অপেক্ষায় নতুন সকাল

বিয়ের পরদিন দুপুরে খেতে বসেছি। আমি এই বাসার নতুন বউ। খাবার টেবিলে আছেন আমার হাজবেন্ড, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, আমার বড় চাচা শ্বশুর, চাচি শ্বাশুড়ি, চাচাতো দেবর, ননদ। সবাই আপনমনে যার যার মতো খাচ্ছেন। কারো কোন সাড়াশব্দ নাই একদম পিনপতন নীরবতা। আমি শুধু ভাবছিলাম আমাদের বাসায় খাবার টেবিলে আমরা কতশত কথা, কত হাসাহাসি হতো! আর বাবা শুধু আমাদের থামিয়ে দিয়ে বলতেন খাওয়ার সময় এতো কথা বলতে হয় না। ইশ! বাবা আমার শ্বশুড়বাড়ি আসলে কত যে খুশি হবেন!

যেহেতু কালই বিয়ে হয়েছে তাই বাড়িভর্তি আত্নীয়স্বজন, মেহমান। সবার সাথে আমার এখনো ভালোভাবে পরিচয় হয়নি। আমরা সবাই সেকেন্ড ব্যাচে খেতে বসেছি। আমার শ্বাশুড়ির রান্না ভালো, বিশেষ করে মাছ রান্নাটা এত ভালো হয়েছে যে প্রচন্ড উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেই ফেললাম ‘মা, মাছটা সেই ফাটাফাটি ভালো হয়েছে!’ সবাই খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! এর আগে কেউ মনে হয় এত নির্লজ্জ বউ দেখে নাই! লজ্জায় পড়ে গেলাম ‘সরি! আমি মনে হয় বেশি জোরে বলে ফেলেছি!”

“না না! ঠিক আছে, খাও তুমি! আরেক পিস দেই?” বলে আমার হাজবেন্ড ফরহাদ আরেক পিস মাছ তুলে দিলো। আমার খেতে লজ্জা লাগছে না কিন্তু সবাই যেভাবে তাকালো সেটা ভেবেই লজ্জা লাগছে। আরে রান্নাটা ভালো হয়েছে তো বলবো না? এটা শুনে সবার তো খুশি হওয়ার কথা! বিশেষ করে শ্বাশুড়ি মা’র! ফরহাদ এতো যত্ন করে মাছটা তুলে দিলো মনে মনে আমি একটা কাহিনী বানিয়ে ফেললাম! হয়তো কাল থেকে আকাশে-বাতাসে, মাঠে-ঘাটে বিভিন্ন আত্নীয়স্বজনের কানে-মুখে রটে যাবে ফরহাদ তো বিয়ে করতে না করতে বউয়ের ভক্ত হয়ে গেছে! জীবনে মাকে কোনোদিন এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়ায় নাই সেই ছেলে এখন বউয়ের পাতে মাছ তুলে দিয়েছে তাও আবার সবার সামনে! বিয়ে করে কেমন বেহায়া হয়ে গেল ছেলেটা! কিন্তু না তেমন কিছুই হলো না!

যাইহোক, বিয়ের আগে বড় আপা কিছু টিপস দিয়েছেন। তারমধ্যে একটা ছিল শোন, শ্বশুরবাড়ি যেয়ে প্রথম দিনই চোখমুখ বন্ধ করে, পারিস না পারিস পাঁচ/ছ রুটি খেয়ে নিবি তাহলে তার পরের দিন কমপক্ষে দুইটা হলেও খেতে দিবে। প্রথমদিন যদি ভদ্রতা করে না না ঠিক আছে, খাবো না, খেতে পারছিনা বলিস তাহলে কিন্তু তোর ভাগ্যে আর খাবার নাই! মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম আমার শ্বশুরবাড়ি তোর মতো এত ছ্যাঁছড়া হবেনা।

আবার এটা ভাববেন না বড় আপার টিপস ফলো করতে যেয়ে দুই পিস মাছ খেয়ে ফেলেছি। আমার শ্বাশুড়ির রান্না এতই চমৎকার যে দুই পিস মাছ খাওয়াও কম হয়ে যায়!

হ্যাঁ, আমার শ্বশুরবাড়ি তেমন নয়। এখানে আমার অবাধ স্বাধীনতা, যখন যা ইচ্ছা করতে পারি কোন বাধা নেই। এখানে কারো পরচর্চা করা হয় না, গীবত নেই, কোনো খোঁটা নেই! নেই বউদের জন্য স্পেশাল কোনো নিয়ম নেই।

ফরহাদ বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান। শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ফরহাদ আর আমি- এই নিয়েই আমাদের ছোট্ট সংসার। আমার শ্বাশুড়ি ভীষণ চুপচাপ মানুষ। কিন্তু যে কথাই বলেন হাসিমুখে বলেন এটা আমার খুব ভালো লাগে। সারাদিন আপনমনে কাজ করেন। দেখেই মনে হয় উনি খুব চিন্তিত! কী এতো চিন্তা?! ওনার কোনো চাহিদা নেই, শখ-আহ্লাদ নেই। বাসাটা একদম ঠান্ডা। আমরা হাউকাউ এর মধ্যে বড় হয়েছি বলেই হয়তো আমার কাছে এমন মনে হয়। সবার কথাবার্তা ভীষণ ফরমাল।

বিয়ের সাত দিনের মাথায় বাসা ফাঁকা হয়ে গেলো। আমি একটু একটু করে আম্মাকে রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করার চেষ্টা করি। যেদিন প্রথম আম্মা শাক বাছতে দিয়েছিলেন আমি অবলীলায় বলে ফেলেছিলাম ‘কীভাবে করবো?” মনে মনে প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম হয়তো তিনি এখুনি বলে বসবেন ‘তোমার মা কিছু শেখায় নাই?’ কিংবা ‘বুড়া বয়সে বিয়ে হয়েছে আর সামান্য শাক বাছা জানোনা?!” কিন্তু না তেমন কিছুই হলো না। উল্টো আম্মা আমাকে হাসিমুখে দেখিয়ে দিলেন। কৃতজ্ঞতায় আমার মনপ্রান ভরে গেল!

আমার শ্বশুরবাড়িতে অন্যান্য সমস্যা না থাকলেও একটা বড় সমস্যা আছে। সেটা হলো আমার শ্বশুর! জি, আমার শ্বশুর-ই হলো এই বাসার মূল সমস্যা! বিয়ের সাতদিন পর এটা আমি আবিষ্কার করেছি। বিয়ে বাড়ির ঝামেলা, আত্নীয়স্বজন বিদায়ে আমার শ্বাশুড়ি ব্যস্ততায় ভুলেই গিয়েছিলেন বাসায় আটা শেষ হয়ে গেছে। রাতে রুটি বানাতে যেয়ে মনে পড়লো আটা নেই। এদিকে শ্বশুর রাতে রুটি খান। খাবার টেবিলে রুটি না পেয়ে আমার শ্বশুর হাতের প্লেট ছুড়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে হনহন করে হেঁটে গেলেন বেডরুমে! আমি আর ফরহাদ তখন খাচ্ছিলাম। এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো অথচ ফরহাদ নির্বিকার খেয়েই যাচ্ছিল! শ্বাশুড়ি, শ্বশুরের পিছে পিছে দৌড়াচ্ছেন ‘আমার মনে ছিলো না, ভুল হয়ে গেছে…শোনো…’ শ্বাশুড়ির মুখের উপর ধুম দরজা লাগিয়ে দিলেন! আম্মার অসহায় মুখখানা দেখে আমি এতোটাই মর্মাহত হলাম যে আমার চোখে পানি এসে গেলো…

‘মা, খাও তুমি।’ শ্বাশুড়ি মা স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করলেও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম নতুন বউয়ের সামনে স্বামীর এমন আচরণে তিনি লজ্জিত, ক্ষত-বিক্ষত!

আমি খেতে পারলাম না। ফরহাদ খাওয়া শেষ করে রুমে চলে গেলো।

‘ কিছুই হয়নি’ এমন ভান করে টেবিলের সব খাবার একে একে ফ্রিজে রাখছেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওনার গা কাঁপছে। চোখে পানি নেই কিন্তু এই চোখকে স্বাভাবিক বলা যায় না।

‘তুমি তো খেলে না কিছু। এক গ্লাস দুধ দেই? “
এতকিছুর পরও কত চিন্তা…

‘না মা…!’ আরো কিছু বলতে চাইছিলাম কিন্তু আমার গলা ধরে আসছিল। উনি নিজেও তো খান নাই। এমন পরিস্থিতি আগে কখনো দেখি নাই। বুঝতে পারছিলাম না আমার কী করা উচিত! কী বলা উচিত!

ফরহাদ খুব স্বাভাবিক ভংগিতে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।
‘কী করো তোমরা?! ঘুমাবে না?”

আমি ফরহাদের দিকে তাকালাম। ছেলেটার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে সে হানিমুনে এসেছে! একপ্রকার রাগ নিয়েই বললাম ‘তুমি যাও, ঘুমাও!’
এদিকে শ্বশুর সাহেব বেডরুমের দরজা লাগিয়ে যে বসে আছেন খোলার নাম গন্ধ নেই। আমাদের সামনে আম্মা আরেকবার রুম নক করলেন। শেষ চেষ্টা। ‘ঘুমিয়ে পরেছো?’ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে গেস্টরুমের বিছানায় মশারি টাংানো শুরু করলেন। তিনি সেখানেই থাকবেন…

এই ঘটনার পর থেকে আমার শ্বাশুড়ির প্রতি আমার ভালোবাসা এক ধাপ বেড়ে যায়। কীভাবে সহ্য করেন এসব?! কোনো প্রতিবাদ, কোনো বিরক্তি নেই! এসব নেই বলেই বছরের পর বছর আমার শ্বশুর এসব করার সাহস পান। এটা তো শুধু একটা উদাহরণ দিলাম। শ্বাশুড়ি মা’র রান্নার ভুলা ধরা, রাগ করে না খেয়ে থাকা, জিনিসপত্র ভাংচুর করা, উঠতে বসতে নিজের স্ত্রীকে ছোটো করে কথা বলা ইত্যাদি তার স্বাভাবিক আচরণ! এটাই যেনো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে- যা আমার শ্বাশুড়ির চুপ হয়ে যাওয়ার অন্যতম একমাত্র কারন।

শ্বশুর আব্বার সাথে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই বরং তিনি আমাকে খুব আদর করেন। আমাকে আদর করলে আমার শ্বাশুড়ি অনেক খুশি হন।

যাইহোক, এবার আরেকটা ঘটনা বলি। কয়দিন আগে কী হলো জানেন? সেটাও খাবার টেবিলে! বলছি। রাতে সবাই খাচ্ছিলাম।
তরকারিতে লবন কম হয়েছিল। আমি শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম। মুখে এক লোকমা ভাত দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিলাম আজকের রান্নাটা আমি করেছি। ‘খুব ভালো হয়েছে! এত স্বাদ! দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি রান্না করেছো! ” আমার শ্বশুর বলছিলেন আর খাচ্ছিলেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ওনার কাছে ভালো লাগছে না । উনি আমাকে খুশি করার জন্য বলছিলেন। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফরহাদ ভাতের মধ্যে পানি ঢেলে চিতকার শুরু করলো ‘ছিঃ! কী রান্না করেছো?! এসব মানুষ খায়?! রান্নাও শেখোনি?!!!”
“এভাবে রিয়েক্ট করছো কেনো?!” আমি খুব শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলাম।
“কিভাবে!? যা সত্যি তাই বলেছি!”

শ্বশুর সাহেবও রেগে গেলেন ‘কী হয়েছে? তুই এমন ব্যবহার করছিস কেন বউয়ের সাথে!? গলার স্বর নিচে নামা!”

‘ছোটোবেলা থেকে শিখেছি বউদের সাথে এভাবেই কথা বলতে হয়…! ” বলেই ফরহাদ উঠে গেলো…

খাবার টেবিলে আমরা তিনজন একদম চুপ। আব্বার সাথে সাথে আম্মাও আস্তে আস্তে রুমে চলে গেলেন।

অনেক রাত৷ আব্বা বারান্দায় বসে আছেন। অনেকক্ষণ হলো বসে আছেন। আমি অপেক্ষা করছি একটু কথা বলবো। কথা বলাটা খুব দরকার । বেডরুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম আম্মা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। কিছু চিন্তা না করেই বারান্দায় চলে গেলাম।

‘আব্বা! একটু কথা বলতে পারি?”

‘ হ্যাঁ বৌমা বলো!”
‘আব্বা, মাফ করবেন। একটা অপরাধ করে ফেলেছি!”

“কী হয়েছে বৌমা!?

“আজকের রান্নাটা আমি করি নাই, আম্মা করেছিলেন!’

আব্বা চমকে উঠলেন! আব্বাকে খুব ভীত লাগছে!
মুখ ফসকে শুধু ‘ওহ’ শোনা গেল!
‘আব্বা, আমি জানি আজকে তরকারিতে লবন কম ছিল। অথচ আমি রান্না করেছি শুনে আমাকে খুশি করতে কী মজা করে খেলেন! আর কতো প্রশংসা করলেন! যদি জানতেন আম্মা রান্না করেছিলেন এভাবে প্রশংসা করতে পারতেন!?”

আব্বা কোনো কথা বললেন না। আমার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

‘আব্বা, আপনি যা করবেন আপনার সন্তান তা-ই অনুসরণ করবে…” বলেই আমি রুমে চলে এলাম।

ফরহাদ তখনো টিভি দেখছিল। হাতে একটা বিশাল চিপসের প্যাকেট। আমাকে রুমে আসতে দেখেই বলে উঠলো ‘কী? আমাকে কোথায় ট্রিট দিচ্ছো তাহলে?”

“ট্রীট দিবো মানে, তোমাকে আমি অস্কার দিলাম যাও!”
‘এতো ভালো অভিনয় জানি জানলে তো নায়ক হয়ে যেতাম!” বলেই ফরহাদ হাহা করে হেসে উঠলো!
‘ইশ! আর আমি নায়কের বউ হতাম! বলো, কী খেতে চাও তোমাকে তাই-ই খাওয়াবো?”

ফরহাদের বিনীত অনুরোধ ‘আগে এক গ্লাস পানি খাওয়াও না প্লিজ?!”

ডাইনিং রুমের টেবিল থেকে পানি ঢালার সময় দেখি আব্বা তখনো বারান্দায় বসে আছেন। চাঁদের আবছা আলোয় তাঁর মুখটা হালকা দেখা যাচ্ছে। আব্বা গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেনো ভাবছেন। ভীষণ চিন্তিত। সেদিনের মতো এতো অসহায় এর আগে আমি তাঁকে দেখি নাই। হয়তো হিসাব মিলানোর চেষ্টা করছেন… কাছে যেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেতে বলবো কিনা মনে হলো… পরে ভাবলাম না থাক, আজকের জেগে থাকাটা তঁার জন্য খুব জরুরি। আজকের রাতটা অন্যসব রাতের মতো নয়। আজকের রাতের পর কাল নতুন সূর্য উঠবে। সেই নতুন সূর্য দেখার অপেক্ষায় আমরা সবাই। আপনি ভাবুন, আব্বা….!

খাদিজা তুল কোবরা কাব্য
২৭ আগস্ট, ২০২১

Send private message to author
What’s your Reaction?
2
7
0
0
1
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Khadiza tul kobra kabbyo
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!