সত্যিকারের বন্ধু

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট দিয়ে ঢুকে যে ছোটখাটো চত্ত্বরটা দেখবেন,সেটার নাম ‘শান্ত চত্ত্বর’। শান্ত চত্ত্বরের দুটো বড় গাছের গোঁড়া সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো।
হৃদি ঐ সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো জায়গাটায় বসে আছে। আজ শান্ত চত্ত্বরে প্রচুর মানুষ। হৃদি বারবার উপরে তাকাচ্ছে। গাছের উপর বসে থাকা কাকেরা যখন তখন পায়খানা করে দেয়।
ওর গায়ের উপর পায়খানা করে দিলে ব্যাপারটা খুব বাজে হবে। হৃদি এখান থেকে উঠে যাবে কি না ভাবছে। 

হৃদির পাশে ওর বান্ধবী সাগুফতা বসে আছে। সাগুফতা অসম্ভব রুপবতী আর স্টাইলিশ একটা মেয়ে। ও খুব দ্রুত একজন টিকটক সেলিব্রেটি হয়ে উঠেছে। টিকটকে ওর নাম ‘Sagufta:-The Princess’.  
সাগুফতা ‘ডাক ফেস’ করে মোবাইল দিয়ে সেলফি তুলছে। সেলফি তুলতে সাগুফতা এতো ভালোবাসে কেন,কে জানে।  

কিছুক্ষণ পর তমাল আর নাঈম এল ওদের কাছে। ওরা আসলে চারজনের একটা গ্রুপ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর গত ৮-৯ মাসের মধ্যে বেশ ভালো একটা বন্ধন গড়ে উঠেছে হৃদি,সাগুফতা,তমাল,নাঈম- এ চারজনের মধ্যে।   
তমাল বলল,”তোরা তোদের ব্লাড গ্রুপ জানিস? ’বাঁধন:- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিট’ বিনা পয়সায় ব্লাড গ্রুপ বের করে দিচ্ছে। আমারটা A+. নাঈম বের করবে ওরটা। তোরা চাইলে যেতে পারিস।”  
হৃদির ব্লাড গ্রুপ O+. সাগুফতা জানে না ওরটা। ওরা চারজন দল বেঁধে গেল সাগুফতা আর নাঈমের ব্লাড গ্রুপ জানতে।  

ওখানে ওরা ফরহাদকে দেখতে পেল। ফরহাদ ওদের ক্লাসমেট। লাজুক ধরনের ছেলে। চশমা পরে। পড়াশুনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ও। 
ফরহাদের সেরকম কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই বললেই চলে। মেয়েদের সাথে খুব একটা মিশতে পারে না ও।   

জানা গেল,ফরহাদের রক্তের গ্রুপ A+. ফরহাদকে ক্লাসের অনেকে ‘নলা’ বলে ডাকে। হৃদি এই বিশ্রী শব্দটার মানে জানে না। জানতে চায়ও না।  
তমাল,ফরহাদের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল,”কী রে নলা,যা যা সেমিনারে গিয়ে পড়তে বস।”  
ফরহাদ ওদের সাথে কোনও কথা বলল না। নিঃশব্দে ও চলে গেল ওখান থেকে।  

নাঈমের ব্লাডগ্রুপ জানা গেল O+. সাগুফতার আঙ্গুল থেকে রক্ত নেয়ার সময় ও অহেতুক ন্যাকামি করতে লাগলো। 
হৃদি,সাগুফতার সাথে মিশেছে। সাগুফতা বেশ শক্ত ধরনের মেয়ে। কিন্তু ছেলেদের সামনে আসলেই ও অহেতুক ন্যাকামি করা শুরু করে।
ছেলেদের সামনে ন্যাকামি করে সাগুফতার কী লাভ হয়,আল্লাহই জানেন।     

বেশ কিছুক্ষণ সাগুফতার ন্যাকামি সহ্য করার পর জানা গেল যে,ওর রক্তের গ্রুপ A+. 

আজকের মতো ওরা চারজন যার যার বাড়ি চলে যাবে। বিদায় নেয়ার সময় তমাল,সাগুফতাকে জড়িয়ে ধরল। তমালের গার্লফ্রেন্ড আছে। 
সাগুফতাও রাফসান ভাইয়ার সাথে এনগেজড। তারপরও ওদের এই হঠাৎ হঠাৎ জড়াজড়ি করাটা হৃদির পছন্দ নয়। 
‘বন্ধুত্ব’ খুব সুন্দর একটি সম্পর্ক। হৃদি চায় না এ সুন্দর সম্পর্কটাতে এক ফোঁটা কালিও লাগুক।  

হৃদির আম্মু হৃদিকে বলে গেছে দুটো ডিম ভেজে রাখতে। হৃদির আম্মু আজ অনেকদিন পর উত্তরায় হৃদির ছোটখালার বাসায় গিয়েছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই অবশ্য তাঁর বাসায় চলে আসার কথা।  
হৃদি চুলার উপর ফ্রাইংপ্যানটা বসিয়ে তেল ঢালছে। আম্মুর অভিযোগ,হৃদি বড্ড খরুচে। রান্নার সময় অতিরিক্ত তেল খরচ করে। অভিযোগটা হৃদিকে বিরক্ত করে। ‘দুই-চার ফোঁটা’ তেল দিয়ে কি ঠিকঠাক রান্না করা যায়? 

এটা ‘আম্মুর সংসার’। এখানে আম্মুর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। হৃদির যখন ছোট্ট একটা সংসার হবে তখন ও ইচ্ছেমতো তেল ঢেলে রান্না করবে।  

হৃদি যখন এসব ভাবতে ভাবতে ডিম ভাজছে,তখন ওর ফোন বেজে উঠল। অফিস থেকে বাবা ফোন দিয়েছে। 
বাবার গলাটা খুব করুণ শোনাচ্ছে। বাবা বললেন,”মা রে,তোর আম্মু খিলক্ষেতে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ওকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। আমিও যাচ্ছি হাসপাতালে। বেশ কয়েক ব্যাগ রক্ত লাগবে। তুই যদি পারিস তোর বন্ধু-বান্ধবকে বলে রক্ত জোগাড় কর……..”
বাবা কথা শেষ করতে পারল না। হৃদি হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। ওর কাছে পুরো পৃথিবীটা শুণ্য মনে হচ্ছে। 

খুব ছোটবেলায় একবার আব্বু-আম্মুর সাথে বৈশাখী মেলায় বেড়াতে গিয়ে হৃদি হারিয়ে গিয়েছিল। সেইসময় হৃদি নামের সেই ছোট্ট মেয়েটা যেরকম অসহায় বোধ করছিল,আজ এতো বছর পর ওর ঠিক সেরকম অসহায় লাগছে।  
ও কাঁপা হাতে বন্ধু নাঈমকে ফোন করল। 

গতকাল রাতে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের খেলা ছিল। নাঈমরা একে সংক্ষিপ্ত করে বলে ‘উচল’। নাঈম,ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মস্ত বড় ফ্যান। মাঠের খেলা তো আছেই। রোনালদোর প্লে বয় ইমেজটা ওকে বড্ড বেশি টানে।   
সেলিব্রেটিরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাবে,মেয়ে-মদ নিয়ে ফূর্তি করবে- তবেই না তাদের ভালো মানাবে!   
মেসির মতো এক নারীতে সারাজীবন মজে থাকলে হবে? অবশ্য আজকাল রোনালদোও মেসির মতো হয়ে যাচ্ছে। 
এইজন্যই নেইমার আজকাল নাঈমকে একটু আধটু টানছে।  

গতরাতে রোনালদোর জুভেন্টাসের সাথে রিয়াল(মাদ্রিদ) এর খেলা ছিল। রাত জেগে খেলা দেখে ফোনের সুইচ অফ করে নাঈম ঘুমাচ্ছে। 
হৃদি ওর বন্ধু নাঈমের ফোন বন্ধ পেল।
হৃদির খুব কষ্ট হচ্ছে। ওর কান্না পাচ্ছে। ও ওর বেস্ট ফ্রেন্ড সাগুফতাকে ফোন দিল।  

সেমিস্টার ফাইনালের জন্য টিকটক সেলিব্রেটি সাগুফতা বেশ কিছুদিন হল নতুন কোনো ভিডিও আপলোড করতে পারে নি।  
ওর ইনবক্সে ভক্তদের মেসেজ এসে ভরে যাচ্ছে,’আপি,তুমি এখন আর ভিডিও দাও না।’ ‘Hey apu,feeling blank'(কান্নার ইমো)। ‘আপু তোমার কী হইসে? মন খারাপ?’  

এসবের চেয়েও বড় কথা টিকটকে ওর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পিউ আর সিনথিয়া এ ক’দিনে বেশ ভালো কিছু ভিডিও ‘আপ’ দিয়েছে। আজই সাগুফতা একটা ভিডিও ‘আপ’ না দিলে ‘Sagufta:-The Princess’ এর বারোটা বেজে যাবে। 

হৃদি সাগুফতাকে ফোন দিয়ে কান্না কান্না কন্ঠে বলল,”দোস্ত,আম্মু অ্যাকসিডেন্ট করেছে। তোর আর আম্মুর রক্তের গ্রুপ তো এক। দিতে পারবি আম্মুকে রক্ত?” 
হৃদির মায়ের অ্যাকসিডেন্টের কথা শুনে সাগুফতার খারাপ লাগছে। কিন্তু আজ টিকটক ভিডিও থুয়ে ওর পক্ষে রক্ত দিতে যাওয়া সম্ভব না। ও কন্ঠটা আর্দ্র করে বলল,”দোস্ত। আন্টির কথা শুনে খারাপ লাগছে। আমিও বিপদে পড়েছি। আমার আম্মুরও আজ মাথা ঘুরছে। আম্মুকে নিয়ে আমি ডাক্তারের কাছে এসেছি দোস্ত।”    

সাগুফতার মা পাশের বাসার আন্টির সাথে বসে তিন-তলা আর চারতলার আন্টিদের নামে গীবত করে বেড়াচ্ছেন। উনি পরিপূর্ণ সুস্থ।  
সাগুফতা দ্য প্রিন্সেস ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হৃদিকে মিথ্যে বলল। মাঝে মাঝে মিথ্যে বলতে হয়। এতে সাপও মরে,লাঠিও ভাঙ্গে না।  

হৃদি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। ওর হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ও চুলো নিভিয়ে,মুখে একটু পানির ঝাঁপটা দিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল।    
রাস্তায় নেমে হৃদি তমালকে ফোন দিল। 

তমাল একটা জটিল সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ও গতকাল রাতে পুষ্পাকে নিয়ে ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিল। পুষ্পা সিটি কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। 
অসম্ভব রুপবতী মেয়ে এই পুষ্পা। ওর ফেসবুক প্রোফাইলের ছবি দেখতে দেখতে তমালের ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যায়।  

পুষ্পাকে একান্তে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে তমালকে সেই লেভেলের ‘সাধনা’ করতে হয়েছে। তমাল এসবে অভ্যস্ত। 
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে তমাল ওকে নিয়ে একটা সিএনজিতে ওঠে। এরপর রাতের আঁধারে সিএনজিতে বসে পুষ্পার ঠোঁটে চুমু খায় তমাল। পাশাপাশি পুষ্পার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অঙ্গ ও স্পর্শ করতে থাকে।  

অধিকাংশ মেয়েদের মতোই পুষ্পাও প্রথমে বাঁধা দিয়েছিল। শেষমেশ আর পারে নি। তমালদের মতো অভিজ্ঞ ছেলেদের ফাঁদে একবার ধরা পড়লে,পুষ্পাদের সহজে মুক্তি মেলে না।  

ঐ রাতে তমালের সন্তুষ্টি আসে নি। পুষ্পার ‘ন্যুড পিক’ পাবার জন্য তমাল অস্থির হয়ে যাচ্ছে। তমালের ‘সাধনা’র দ্বিতীয় স্তর চলছে। ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।  
পুষ্পার প্রতি তমালের এই আকর্ষণের কথা জেনে ফেলেছে তমালের বর্তমান গার্লফ্রেন্ড তনুশ্রী। একটু আগে তনুশ্রী ফোন দিয়েছিল। তমাল আর তনুশ্রীর মধ্যে বেশ একচোট ঝগড়া হয়েছে।
তনুশ্রী হুমকি দিয়েছে,তমাল যদি পুষ্পার দিকে আর এক পা-ও বাড়ায় তাহলে ও তমালের খবর করে দেবে।  

তনুশ্রীকে ঠান্ডা করার উপায় তমাল জানে। বছর দুয়েক আগে ওদের রিলেশনের শুরুর দিকে তমাল তনুশ্রীর ‘ন্যুড পিক’ নিয়ে রেখেছে। 
সম্পর্কের শুরুর দিকে,মেয়েদের আবেগ যখন অতি উচ্চে থাকে তখন বোকা সেজে ‘ন্যুড পিক’ সংগ্রহ করে রাখতে হয়। বলতে হয়,”প্লিজ জান। একবার দাও। দেখেই ডিলিট করে দেব। প্রমিজ।” 

কিন্তু অবশ্যই ওসব ডিলিট করতে হয় না। ওগুলো ভবিষ্যতে কাজে লাগে। যেমন তমালের এখন লাগবে। 

হৃদির ফোন পেয়ে তমাল বলল,”দোস্ত,আমার দাঁতে প্রচণ্ড ব্যথা। মাথা উঠাতে পারছি না। আমি সুস্থ থাকলে অবশ্যই যেতাম দোস্ত।”  

হৃদির তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর একজনও আসতে পারছে না। বাসে হৃদির পাশে বসা মহিলা ওকে বললেন,”এই মাইয়া,কান্দো ক্যান? আল্লাহরে ডাকো। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।” 
হৃদির হঠাৎ ওদের ক্লাসমেট ফরহাদের কথা মনে হল।  

ফরহাদের মায়ের গতকাল রাতে হঠাৎ ১০৩ ডিগ্রী জ্বর এসে গিয়েছিল। এখন অবশ্য উনি একটু ভালো। 
ফরহাদের বাবা চাকরিসূত্রে সিলেটে থাকেন। আপাততঃ ওদের বাসায় মা আর ফরহাদ এ দুজনই আছে। 
হৃদির ফোন পেয়ে ফরহাদ বলল,”তুমি টেনশন কোরো না হৃদি। হসপিটালের ঠিকানা দাও। আমি এক্ষুণি আসছি।” 

আল্লাহর অশেষ রহমতে হয়তো এ যাত্রায় হৃদির মা বেঁচে যাবেন। আপাততঃ উনাকে ২৪ ঘন্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। যে কয়ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন ছিল শেষমেশ সবই জোগাড় করা গেছে।   

রক্ত হৃদির বাবা জোগাড় করেছেন,ছোট মামা জোগাড় করেছেন,বাবার বন্ধু আশরাফ কাকা জোগাড় করেছেন,আর হৃদি জোগাড় করেছে ওর ‘বন্ধু’ ফরহাদেরটা।  

হৃদির বাবাকে উদভ্রান্ত লাগছে। উনি ফরহাদকে বললেন,”তুমি হৃদির বন্ধু? তোমাকে আগে কখনো দেখি নি। তোমার আন্টিকে বাসায় নিয়ে গেলে তুমি অবশ্যই বাসায় আসবে বাবা।”        

হৃদির সামনে লাজুক মুখ করে ফরহাদ দাঁড়িয়ে আছে। হৃদির কেন যেন খুব ইচ্ছে করছে ফরহাদকে জড়িয়ে ধরতে।

হাসপাতালের এতো মানুষের মধ্যে সেটা সম্ভব নয়। ফরহাদ এখন চলে যাবে।

ফরহাদ যাবার সময় হৃদি ওর একটা হাত ধরল। ফরহাদ অবাক চোখে হৃদির দিকে তাকিয়ে বলল,”কিছু বলবে?”

হৃদি বলল,”পরে বলব।”

সব কথা একবারে বলে দিতে নেই। কিছু কথা পরে বলার জন্য তুলে রাখতে হয়।

Munif Muhtasim

Send private message to author
What’s your Reaction?
3
2
0
0
0
0
2
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Munif Muhtasim
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!