পূর্ণিমা তিথি সেদিন। বৈশাখের পূর্ণ চাঁদের আলোয় আমাদের পৃথিবী আলোকিত। আকাশ সে-রাতে তারায় তারায় ভরা। শীতলাবাড়ি মন্দিরে পুজো দেখতে গিয়েছি। পুজোশেষে বান্ধবীরা চলে গেছে। আমি চতুর্থ সিঁড়ির এককোণে বসে আছি। এখানে ওখানে আরো কয়েকজন আছে। আজকে ছেলেটার সাথে দেখা হবে। প্রথম দেখব তাকে। ছেলেটার নাম… নাহ্ বলা যাবে না। যে-নামে আমি ডাকি সে-নামটাই বলি। শতদল। আমি ডাকি শতদল। ফেইসবুকেই পরিচয়। বিএল কলেজ থেকে গণিতে এইবার মাস্টার্স করেছে। রাজনীতি করে। আপলোড করা ছবি-টবি দেখে যতদূর বোঝা যায় আরকি। বসে বসে যখন এইসব লিখছি, তখন হঠাৎ কেউ আমাকে ডেকে বলল, “চারু, কেমন আছো?” আমি তাকিয়ে দেখি ছেলেটা সামনে দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে হালকা হাসি। হাঁপাচ্ছে। মনে হচ্ছে দৌঁড়িয়ে এসেছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। একজোড়া দুফিতাওয়ালা স্যান্ডেল পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু বলছি না দেখে আবার বলল, “চিনতে পারছ না? আমি…”
“শতদল। এখানে বোসো।” আমি বললাম। ছেলেটা কাচুমাচু করে পাশে বসল।
“চারু, তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি। এটা আনতেই একটু দেরি হয়ে গেল।”
“আচ্ছা। সমস্যা নাই।”
ছেলেটা পকেট
“শতদল, প্লিজ কিছু মনে করো না, আমি এটা নিতে পারব না।”
শতদল মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। অনেকক্ষণ আর কোনো কথা হলো না আমাদের। “আচ্ছা ঠিক আছে। দাও, পরিয়ে দাও।” এইবার ওর মুখে একমুখ হাসি প্রস্ফুটিত হলো। অদ্ভুত চমৎকার সেই হাসি। যেন একটি বুঁজে থাকা ফুলের কোরক তার সমস্ত-পাপড়ি মেলে বিকশিত হলো। ও আমার বাম হাতের অনামিকায় আংটিটা যতক্ষণ পরিয়ে দিতে লাগল, আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কী অনিন্দ্যসুন্দর নির্মল মুখ! তারপর থেকে আমাদের প্রায়ই দেখা হতে লাগল। কখনও হুড খোলা রিকশায়, কখনও আমরা বৃষ্টিবিলাসে বেরিয়েছি খালি পায়ে। কখনও-বা মেঘের ভেলায় ভাসছি, দুজনে দুজনার মুখপানে চেয়ে। কোনো কোনো রাত্রির দ্বিপ্রহরে ছাদে দাঁড়িয়ে তারাদের দিকে তাকিয়ে আছি। দুজন একসুরে গেয়ে চলেছি মেঘমল্লারের গান। আবার কখনও ঠাঁঠাঁ কাঠফাঁটা রৌদ্রে আমরা পিচঢালা শহরতলি হেঁটে হেঁটে ঘুরছি। ছাতাবিহীন।
টিউশনি-ফেরত শতদলের ঘামে ভেজা গায়ের গন্ধ কেন জানি না আমার এতো ভালো লাগত! কলার চেপে পুরুষের গায়ের গন্ধ শুকা নারীর জন্য বোধহয় পরম পাওয়া। বাসায় ফিরতে সেদিন একটু সন্ধ্যা হয়ে গেল। মা বারবার ফোন দিচ্ছিল, রিসিভ করিনি।
শ্রাবণ মাসের হঠাৎ পশলা বৃষ্টিতে দুজনে ভিজে একাকার। যানবাহনবিহীন রাস্তায় দুজন হাঁটছি। গলির ভিতর দিয়ে একটা কাকভেজা কুকুর ঘেউঘেউ করতে করতে চলে গেল। পায়ের নুপুরের ঝনঝন নিক্কণ-ধ্বনি গলির দেয়ালে অনুনাদিত হচ্ছে। বাসার কাছে এসে দুজনে দাঁড়িয়ে গেলাম। আচমকা বিদ্যুতের একটা ঝলকানির সাথে মেঘ গর্জন করে উঠল। মুহূর্তে গলির ল্যাম্পপোস্ট নিভে গেল। কী হলো বুঝতে পারলাম না, হঠাৎ ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বসলাম। তারপর দুমাস হলো আমরা দেখা করিনি। শুধু ম্যাসেঞ্জার আর ফোনে আলাপ হয়।
আজ দেরিতে ঘুম ভেঙেছে আমার। উঠেই দেখি, “ঘুমিয়ে আছো চারু?” শতদলের ম্যাসেজ। আমি কলব্যাক করলাম।
“চারু, তোমাকে আজ একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। তোমার-আমার খুব কাছের তিনি।” শতদল খুশিখুশি সুরে বলল।
“তোমাকেও একটা কথা বলার আছে।”
“বলো।”
“না। বিকালে দেখা হলে বলব।”
“আচ্ছা, শুনো? আজ নীলপেড়ে শাড়িটা পরবে কিন্তু। আর বড়ো লাল টিপ দিবে কপালে। লাল টিপে তোমায় অপরূপ লাগে।”
“আচ্ছা, বাবা! এখন বাই।”
বিকালে আমার মেস-বাসার সামনে এসে আমাকে কল করল। নিচে নেমে দেখি শতদল রিকশায় বসে আছে। আমাকে তুলে নিল। রিকশা চলছে। আমি রিকশার হুড তুলে দিলাম। ও একটা লাল গোলাপ আমার সামনে ধরে বলল, “এটা তোমার জন্য। আমাদের ছাদের গাছে আজ ফুঁটেছিল।”
“তুমি গাছের ফুল কেন ছিঁড়েছ? এটা আমার পছন্দ না।”
“সরি। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল ফুলটা তোমার খোঁপায় ভালো লাগবে।”
“আশ্চর্য! তাহলে হাতে কেন দিলে?”
ও ফুলটা আমার চুলের খোঁপায় গুঁজে দিল। আমার চোখের কোণে মিটমিট হাসি এলো। আমি সামলে নিয়ে বললাম, “রিকশা থামাতে বলো। আমি হাঁটব।”
আমার ডানহাতের আঙুলগুলো ধরে রেখেছে শতদল। শহরের গমগম ভিড়ের মধ্য দিয়ে আমরা হাঁটছি।
“মা তোমাকে দেখতে চেয়েছে।”
“সত্যি!” আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।
“হ্যাঁ। আজ সন্ধ্যায় তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাব।”
আমি মাথাটা ওর বুকের ওপর নুইয়ে রেখেছি। শতদল ওর উষ্ণ হাতে আমার চোয়াল ছুঁয়ে দিল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারিদিকের ল্যাম্পপোস্টগুলো এক-এক করে জ্বলে উঠল। আমরা ফুচকা অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কোত্থেকে চশমা পরা এক বৃদ্ধ লাঠি ভর দিয়ে এগিয়ে এসে শতদলকে বলল, “বাবা আমাকে একটু রাস্তাটা পার করে দেবে?” শতদল বাচ্চাদের মত মুখ করে আমার দিকে তাকাল। যেন অনুমতি চাইল। আমি ঘাড় নাড়িয়ে বললাম, “যাও।”
তারপর। তারপর আমরা আমাদের গল্পের দিনলিপির শেষ পাতায় পৌঁছুলাম। শতদলের রক্তাক্ত মাথা আমার কোলের ওপর শুয়ে আছে। শ
“চারু, খুব ভালোবাসি তোমায়, খুব ভালোবাসি” বলতে বলতে শতদল ঘুমিয়ে পড়ল আমার কোলে। আর কোনো কথা বলতে পারিনি শতদল। বৃদ্ধ লোকটি শতদলকে নিয়ে চলে গেল।
“আমি বেহুলার মতো শতদলকে কোলে করে ওর বাড়ির উঠানে নিয়ে হাজির হয়েছি। ওর বিধবা মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। আমি কী বলব কিছুই বুঝতে পারছি না।….।”
আজ সাতাইশ বছর পূর্ণ হলো আমার বাবা এ পৃথিবীতে নেই। তাঁর ছবি ছাড়া আমি আর কিছুই জানি না তাঁকে নিয়ে। উপরের গল্পটুকু পড়েছি আমার মা’র ডায়েরি থেকে।
সেদিন সন্ধ্যাহ্নিক করে যখন শতদলের ফটোতে ধূপের ধোঁয়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুজো করছিলাম, আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল আমার ছেলে। অনিরুদ্ধ রয়। আজ ওর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছে। মস্ত বড়ো হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত পড়ায়। আমাকে বলল, “তুমি আর কেন ডায়েরি লেখ না, মা? তারপর কী হয়েছিল বলো না, মা।”
আমি আবার ডায়েরি লিখতে শুরু করলাম। সেদিন যখন তোমার দিদাকে বলেছিলাম, তোমার অনি মরেনি মা। ওর ভ্রুণ বেঁচে আছে–শুনেই সেদিন তোমার দিদা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমার নিজের মা-বাবাও আমার অন্তঃসত্ত্বার কথা শুনে ঘরে উঠতে দেয়নি, বাবা।
আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আমার ছেলে। ও শুনছে আমার গল্প বলা। আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ওর চুলে। অনিরুদ্ধ তাকিয়ে আছে ওর বাবার ছবির দিকে। ওর চোখ বেয়ে জল পড়ছে। একটু পর ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আমার ভালো মা, তুমি আমার সোনা মা।” আমার কপালে চুমু খেল ও। এতো বছর পর কেউ আমার শূন্য কপালখানি চুমুতে ভরিয়ে দিল। গল্পের জীবন হয়ত শেষ হয়ে যায়, কিন্তু জীবনের গল্প শেষ হয় না কখনো। পৃথিবীর রোজনামচায় অবিরাম সে-গল্প লিখে চলেছেন কেউ। আজ এতোটুকুই। কাল ভোর ভোর উঠতে হবে। অনেক কাজ। কাল অনিরুদ্ধকে দেখতে আসবে মেয়েবাড়ি থেকে। ওকে কিছুই জানাইনি। সারপ্রাইজ দিব। বদ ছেলেটা আবার চুপিচুপি লেখাটা পড়ে না ফেলে!
–সৌমেন মণ্ডল (Saumen Mondal)
Send private message to author





