ছাত্রাবস্থায় আমার তেমন কোন উপার্জন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম এক বছর অনেক চেষ্টা করেও টিউশন জোগাড় করতে পারিনি। নতুন শহর, নতুন পরিবেশ, চেনাজানা একদমই ছিল না৷ অনেক মানুষকে বলে বলে শেষ পর্যন্ত একজনকে পড়ানোর সুযোগ পেলাম। ছাত্র পাওয়ার সাথে সাথে বাসায় ফোন দিয়ে বলেছিলাম আজ থেকে আমাকে আর খরচের টাকা দিতে হবে না। ফোনের অপাশ থেকে মায়ের “আচ্ছা” শব্দটায় যে অনেকটা তৃপ্তি আর স্বস্তির ভাব ছিল সেটা বুঝেছিলাম।
টিউশনির টাকা দিয়ে নিজের খরচ চালিয়ে দিতাম৷ কষ্ট হলেও বাড়িতে বলতাম না। কিছু টাকা বাঁচিয়ে মায়ের জন্য এটা সেটা কিনতে আমার ভীষণ ইচ্ছে হতো, যদিও সুযোগ হতো না। মায়ের জন্য আমার ভীষণরকম মায়া কাজ করতো। কিন্তু বাবার জন্য এই অনুভূতি কাজ করতো না। আমাদের বাবা চাকরির জন্য বাইরেই থাকতেন। ছুটি ছাড়া বাবা বাসায় আসতেন না। তাই মায়ের সাথে যেমন সম্পর্ক বাবার সাথে সেটা হয়ে উঠেনি কখনও।
প্রতি মাসে বাবা এসে মাসের বাজার করে মায়ের কাছে অল্প কিছু টাকা দিয়ে যেতেন। মা প্রয়োজনের বেশি কখনও বাবাকে বলতেনও না। বাজার শেষ হলেও বাবা জানতেন না। বাবা যখন বাড়ি আসতেন আমাদের ভীষণ আনন্দ হতো। সেই সময় মা ভালো ভালো রান্না করতেন। আমরা সারা মাস বাবার আসার জন্য অপেক্ষা করতাম। মাসে দু’একবার ভালো খাবারের অপেক্ষা করতাম।
বাবা যেই সময় বাড়ি থাকতেন মাকে দেখতাম নিজের পুরোনো ছেঁড়া শাড়িগুলোকে লুকিয়ে কিছুটা ভালো শাড়ি পরতে। পায়ের ছেঁড়া স্যান্ডেল রেখে বাইরে পরার ভালো জুতা পরতেন। চুলে তেল দিতেন। উষ্কখুষ্ক চুলগুলো বেঁধে পরিপাটি হয়ে থাকতেন। সারা মাসের কষ্টের ছাপ মায়ের চেহারাতে আর দেখাই যেতো না।
মায়ের সেই মুখটা দেখে আমার রাগ হতো। মা বাবার থেকে এইভাবে সবকিছু লুকিয়ে যায়। মাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম এমনটা কেন করে। মা বলেছিল, ” পুরুষ মানুষের জন্য সবচেয়ে শান্তির জায়গা হচ্ছে তার ঘর। তোর বাবা সারা মাস বাইরে থাকে। এই কিছুদিন যখন বাড়ি আসে তখন যদি বাড়ির এই অবস্থা দেখে তাহলে তো তোর বাবার ভীষণ কষ্ট হবে। এই যে সুন্দর একটা পরিবেশ দেখে, তার তো এইটুকুতেই শান্তি রে। এসব তুই বুঝবি না৷ সংসার তো সবাই করে কিন্তু সংসারে সুখটা সবাই পায় না। সংসারটাকে নিজের মতো করে সাজাতে হয়। ভালোবাসতে হয়।”
আমার মা হয়তো সবকিছুতেই সুখী ছিলেন। বাবা মায়ের মাঝে অশান্তি বা ঝগড়া হতে আমরা দেখেনি কখনও। মা সবসময় সংসারটাকে আগলিয়েই রাখতেন। আমরাও মাকে কখনও হাউজ-ওয়াইফ বলে পরিচয় দেইনি, মাকে বলেছি হাউজ-মেকার।
ইদে আমরা তিন ভাই-বোনই নতুন কাপড় কিনতাম। বাবাও কিনতো। মা নিজে বাবার জন্য পছন্দ করে কাপড় কিনতো। কাপড় কেনার সময়ও মা বলতেন, “তোদের বাবা বাইরে থাকে। তার সবসময় পরিপাটি থাকা দরকার।” মা নিজের জন্য কিছু কিনতেন না। সেই টাকাটা বাঁচিয়ে ইদে একটু ভালো রান্না করতেন। ইদের আগে মা তার সবগুলো শাড়ি বের করতেন। তারপর অপেক্ষাকৃত ভালো একটাকে খুব ভালো করে ধুয়ে দিতেন। শাড়িতে ভাতের ফেন দিতেন। তারপর সেটা শুকিয়ে ভাঁজ করে বিছানার নিচে রেখে দিতেন। মা ইদে সেই শাড়িটাই পরতেন। মায়ের মুখ মলিন হতেও দেখিনি। সুখ যে আপেক্ষিক একটা বিষয় এটা মায়ের থেকেই বুঝেছি।
একদিন টিউশন শেষ করে ফিরছিলাম। রাস্তার পাশে এক লোক কিছু শাড়ি বিক্রি করছিল। বড়ো বড়ো শপিংমলে ঢুকে শাড়ি দেখার মতো টাকা কখনও আমার কাছে ছিল না। রাস্তার পাশ থেকে মাত্র তিনশো টাকায় একটা শাড়ি কিনেছিলাম। আমার মা সেই শাড়ি পেয়ে কী যে খুশি হয়েছিল! আনন্দে তার চোখে পানি চলে এসেছিল।
আলমারির প্রথম তাকে সেটা রাখা ছিল। কেউ আসলেই বের করে দেখাতেন, সবাইকে বলতেন আমার মেয়ে এটা কিনে দিয়েছে। মা যখন এইটুকু বলতেন তখন মায়ের আনন্দ আর সন্তানের জন্য গর্ব দুটোই দেখা যেতো। মা সেই শাড়িটা পরেই সবসময় বাইরে যেতেন। পরতে পরতে শাড়িটার রং নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবুও মায়ের কী ভীষণ পছন্দের শাড়ি ছিল সেটা।
ফেরিওয়ালাদের থেকে মানুষ পুরাতন কাপড়ের বদলে হাড়ি পাতিল কিনে থাকে। আমার মা ফেরিওয়ালাদের থেকে সস্তায় শাড়ি কিনতেন। সংসারের খরচটুকু বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা ছিল মায়ের।
লাল একটা শাড়ি পছন্দ হয়েছিল মায়ের। সেই সময় টাকা ছিল না। মা ফেরিওয়ালাকে বলেছিল সামনের সপ্তাহে আসবেন, শাড়িটা কিনব। এক মাস পর ফেরিওয়ালা আসলো। আমার মায়ের পরনে তখন ছিল সাদা শাড়ি। আমাদের বাবা মারা গেছেন সপ্তাহখানেক আগেই। মায়ের সেই লাল শাড়িটা আর কেনা হলো না।
বাবা মারা যাওয়ার পর আমার বাবার জন্য ভীষণ কষ্ট হতো। জন্মের পর থেকে আমরা ভাই বোনেরা বাবাকে খুব কম সময়ের জন্যেই কাছে পেয়েছিলাম। বাবাও খুব অল্প সময় তার ছেলে মেয়েদের আদর করার সুযোগ পেয়েছিলেন। বাবা চাইলেই ছুটি নিয়ে একটু বেশি সময় আমাদের সাথে থাকতে পারতেন। কিন্তু বাড়তি একটু সুবিধার জন্য বাবা প্রয়োজনের জন্য ছুটি নেয়নি। সারাটা জীবন মানুষটা কাজ করে গেলেন। বাইরের পরিবেশে একা থাকলেন। একা জীবন পাড় করলেন কেবল আমাদেরকে ভালো রাখার জন্য। অথচ বাবা বেঁচে থাকতে আমাদের অভিমানটা সবচেয়ে বেশি ছিল বাবার উপরেই।
এখন আমরা তিন ভাই-বোনই লেখাপড়া শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। এখন মায়ের জন্য শাড়ি কেনার মতো প্রচুর টাকা আছে। কিন্তু মা বেঁচে নেই। আমার কিনে দেওয়া সেই সস্তা শাড়িটাই ছিল মাকে দেওয়া প্রথম আর শেষ শাড়ি…।






