আর্তনাদ।

আমাকে ধর্ষণ করা হলো গতরাতে। শুনলাম আমার বাবারও না-কি একই রকম কষ্ট হচ্ছে। তারও না-কি মাথার চুল থেকে শুরু করে শরীরের প্রতিটা লোম টেনে তুলার কষ্ট অনুভব হচ্ছে, সিগারেটের আগুনে দগ্ধ হওয়া শরীরের কষ্ট হচ্ছে।

শুনলাম, আমার মায়েরও না-কি আমার মতো করেই কষ্ট হচ্ছে। আমার তলপেটের সামান্য নিচের অংশে অনবরত ছুড়ি দিয়ে কাটার কষ্ট না-কি তারও অনুভব হচ্ছে, হাত পা শক্ত করে চেপে ধরার কষ্ট হচ্ছে।

শুনলাম, আমার ছোটো বোনটারও না-কি আমার মতো করেই কষ্ট হচ্ছে। তারও বুকের মাংস্পিণ্ডটা কেউ সজোরে কামড়ে দিয়েছে, রক্তাক্ত করেছে পুরোটা শরীর, জিভের অংশ, ঠোঁট গলা সবকিছুতেই না-কি কামড়ে আর খামচে ধরেছিল কেউ।

শুনলাম, আমার ছোটো ভাইটারও না-কি একই রকম করেই কষ্ট হচ্ছে। তার মুখেও না-কি চুনকালি পড়েছে, তাইতো আজ বিকালে ব্যাট বল হাতে পাড়ার মাঠে দৌড়ে যেতে দেখেনি কেউ।

আজ আমাদের তুলসি তলায় প্রদীপ জ্বলেনি, মা আরতি দেয়নি, পায়ে আলতা পরেনি, জলের গ্লাসের জল পালটে দেয়নি, মায়ের লাল সাদা শাড়িটাও আজ পরা হয়নি। আজ আমাদের তিন ভাইবোনের মারামারিও হয়নি।

আমাদের ঘরে আজ উনুন জ্বলেনি, রান্না হয়নি। আজ মা আমাকে তরকারি কুটতেও বলেনি, কুয়ো থেকে জল তুলার কথা না শুনলে চুলের মুঠি ধরে মারতেও আসেনি। আজ আমাদের খাওয়া হয়নি। আজ মায়ের কাছে বায়না করে বলেনি, মা, বিশটা টাকা দাও ফুচকা খেতে যাব, সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো।

আমি তো সন্ধ্যার আগেই ফিরছিলাম। রাস্তায় পথ আটকে দাঁড়ালো পাশের বাড়ির নিতাই’দা। আমাকে বললো, “এই চারু, হাটে যাবি? রথের মেলার সাজটা কেমন হলো দেখে আসবি, আগে আগে দেখে এসে বান্ধবীদের সাথে গল্প করে বেড়াবি। সন্ধ্যার এখনও ঢেড় দেরি, আমার গাড়িতে করে যাব আর আসবো।”

সন্ধ্যা হলো। তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বললো। জলের গ্লাসে জল ভরা হলো। শাড়ির অংশে তুলসী তলাটাকে মুছে দিয়ে গড় করে প্রণাম করা হলো। মা শাড়ি পাল্টালো, রান্নাঘরে গেলো, চারু চারু করে ডাকলো। ছোটো বোন পড়া শেষ করে ফিরলো, ভাই ফিরলো, বাবাও ফিরলো, শুধু আমিই ফিরতে পারলাম না। চারদিকে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। এই পথে দিনের বেলা এসেছি বহুবার কিন্তু আজ সবই অন্ধকার, চোখে যেন দেখছি না কিছুই।

অন্ধকারে আমার চিৎকার প্রথমে শুনতে পেলো নিরুদা। সে শুধু আমাকেই দেখতে পেলো, নিতাইদা’র জ্বলন্ত সিগারেটের আগুন তখনও যে আমার ঠোঁট পুড়াচ্ছে তা সে দেখতে পেলো না। দেখতেও পারবে না, নিতাইদা’দের বাড়িতেই যে মানুষ হয়েছে সে। আমার বাড়িতে খবর পাঠালো, মা বাবা পাগলের মতো ছুটে আসলো, আমার বেহুশ হয়ে যাওয়া শরীরটা খুব যত্ন করে আগলিয়ে বাড়ি নিয়ে গেল।

পাড়াপড়শিরা এলো। সাতকাণ্ড রামায়ণ শুনালো। গল্প বানালো। দোষ গুণ যাচাই বাছাই করলো।
আত্মীয় স্বজনেরা এলো। আমার উপর দোষ চাপালো। চিৎকার চেচামেচি করে পাড়া সুদ্ধ লোক জড়ো করেছি যে, এইবার আমার বিয়ে হবে না বলে আফসোস করলো।

পুলিশ এলো। আমার সামনে সাদা কাগজে কী কী যেন লিখলো৷ মিডিয়ার লোক আসলো। মায়ের কাছে আমার ছবি চাইলো, শার্ট, টি শার্ট, স্কার্ট পরা কোনো ছবি। যেন সবাই বলতে পারে, আমি ধর্ষণ হয়েছি পোশাকের জন্য। সন্ধ্যার পর একা একটা মেয়ে মানুষ বাইরে ছিলাম বলেও ধর্ষণ হয়েছি। খবর ছাপা হলো, পত্রিকার বিক্রি বাড়লো। খবরের চ্যানেলের টিআরপি বাড়লো। পুলিশ ঘুষ পেলো। শুধু চারুলতা বিচার পেলো না।

নিতাইদা, আমাকে ধর্ষণ করার পর কয়েক গোছা দড়ি রেখে গেলেই আমরা পরিবারের সবাই সেখানে ঝুলে যেতে পারতাম। তাহলে তোমাকে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা, পুলিশকে ঘুষ দেওয়া, এলাকার মান্যগণ্য লোককে হাত করা কিংবা নিরুদা’র বোনের বিয়ের খরচের দায়িত্ব নিতে হতো না তোমার বাবাকে।

এরপরের বার কাউকে ধর্ষণ করলে সাথে কয়েক গোছা দড়ি নিয়ে যেয়ো…..।

লেখা : Esrat emu.

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
1
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Esrat Emu
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!