কান্না শুনিতে কি পাও?

এখানে গড়ে উঠছে
নতুন এক শহর
দিনরাত ব্যস্ত হাজারো মানুষ।
বিশাল বড় এক কর্মযজ্ঞ
বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে।

চারিদিকে স্তুপ করে রাখা
লক্ষ লক্ষ ইট।
আছে বালু, সিমেন্ট আর রড,
বড় বড় সীমানা দিয়ে ঘিরে রাখা
বিশাল বিশাল হরেক রকম
সব যন্ত্রপাতি।

হাজারো মানুষের স্বপ্ন,
গড়ে উঠবে এখানে
আধুনিক এক বসতি।
জীবন হয়ে উঠবে গতিময়।

মনে কি পড়ে?
এখানেই ছিল খেটে খাওয়া
সহজ সরল মানুষ গুলোর
নিত্য পদচারণা,
ছিল শিশুদের
দুরন্ত উল্লাস আর ছুটোছুটি।
ছিলো মেঠো পথ ধরে
মাথায় ছাতা দিয়ে
ঘোমটা মাথায় নাইওরীর
বাবার বাড়ী আসার দৃশ্য।

মনে কি পড়ে
এই নিভৃত জনপদে
রোদেলা দুপুরে
সলাজ গৃহবধূর পুকুর ঘাটে
স্নানান্তে কলসি কাঁখে
গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে
ঘরে ফেরার দৃশ্য।

মনে কি পড়ে?
প্রতিদিন পড়ন্ত বিকেলে
এখানে উঠোনে উঠোনে
দুরন্ত কিশোরীদের
উপেয়েনটি বাইস্কোপের ছুটোছুটি।
মাঠে মাঠে কিশোর যুবাদের
দাড়িয়াবান্ধা আর
হাডুডু খেলার আনন্দ।

মনে কি পড়ে?
এ জনপদের
খেতের আল ধরে
শিশু কিশোরদের দল বেঁধে
স্কুলের যাবার দৃশ্য।

মনে কি পড়ে?
শীতের সকালে
এই জনপদে
খোলা আকাশের নীচে
উনুনের চার পাশে
কাঁথা আর চাদর মুড়ি দিয়ে
বসে থাকা শিশুদের মুখ।

মনে কি পড়ে?
শান্ত এ নিভৃত জনপদে
নিত্যদিন প্রত্যুষে
বাড়ীতে বাড়ীতে
কোরআন তেলাওয়াতের
সমুধুর সুর।

মনে কি পড়ে?
প্রত্যুষে এ শান্ত জনপদের
ঘরে ঘরে মোরগের ডাকে
ঘুম ভাঙার দৃশ্য।

মনে কি পড়ে এই জনপদে
কোন এক জ্যোৎস্না স্নাত রাতে
ঘরে ঘরে বাড়ীর উঠোনে
ধান মাড়াইয়ের উৎসব।

মনে কি পরে
এই জনপদে
শীতের প্রতি প্রত্যুষে
ক্ষেতের আল ধরে
ভরা খেজুর রসের কলস নিয়ে
কৃষকের ঘরে ফেরার দৃশ্য।

এই তো সেই জনপদ,
যেখানে সবাই ছিল
এক বড় পরিবারের মতো।
ছিল একে অপরের
সুখ দুঃখের সহযাত্রী।
সহজ সরল জীবন ছিল
এ জনপদের মানুষ গুলোর।

তোমাদের আজ বড়ই প্রয়োজন
আধুনিক এক শহর।
তোমাদের স্বপ্ন পূরণে
আমরা আজ বিতাড়িত,
আমাদের বাস্তুভিটা থেকে।
চোখের জলে বিদায় দিয়েছি
শত বছর আঁকড়ে থাকা
বাপ দাদার এই ভিটে মাটি।
যে মাটিতে চির নিদ্রায়
ঘুমিয়ে আছে
আমাদের হাজারো ‌পূর্ব পুরুষ।

তোমরা কি জানো?
এখানে প্রতি ইঞ্চি মাটিতে
মিশে আছে আমাদের ঘাম,
আমাদের রক্ত।
আর মিশে আছে
ছেড়ে যাবার সময়ের
দু চোখের গড়িয়ে পড়া
আমাদের অবারিত অশ্রু।

বহু বছর পর
কোন একদিন হয়তো
জীর্ণ শীর্ণ শরীরে,
ফিরে আসবো আবার
আমার ছেলে বেলার
এই ঠিকানায়।
যেখানে প্রতিটি ইঞ্চি
জমিতে লেগে আছে
আমার লক্ষ কোটি পদ চিহ্ন।

ফিরে যাবো সেই
ছেলে বেলার স্মৃতিতে।
বড় বড় চোখে তাঁকিয়ে
দেখবো চার পাশ।
মিলিয়ে দেখবো
সেদিন আর এদিন।

খুঁজে বেড়াবো আমার
শৈশবের সেই হারিয়ে যাওয়া
জনপদ আর স্মৃতি গুলো।
খুঁজে ফিরবো আমার
ফেলে যাওয়া সেই
নিত্য দিনের পদচিহ্ন।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টি আর চোখ
নিয়ত তাকাবে চারিদিকে,
পেরিয়ে যাবে
মিনিট, ঘন্টা আর প্রহর।
শত শত বিশাল বিশাল
অট্টালিকার ভিড়ে
আর কোনদিন
খুঁজে পাবো না
আমার সেই জন্ম ভিটার ঠিকানা।
সমস্ত হৃদয় জুড়ে
তখন এক অদৃশ্য হাহাকার।

এক সময়
ক্লান্ত শরীর নিয়ে
ফিরে যাবো আবারো।
চোখে বাঁধভাঙা অশ্রু।
অবুঝ নাতিটা
তাকিয়ে দেখবে
আমার কান্না।
প্রশ্ন করবে দাদু
কি হয়েছে?
কাঁদো কেন?
ওর নিষ্পাপ কচি হাত
থেকে থেকে মুছে দেবে
আমার গড়িয়ে পরা
ফোটা ফোটা অশ্রু।

ওরে অবুঝ শিশু,
কি বলে তোকে বুঝাবো,
আমার মনে বয়ে যাচ্ছে
কি এক প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়?

এক সময় আবারো
ফিরে আসবো
সেই অনিশ্চিত ঠিকানায়।
যা লিখা ছিলো
আমার নিয়তিতে।
দাদু আর নাতি দু জনের
চোখেই তখন অশ্রু।

তোমাদের এ নতুন শহর
হবে প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরা
মুখরিত এক প্রাঙ্গণ।
কখনোই তোমাদের
মনে আসবে না
এখানেই মিশে আছে
মিশে ছিলো,
আমাদের স্বজনদের
শত বছরের পদচিহ্ন।

তোমাদের স্বাগত জানাবে
আলো‌ ঝলমলে
এক উজ্জ্বল শহর।
আর আমরা
চলে যাবো তোমাদের
দৃষ্টির অন্তরালে
কোন এক অনিশ্চিত গন্তব্যে।
পেছনে পরে থাকবে
আমাদের হারানো শৈশব
কৈশোর আর দুরন্ত যৌবন।

আমাদের আগামী প্রজন্মের
দুঃখ, কষ্ট আর
নিয়ত অশ্রুর বিনিময়ে
তোমাদের দিয়ে গেলাম
এক আরাধ্য উপহার
আলো ঝলমল
আর আনন্দ উল্লাসে ভরা
এক নতুন শহর।

মো: আওরঙ্গজেব চৌধুরী।

Md. Aowrangazeb Chowdhury

28 May 2021.

Send private message to author
What’s your Reaction?
0
1
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Aowrangazeb Chowdhury
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Shibli Sayeek
Member
4 years ago

কবিতাটি শেষ পর্যন্ত পড়লাম। আধুনিক কবিতা হিসেবে অসাধারণ।

রবীন্দ্রনাথের “দাও ফিরিয়ে সে অরণ্য, লও এ নগর”

কথাটি এবং একই সাথে

সুকান্ত ভট্টাচার্যের “জীর্ণ পৃথিবীতে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার”

আমার কাছে মনে হলো, এই দুটি কথার আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার ভাবগাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে এই কবিতাটিতে।

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!