আমাদের শৈশব, কৈশোর, বেড়ে ওঠা: সামাজিক অনুশাসন।

বর্তমান বাস্তবতায় আমরা এখন অনেকটাই সেকেলে। জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। এ দীর্ঘ সময়ে দেখেছি বিভিন্ন প্রজন্মের বেড়ে ওঠা। আসুন দেখে নেই আমাদের শৈশব আর কৈশোরর সময়টা কেমন ছিল।

সে সময়টাতে সত্যিকার অর্থে শহুরে জনপদ ছিল একেবারেই সীমিত। এমন কি জেলা শহর গুলোতে ও মানুষের জীবনযাত্রা ছিলো অনেকটা গ্রামীণ ধাঁচের। মানুষে মানুষে জানাশোনার পরিধি ছিলো অনেক ব্যাপক ও আন্তরিক। প্রায় প্রত্যেকেই আশে পাশের গ্রামের লোকজন এমন কি ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নাম, পরিচয় ও গ্রামের নাম জানতো।

স্কুলগুলো‌ ছিল অনেক দূরে দূরে। বিশেষত তখনকার একেকটি থানা তথা বর্তমান উপজেলায় গড়ে ২/৩ টি হাইস্কুল ছিল। কলেজগুলো ছিল সাধারণত মহকুমা সদরে।বেশীর ভাগ শিক্ষার্থীকেই তখন গড়ে দুই তিন মাইল বা তার ও বেশী দূরত্ব হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। আমরা তখন স্কুলে যেতাম দল বেঁধে। সাধারণত আমাদের বাড়ীর কাছাকাছি স্কুলের যে শিক্ষকের বাড়ী থাকতো আমরা সেই শিক্ষকের বাড়ীর কাছে কোন এক জায়গায় গিয়ে সবাই জড়ো হতাম। আর দল বেঁধে শিক্ষকের পেছনে পেছনে স্কুলে যেতাম। ফিরতি পথে ও আমরা একই নিয়মে বাড়ীতে ফিরে আসতাম।

স্কুলের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত বিষয়বস্তু ছিল নানান বৈচিত্র্যে ভরপুর। বিখ্যাত মনীষীদের জীবন চরিত্র, তাদের ছেলেবেলা, ভ্রমণ কাহিনী, বিখ্যাত সমাজ সেবক,
পরহিতৈষী, বিশ্বখ্যাত আবিষ্কার, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, দেশ প্রেমিক, বিখ্যাত সব যোদ্ধা আর বড় বড় নেতাদের জীবন চরিত্র পড়তাম আমরা আমাদের পাঠ্যসূচীতে। এ সমস্ত পাঠ্যসূচী থেকে আমরা উন্নত চরিত্র গঠন, আদর্শ, দেশপ্রেম সহ নানান মানবিক গুণাবলী আয়ত্ত করতে অনুপ্রাণিত হতাম। এ সময়টাতে আমাদের পাঠ্যসূচীর একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল নানান ধরনের চারিত্রিক ভালো গুণাবলী নিজেদের মধ্যে ধারণ করার আগ্রহ তৈরী করা।

সে সময়টায় আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন পিতা মাতার মত। স্নেহশীল, দায়িত্ববান, নির্মোহ আর ছাত্র ছাত্রীদের ভালোবাসতেন‌‌ একেবারে নিজের সন্তানের মতই। আজকালকার মত শিক্ষার ক্ষেত্রে এত বিভাজন ছিলনা তখন, ছিলনা শিক্ষার কোন বাণিজ্যিকরণ। গ্রামের স্কুল গুলো থেকে ও দেখতাম প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র ছাত্রী সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান করে নিতো। বেশীর ভাগ শিক্ষকদের জীবনই ছিল অত্যন্ত সাদামাটা আর আর্থিকভাবে ও তাঁরা তেমন সচ্ছল ছিলেন না। আর্থিক টানাপোড়েনে থেকে ও তাঁরা তাঁদের দায়িত্বের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। অনেক শিক্ষককেই দেখেছি তাঁরা প্রয়োজনে ছাত্র ছাত্রীদের নিজ বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে বিনা পয়সায় পড়াতেন। শিক্ষা দানকে তখন প্রায় ক্ষেত্রেই সেবা হিসেবেই গ্রহণ করতেন শিক্ষকরা। সমাজে শিক্ষকদের সম্মান ও ছিল তখন অনেক উঁচুতে।

শিক্ষকরা যেমন আমাদেরকে নিজের সন্তানের মত ভালবাসতেন ঠিক তেমনিই শিক্ষকদের জন্যে আমাদের ও ছিল প্রগাঢ় শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। লেখাপড়ার পাশাপাশি আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকে পেতাম জীবন গঠন আর সুন্দর মানুষ হবার উপদেশ আর অনুপ্রেরণা।তাঁদেরকে আমরা অনুসরণ, অনুকরণ করতাম আর চেষ্টা করতাম তাঁদের কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে।

তখনকার সময়ে নিজস্ব ও পারিবারিক বয়োজ্যেষ্ঠদের অনুশাসনের বাইরে ও ছিল পাড়া প্রতিবেশী ও গ্রামের অন্যান্য বয়স্কদের অনুশাসন। আমরা কখনো এখানে কোন রকম পার্থক্য দেখিনি। আশে পাশের যে কোনো বয়স্ক লোকদের আমরা শ্রদ্ধা করতাম নিজের পরিবারের বড়দের মতোই। শুনতাম তাঁদের কথা, মানতাম তাঁদের আদেশ। পালন করতাম তাঁদের নির্দেশ। বাস্তব অর্থে সে সময় যে কোন বয়োজ্যেষ্ঠই ছিল আমাদের শিক্ষক। আমরা তাঁদেরকে সে দৃষ্টিতেই দেখতাম। আমাদের জীবন আর চরিত্র গঠনে আমরা মূলত পরিবারের বাইরে ও স্কুল শিক্ষক আর আশে পাশের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে ও অনেক শিখেছি।

মনে পড়ে আত্মীয় স্বজনদের বাড়ী বেড়াতে যাবার কথা। কোন আত্মীয়ের বাড়ীতে বেড়াতে গেলে মনে হতো আমরা যেন আশে পাশের দশ বাড়ীর মেহমান। আপন পর বলে কিছুই ছিল না তখন। বেড়াতে গেলে স্নেহ, ভালোবাসা, আদর আর মমতা পেয়েছি আশে পাশের সবার কাছ থেকেই। তখনকার সময়ে মানুষজন আর্থিক ভাবে তেমন সচ্ছল ছিল না। গ্রাম পর্যায়ে আপ্যায়নের তেমন কিছুই ছিল না তখন। তারপর ও খালি মুখে আমরা কখনো ফিরে আসতে পারতাম না কোন বাড়ী থেকে। দেখতাম আশে পাশের বাড়ীর মুরুব্বীরা যে যার সাধ্যমত গাছের একটি আম, চিড়া বা মুড়ির মোয়া, এক ফালি নারিকেল, একটি কলা, একটি পেয়ারা, বাটিতে কিছুটা চিড়া বা মুড়ি বা চালের গুঁড়ার বানানো কোন একটি পিঠা গুঁজে দিতো আমাদের ছোট্ট হাতে। আমরা তাতেই ছিলাম বেজায় খুশি। দামের দিক থেকে এগুলো হয়তো একেবারেই নগণ্য। কিন্তু যে ভালোবাসায় এগুলো মোড়ানো ছিল তা যে কোন মূল্যেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমাদেরকে খাইতে দিতে পেরে তাদের যে আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখেছি তা এক কথায় ভালোবাসার যে কোনো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ।

তখন যোগাযোগের তেমন ভালো ব্যবস্থা ছিলনা গ্রামাঞ্চলে। পায়ে হাটা, নৌকা, গরুর গাড়ি আর কোথাও কোথাও সীমিত আকারে রিক্সার প্রচলন ছিল। মাঝে মাঝে দেখতাম গ্রামে বিভিন্ন বাড়ীতে মেয়েরা বাবার বাড়ীতে নাইওর আসতেন। নাইওর আসলে আশে পাশের বাড়ীর সমবয়সী মেয়েরা, বউরা আর বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা আসতেন নাইওর দেখতে। প্রায় ক্ষেত্রেই সন্ধ্যার পরে হারিকেন জ্বালিয়ে দল বেঁধে পায়ে হেঁটে হেঁটে এরা আসতেন নাইওর দেখতে। উঠোনে পাটি বিছিয়ে দল বেঁধে চলতো সুখ দুঃখের নানান আলাপ। প্রায় সময় চাঁদনী রাতেই মহিলারা বসতেন পাটি বিছিয়ে উঠোনে। মেতে উঠতেন আলাপচারিতায়। চারিদিকে চাঁদনী রাতের উজ্জ্বল আলো আর আশেপাশে ঝোপ ঝাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকার ছন্দময় ডাক। এক অদ্ভুত স্বপ্নময় পরিবেশ। এ আলোচনায় আপ্যায়নের মুল উপাদান ছিল পান সুপারি। পান ভর্তি বাটা থাকতো মাঝখানে। পানের সাথে থাকতো সুপারি, খয়ের, চুন, জর্দা আর সাদা পাতা। আলাপের মাঝে মাঝেই কেউ কেউ মুখে পুরে দিতেন পান। প্রায় ক্ষেত্রেই নাইওর আসার সময় নাইওরী তাঁর শ্বশুর বাড়ি থেকে হরেক রকমের ঘরে বানানো পিঠা, ফল মুল বা অন্য কোন খাদ্য সামগ্রী নিয়ে আসতেন। যখনই আমরা সে বাড়ি গুলোতে যেতাম আমাদের ভাগ্যে ও জুটতো সে সমস্ত খাবারের কিছু কিছু ভাগ।

আমাদের জীবন ছিল নিরেট সাদামাটা আর একেবারেই সহজ সরল। আপন পরের ভেদাভেদ কখনোই চোখে পড়েনি তখন। শিক্ষা পেয়েছি পরিবেশ থেকে, পরিবারের কাছ থেকে, পারিপার্শ্বিকতা থেকে, শিক্ষক, মুরুব্বী, পাড়া প্রতিবেশী আর বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে ও সামাজিক অনুশাসন থেকে ও আমরা শিখেছি অনেক কিছু আর তা ধারণ ও করেছি হৃদয়ে। আর সে শিক্ষা আর মূল্যবোধ বয়ে বেড়িয়েছি যুগ যুগ ধরে।

পেরিয়ে গেছে জীবনের লম্বা এক সময়। জীবন সায়াহ্নে এখন আমাদের প্রজন্ম। অনেক স্মৃতি ভেসে ওঠে মনে। কালজয়ী বিখ্যাত বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের ভাষায় বলতে হয় “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম”। আসলেই আমাদের দিনগুলো ছিল খুবই সুন্দর, স্মৃতিময়, বর্ণময় আর স্নেহ, ভালোবাসা, পারস্পারিক আদর সোহাগে পরিপূর্ণ। বাকী জীবনটা সেই সুখময় স্মৃতি হৃদয়ে ধারণ করেই কেটে যাক সেটাই আজ ও আগামী দিনগুলোর প্রত্যাশা।

Md. Aowrangazeb Chowdhury
মোঃ আওরঙ্গজেব চৌধুরী।
টরন্টো, কানাডা।

Send private message to author
What’s your Reaction?
1
0
0
0
0
0
0
Share:FacebookX
Avatar photo
Written by
Aowrangazeb Chowdhury
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Locbook Platform

Locbook is an independent platform for aspiring writers

error: Content is protected !!