদ দেখাবে! সেখানে আমাকে কিনা এখন তাকে সব করাতে হবে! মা বলে দিয়েছেন তার এক এবং একমাত্র দূর্বলতা হচ্ছে চা! সকাল থেকে রাত অব্ধি কম না হলেও দশ বারো কাপ চা পান করে। চাও হতে হবে স্পেশাল। গরুর দুধের সাথে হালকা লিকার আর অল্প লাল চিনি। কাজের লোকের হাতের চা সে খায় না। মা করে দিলে খায় নয়তো নিজেই করে খায়। আর এজন্যই ঘরে চুলা, ফ্রিজ, ফ্রিজে গরুর দুধ সব রাখা থাকে। ও নাকি নাস্তা, চা খেয়ে আবার আলাদা চা খায়! প্রথম চা তো নাস্তার অংশ তাই!
বাসর রাতে ঘরে ঢুকে কোথায় আমি লজ্জা পাবো, গুটিশুটি মেরে বসে থাকবো! না উনি নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে খাটের এক কোন গুটিশুটি মেরে বসে আছেন। আধা ঘন্টায় একটা টু শব্দও করেন নি, মাথা তুলে আমার দিকে ঠিক মতো তাকাতেও পারেনি। শেষে বাধ্য হয়ে আমিই কথা বললাম, কেমন আছ? মেঘ উত্তরে বললো, ভালো-আপনি?
আমি তুমি করে আর উনি আপনি করে বুঝেন অবস্থা!
ঘন্টা খানেক হয়ে গেছে তখনো একই ভাবে বসে আছে দরদর করে ঘামছে। ফ্যান ছেড়ে দিলাম শীতের মাঝেই। হঠাৎ করে মায়ের কথা মনে হলো। জিজ্ঞেস করলাম, চা খাবে? এই প্রথম সে মুখ তুলে তাকালো। চোখ বড় বড় করে (ভারী গ্লাসের চশমার কাঁচের ভিতর দিয়ে চোখ বড় বড় মনে হচ্ছিলো) তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে মাথাটা উপর নিচ করলো বেশ কবার। ওর হাসিটা অদ্ভুৎ মায়াবী। এক হাসিতেই আমি কাত! বিছানা থেকে উঠে বিয়ের শাড়ি আর সাজগোজ নিয়েই চা বানাতে গেলাম। ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে সসপ্যানে ঢেলে একটা এলাচ সাথে একটা দারুচিনির টুকরো দিয়ে দিলাম। বেশ খানিকক্ষণ দুধ জ্বাল দিয়ে তাতে দেড় চামচ চা পাতা ছেড়ে দিলাম। কাপে অল্প চিনি দিয়ে চা ঢেলে ওর সামনে নিয়ে ধরতেই ও কেমন নড়েচড়ে বসলো। ওর নাকে চায়ের সুগন্ধি যাওয়া মাত্র ওর চোখে মুখে অদ্ভুৎ আলো দীপ্তি খেলে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ বুঁজে রইলো ঝাড়া দশ সেকেন্ড। কোন কথাই বললো না, চা কেমন হয়েছে! এক বারেই চা শেষ করে কাপ আমার হাতে তুলে দিল। আমি অবাক হয়ে ওর চা পান দেখছিলাম। কেউ এতোটা নিবিষ্ট মনে আগ্রহ নিয়ে চা পান করতে পারে ওকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। পৃথিবীর অন্যতম সেরা দৃশ্য দেখলাম মনে হচ্ছিলো। কাপটা ধুয়ে এনে টেবিলে রাখতে না রাখতেই মেঘ বললো, কিছু মনে না করলে আরেক কাপ চা বানিয়ে দিবেন?
আমি চোখ গরম করে বললাম দিবো তবে এক শর্তে। আগে আমাকে তুমি করে বলো, তারপর চা পাবে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাটির দিকে তাকিয়ে বললো, আমাকে আরেক কাপ চা বানিয়ে দেবে? চা টা অসাধারণ ছিলো।
এই প্রথম আমি নিজের মানুষের জন্য মনের সব ভালোলাগা মিশিয়ে আবার চা বানিয়ে আনলাম। মেঘ এক নিমিষেই চা শেষ করলো। ওর চা খাওয়াটা অদ্ভুৎ। এক হাতে পিরিচ ধরে রাখে অন্য হাতে কাপ তুলে নেয়। শেষ না করে পিরিচে আর কাপ রাখেই না৷ চুমুকে চুমুকে চা শেষ! পনের মিনিটের মাথায় আবার যখন চা চাইলো তখনই মাথায় বুদ্ধি খেললো।
এবার চা চাইতেই আমি শর্ত দিয়ে বসলাম আবার। তুমি যেহেতু এক হাতে পিরিচ ধরে রাখো তার মানে ওই হাতের তখন কোন কাজ থাকে না। তাই যতক্ষন চা শেষ না হবে ততক্ষণ ওই হাত দিয়ে আমার হাত ধরে রাখতে হবে। প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না কিন্তু চায়ের নেশায় শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলো। আমিও দ্রুত চা বানিয়ে ওর পাশে বসে ওকে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলাম সাথে আমার ডান হাতটাও বাড়িয়ে দিলাম। সে ডান হাতে চায়ের কাপ নিলো আর বাহাত! পুরোপুরি কাঁপছে, এগোয় আবার পেছায়। কি একটা অবস্থা! শেষ পর্যন্ত আমিই হাত বাড়িয়ে ওর হাত ধরলাম। মনে হলো দুজনই বিদ্যুতায়িত হলাম পুরো শরীরে ভেতরে ৪৪০ ভোল্ট প্রবাহিত হলো। কিন্তু কেউই কারো হাত ছাড়লাম না। কেমন এক ভালোলাগা বলে বোঝাতে পারবো না। নিজের মানুষের অল্প একটু ছোঁয়া যে এতো ভালোলাগার হতে পারে, এই প্রথম জানলাম। তবে মেঘ তাড়াতাড়ি হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিতে খুব দ্রুত গরম চা পান করতে গিয়ে জিহবা পুড়িয়ে ফেললো। চল্লিশ পঞ্চাশ সেকেন্ডেই চা পান শেষ।
মিনিট বিশেক পরে আবার যখন ও চা চাইলো, তখন আমারও সাহস আর ইচ্ছে গেলো বেড়ে। এবার শর্ত দিলাম চা পান করতে যতক্ষন লাগবে ঠিক ততক্ষনই আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে হবে। সে রাজি হলো না। আমিও চা দিলাম না। পাঁচ মিনিট গাইগুই করে গররাজি হলো মেঘ। আমি এর মধ্যে বিয়ের শাড়ী, গহনা সাজ পালটে নিয়ে রাতের পোশাক পরে নিয়েছি। চা বানিয়ে এনে ওর হাতে ধরিয়ে ফোনে স্টপ ওয়াচ চালু করে নিলাম। ও শরবতের মতো করেই চা পান করলো চল্লিশ সেকেন্ডে। আমি বুঝতে পারছিলাম, এবারো ও মুখ পুড়িয়েছে গরম চা দিয়ে। মুখ হা করে বসে আছে। আমি বললাম কই ধরো আমাকে। ও পারলে পেছাতে গিয়ে খাট থেকেই পরে যাচ্ছিলো, উল্টো আমিই ওকে ধরলাম। ওর যদি ছবি তুলে রাখতে পারতাম! ফর্সা মুখ পুরো টুকটুকে লালা। লজ্জায় চোখ তুলে চাইতেই পারছে না। আমাকে জড়িয়ে ধরেছে ঠিকই কিন্তু দুজনের ভিতরে আরেকজন দাঁড়াবার মতো ফাঁকা রেখে। আমিও আর জোড় করলাম না। ওর দৃষ্টি দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার দিকে। চল্লিশ সেকেন্ড হওয়া মাত্রই আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো মনে হয়। তবে এবার আগের চেয়ে বেশ প্রফুল্ল এবং স্বাভাবিক মনে হলো ওকে। এক দুবার চোখে চোখ রেখে কথাও বললো। আমি মায়ের বুদ্ধি মতো, তার ক্লাস আর পড়ালেখা নিয়ে কথা বলতেই অনেকটা সহজ হয়ে এলো।
পঞ্চম বার চা চাইলে আমি এবার একটু দুঃসাহসিক কাজ করলাম। কঠিন শর্তারোপ করলাম। এবার চা পেতে হলে ওকে একটা চা মাখা ঠোঁট দিয়ে আমাকে আদর দিতে হবে৷ ভেবেছিলাম ও রাজি হবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও রাজি হয়ে গেলো। ওর এই রাজি হওয়াতে এবার আমিই লজ্জা পেলাম। কেমন হাত পায়ে আড়ষ্টতা পেয়ে বসলো। চা বানাতেই পারছিলাম না। কি হবে ভাবতেই কেমন প্রজাপতি উড়ছে মনে। চা দিলাম ওর হাতে, এবার আমার হাতই কাঁপছে। ও ধীরস্থিরভাবে চা হাতে নিলো, সময় নিয়েই এবার পান করলো। প্রায় দেড় মিনিট লাগল চা শেষ করতে। খালি কাপ আমার হাতে তুলে দিতেই পাঁচ সাত ফিট দূরত্ব আমার কাছে মাইল খানেক মনে হচ্ছিলো। কাপ রেখে ফিরে আসতেই ও আমার সামনে দাঁড়ালো। এরপর হঠাৎ কি যে হলো, দেড় মিনিট সময় বরাদ্দ ছিলো। কখন সেটা তিন মিনিট ছাড়িয়ে গেছে টের পাইনি৷ তবে আমার বানানো চায়ের হাল্কা সুগন্ধি আর স্বাদ এবার আমি নিজেও অনুভব করলাম ওর ঠোঁট দিয়েই। হাজার কথায় যতোটা কাছের, নিজের মানুষ হয় তারচাইতে অনেক বেশী কাছের হয় একটা গাঢ় স্পর্শেই!
ষষ্ঠ আর সপ্তম বার চা বানিয়ে খাওয়ালাম ওকে। তবে এই দুবার কি শর্ত? কে কাকে দিয়েছিলাম তা না হয় তোলা থাকলো আরেক দিনের জন্য। শুধু এটুকুই বলছি, চা নামের এই পানীয় সেই রাতে অনেক কিছুরই স্বাক্ষী হয়ে রইলো, সাথে মেঘ ও বৃষ্টির ভালোবাসার গল্পেরও।
– Rakib Shams Shuvro
Send private message to author





