হলদে পাখি

আমাদের ঘরের বাইরে উঠান৷ তারপর দু’টো বেলের গাছ। গাছের পর সেই খড়খড়ে উঠানের আরো খানিক বাদে বড় চাচীদের ঘর। পাকা বারান্দার পরে রঙিন টিনের বেড়া। মাঝে মাঝে বড় চাচী সে বারান্দায় দাঁড়ায়ে দক্ষিণ দিকে উদাস হয়া তাকায় থাকেন৷ আমারে দেখলে আদর কইরা ডাকেন, ‘এ ছোট্টু শুনে যা’। গেলেই জিজ্ঞেস করেন, ভাত ‘খাইছিস?’ আমি মাথা দোলায়ে যদি বলি খাইছি, তারপরও বড় চাচী বিশ্বাস করেন না। বলেন, ‘পেটটা শুকায়ে কাঠ হয়া আছে যে! কৈ মাছের তরকারী রানছি, সাথে লাল শাক।’ বলেই প্লেটে ভাত নিয়ে আসেন। সাদা ভাতে লাল শাক যেন সাদা শাড়ির পাড়ের মত টকটকে কইরা ফোটে।

বিকেল বেলা ডাকেন খই মাখা খাইতে। আমি ছুটে যাই। বড় চাচী আমারে একশো একটা কথা জিজ্ঞেস করেন। ঠিকমত পড়তেছি কি না, খাতাপত্র সব হারায়ে আসছি কি না ইত্যাদি। আমি মুড়ি চিবাই, মাথা দুলায়ে বলি- সব আছে ঠিকঠাক।

আমি সারা বাড়ি দৌড়ায়ে খেলি। বড় চাচী বারান্দায় দাঁড়ায়া বলেন, ‘ছোট্টু আস্তে দৌড়া। পড়ে যাবি তো।’ আমি আরো জোরে দৌড়াই। পড়ে যাওয়ার ভয়-ডর যে আমার করে না।

সূর্য মাথার উপর ঘোরে। পুকুর পাড়ে কদম ডালে একটা হলদে পাখির বাসা। বিকেল হইলে সে সুর কইরা কইরা ডাকে।

বৈশাখ মাসে পলাশতলী মেলা হয়। সাতদিনের মেলায় কী না আসে! হাড়ি, পাতিল, টমটম, সার্কাস, নাগরদোলা গুণে শেষ করা যায় না। মেলার একপাশ থেকে ঘুরে আরেকপাশে যাইতে যাইতে ক্ষিধা লাগে। আর আসে সাহা দের সন্দেশ। ঘ্রাণে পুরা মেলা ভন ভন করে পাক খায়। বড় চাচী প্রতিদিন আমারে দশটাকা দেন। আমি সারা মেলা ঘুরেও দশটাকা শেষ করার জায়গা খুঁইজা পাই না।

সেবার মেলায় ঝড় উঠলো। বৃষ্টির খবর নাই। আমি হাতের মাঝে কাগজের মধ্যে সন্দেশ নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়াই। একখানা আমার, আরেখানা মা’র, আর একটা বড় চাচীর। চাচীর জন্য আমি কিছু কিনতে পারি নাই কোনদিন। এই প্রথম চাচীর জন্য সন্দেশ নিয়ে যাইতেছি। কী যে আনন্দ! বাড়ি যাইতে যাইতে ঝড় থামলো। উত্তরের আকাশ কালো মুখ করে বৃষ্টি নামাইলো। আমার হাতের কাগজ ভিজে সন্দেশ গলতেছে। আমি দৌড়াইতেছি, দৌড়াইতেছি আর দৌড়াইতেছি। থামতেছি না কোথাও।

বাড়ি আইসা গেলাম বড় চাচীর ঘরে। বড় চাচী কোথাও নাই। না ঘর, না বারান্দা, না পাকের ঘর। সব শূণ্য। উলটে পড়ে আছে পানির কলস, ভাতের পাতিল।

মা’র কাছে আইসা জিজ্ঞাস করলাম, মা, বড় চাচী কই?’ মা কথা কইলো না। চুপ করে থাকলো। আমি সেদিন একটা নতুন শব্দ শিখলাম। ‘তালাক’। যদিও মানে বুঝি নাই।

এরপর আর বড় চাচীকে দেখি নাই। পুকুর পাড়ে জলের উপর যে কদম গাছ আছিলো৷ তা ভাঙলো সেদিনের ঝড়ে। ঘর হারানোর শোকে হলদে পাখিটা কই হারাইলো জানা গেল না।

বছর ঘুরলো। পলাশতলীর মেলা বসলো। সাহা রা সন্দেশ আনলো। বড় চাচা নতুন বড় চাচী ঘরে তুললো। আমি কেবল সে বেল গাছের ওপার থাইকা দেখলাম। না গেলাম বড় চাচার ঘরে, না গেলাম পলাশতলীর মেলায়। আমার পেট শুকায়ে কাঠ হইলো। কৈ মাছটা বিদেয় নিলো পাখানা ঝাপটাইতে ঝাপটাইতে, দেখলাম না আর লাল শাক। বারান্দার তারে উড়লো না বড় চাচীর লাল সাদা শাড়ি।

দিন কাটলো। খাতা কলম হারায়ে স্কুল পাশ করলাম। শহর গেলাম। বড় শিক্ষাও নিলাম। ডিগ্রি জুটলো কত! যেন সেই পলাশতলী মেলার পসরা। সেকেন্ডারি, হায়ার সেকেন্ডারি, অনার্স, মাস্টার্স কত কী! ওদিকে বন্যা হইলো। খড়া হইলো। বড় চাচার দুইটা বাচ্চা জন্মিলো। তারা এখন সারা বাড়ি দৌড়ায়া বেড়ায়। আছাড়ও খায়। আমি আমাগো বারান্দায় বইসা বইসা ইংরেজি সাহিত্যর বইগুলান এপিঠ ওপিঠ করি খালি।

একদিন বৈশাখমাস। শুনশান চারপাশ। ঝড় নাইয়োর আসবো। বাজনা বাজে সবখানে।

আমি রওনা হইলাম আমিনপুর; বড় চাচীর বাপের বাড়ি। গেলাম। আমাকে কেউ চিনলো না। জিগাইলো- কার কাছে আসছেন? আমি কোন উত্তর দিলাম না। গিয়া দেখি একটা দ্বোচালা ঘরের মেঝেতে পাটি বিছায়া শুয়া আছে বড় চাচী। চুল পেকে যেন হয়ে আছে ধবধবে সাদা শাড়ি। চোখের দৃষ্টি বানের ঘোলা জল। গিয়া খাড়াইলাম দরজায়। সাথে সাথে উইঠা বসলেন বড় চাচী। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে?’। আমার মুখের দিকে তাকায়া চুপ থাকলেন খানিক্ষন। এরপর কইলেন, ‘ছোট্টু বাজান?’ আমি কাছে গেলাম। কইলাম, ‘আমি আপনারে নিতে আসছি।’ বড় চাচী আমার মুখের দিকে তাকায় আছেন। কথা কইতে পারেন না। দম ফেলায় কইলেন, ‘কই?’

কইলাম, ‘আমাগো বাড়ি। পলাশতলী মেলা লাগছে। কত কী যে উঠছে এবার! চলেন।’

আমি বড় চাচীরে সাথে নিয়ে বাড়ি আইলাম। আসমান ভাইঙা বৃষ্টি হইতেছে। পুকুর পাড়ে আমের গাছে একটা হলদে পাখি সে বৃষ্টির মাঝেও সুর কইরা ডাকতেছে।

-Afm Ariful Islam

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
43
0
2
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Afm Ariful Islam
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Nadim Satej
Member
4 years ago

খুবই সুন্দর!! ভালো ছিল অনেক। মন ছুঁয়ে গেছে♥♥

বিড়ালের মা
Guest
বিড়ালের মা
4 years ago

অসাধারণ ❤️

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!