দুটি মেয়ের জন্মদিনেই দুপুরে বাসায় মিলাদের আয়োজন করে আশা । পাশেই এতিমখানায় খাবার পাঠিয়ে দেয়। কয়েকটি মসজিদের হুজুরদের দাওয়াত করে, বাসায় নানান পদের খাবার রান্না করে।
খুব কাছের আত্মীয় স্বজনদের জন্মদিনের কথা বলেনা। মিলাদের দাওয়াত দেয়। যাতে গিফট এর ঝামেলায় কেউই না যায়।
সবাইকে রাতেও খেয়ে যাবার অনুরোধ করে।
বিকেল থেকে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি চলতে থাকে সে অনুষ্ঠান।
এবার অতিথির তালিকায় ওর প্রিয় এক ননদ তামান্নার সাথে দেখা হবে কয়েকবছর পরে। তামান্না ফুফাতো ননদ হলেও নিজের ননদ না থাকাতে ভীষণ ভালবাসে আশা।
আশার বিয়ের পর থেকে প্রায়ই তামান্না মাসখানেক থাকতো যখনই আসতো আশার বাসায়।
তামান্না এলে আশা এখানে সেখানে ঘুরতে যেতো সময়টা দারুণ ভাবে কেটে যেতো।
তামান্নার প্রেমিক যখন ধোঁকা দিয়ে বিয়ে করে ফেলেছিল অন্য একজন কে। তখন মন খারাপ করে আশার কাছে চলে এসেছিল তামান্না।
আশা আগলে রেখেছিল। তামান্নার কষ্ট না হবার জন্য অনেক ঘুরছে সেবার, শপিং করেছে প্রচুর।
এমনকি রাতে যাতে তামান্না মনের দুঃখে আত্মহত্যা করে না বসে,রাতে উঠে এসে বারবার দেখে যেতো আশা। চুলে তেল লাগিয়ে দিতো। তামান্নার চোখের জল মুছে দিয়ে ঘুমানোর জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো ……
বাড়িতে ফিরে যাবার কয়েকমাসের মধ্যে তামান্নার বিয়ে হয়ে যায়। আশার স্বামী বাপ্পি তখন খুব ব্যস্ত ছিল বলে আশা যেতে পারেনি।
তামান্না খুব মন খারাপ করে ছিল আশা না যাওয়াতে।
আশার স্বামী তার মাকে তামান্নার বিয়েতে উপহারের জন্য টাকা পাঠালে ও,আশা তামান্নার পছন্দ মতো আলাদা উপহার পাঠিয়েছিল।
বিয়ের পর ঢাকায় চলে যাওয়ায় তামান্না, আর দেখা হয়নি ওর সাথে আশার।
এবার তামান্না ওর খালা শ্বাশুড়ির বাসায় এসেছে কয়েকদিন হলো।
আশা ওর মেয়ের জন্মদিনে তামান্না কে দাওয়াত দিল।জন্মদিনের কথা না বলেই।
উচ্ছ্বসিত আশা। অনেক বছর পরে প্রিয় মুখটা দেখবে।
সেদিনের তামান্না এখন এক ছেলের মা!
দুপুরের আগেই তামান্না এলো। সাথে ওর শ্বশুড়বাড়ির আত্মীয় কয়েকজন।
ব্যস্ততার মাঝে ও,অনেক অতিথি থেকে তামান্নার দিকে খেয়াল রেখেছে আশা।
নিজের বোনদের ও তামান্নার সাথে কথা বলার জন্য বারবার অনুরোধ করে ছিল।
সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ শেষ করে আশা যে শাড়িটা পরবে ঠিক করে ছিল সেটা সুন্দর কিনা দেখানোর জন্য ওর বোন আভাকে ডেকে ওর সাথে হাসতে হাসতে কথা বলছিল।
খাটে বসেছিল তামান্না আর ওর আত্মীয়রা।
তামান্না বলে উঠলো, “দুই মেয়ের মা এখনো কতো ডং। আগের মতো চঞ্চল! “
আশা অবাক হয়ে গেলো ওর কথা শুনে!
বললো, “দুই মেয়ের মা বলে কি চঞ্চলতা থাকবে না? এটা কেমন কথা? “
বুড়ী মহিলার মতো বললো, “মেয়ের মার এতো ডং করা ঠিক না!”
আশা আর কিছু বলবে, আভা থামিয়ে দিল।
“বাদ দেন।বিয়ের পরে মুরুব্বি হয়ে গেছে,
দেখেন না,মোটা হয়ে কি অবস্থা। কি বয়স্ক লাগছে। “
আশা শাড়ি পরলে,লম্বা আর ছিপছিপে গড়নের জন্য অনেক সুন্দর লাগে।
এ শাড়িটি আরও ভীষণ সুন্দর লাগছে।
কেক কাটার পর্ব শেষ করে আশা বড় পাতিলে বিরানি বসিয়ে, শেষ পর্যায়ে এসে কাজের সাহায্যকারীকে চুলা অল্প করে দিয়ে, খেয়াল রাখতে বলে।
তামান্নার সাথে আশার মেয়ের বান্ধবীর মা কথা বলছে।
আশা এসে বললো, “ভাবী, দুঃখিত। বিরানি বসাতে গিয়েছি,আপনার সাথে কথা ও বলতে পারিনি। “
তামান্না বলে উঠলো, “বিরানি ও রান্না করতে পারো এখন? আমি তো ভেবেছি আগের মতো যখন তখন বাহিরে বেড়াতে গিয়ে দামী রেষ্টুরেন্টেই খাও। ভালো। মেয়ের মায়ের রান্না শেখা উচিৎ। “
আশা বিব্রত হয়ে গেল।
বললো, “ছেলের মায়ের রান্না করতে হয়না। আজ শুনলাম। “
এ কথা বলে অন্য রুমে চলে গেলো।
আশার বোন আভা একসময় ভয় পেতো।
তামান্নাকে আপন ভেবে কোনো আড্ডায় হয়তো বলেছিল আশা। তামান্না অনুষ্ঠানে সবার সামনেই “আভা এখনো আগের মতো ভয় পাও?”
সবাই অবাক হয়ে আভাকে দেখতে লাগলো। আভা লজ্জায় বললো, “কে বলেছে আপনাকে আমি ভয় পেতাম? “
তামান্না বললো, “আশা ভাবী। আগে তোমার এ ভয় পাওয়া রোগ নিয়ে চিন্তা করতো খুব। তখন বলেছিল আমাকে।”
আভা রাগ করে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো অন্য রুমে গিয়ে।
আশা অনেক বুঝিয়ে শান্ত করেছে।
আভা বললো, “দুপুর থেকে এ নিয়ে তামান্না আপু,আমাকে কয়েকবার বলেছে, তোমার বিয়ের দাওয়াত কখন খাবো।প্রেম করো নাকি? তখন কিছু বলি নাই। এখন সবার সামনে ভয়ের কথা আমি ভুলে ও গেছি, উনি মনে রেখেছে। “
তামান্নার উপর মনে মনে রেগে গেলো আশা।
অনুষ্ঠানে আশার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী রুবা এসেছিল। আশাকে বললো, “তুই ইদানীং বেশ ভালো কবিতা লিখছিস।”
আশা ডং করে বললো, “কিছুদিনের মধ্যেই বই পাবি।”
অভিনন্দন! বলিস কি? বলে জড়িয়ে ধরলো রুবা।
হঠাৎই তামান্না মুখ বেঁকিয়ে বললো, “কোন দিন শুনবো কবি, লেখক কারোর সাথে প্রেম হয়ে গেছে। তখন আমার ভাইকে ফেলে রেখে তার সাথে পালাবে!”
প্রচন্ড রেগে গেলেও ঘৃণায় এই কথার জবাব হেসে উড়িয়ে দিলো আশা।
বললো, ” লেখার জন্য স্বামীকে ছাড়বো না।তুই নিশ্চিত থাক!”
আসলে কি বলবে রাগে বুঝতে পারছিল না আশা।
একটা তরুণ মেয়ে, কি উচ্ছলতা, চঞ্চলতায় প্রাণবন্ত ছিল।
বিয়ের পর, ছেলের মা হয়ে কি পরিবর্তন!
যাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিল আশা, এখন ও কখন যাবে সে অপেক্ষা করতে লাগলো।
রাতের খাবার শেষ করে বিদায় নেয়ার সময় তামান্না বললো, “আমার ছেলের বাবা বৃহস্পতিবার নিতে আসবে, শনিবার চলে যাবো।ভাবী যদি গাড়ি পাঠিয়ে দাও, তাহলে এসে এর আগে দুই দিন থেকে যাবো।”
আশা বললো, “গাড়ি তো বাপ্পি ইদানীং আমাদের ও দিতে পারে না। ওর কাজ এখন এখান থেকে দূরে পরেছে। তবুও দেখি,যদি পারি পাঠাবো।
আশার বাসায় বিয়ের পর প্রথম এসেছে। তামান্না। আশা ওর জন্য অনেক দামী একটা শাড়ি, দুটো কাজ করা সুতির থ্রিপিস।ওর বরের জন্য পাঞ্জাবি, পারফিউম আরও অনেক কিছু রেখেছিল প্যাকেট করে। খামে করে ওর ছেলের জন্য টাকা ভরে রেখেছিল। সে খামে তামান্নার জন্য একটা চিঠি।
“আবারও আগের মতো মন চায় তোকে নিয়ে ঘুরতে,
ভালবাসি,খুঁজি তোকে পুরনো স্মৃতিতে। “
কিছুই দিলোনা আশা।
এ ভালোবাসা মাখা জিনিসগুলোর মাঝে অকৃত্রিম মমতা বোঝার ক্ষমতা তামান্নার নেই।
আত্মীয় স্বজনরা কেউ এলে আশা নিজেই টাকা, এটাসেটা গিফট দেয়। তামান্না সবচেয়ে প্রিয় আশার তাই অনেক কিছু দিয়েছে অনুমান করে বাপ্পি ও ব্যস্ততার মাঝে কিছু আর বলেনি বোনকে বিদায় জানিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলার জন্য যেতেই তামান্না বললো, “ভাইয়া, আমাদের ভাইপো হবার খবর কখন শোনাবেন?”
বিব্রত হয়ে বাপ্পি বললো, “আল্লাহর ইচ্ছেতে দুই মেয়ে নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”
“না ভাই, একটা ছেলে তো লাগবেই!”
বাপ্পি বললো, ঠিক আছে, রাত হয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় যাবার আগে কয়েকটি দিন থাকিস আমাদের এখানে। ড্রাইভার কে বলে দিয়েছি, তোদের নামিয়ে দিয়ে আসবে। “
আশা কিছুই বললো না।
অন্য অতিথি নিয়ে ব্যস্ততার মাঝে ও তামান্নার কথা গুলো আশার বারবার মনে পড়ছিল। কষ্ট পাচ্ছিল আশা।
দুইদিন ধরে তামান্না ফোন করছে হয়তো বাসায় আসার জন্য। ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে সালাম জানিয়ে, আশা ফোন ও ধরেনি। ম্যাসেজ এর জবাব ও দেয়নি।
তামান্না জানে, আশার বাসা থেকে উপহার টাকা না নিয়ে কোনো অতিথি যায়নি। ভেবেছে অনুষ্ঠানে অতিথিদের সামনে হয়তো দেয়নি বা ব্যস্ততায় ভুলে গেছে। তাই আশার বাসায় আসার জন্য ছটফট করছিল।
বাপ্পি আজ ঢাকা যাবে বিকেলে। আশা বললো, “কবে ফিরবে ঢাকা থেকে?”
বাপ্পি বললো, কাজ শেষ হলে রবিবার চলে আসবো। “
“তাহলে আমি মায়ের বাসায় বৃহস্পতি,শুক্রবার থেকে আসি। অনেক দিন যাওয়া হচ্ছে না। শনিবার চলে আসবো।”
“ঠিক আছে যাও।”
আশা মায়ের বাসায় ইচ্ছে করেই হঠাৎ এসেছে। যাতে তামান্নার সাথে আর দেখা না হয়।
আশা তার শ্বশুড়বাড়ির অন্য ননদ গুলোর থেকে তামান্না কে ভীষণ ভালোবাসতো।এখন দেখছে সবগুলো একই রকম।
বিয়ের পর পর চাচাতো ননদ,জেঠাতো ননদ দুজন আসতো, থাকতো। প্রতিবার বাপ্পি ওরা চলে যাবার আগে শপিং করার জন্য আশা কে টাকা দিতো।আশা জামা, কানের দুল এটা সেটা কিনে দিতো।
একবার, বাপ্পির টাকার সমস্যা ছিল। তবুও ১৫০০ টাকা দেখা বললো, “কিছু কিনে দিও,ওদের।”
“১৫০০ টাকায় কি হবে? আরও ৫০০ দাও।”
বাপ্পি বিরক্ত হয়ে ৫০০ টাকা আশাকে দিয়ে বললো, “প্রতিবার জামাকাপড় দিতে হয়?”
আশা বললো, “আস্তে বলো শুনতে পাবে।”
দুই ননদিনীকে নিয়ে আশা শপিং এ গেলো। ওরা অনেক দামী থ্রিপিস দেখছিল। আশা ওর বাজেট অনুযায়ী দামের থ্রি পিস দেখতে বললো দোকানদারকে।
তবু্ও নিজের থেকে ২০০ টাকা দিয়ে দুটো থ্রি পিস কিনে দিয়েছিল ১১০০ টাকা করে।
হালকা নাস্তা করিয়ে বাসায় নিয়ে এসেছিল ওদের আর কিছু কিনে না দিয়ে।
বাসায় এসে আশা খেয়াল করছিল। ওরা দুজন আশার সাথে কথা বলছে না।বারান্দায় বসে ফিসফাস করছে। আশা কে দেখে মুখ থমথমে।
ওরা ভেবেছিল, আশা ইচ্ছে করে কম দামী থ্রিপিস কিনে দিয়ে বাকি টাকা রেখে দিয়েছে।
রাতে বাপ্পি এলে, আশা খাবার টেবিলে দুই ননদিনীকে শুনিয়ে বললো, “তুমি তো প্রথমে ১৫০০ টাকা দিয়েছিলে, আমি জোর করে ৫০০ বাড়িয়ে নিয়েছি।তবুও আমার থেকে আরও ২০০ টাকা দিয়ে তোমার বোনদের জন্য থ্রিপিস পেয়েছি। ইদানীং সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। তুমিতো শপিং করোনা তাই চিন্তাও করতে পারোনা। দামের কি অবস্থা!
এরপর দুজন স্বাভাবিক হয়েছিল।
অথচ এখন দুজনের বিয়ে হয়েছে। কখনো আশার জন্য কিছু উপহার পাঠায়নি।
এমনকি আশা গ্রামে গেলে, শ্বশুড়বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি চলে আসে। সেখানেই দেখা করে যায়।নিজেদের ওখানে দাওয়াত ও দেয়না।
চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে এলো আশা, তামান্নার ফোন বাজছে।
আশা রিসিভ করলো, হ্যালো বলতেই, তামান্না বললো, “ভাবী ভাই নাকি ঢাকা তুমি বাবার বাড়ি? “
“হুম, অনেক দিন আসা হয়না। তোর ভাই ঢাকায় যাচ্ছে শুনে আমিও হঠাৎই চলে এসেছি। “
“তোমাকে এতোবার ফোন দেই ধরো না। তাই ভাইকে ফোন দিয়ে শুনলাম তোমরা কেউ বাসায় নেই।কাল আমার ছেলের বাবা আসবে। তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবো ভেবেছিলাম। “
আশা বললো, “ফোন তো তোমার ভাইঝি দের কাছে বেশি থাকে।গেইমস খেলে।খালামনিকে ভিডিও কল করে।খেয়াল করিনি।”
“ভাই ও তাই বললো। তাহলে তোমার সাথে দেখা হবেনা আর?”
“সেদিন তো দেখা হলো। আবার এলে কখনো বেড়াতে এসো,আমাদের বাসায়। ঠিক আছে, রাখি।” বলে ফোন কেটে দিলো, আশা!
অবাক হয়ে গেলো তামান্না।
ছেলের বাবাকে বলেছিল , “আশার বাসায় এলে অনেক কিছু উপহার পাবে। প্রতিবার পায় অনেক কিছু, সব বলেছে। আশা ভাবী এতো ছোটলোক, হিংসুটে হয়েছে এখন জানলে ছেলের বাবাকে কিছুই বলতোনা।এখন নিজেই লজ্জা পাচ্ছে।
শনিবার তামান্না ঢাকায় চলে যায়।
আশা নিজের ঘরে ফিরে এসে প্যাকেট টা ছিড়ে খাম নিয়ে টাকা গুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।পঙতি গুলো ছিড়ে বাতাসে উড়িয়ে দিলো। অন্য উপহার গুলো নিজের জন্য রাখতে গিয়ে ভাবলো “শুধু অপমানজনক কথা বলার জন্য উপহার গুলো তামান্নার হলো না।
আসলে ভালবাসা দিয়েই অমূল্য ভালবাসা পাওয়া যায়। তামান্না শেষে উপহার পাবার আসায় দেখা করতে উদগ্রীব হয়ে ছিল। অথচ দেখা হবার সময় যদি সম্মান রেখে কথা বলতো,সবকিছু এমনিতেই পেত। যা ওর জন্যই যত্নে রাখা ছিল।দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশা, ভাবলো, ” একজন কে কষ্ট দিয়ে কথা বলে আসলেই কি সুখ পাওয়া যায়? এটা তো অসুস্থ মানসিকতার পরিচয়!”
– শিরিন আক্তার আইভি ( Shirine Akther Ivy )
Send private message to author






