৮
এই কদিনের ঘটনার আপডেট শম্পাদিকে রেগুলারই দিয়েছি। প্রতি রাতেই ফোন করতাম। মিতু আর প্রলয়ের হুমকি পাওয়ার খবর, প্রলয়ের ক্ষমা চাওয়ার ঘটনা, সবই বলেছি শম্পাদি কে। বাদ রেখেছি শুধু সোহরাব সাহেবের গল্পগুলো। অপেক্ষা করেছিলাম কবে শম্পাদি সুস্থ হয়ে স্কুলে আসা শুরু করবেন।
শম্পাদি এখন সুস্থ। আজকে স্কুলে এসেছেন। আমার ক্লাস একটু আগে শেষ হয়েছে। দুইটা বাজি বাজি করছে। চাইলে বেরিয়ে যেতে পারি, কিন্তু শম্পাদির জন্য পারছি না।
টিচার্স রুমে বসেছিলাম। শম্পাদির অপেক্ষায়। উনাকে বলার মত অনেক কথা জমে আছে। এগুলো ইচ্ছে করেই ফোনে বলিনি। এসব গল্প সরাসরি বলার মজাই আলাদা।
আরেকবার ঘড়ি দেখলাম। দুইটা বাজে। ক্লাস শেষ হয়ে গেছে আই গেস। রাস্তায় হয়তো কারো সাথে গল্প করছেন। অস্থির লাগছে। ফোন করতে যাব এমন সময় ঢুকলেন শম্পাদি।
— তোমাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম।
ফোনটা কান থেকে নামাতে নামাতে বললাম।
— আর বলিস না, রাস্তায়…
— চলো বেরোই।
শম্পাদিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললাম। শম্পাদি বোধহয় একটু রেস্ট নিতে চাইছিলেন। কিন্তু সেই রিস্ক নিতে ভয় পাচ্ছি। কেউ এসে পড়লে দেখা যাবে শম্পাদির সুস্থতা নিয়ে আলাপ শুরু করে দেবে। এই মুহূর্তে রুম ফাঁকা। বাকীরা এসে পড়ার আগেই এখান থেকে কেটে পড়তে হবে। চেয়ারে একটু হেলান দিয়েছিলেন, কিন্তু আমার তাগাদা দেখে আবার সোজা হয়ে বসলেন। হয়তো কিছু বলতেন, আমার ‘চলো চলো’ শুনে আর আমার অস্থিরতা দেখে হেসে ফেললেন। তবে মুখে কিছু বললেন না। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন
— মেয়েদের বিয়ে লাগলে, পাগলামিও বেড়ে যায়।
— সেসব পড়ে দেখা যাবে, এখন ওঠো। কে এসে পড়লে…
বলে নিজের ব্যাগ ওঠানোর সাথে সাথে শম্পাদির ব্যাগও হাতে নিয়ে ফেললাম। আমার এসব কাজ দেখে হেসে বললেন
— পেটে কথা বেশি জমে গেছে?
— বাসায় ফোন করে বলে দাও, দুপুরে ফিরছো না।
— কোথায়? আবার ঐ…
হেসে ফেললাম। বললাম
— নাহ। আজ ভয় নেই। ভালো খাবার খাওয়াবো। তাছাড়া, আজ নস্টালজিক মুডে নেই। আজ টেনশান মুডে আছি।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন।
— টেনশান কেন?
আমি তখন ভয়ে আছি রাস্তায় কারো সাথে দেখা না হয়ে যায়। হাঁটার গতি বাড়াতে বাড়াতে কোন রকমে শুধু বললাম
— চলো বলছি।
কপাল ভালোই বলতে হবে। কোন টিচারের সাথে দেখা হল না। বেশ নিরাপদেই বেরিয়ে আসলাম। কোন ভাড়া ঠিক না করেই সামনে যেটাকে পেলাম সেই রিক্সায়ই উঠে বসতে বসতে বললাম
— আজ তোমাকে সেই ক্যাফেতে নিয়ে যাব।
— সেই চোরের ক্যাফে?
— তুমিও?
— ঐ খটোমটো ওয়ার্ড টা সবসময় মনে আসে না।
হেসে ফেললাম। বললাম
— ওকে, তোমার জন্য ছাড়। তুমি চোর বলতে পার।
রিক্সা এগিয়ে চললে একে একে এই কদিনের গল্প বলা শুরু করলাম। জানালাম অবশেষে এনগেজমেন্ট হচ্ছে। শুক্রবার। কথাটা ফোনেও বলা যেত। ইচ্ছে করেই বলিনি। এসব কথা সামনাসামনি বলার একটা আনন্দ আছে। কথাটা শুনে খুশি হবে ভেবেছিলাম। মনে হল না ততোটা খুশি হয়েছেন। মুখে শুধু জানতে চাইলেন
— ছেলেটাকে কেমন লাগল?
রাস্তার দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলাম।
— ভালোই।
গলার আওয়াজে বোধহয় তেমন আনন্দ ছিল না। কথাটা শম্পাদির কান এড়ালো না। বললেন
— এতো নিরামিষ গলায় বলছিস কেন?
ব্যাপারটা আমার নিজের কাছেই অবাক লাগল। সোহরাব সাহেবের সাথে সেদিনের মিটিং খুব খারাপভাবে শেষ হয়নি। ইনফ্যাক্ট ভালোই হয়েছিল। যখন জানালো ‘কোন প্রলয়?’ তখনই বুঝে যাই, রং গেস। কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এধরণের মুহূর্তে আমি দেখেছি অনেস্ট কনফেশান খুব কাজে দেয়। এক মুহূর্ত সময় নিলাম। এরপরে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলাম
— প্রলয় ইজ মাই এক্স।
এরপরে কিছুটা পজ দিলাম। অপেক্ষা করলাম, কি বলে। বলল না। বরং স্যুপে চুমুক দিল। অপেক্ষা করে আছে আমার কথা শোনার জন্য।
— আসলে হি ইজ সাম সর্ট অফ ট্রাবল। কেউ ওকে হুমকি দিচ্ছে… তাই আমার মনে হয়েছিল…
— আই অ্যাম দ্যাট গাই?
অস্বস্তিভরা একটা হাসি দিয়ে বললাম
— ইয়েস।
ভদ্রলোক মাথা নোড করলেন। বোঝালেন যে তিনি ব্যাপারটা বুঝেছেন। এরপরে বললেন
— আমি জানি না কেন আপনার এই ধারণা হয়েছে, বাট আই অ্যাম নট দ্যাট টাইপ অফ গাই। আমি সেদিনও বলেছিলাম, আজকেও বলছি, বিয়েটা আপনার অমতে হলে, প্লিজ টেল মি…
উনাকে পুরোটা শেষ করতে দিলাম না। বললাম
— না না। আসলে সেদিন প্রলয় যেভাবে আমার কাছে এসে সরি বলল… আই রিয়্যেলি ফেল্ট সরি ফর হিম।
ভদ্রলোক ন্যাপকিনে মুখ মুছলেন। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না বিরক্ত হয়েছেন, না জাস্ট কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছেন। আমার কেমন যেন বুক দুরদুর করতে শুরু করল। কথাগুলোর অন্য কোন মিনিং না বের করে।
— দেখুন, ইফ হি রিয়্যেলি ইজ ইয়োর পাস্ট, অ্যান্ড ইউ ওয়ান্ট টু হেল্প হিম, দেন… আই মিন পুলিশের ওপর মহলে আমার বেশ জানাশোনা আছে। আই ক্যান হেল্প হিম।
ভদ্রলোককে কেন যেন বেশ ভালো লেগে গেল। মনে হল এই লোক বেশ ভালো বন্ধু হবে। কেমন অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বোধহয় একটু বেশিক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। ভদ্রলোক চোখের সামনে একটা চুটকি বাজালেন। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে কোনরকমে শুধু বললাম
— সরি।
এরপরে আর সমস্যা হয়নি। বেশ সাবলীল আলাপ হল। ভদ্রলোকেরও একজন এক্স ছিল। ইয়াং বয়সের। ক্লাসমেট। এরপরে মেয়েটার একটা খুব ভালো সম্বন্ধ আসে। মেয়েটা সেখানে ভালো ফিউচার দেখে…
শম্পাদির ধাক্কা খেয়ে বর্তমানে ফিরে এলাম। উনি তাকিয়ে আছেন। আমার নিরামিষ টাইপ ‘ভালোই’ এর কারণ জানবার জন্য। বললাম
— আসলে… হি ইজ গুড। বাট…
— এই ‘বাট’ খুব ভয়ের জিনিস। মন থেকে পছন্দ না হলে এখনই ‘না’ বলে দে।
শম্পাদির দিকে তাকালাম। সামনে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমিও চোখ ঘোরালাম। বললাম
— আমার জায়গায় তুমি হলে কি করতে?
— হ্যাঁ বলতাম।
— তাহলে?
এবার আমার দিকে ফিরল। টের পেলাম ব্যাপারটা। আমিও ঘাড় ঘোরালাম। মুখোমুখি হলে শম্পাদি বললেন
— কোনভাবে সময় বের কর।
— মানে?
— মানে তুই ও চোর, না কি বলে, ক্লিপ্টো… ওর প্রেমে পড়েছিস। কাজটা চাইল্ডিশ, বাট করে ফেলেছিস। বিয়ের পরে যদি কখনো ছেলেটাকে খুঁজে পাস, একটা হতাশা তোর পিছু নেবে। খুব বাজে জিনিস।
— কি করতে বল?
— এনেগেজমেন্টটা কোনভাবে পিছিয়ে, একটু ট্রাই কর ওকে খোঁজার। আই থিঙ্ক ওর সাথে তোর ভালো জমবে। ইট উইল বি অ্যা গুড ম্যাচ।
কথাটা শুনতে অবান্তর লাগলে, টের পেলাম বুকের ঢিপঢিপানি বেড়ে গেছে। মুখে বললাম
— তুমি কি পাগল হয়েছো?
গলার আওয়াজে বোধহয় তেমন জোর ছিল না। কথাটার সোজাসুজি উত্তর দিলেন না শম্পাদি। জিজ্ঞেস করলেন
— ছেলেটাকে পছন্দ হয়নি?
— তা বলছি না… বাট…
রিক্সাটা পৌঁছে গেছে। ওকে থামতে বললাম। রাস্তার ধারেই ক্যাফেটা। নেমে দরজা পর্যন্ত যেতে সময় লাগল না। ভেতরে বেশ ফাঁকা। এখানে আসলে মূল ভীড়টা হয় বিকেলের পরে। এই সময় আসলে ক্যাফে রেডি করার ঘটনাগুলো ঘটে। আমাকে দেখে ওয়েটার একটা হাসি দিল। চিনে গেছে আমাকে।
এগিয়ে গিয়ে একটা টেবিলে বসলাম। ওয়েটারটা এগিয়ে আসলে বললাম
— দুটো কফি।
— দেরী হবে ম্যাডাম।
ঘাড় নেড়ে বোঝালাম, সমস্যা নেই। এরপরে শম্পাদির দিকে তাকিয়ে বললাম
— এই কদিন, প্রতিদিন এসেছি। ওয়েটার ব্যাটা চিনে গেছে।
শম্পাদি হাসল। বলল
— এরপরও বলছিস তুই প্রেমে পড়িসনি?
— পড়িনি বলছি না, বাট…
মাথা দুদিকে নেড়ে বোঝালাম এর কোন মানে হয় না, এটাই জানি। মুখে বললাম
— ইট ইজ ইম্পসিবল।
শম্পাদি হাত বাড়িয়ে আমার হাতটা ধরলেন। চোখে একরাশ উৎসাহ। মুখে বললেন
— আই নো, প্রেমে পড়ারও কিছু নিয়ম থাকে, বাট নিয়ম ভেঙ্গেও প্রেম হয়।
শম্পাদির দিকে তাকালাম। মনে হল উনার সাথে আমিও একমত। মুখে বললাম
— হাতে আছে আর মাত্র দুটো দিন। এর মধ্যে যদি দেখা না হয়…
আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন শম্পাদি। ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি বললেন
— আর যদি দেখা হয়?
— কিভাবে?
এক মুহূর্ত ভাবলেন শম্পাদি। এরপরে বললেন
— এখন পর্যন্ত একটা ব্যাপার তো সিওর। কেউ একজন সেই মেয়েটাকে আর তোর প্রলয়কে টেক্সট করেছে।
— ইয়া।
— পুলিশ চাইলেই ট্রেস করতে পারবে, যে নাম্বার থেকে এসেছে, সেটার লোকেশান। কিংবা যদি সেই মেয়েটার ইমেইল হ্যাক করে থাকে, সেক্ষেত্রেও পুলিশের সাইবার সেল সেই আইপি অ্যাড্রেস ট্রেস করতে পারবে।
— বলতে চাইছো ক্লিপ্টোম্যানিয়াকই সেই হুমকি দাতা?
শ্র্যাগ করলেন। এরপরে ঠোঁট উল্টে বললেন
— নট সিওর। বাট আমার গাট ফিলিংস তাই বলছে। তোর কি মনে হয়?
কথাটা যে ভাবিনি এমন না। ভেবেছি। এবং কোন উত্তর পাইনি। সৎ কনফেশানটা করলাম
— জানি না।
আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন শম্পাদি। এরপরে বললেন
— ওকে, হতেই পারে আলাদা জন। যদি তেমন হয়ও, লস নেই। জানা গেল, হু ইজ দ্যাট গাই, যে তোর অপমানের প্রতিশোধ নিতে এমন উঠেপড়ে লেগেছে। আর যদি…
চোখে দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বললেন
— ট্রাই করতে দোষ কি?
মাথা নোড করে বোঝালাম, আমারও সম্মতি আছে। জিজ্ঞেস করলেন
— পুলিশে চেনাজানা কেউ আছে?
‘পুলিশ’ কথাটা কানে বাজল। ঝট করে মানুষটার কথা মনে আসল। কানে এখন ভাসছে উনার আশ্বাস। উত্তরটা দিলাম না। শুধু চোখে একটা দুষ্টুমির হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম শম্পাদির দিকে। প্ল্যান করে ফেলেছি, কি করব। বললাম
— আছে।
চলবে
Razia Sultana Jeni
Send private message to author





