-“রাহাতের বউ হয়ে থাকতে হলে আমাদের কথা মতই চলতে হবে”- এতক্ষণ ধরে শাশুড়ির তির্যক বাক্যবানগুলো যুক্তি-তর্ক দিয়ে ডজ করা গেলেও, এই কথার প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া মীরার আর কিছু করার ছিলনা।
রাহাত অনেক কষ্টে নিজের আবেগ চেপে রেখেছে, তা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এত বড় কথার পরে মীরা আশা করেছিল, অন্তত এইবার রাহাত তার মুখ খুলবে। দীর্ঘ একটা সময়ের অস্বস্তিকর নীরবতা মীরাই প্রথম ভাঙ্গলো।
“তাহলে তাই হোক রাহাত। তোমার সাথে আর থাকা হলোনা”।
মীরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার সময়ও মনে মনে ক্ষীণ আশা করেছিল-হয়তো রাহাত আরেকবার পিছন থেকে ডাকবে, হাতটা ধরে আটকাবে। কিন্তু রাহাত তার মৌনব্রত জারি রেখেছিল। মীরার কেন যেন কান্নাও আসছেনা। এইরকম ভোঁতা অনুভুতির সাথে ওর পরিচয় নেই। সবসময় হাস্যোচ্ছল মেয়েটাকে নিজের করে পেতে যে রাহাত এক সময় ঘন্টার পর ঘন্টা ভার্সিটির হলের বাইরে ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত, ওকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য ছোট-বড় সবাইকে দিয়ে ওকালতি করিয়ে শেষ পর্যন্ত মন গলাতে পেরেছিল, সেই মেয়েটা আজ সব কিছু চুকিয়ে ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তবু রাহাত এত নিষ্পৃহ! মীরা আর ভাবতে চায়না। একটা রিকসা ডেকে তড়িঘড়ি এই বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে সে চলে যেতে চায়।
****
মীরার প্রেজেন্টেশন শেষ হয়েছে মিনিট পনেরো হলো। সেমিনার রুমের বাইরে দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চাচ্ছেনা।কী ডিসিশন হচ্ছে ভেতরে? দরজা খুলে মীরার প্রফেসর বেরিয়ে এলেন। উনার সদাগম্ভীর মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। হাত-পা কাঁপাকাঁপি অবস্থাতেই মীরা কোমতে উঠে দাঁড়ায়।
“কনগ্র্যাচুলেশন্স, ডক্টর মীরা!”
মীরার চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই পানি চলে আসে। এতদিনের ভোঁতা ভাব কেটে গিয়ে ওর ভেতর আবেগের প্লাবন শুরু হয়েছে যেন। যে পিএইচডি করার জন্য জেদ করে সংসার ছেড়ে মীরা এই ভীনদেশে চলে এসেছিল পাঁচ বছর আগে, সেই কাংখিত ডিগ্রী হাতে পেয়েও কোথাও কি ওর পোড়াচ্ছে? ওর নিজের বাবা-মা, আত্মীয়, বন্ধু সবাই ওর সমালোচনায় এতদিন মুখর ছিলেন। মেয়েদের জীবনে সংসারের চেয়ে একটা ডিগ্রীর দাম কীভাবে বেশী হতে পারে? মীরা কাউকে বোঝাতে পারেনি, একসময় আর বোঝাতে চায়ও নি- প্রসংগটা শুধুই একটা ডিগ্রী বা ভালো ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক নয়। এ ছিল রাহাতের জীর্ণ ব্যক্তিত্বের সাথে মীরার আদর্শিক সংঘাত। রাহাতের জীবনে মীরা কোন কক্ষচ্যুত উপগ্রহ ছিলনা। ওর আপন ছোট বোন- তনুর বান্ধবী ছিল মীরা। তনুকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিতে গিয়েই একদিন মীরার সাথে পরিচয় হয় রাহাতের। সেই থেকে মীরাকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগে রাহাত। মীরা বিয়ের জন্য ব্যস্ত ছিলনা। ও চেয়েছিল আগে ক্যারিয়ারে সেটেল হতে। কিন্তু রাহাত ওকে কতই না আশ্বাস দিয়েছিল! “তুমি, আর তনু কি আলাদা? তনুও তো তোমার মত ভালো রেজাল্ট করেছে। সে ও ক্যারিয়ারে জড়াবে, তাহলে তোমার এত ভয় কিসের? আমার পরিবার থেকে তোমার পড়াশোনা, চাকরিতে কখনো বাঁধা আসবেনা”।
তনু আসলেই অনেক ভালো রেজাল্ট করেছিল। ওদেরই ক্লাসমেট মামুনের সাথে ওর ভাব ছিল সেই সেকেন্ড ইয়ার থেকে। গ্র্যাজুয়েশনের এক মাসে মাথায়ই ওরা বিয়ে করে। মামুন আর তনু একেবারে যাকে বলে মানিকজোড়। দুজনের একই সাথে স্কলারশিপ হলো অ্যামেরিকায় পিএইচডি প্রোগ্রামে। বিয়ের একবছরের মাথায় ওরা চলেও আসলো অ্যামেরিকায়। রাহাতকে নিয়ে কী করবে, নাকি আগে অ্যাপ্লাই করবে- এইসব ভাবতে ভাবতে মীরার একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। তবু পাশ করার এক বছরের মাথায় রাহাত ওকে বৌ বানিয়েই ছাড়লো, আর তার ছয় মাস পরে মীরারও স্কলারশিপের চিঠি চলে এলো। কিন্তু রাহাতের মা বেঁকে বসলেন। একমাত্র ছেলের বৌ বিদেশ চলে গেলে পিছু পিছু অবশ্যই রাহাত যাবে। উনি একমাত্র ছেলেকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না। কাজেই মীরাকে বিদেশের আশা বাদ দিয়ে দেশেই সেটেল হতে বলা হলো।
“আমি ফিরে আসবো তো মা”- মীরার আশ্বাস ধোপে টিকলো না-“ একবার বিদেশ গেলে কেউ আসে?”
“আপনার মেয়ে তনুও তো বাইরে গিয়েছে, তখন তো আপনি না করেননি”- এইবার কিঞ্চিত কৈফিয়ত দাবী করে মীরা।
“তনুর শ্বশুড়বাড়ি থেকে আপত্তি করেনি, তাই গিয়েছে। কিন্তু তোমার ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে”।
সারাদিন দেন-দরবার করে মীরাকে দমাতে না পেরে অবশেষে উনার অভিমত ছিল-মীরা যদি যায়ই, তবে যেন রাহাতকে ছেড়ে যায়। মীরা হয়তো শেষ পর্যন্ত সংসারকেই বেঁছে নিত। আটপৌঁঢ়ে বাংগালিয়ানা ত্যাগ করা মেয়েদের জন্য কিছুটা অসাধ্যই। কিন্তু বিয়ের আগে রাহাত যেভাবে নিজেকে নির্ভরযোগ্য একজন স্বামী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল, তার ছিটেফোঁটাও সেদিন রাহাতের মধ্যে মীরা দেখতে পায়নি। রাহাত যদি একবারও মুখ ফুটে মীরার পক্ষ নিয়ে ওর বাবা-মাকে বোঝাতে চেষ্টা করত, তাহলে হয়তোবা মীরা এমন নির্বিকারভাবে এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারতোনা। রাহাতের চুপ করে থাকা সেদিন মীরাকে যত কষ্ট দিয়েছিল, একসাথে সারাজীবন থেকে প্রতিনিয়ত সেই কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়াতে মীরার আত্মমর্যাদায় লাগছিল। তাই সমাজের গঞ্জনা সহ্য করে হলেও মীরা নিজেকে গ্লানিমুক্ত রাখতে চেয়েছে। গত পাঁচ বছর অমানুষিক পরিশ্রম করেছে মীরা। দেশে বাবা-মা নারাজ, ফোনেও ঠিকমত কথা বলেন না। একা একা পাঁচটি বছর শুধু জেদকে কাজে লাগিয়ে দিন রাত পড়াশোনা চালিয়ে গেছে সে। আজ মীরা ইচ্ছেমতো সেলিব্রেট করতে পারবে।ক্যারিয়ারের অনেক গুলো দিক এখন ওর হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। নিজের পছন্দমতো স্যালারি হাঁকিয়ে যেকোন চাকরি বগলদাবা করতে পারবে সে। কিন্তু এত সব অর্জন, আত আনন্দ-সব কেন যেন ফিকে লাগছে।তবে কী মীরা এখনো সেই আটপৌঁঢ়ে বাঙ্গালী নারী হয়েই রয়ে গেল, সাঁঝবেলাতে যার জগতের সব অর্জনের চাইতে ঘরকন্যার সুখকেই বড় মনে হয়?
নাহ, যা গেছে, তা নিয়ে মীরা দুঃখ করবেনা। রাহাতের জন্য তো কখনোই নয়। তবে তনুকে মীরা একটা ফোন দিল। তনু এখনো অ্যামেরিকাতেই আছে।ওর পিএইচডি আগেই শেষ হয়েছে। এখন ভার্সিটিতেই লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে। তনুর সাথে মীরার প্রায়ই কথা হয়। বা বলা যায়, তনুই মীরাকে ফোন দেয়। ওর নিজের অনুশোচনা কম নয় মীরার জন্য। সে ই তো তার মেরুদন্ডহীন ভাইকে বিয়ে করার জন্য জন্য মীরাকে অনেক বলে কয়ে রাজি করিয়েছিল। মীরার অবশ্যি তনুর উপর কোন রাগ নেই। কারন তনু অনেক চেষ্টা করেছিল ওর মাকে বোঝানোর। এমনকি রাহাতকেও ভর্ৎসনা করেছিল কড়া গলায়। মীরাকে অনেকদিনই অনুরোধ করেছে, ফ্লোরিডায় ওর কাছে গিয়ে কয়েকদিন থাকার জন্য। মীরা যায়নি কখনো। কাজের ব্যাস্ততা দেখিয়ে শিকাগোতেই রয়ে গেছে। আজ মীরার খবর শুনে তনু ফোনের মধ্যে খুব জোরে আনন্দের চিৎকার দেয়। মীরার হঠাত খুব ভালো লাগে। যাক,অন্তত একজন আছে, যে তার জন্য সত্যিকার অর্থেই খুশি হলো। এতদিন পরে মীরা নিজেই এবার তনুর সাথে দেখা করতে চায়। তবে কেন যেন মীরার মনে হলো-এই কথা শুনে তনু কেমন মিইয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিজেই শিকাগো এসে মীরার সাথে দেখ করবে বলে কথা দিল তনু।
****
তনুর কী হয়েছে? চেহারার এ কী হাল? চোখের নিচে কালশিটে, মুখ লাবণ্যহীন!
“মীরা, তুই কি আমাদের পরিবারকে অভিশাপ দিয়েছিলি, সত্যি করে বলতো?”
“ছি, ছি, তনু- এই সব কী বলছিস? রাহাতের উপর আমার রাগ আছে, কিন্তু তুই তো আমার বান্ধবী! কিন্তু কী এমন হলো, যে তোর এই অবস্থা?”
তনুর চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। ওর পিএইচডি চলা অবস্থাতেই দুই বার মিসক্যারিজ হয়েছে। এখন আর কনসিভও করতে পারছেনা। ডাক্তার দেখে বলেছে- ওর জরায়ুটা নাকি হস্টাইল জরায়ু। মানে বাচ্চা গর্ভে আসলেও সেটা টিকে থাকার চান্স কম। তনুর মানিকজোড় মামুন নাকি এসব দেখে শুনে হঠাত ওর প্রতি আচরণ বদলে ফেলছে-এখন ওকে সবসময়ই কেমন এড়িয়ে যেতে চায়। মামুনের বাবা-মা দেশ থেকে ফোন দিয়ে প্রতিদিন অশান্তি করেন।বউকে বেশী পড়াতে গিয়েই নাকি মামুন নিজের এমন সর্বনাশ করেছে। বয়স হয়ে গেলে নাকি বাচ্চা হওয়ার ক্ষমতা মানুষের এভাবেই নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিদিনের কানপড়াতে মামুনের দৃষ্টিভংগী ও কি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে?-তনু একনাগাড়ে বলে অঝোরে কাঁদতে থাকে। মীরা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে-ওর মুখে কোন কথা যোগায় না। চকিতে ওর শাশুড়ির কথা মনে পড়ে- একদিন নিজের মেয়ের সুখ নিয়ে তিনি খুব নিশ্চিন্ত হয়ে পরের মেয়ের কাছ থেকে স্বামী-সোহাগ কেড়ে নিয়েছিলেন। আজ তনুর অবস্থা দেখে উনি কেমন আছেন? কিন্তু ছি ছি, মীরা এসব কী ভাবছে? ও তো এত নিচে নামেনি, যে শাশুড়ির মেয়ের দূরবস্থার কথা শুনে মনে মনে আত্মতৃপ্তিতে ভুগবে!
“কোন চিকিৎসা কি নেই তনু?”
“ বাচ্চা কনসিভ করতে আমার কোন সমস্যা নেই। আমার এগ কাউন্ট ঠিকই আছে, শুধু জরায়ুটা ভঙ্গুর। ডাক্তার বলেছেন, আমি এখনো মা হতে পারবো, কিন্তু অন্য কারো সাহায্য নিয়ে”।
“অর্থাৎ সারোগেট মাদার?”
“হ্যা। কিন্তু বিদেশ বিভুঁইয়ে কাকে ভরসা করবো? পয়সা দিলে এমন সারোগেট মাদার এখানে অনেক পাওয়া যাবে, কিন্তু তাতে আমার মন সায় দেয়না। মা না হয়েও আমি বাঁচতে পারতাম রে, কিন্তু মামুনের নির্লিপ্ততা যে আর সইতে পারছিনা”।
তনু আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, আর মীরা কোন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে যায়।
******
কলিং বেল বেজেই চলেছে। মীরা মাত্র গোসল থেকে বের হয়েছে। মাথায় টাওয়াল পেঁচানো অবস্থাতেই দরজার খুলতে দৌঁড় দিতে হলো। বাইরে অপেক্ষমান ব্যক্তিটির তাড়া মনে হয়ে খুব বেশী। দরজা খুলে মীরাকে হতভম্ভ হয়ে যেতে হলো।
“মীরা, প্লিয, মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়ার আগে শুধু পাঁচটা মিনিটের জন্য আমার কথা শোনো, প্লিয”।
রাহাত দাঁড়িয়ে আছে। মীরার ইচ্ছে করছিল আসলেই মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ভদ্রতা, সহানুভুতিশীলতা এইসব গুণ মীরার মধ্যে আল্লাহ কি একটু বেশীই ঢেলে দিয়েছেন? রাহাতের মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওর উপর দিয়ে সত্যিকার টর্নেডো বয়ে গেছে। মীরা চাইলেও কঠোর হতে পারেনা। বসার ঘরে রাহাতকে অপেক্ষা করতে বলে নিজে ভদ্রস্থ হয়ে আসতে উপরে উঠে আসে। এত বছর পরে কী চায় কাপুরুষটা?
“বলো রাহাত, কী হয়েছে? আর হলোই যদি, দশ বছর পরে কেন?”
“মা নেই, মীরা!”- কী একটা নাটক শুরু হলো! আবার সেই ভার্সিটি লাইফের মত শুরু করেছে রাহাত। সে নাকি এত দশ বছরে একদিনও শান্তিতে ছিলনা। মীরা ওকে ছেড়ে চলে যাবার পরে ও আর বিয়েও করেনি। কারন মীরাই ছিল তার একমাত্র ভালোবাসা। কিন্তু মায়ের বিরূদ্ধে গিয়ে কথা বলার সাহস ছিলনা ওর। হ্যা, সে জানে, সে যে কত বড় কাপুরুষ। কিন্তু মীরা তো তার মত খারাপ নয়। মীরা কি পারেনা তাকে ক্ষমা করে দিতে? সে জানে, মীরার জীবনের গত দশ বছর সে ফিরিয়ে দিতে পারবেনা, কিন্তু জীবনের যে কয়টা দিন অবশিষ্ট আছে, সে মীরার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়, ব্লা , ব্লা …
মীরার হাসি উঠে যায়। পাগল বিদেয় করতে পারলেই সে বাঁচে। আজ উইকএন্ড, না হলে এতক্ষণে সে অফিসেই চলে যেত। রাহাত মনে হয় দিন বেঁছেই এসেছে। মীরা অনেক কষ্টে ভদ্র ভাষায় ওকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু রাহাত তার আগের মতই ছ্যাঁচড়ামো চালিয়ে যায়। প্রতিদিন মীরার অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা, রাত-বিরেতে ফোন দিয়ে বিলাপ করা। একদিন মীরার ভীষণ রাগ উঠে। যুক্তি-তর্কের কোন ধার ধারছেনা রাহাত। মীরা ওকে অনেক অপমানসূচক কথাও বলেছে, তাতেও তার বিকার নেই। একটা বিহিত না করলেই নয়।
“গত দশ বছরে অনেক কিছু হয়েছে রাহাত। তুমি বিয়ে না করলেও আমার জীবনে একজন এসেছিল”।
“তাহলে কোথায় সে? আমি তো দেখতে পাচ্ছিনা। তুমি মিথ্যে বলছো। আমি তোমার সব খবরই রেখেছি মীরা। তুমিও আমার মত একা”।
“আমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে রাহাত, আমি আর আগের মীরা নই”।
“তুমি যা-ই হও না কেন মীরা, আমি তোমার চরণে একটু আশ্রয় চাই”- রাহাত এইবার শরৎচন্দ্রের বুলি কপচানো শুরু করে। মীরারও ইচ্ছে করে সাহিত্য থেকে ধার নিয়ে বলতে-“আমি একবার যে ছ্যাপ মাটিতে ফেলসি, তা আর কখনো মুখে নিবোনা”।– কিন্তু ওর কাছে আরো নির্ভুল উপায় আছে মানুষ চেনার।
“ তুমি যা ভাবছো, তা নয় রাহাত। এদিকে এসো”-মীরা নিজের টি-শার্ট তুলে প্যান্টটা কোমরের কাছে একটু নামিয়ে আনে। রাহাত প্রথমে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। একসময় মীরা ওর স্ত্রী ছিল, কিন্তু এখন বলা নেই, কওয়া নেই-মীরা কাপড় খুলে ফেলছে কেন? কী দেখাতে চাচ্ছে? ওর পুরো তলপেট জুড়ে স্ট্রেচ মার্কে ভরা!
“তোমার কি বাচ্চা হয়েছিল মীরা?”-রাহাতের গলায় অবিশ্বাস! “তুমি বিয়ে করেছো বলে তো শুনিনি। ছিঃ, মীরা! কার সাথে কি করে আবার নির্লজ্জের মত আমাকে পেটের দাগ দেখাচ্ছো?”
মীরা হো হো করে হাসছে কেন? ওর কি কোন অনুতাপ নেই?
“ তুমি যে বদলাওনি, তা ছোট্ট এই পরীক্ষা করেই বুঝতে পারবো-এইটুকু বিশ্বাস আমার তোমার উপরে ছিল রাহাত! তুমি এইবার আসতে পারো”- রাহাতকে প্রায় ঠেলে বের করে দিয়ে মীরা দরজা লাগিয়ে নেয়। আজ সত্যি এত বছর পরে মীরার মনে যে খচখচানি ছিল, সেটা দূর হলো। দশ বছর আগে রাহাতকে ছেড়ে এসে মীরা ভুল করেনি। নিজের পড়াশোনা, ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিয়ে ও আসলে নিজের উপরই সুবিচার করেছে। না হলে লোকলজ্জার ভয়ে যদি সংসার টিকিয়ে রাখতো, তাতে রাহাতের স্বার্থপরতায় ওর শুধু কায়া টিকে থাকতো, আত্মা নয়। মা বেঁচে থাকতে রাহাত মুখ ফুটে মীরার জন্য সংগ্রাম করতে পারেনি, আজ উনি মারা গিয়েছেন বলে পুরোনো প্রেম উথলে উঠেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে মীরার সব খবর রেখেছে-সে বিয়ে করেছে কি না, কারো সাথে সম্পর্ক করেছে কি না। কিন্তু নিজের বোনের সংসার শেষ পর্যন্ত কার বদান্যতায় টিকে আছে, সেই খবর রাখার মত বুদ্ধি-বিবেক তার ঘটে ছিলনা। মেরুদন্ড জন্মের সময় নিয়ে জন্মাতে হয়, ওটা পরে আর গজায় না-রাহাতই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। মীরা ফুরফুরা মনে ঘুমাতে যায়। এখন থেকে প্রতিদিনই তার খুব ভালো ঘুম হবে-এ বিষয়ে আর সন্দেহ নেই।
………সমাপ্ত………
মেহজেবীন আক্তার (Mahjabeen Akter)
Send private message to author


