” মুরগি কুরবানি দেয়া যায় না মা?”
মা হেসে বলে,” না রে বাপ দু’পা ওয়ালা পশু কুরবানি দেয়া যায় না।”
“তাহলে আমরা দুইটা মুরগি একসাথে কুরবানি দিব, দুইটার চার পা হয়ে যাবে।”
আমার কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়ে মা। “যা এখান থেকে আমাকে কাজ করতে দে।”
আমার বাবা একটা জুট মিলে কাজ করে। সামান্য বেতন পায়। সে আয় দিয়ে কুরবানি দেয়ার ক্ষমতা হয় না। কুরবানির আগেরদিন বাবা দুই-তিনটা মুরগি নিয়ে আসে।
কুরবানি ইদের দিন মুরগি জবাই করা যায় না তা-ই আগেরদিন জবাই করে কেটে কষিয়ে রেখে দেয়।
ইদেরদিন বাবা আমাকে খুব ভোরে ডেকে তুলে। আমার ঘুম ভাঙ্গতে চায় না। বাবা বলে, “উঠ বাপ ইদের দিন ফজরের নামাজ পড়তে হয়। ফজরের নামাজ না পড়লে ইদের নামাজ কবুল হয় না।”
বাবার সাথে মাও ডাকে একটু ধমকের স্বরে, “উঠ তাড়াতাড়ি, নামাজের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। “
আমি ঘুমঘুম চোখে উঠে বসি। ঢুলুঢুলু করে আমাদের চাপ কলে ওজু করে মসজিদে যাই।
ফজরের নামাজ পড়ে বাবা আর আমি একসাথে বাসায় চলে আসি। আমি আবার শুয়ে পড়ি ঘুম আসে না। বাবা জায়নামাজে বিছিয়ে নফল নামাজ পড়ে। নামাজ পড়ে মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে দোয়া করে,” হে আল্লাহ তুমি আমাকে কুরবানি করার ক্ষমতা দেউনি। তাই আমি কুরবানি দিতে পারিনি। তুমি আমার ছেলে কে কুরবানি দেয়ার ক্ষমতা দিয়ো আল্লাহ।”
বাবার কান্নার শব্দ শুনে আমারও কান্না পেত। মনে মনে বলতাম বড়ো হয়ে আমি বড়ো গরু কুরবানি দিব। বাবা দেখবে বাবার কষ্ট থাকবে না।
বাবার সাথে গোসল করতে যাই। আমাদের বাড়ির পাশের নদীতে। বাবা ইদের সময় নতুন সাবান কিনে আনে। নতুন কসকো সাবান দিয়ে গোসল করি।
পুরনো পাঞ্জাবি পরে বাবার সাথে ইদের নামাজ পড়তে যাই। নামাজ পড়ে সোজা বাসায় চলে আসি।
মা আমাদের সেমাই খেতে দেয়। আমরা কুরবানি দেই না। ইদের নামাজের পরে কোনো কাজ থাকে না। বন্ধুরা সবাই গরু নিয়ে ব্যস্ত তাই ঘুরতে বের হই না।
বাবা মায়ের সাথে রান্নায় সাহায্য করেন। না, আমার বাবা কারো গরু কাটতে যায় না।
দুপুরে মা চালের রুটি আর মুরগির মাংস ভুনা করে। বাবা-মা আর আমি তিনজন একসাথে খেতে বসি।
প্রতি ইদে আমরা মুরগির মাংস খাই। আমাদের বাসায় কোনো ফ্রিজ নাই। তাই মাংস জ্বাল দিতে দিতে একসময় খসে যায়। সেই মাংস আমরা রুটি দিয়ে খাই।
বাবা-মা দুজনেই আমায় ছেড়ে চলে গেছেন বহুবছর আগে। আজ আল্লাহ আমাকে কত টাকা দিছেন।
এবারের কুরবানির ইদে তিনটা গরু কিনেছি। ইদের নামাজ পড়েছি আমাদের সেই মসজিদটাতে যেখানে বাবার সাথে নামাজ পড়তে যেতাম। নামাজ পড়ে বাড়িতে এসেছি, আজ আমার পাশে কত মানুষ!
ম্যানেজার এসে বলে, “স্যার সব রেডি এখনি কুরবানি দিবে আপনি যাবেন?”
“না, তুমি সব ব্যবস্থা করো।” ম্যানেজার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। একজন মানুষ কুরবানি দেয় অথচ সামনে যায় না! ও হয়ত হিসাব মিলাতে পারে না। ওকে বলতে পারি না।গরু দেখলে আমার বাবার কথা মনে পড়ে যায়! আমার খুব কষ্ট হয়!
আর শোন, “আমাদের এলাকার কুরবানি দেইনি এমন প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে মাংস পৌঁছে দিবা একটা ঘরও যেন বাদ না পড়ে।”
“জি, স্যার। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।”
ইদের দিন বাড়িতে গরুর মাংস রান্না হয়। কত মানুষ আসে বাড়িতে, সবাই মজা করে খায়! আমার খেতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে মুরগির মাংস খেতে কিন্তু কাউকে বলি না, আমি জানি মুরগির মাংস রাধলেও সেই স্বাদ পাবো না। আমার স্বাদ যে হারিয়ে গেছে!
® নাবিল মাহমুদ (Nabil Mahmud)
Send private message to author



