মেঘমেদুর

শীত চলে যাচ্ছে যাচ্ছে ভাব। অনেকদিন এক জায়গায় তল্পিতল্পা নিয়ে থেকে চলে যাওয়ার সময় যেমন মানুষ কষ্ট পায়, বারান্দা থেকে নেমে উঠোনে দাঁড়ালেই পা দুটোতে টান পড়ে মায়ার বন্ধনে, তেমনই প্রকৃতিকেও পিছন থেকে কে যেন ডেকে বলে, “থেকে যাও-না আর ক’টা দিন!” তাই শীত এখনও সেই মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি। হালকা কুয়াশায় ভরিয়ে তোলে সকালবেলাটা এখনও। ঘাসের মাথায় মুক্তোর মতো শিশির দোলে, গাছের পাতায় ঝরে কুয়াশার চোখের জল। তারপর সূর্যের কাছে মাথা নত করে ম্লান মুখে মিলিয়ে যায় সারাদিনের জন্য।

শুভ যখন বাসে উঠতে যাবে, একটা চার-পাঁচ বছরের মেয়ে-শিশু একতোড়া গোলাপ হাতে সামনে এসে দাঁড়াল।

“ভাইয়া একটা ফুল ন্যান, আজ দিনটা খুব ভালা। ভাবিকে দিয়েন। খুব খুশি হইবন।”

শুভ দাঁড়িয়ে গেল। মেয়েটার দিক অপলক তাকিয়ে দেখল। দুটো বেণীগাঁথন চুলের ডোরা পিঠে ঝোলানো, তেল জবজবে কোঁকড়ানো চুলের মাঝ বরাবর সিঁথি কাটা মাথার তালু পর্যন্ত। কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ। পুতুলের মতো লাল-সাদা একটা ফ্রক পরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে শুভর সামনে। মেয়েটির পা-জোড়া খালি। কী সুন্দর কোমল পা অথচ জুতো নেই, মোজায় ঢাকা নেই হাঁটু অবধি। শুভর কাছে এইটা একটু বেমানান দেখাল। কিছু বলল না। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বাছছিল শুভ। “কোনটা নিই, কোনটা নিই?” মেয়েটা মৃদু হেসে বলল, “ভাইয়া সবগুলানই তাজা। সক্কালেই তুইলা আনছি।”

ডালসহ একটা ফুল ওর হাতের তোড়া থেকে তুলে নিল। দশটা টাকা হাতে ধরিয়ে বাসে উঠল শুভ। বাস ছাড়ল। মেয়েটা বাসস্টপে দাঁড়ানো আরো কয়েকজনের কাছে গিয়ে একই কথা বলছে। শুভ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখল। চেয়ে থেকে থেকে ‘চলে যাওয়া’ দেখার মধ্যে এক ধরনের হৃদয়-মোচড়ানো আনন্দ আছে বোধহয়।

বছর দুয়েক আগের এমনই একটি শীতের সকালের দৃশ্য ভেসে উঠল শুভর রেটিনায়।

“তোমার এখনও দেরিতে পৌঁছানোর অভ্যাসটা গেল না, শুভ!” দূর থেকে পোউষি বলল। পোউষিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তার গলার কড়া সুর খুবই স্পষ্ট।

“এ্যই সরি, সরি! রাতে এলার্ম দিয়ে রাখতে ভুলে গেছিলাম।” শুভ দৌঁড়ানোর ভঙ্গিতে কাছে আসতে আসতে বলল।

পোউষি সাদা রঙের কামিজের ওপর ধূসর রঙের ঢাকাই মখমলের চাদর জড়িয়ে এসেছে। মাথার চুলগুলো চাদরে আবৃত। চাদরের দু’প্রান্তের ঝুরঝুরে সুতা ঝুলমুল করছে।

শুভর গায়ের কালো শালটা দেখেই তেলেবেগুনে বলে উঠল পোউষি। “তুমি আবার সেই শালটা পরেছ। তোমাকে কতবার বলেছি এই শালটা পরবা না।”

“গুনিনি, কিন্তু অনেকবার।”

“হয়েছে, ন্যকামো ছাড়ো। আর এটা গায়ে জড়াও।” বলে নিজের গায়ের চাদর খুলে শুভর গায়ে পেঁচিয়ে দিল। পোউষির ঘনগোছা চুলের বোঝা নিমিষে লুটোপুটি খেলো ওর পিঠে।

শুভ সে দৃশ্য দেখতে দেখতে বলল, “তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে, পোউষ।”

“যাবে না, মাছের আবার শীত-গ্রীষ্ম! এবার হাঁটো।”

শুভ মাছের ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারল না। হয়ত চাইনি বুঝতে। বলল, “আচ্ছা, আমরা এতো সকালে কোথায় যাচ্ছি?”

“তোমার হাতটা দাও।”

শুভর বামহাতটা পোউষ নিজের হাতের তালুতে বন্দি করে নিল। বলল, “জানি না। তোমার হাত ধরে শুধু হাঁটতে চাই গোল পৃথিবীর এই সমতল পথ বেয়ে।”

কুয়াশার আস্তরণে দূর ঝাপসা হতে লাগল। গোলাপ হাতে ছোট্ট মেয়েটিকে আর দেখা গেল না।

“ভাই, সিট আছে ত, সিটে বসুন।” কন্ডাক্টর এসে বলল।

শুভ ঠোঁট জিভে মুছে বলল, “হ্যাঁ, বসছি।”

“কোথায় যাবেন, মামা?”

শুভ কোথায় যাবে ঠিক বলতে পারল না। পিছনের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করবে বলে উঠতে গিয়ে হঠাৎ ধাক্কা খেল সামনের সিটে। গাড়ি ব্রেক কষেছে। শুভর মুখ শুকিয়ে গেল। একশ টাকার নোট দিয়ে বলল, “পরের স্টপেজই নামব।” শুভ গোলাপের ডালটা হাতে নিয়ে মাথা এলিয়ে দিল ব্যাক-সিটে।

বাড়ি ভর্তি মানুষে। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। চারিদিকে শুধু হৈচৈ। ছোটো কয়েকটা বাচ্চা মিলে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলছে উঠোনে। পোউষি খাটের ওপর বেনারসি পরে বসে আছে। এ-সে এসে দরজা ঠেলে উঁকি দিয়ে বোউকে দেখে যাচ্ছে। বেনারসিতে পোউষিকে অপরূপ লাগছে। স্নিগ্ধ হাত-জোড়া আজ মেহেদীতে রাঙানো। নাকে বড়ো একটা নোলক। কানে ঝুলছে সোনার শঙ্খাকৃতি দুল। আর দু-পা রাঙানো লাল আলতায়।

উঠোন থেকে একটা ছোট মেয়ে দৌঁড়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। বলল, “দিদি, বাইরে খুব মেঘ করেছে।”

“ত?” পোউষ থমথম গলায় বলল।

“মেঘের সাথে কি মানুষের মিল থাকে, ‘দি?”

“জানিনে।”

“কিন্তু তোর সাথে মেঘের অনেক মিল।”

“কেন?”

“কারণ মেঘগুলোও আজ তোর মতো সেজেছে। বড্ড রঙিন। এখন বৃষ্টি না হলেই হয়।”

মেয়েটি চলে গেল। পোউষি জানলা খুলে আকাশটা ভালো করে দেখল। কিন্তু কোথাও কোনো মেঘ খুঁজে পেল না। হঠাৎ পোউষের দুচোখের কোণ জলে ভরে উঠতে লাগল। সহসা একটা বিদ্যুতের ঝলকানি জানলা ভেদ করে ঘরে এলো এবং পরক্ষণে মেঘের গুড়ুগুড়ু আওয়াজ শুনতে পেল পোউষি। চোখের জল হাতে মুছে নিজে নিজেকে বলল, “মোটেও না। কে বলেছে, নারীর সাথে মেঘের মিল। কেউ বললেই তাই হবে না-কি! আজ আকাশে মেঘও হবে না, মর্তে ছিটেফোঁটা বৃষ্টিও হবে না।” নিজেকে যতই শক্ত করতে চাইল পোউষ, ততই যেন বুক মেঘের মতো ভারি হতে থাকল তার।

শুভ বাস থেকে নেমে হাঁটছে। কোথায় নেমেছে শুভ জানে না। সামনে দেখল একটা চায়ের দোকান। এগিয়ে গিয়ে এক কাপ চা দিতে বলে শুভ কাঠের বেঞ্চে বসল। শুভর মনে পড়ল গোলাপটা ও সিটে ফেলে এসেছে।

যেদিন পোউষির সাথে প্রথম দেখা করতে গিয়েছিল, সেদিনও বাসে ফেলে এসেছিল জীবনের প্রথম গোলাপ। পোউষ অবশ্য শুভর শুকনো মুখখান দেখে শুধু একটা মৃদু হাসি দিয়েছিল। বলেছিল, “আজ একটা ফুল ফেলে এসেছ ত কী হয়েছে। আমি চাই একদিন তুমি আমাকে একটা আস্ত বাগান দেবে। কী দেবে না?”

শুভ নিজের ভুলের জন্য তখনও অনুশোচিত করে রেখেছে ওর শ্মশ্রু-কামানো ফর্সা গালটা। পোউষ ওর নরম হাতে গালটা টিপে দিয়ে বলল, “আজ যেন কী বলবে বলে এসেছ, বলো।”

শুভ একঝলক দেখে নিল পোউষকে। পোউষ মেঘবরণ জামদানি শাড়ি পরে এসেছে। শাড়ির কালো পাড়ের সাথে ম্যাচিং করে পরা কালো ব্লাউজ এবং কালো শায়া। পায়ে কালো ফিতের পাতলা চটি। মেয়েরা ছেলেদের মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনতে যে খুব ভালোবাসে, সেটা শুভ খুব ভালোই জানে।

শুভ অন্যমনস্ক নয়নে আকাশের দিকে তাকাল। কিছু গুচ্ছ কালো রঙের এলোপাতাড়ি মেঘ ভেসে যাচ্ছে দূরে। বলল, “নারীর সাথে মেঘের কতো মিল!”

পোউষ বিষণ্ণ হয়ে গেল। বলল, “হঠাৎ এমন কথা?”

“না, এমনি। আসলে মেঘ আজ তোমার সাজে সেজেছে, দ্যাখো!” শুভ তর্জনী তুলে দেখাল।

পোউষ একবারো আকাশের দিকে তাকাল না। পাশে এসে বলল, “বলো-না শুভ সেই কথাটা।”

“এখুনি শুনবে?”

“হ্যাঁ, এক্খনি। বলো!”

“শুনলেই ত গল্প ফুরিয়ে যাবে পোউষ। বরং চলো আমরা একটা অন্যরকম গল্প বানাই। যে-গল্পে কোনো সংলাপ থাকবে না। আমাদের দুজনের পথচলার পায়ের চিহ্ন জুড়ে থাকবে শুধু না-বলা কথোপকথন।”

“তুমি মাঝে মাঝে খুব অদ্ভুত হয়ে যাও, শুভ!আমাকে তোমার কিচ্ছু বলতে হবে না। শুধু বলো আমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবে না।”

শুভ পোউষের হাত দুটো শক্ত করে ধরল। বলল, “যাব না।”

শীতের কাপের চা চুমুক দিয়ে শেষ করে উঠল শুভ। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে গন্তব্যহীন সমতল পথে হাঁটা ধরল। গায়ে সেই কালো শালটা।

আজ আর কেউ শুভর গায়ে কালো শাল দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল না। ডানহাত দিয়ে চাদরের ঝরে পড়া প্রান্তটা উঠিয়ে নিল কাঁধে। শুভর বামহাতের আঙুলের ফাঁকে পুড়ে পুড়ে ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে একাকী সিগারেট।

–সৌমেন মণ্ডল (Saumen Mondal)

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
2
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Saumen Mondal
1 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!