ল্যাপটপ

ঘুম থেকে উঠেই মেসেঞ্জার চেক করা বহুদিনের অভ্যাস। আজও ব্যাতিক্রম হয় নি। চেক করতে করতে হঠাৎ থমকে যেতে হলো।

ইউনিভার্সিটি জীবনের এক বড় ভাই মেসেজ দিয়েছেন। খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। অস্বাভাবিক ব্যাপারটা হচ্ছে, বড় ভাই মারা গিয়েছেন প্রায় দুবছর আগে।

আমার ফ্রেন্ডলিস্টে কিছু প্রোফাইল আছে মৃত।
এই প্রোফাইলের মালিকেরা আজ আর আমাদের মাঝে নেই। স্মৃৃতির জন্য আমি আনফ্রেন্ড করি না। প্রোফাইল গুলো থেকে মাঝে মাঝে ঘুরে আসি। একমূহুর্তের জন্যে হলেও মন অতীতে ফিরে যায়।

বড় ভাই মেসেজ দিয়েছেন, “ভালো আছিস। তোদের দেখতে বড় ইচ্ছা হয় রে”!

মানুষ কিছু না বুঝলে প্রথমে অবাক হয়। তারপরে এই অনুভূতিটা পাল্টে যায় আতংকে। কিছুক্ষনের জন্যে থমকে গেলাম। তারপর ফোন দিলাম আমার ইউনিভার্সিটির কাছের এক বন্ধুকে। বিদেশে থাকে, কিছুদিনের জন্য দেশে এসেছে। বেঁচে থাকতে আমাদের দুজনকেই ভাইয়া অনেক আদর করতেন।
আজকাল এই বন্ধুটির সাথেও আর দেখা হয় না।

সে প্রথমে আমার ফোন পেয়ে খুব অবাক হলো।
আরো অবাক হলো ফোন করার কারণ শুনে।

ইউনিভার্সিটি ছেড়ে আসার পর আমরা কয়েকবার ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম।
ভাইয়া আমাদের খুব সমাদর করতেন। ভাবী নিজ হাতে আমাদের রান্না করে খাওয়াতেন। তার গ্রামের বাড়িতে কাটানো প্রতি দিনই একটা উৎসব ছিলো।
যতদূর জানি সেখানেই ভাইয়ার কবর হয়।
দুজনেই ঠিক করলাম ভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে যাবো।

আমরা গাড়িতে করে গ্রামের দিকে যাচ্ছি। অনেক কথা হলো যেতে যেতে। নিজেদের কথা হলো।নিজেদের পরিবারের কথা হলো। সেই বড় ভাইয়ের কথা হলো। একসময়ের বৈরাগী ছেলেগুলো আজ পুরোদস্তুর সংসারী। তবে জীবন অনেককিছু কেড়ে নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে। আমরা আর আগের মতো থাকতে পারি নি।

ভাইয়ার বাড়ি পৌঁছে গেলাম বিকালের আগেই। পুরো বাড়িই প্রায় ফাঁকা। ভাবীও মারা গেছেন এবছর। এখবর আমরা জানতাম না। ভাইয়ার একমাত্র ছেলেটা তার দাদার সাথে থাকে। আমাদেরকে গভীর স্নেহে বুকে টেনে নিলেন তিনি।

আমি সংকোচ করছিলাম বৃদ্ধ এই মানুষটিকে মেসেজটার কথা বলা ঠিক হবে কি না। শেষ পর্যন্ত আর বলতে পারলাম না।

ভাইয়ার ছেলেটার সাথে দেখা হলো আমাদের। আট নয় বছর হবে বয়স। অবিকল ভাইয়ার মতো দেখতে। উঠানে খেলছিলো ছেলেটা।
সে আমাদের দেখে খেলা ফেলে কাছে আসলো।

আমাদের দুজনকেই সে চেনে। তার বাবার ল্যাপটপে ছবি দেখেছে। তার বাবা মার সব জিনিস সে যত্ন করে রেখে দিয়েছে তার কাছে। আমি তার কাছে তার বাবার ল্যাপটপটা একটু দেখতে চাইলাম। সে বাধ্য ছেলের মতো এনে দিলো।

ল্যাপটপে বড় ভাইয়ের ফেসবুকে লগইন করা। মেসেঞ্জার অপশনে গিয়ে দেখি, ফ্রেন্ডলিস্টের সবাইকে একই মেসেজ দেয়া,
“”ভালো আছিস। তোদের দেখতে বড় ইচ্ছা হয় রে”!

আমি প্রশ্ন করলাম, “বাবা এই মেসেজগুলো কি তুমি পাঠিয়েছো”?

মাথা নিচু করে সে বললো হ্যাঁ। কেউ তাকে দেখতে আসে না, ওর খুব খারাপ লাগে একা একা থাকতে।

আমার পাশে বন্ধুটি অঝোরে কাঁদছে। আমারও চোখ ভেজা। এই ছেলেটির বাবা বেঁচে থাকতে ভালোবাসা দিয়ে আমাদের যেভাবে স্পর্শ করেছেন,
ছেলেটিও আজ সেভাবে করে দিলো।

আমরা পরদিন সকালে চলে আসবো। আমার বন্ধুটি বড় ভাইয়ার বাবার পা চেপে ধরলো। সে নিঃসন্তান। স্ত্রীকে নিয়ে একা বিদেশে থাকে। ছেলেটিকে সে তার কাছে নিয়ে যেতে চায়। নিজের ছেলের মতো মানুষ করতে চায়।

বৃদ্ধ রাজি হলেন।
সেদিন আমরা চলে এসেছিলাম। আমার বন্ধু পত্নী দেশে আসেন। তারা ছেলেটিকে দত্তক নেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা চলে যান দেশ ছেড়ে। ছেলেটিও চলে যায় তার নতুন পরিবারের সাথে।

এয়ারপোর্টে আমি তাদের বিদায় দিতে গিয়েছিলাম আমার মেয়েকে নিয়ে। সারাটা পথ এটাই ভেবেছিলাম, একটা মেসেজ থেকে কত কিছু হয়ে গেলো।

যাওয়ার সময় ছেলেটি আমার কাছে আসলো।
সে আমাকে একটি উপহার দিতে চায়।
নিঃশব্দে তার বাবার ল্যাপটপটা সে আমার হাতে তুলে দিলো।

বাড়ি ফিরে আসার সময় সেদিন যেন আমি আমার সেই অকালে চলে যাওয়া বড় ভাইয়ের উপস্থিতি অনুভব করছিলাম।

তিনি যেন চুপ করে স্মিত হাসি হাসছেন।
আসলেই জীবন নাটকের চেয়েও নাটকীয়।

-ল্যাপটপ
Piash Mahboob Khan

Send private message to author
What’s your Reaction?
2
3
0
0
0
2
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Piash Mahboob Khan
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Sanjana
Member
4 years ago

সুন্দর লিখেছেন।

1
Mahi An Nur
Member
Mahi An Nur
4 years ago

ভালো লাগলো

1

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!