সকাল থেকেই দাদি কাঁদছেন। নাস্তা করেন নাই, চাও খান নাই। তাঁর একটাই কথা তিনি বাড়ি যাবেন! দাদি আমাদের বাসায় এসেছেন আজ নয়দিন হলো। দাদি আসলে আমাদের ঈদ ঈদ একটা ভাব চলে আসে। বেশি পড়াশোনা করতে হয় না। আর সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হলো আম্মা বকতেও পারেন না, মারতেও পারেন না। কিন্তু এবার দাদির আসাটা আম্মার মধ্যে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নাই। কারণ সামনে আমাদের বার্ষিক পরীক্ষা। পড়াশোনায় কোনো মাফ নাই।
দাদি আমাদের সাথে থাকতে চান না। ছোটো চাচার সাথেও না। আমার ছোটো চাচা দেশের বাইরে থাকেন। চাচা কয়েকবার দাদিকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। দাদি রাজি হন না। দাদির একটাই কথা শহরেই থাকতে পারি না আর তোর বিদেশ!? ছোটো চাচা আবার দাদিকে আশ্বাস দেন “ঢাকা শহর থেকে বিদেশ ভালো!” দাদি এসব কথা কানে নেন না!
তো যা বলছিলাম, দাদির কান্না থামছেই না। বাবা কাঁচুমাচু মুখ করে নাশতা করছেন। যেনো কিছুই করার নেই। দাদি সামনে বসে কাঁদছেন ‘ আমি বাড়ি যাবো! কমলার বাচ্চা হবে! আমি বাড়ি যাবো!”
আম্মা, বাবার দিকে শুধু বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছেন।
আম্মার চোখের ভাষা বুঝে বাবা আবার দাদিকে বুঝাচ্ছেন ‘যাবা তো! কাঁদার কী আছে?!”
দাদির কান্না আরো বেড়ে যায় “… আমি বাড়ি যাবো! ….ওরে কমলা রে…!”
সাত সকালে নাকি বজলু চাচা ফোন করেছিলেন। বজলু চাচা হচ্ছেন বাবার দুঃসম্পর্কের চাচাতো ভাই। চাচা জানিয়েছেন কমলার শরীর ভালো না। ব্যাথা উঠেছে। এটা শোনার পর থেকেই দাদির আহাজারি শুরু!
বাবার নাশতা শেষ। অফিস যাবেন। যাওয়ার আগে বার বার বললেন আজকে নাকি ইমপর্ট্যান্ট মিটিং আছে। দাদিকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। আর তাছাড়া বাড়িতে কমলা একা না। রহিমার মা আছেন, রহিমা আছেন, রাবেয়া ফুপু আছেন, বজলু চাচা আছেন। কিন্তু কোনো যুক্তিই দাদিকে শান্ত করতে পারছে না।
এদিকে আম্মারও স্কুল যাওয়ার টাইম হয়ে গেছে। আম্মা সরকারি গার্লস স্কুলের টিচার। স্কুল যাওয়ার আগে আমাদের নাশতা, পড়াশোনা, দুপুরের খাবার সব রেডি করে যান। আজকে আবার মর্জিনা খালাও কাজে আসেন নাই। তাই আম্মার মেজাজ এখন তুংগে! রান্নাঘরে যেভাবে জিনিসপত্র ছুড়ে কাজ করছেন আমরা দুই ভাইবোন ভয়ে পড়তে বসলাম।
“এই মাসুম ! তুই আমাকে বাসে তুলে দে, আমি একাই যাবো!” বাবা জুতার ফিতা বাধা বাদ দিয়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন ‘ তোমার মাথা খারাপ!? তোমার এই শরীরে আমি তোমাকে একলা ছাড়বো?!” কী ভেবে আবার আশার বানী শোনালেন ” আচ্ছা দাঁড়াও, আমি অফিস যাই। রহমত আছে কী না দেখি। যদি ফ্রি থাকে, রহমতের সাথে চলে যেয়ো….”
কথা শেষ হওয়ার আগেই আম্মা রান্নাঘর থেকে হুংকার দিয়ে ছুটে এলেন ‘মানে কী!? কী এমন হয়ে গেছে যে তোমার রহমতের সাথেই মা’কে পাঠাতে হবে!? কমলার বাচ্চা হবে, মা কি ডাক্তার? বাড়িতে আর মানুষজন নাই?”
বাবা আর কথা বাড়ালেন না। দাদিও কাঁদতে কাঁদতে রুমে ঢুকে গেলেন।
এমন না আমার আম্মা, দাদিকে পছন্দ করেন না। বরং বেশিই আদর, যত্ন করেন। আম্মা সবসময়ই চান দাদি আমাদের সংগে থাকুন। কিন্তু দাদির এই বন্দী জীবন ভালো লাগে না। খোলা আকাশ, গাছ-ভর্তি উঠোন, মাটির গন্ধ এসব না থাকলে দাদির নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বাড়িতে সারাদিন কাজ করেন। বাড়িভর্তি কাজের মানুষ, তারপরও! নিজের কোনো যত্ন নেন না, ঠিক সময়ে খাওয়া দাওয়া করেন না। ঠিকমতো স্যান্ডেলও পায়ে দেন না। কিছুদিন আগে পায়ে কাঁচের টুকরো ঢুকে গিয়েছিলো। তারমধ্যে ডায়েবিটিস এর রোগী। তখনই আম্মা জোর করে আমাদের বাসায় এনেছেন। দাদি কমলার জন্যই আসতে চান নাই। কিন্তু কে জানতো কমলার শরীর এত তাড়াতাড়ি খারাপ হবে!
দাদি বজলু চাচাকে ফোন দিলেন।
‘বজলু, বাপ আমার! তুই এসে আমাকে নিয়া যা!’
‘কী কন চাচীম্মা! বাড়িতে ধান আসছে না?! কত মানুষ কাম করে। তাদের ফালায় কীভাবে যাই?”
“আমি জানতাম এমন কিছুই হবে… এজন্যই আসতে চাই না।’
বজলু চাচার সাথে কথা শেষ করে দাদী আবার নতুন উদ্যোমে কান্না শুরু করেন। একটু থামেন কী যেন বিড় বিড় করেন আবার শুরু হয়।
সত্যি সত্যি দাদি সকাল থেকে না খাওয়া। টেবিলে এখনো সকালের নাশতা পড়ে আছে। কত সাধলাম উলটা আমাদের জড়িয়ে ধরে কান্না! দাদির কান্না দেখে আমাদেরও কান্না আসে। তাঁর এই বাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। বজলু চাচা নাকি এও বলেছেন কমলাও দাদির জন্য কাঁদছে! আমরা শুনে অবাক হই দাদির প্রতি কমলার ভালোবাসা দেখে!
আর হবেই বা না কেনো? সেই ছোটোবেলা থেকে কমলা দাদির কাছে। কমলার অল্প বয়সেই মা মারা যায়। এরপর থেকে দাদিই তার মা-বাবা। খাওয়া দাওয়া গোসল সব দাদির কাছেই। দাদির হাতেই বেড়ে ওঠা। কমলাও দাদি ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।
যাইহোক, দাদির এই অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে আমরা আম্মাকে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলি। দাদি এখনো আশায় আছেন কেউ একজন তাঁকে বাড়ি নিয়ে যাবেন। কমলার এই কষ্টের সময় তিনি পাশে থাকতে চান।
সাধারণত, আম্মা বাসায় আসার আগেই আমরা পড়া টড়া রেডি করে ফিটবাবু হয়ে বসে থাকি। কিন্তু আজকে তা হলো না। আজকে আমাদের থেকে দাদির দিকেই সবার মনোযোগ ।
আম্মা বাসায় এসেছেন। দরজায় ঢোকার সময় আমরা মুখ দেখেই আমরা বলে দিতে পারি আম্মার মেজাজ ভালো না খারাপ? আজকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আম্মার মেজাজ চূড়ান্ত খারাপ। তার উপর টেবিলে রাখা সকালের নাশতা দেখে মেজাজ আরো সুপার ডুপার খারাপ হয়ে গেল। দাদির উদ্দেশ্য জোরে জোরে বললেন ‘এখনো খাবার শেষ হয় নাই?! খাবার কী দোষ করেছে?”
মনে হলো আম্মার কন্ঠ শুনে দাদির কান্নার শব্দ হালকা হয়ে এলো। “টেবিলে ভাত তরকারি দেওয়া হয়েছে খেতে আসুন’। কিন্তু দাদির কোনো সাড়াশব্দ নাই। আম্মা দাদির রুমের দরজা খুলে দাদির হাত ধরে টেনে ডাইনিং রুমের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। দেখে মনে হলো দাদি যেনো ছোট্ট বালিকা। মায়ের উপর অভিমান করেছে!
‘এমনি আপনার শরীর খারাপ তার উপর খান নাই! এই যে কমলার জন্য এত কাঁদছেন আপনি অসুস্থ হলে কমলার দেখাশোনা করবেন কিভাবে?”
দাদি গাল ফুলিয়ে বসে রইলেন। এই মহিলা এতক্ষণ কাঁদছিলেন কে বলবে দেখে?!
আম্মা প্লেটে ভাত -তরকারি নিয়ে মাখানো শুরু করলেন। এক লোকমা ভাত দাদির মুখের কাছে ধরে বললেন
‘নেন, হা করেন! তাড়াতাড়ি! ‘
সত্যি কথা কী আমার দাদি আম্মাকে ভীষণ ভয় পান। আর শুধু দাদি কেন আমরা সবাই-ই ভয় পাই। কিন্তু আম্মার এই রাগের মধ্যে ভালোবাসাটা খুঁজে নিতে হয়। এমন লুতুপুতু আদর তিনি করতে পারেন না। আর আমার ধারণা দাদিও সেই ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছেন। সেটারও প্রমান আছে। দাদি যখনই কিছু করেন বা সিদ্ধান্ত নেন আম্মাকে ফোন দেন। বাবা এসবের ধারের কাছেও নাই। দাদির অভাব -অভিযোগ সব আম্মার কাছে।
দাদি খাচ্ছেন আর চোখের পানি মুচ্ছেন। আমরা দুই ভাইবোন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। আম্মা আমাকে বললেন দাদিকে এক গ্লাস পানি ঢেলে দিতে। দাদি ভাত গিলতেই পারছেন না।
‘পানি খান!”
দাদি তাড়াতাড়ি পানির গ্লাসটা হাতে নেন।
আম্মা খুব স্বাভাবিক ভংগিতে বলছেন ‘কেনো এমন বাচ্চাদের মতো করেন মা? মানুষ শুনলে হাসবে।’
দাদি কোনো উত্তর দিলেন না। চুপ করে রইলেন।
খাওয়া শেষ হলো।
দাদি চা খেতে ভীষণ পছন্দ করেন। সকাল থেকে তিনি চা না খেয়ে আছেন -ভাবা যায়!? ভাত খাওয়ার পর আম্মা চা বানিয়ে সামনে রাখলেন। দাদি শুধু একবার তাকালেন। কোনো আগ্রহই দেখালেন না।
হঠাৎ ফোনের শব্দ । তাড়াহুড়ো করে দাদির রুম থেকে আমি ফোনটা এনে দেই। আমরা দুই ভাইবোন, আম্মা সবাই উন্মুখ হয়ে আছি। বজলু চাচা ফোন দিয়েছেন। কমলার বাচ্চা হয়েছে! এই খবর শুনে দাদি কতবার যে আলহামদুলিল্লাহ পড়লেন তার ঠিক নেই।
‘দে দেখি কমলারে একটু দে!’
কমলা ভালো আছে বলা সত্ত্বেও দাদি কমলার সাথে একটু কথা বলতে চান। সদ্য প্রসূতি মাতা কমলার কানে চাচা ফোন ধরেন। কমলাও যেনো বুঝতে পারে ফোনের ওপারে দাদি! তাই ক্লান্ত মৃদু স্বরে ‘হাম্বা…’ বলে জানিয়ে দেয় সে ভালো আছে! তার জন্য যেনো চিন্তা না করে!
দাদি খুশি হয়ে যান। তাঁর মুখে এখন শুধু হাসি আর হাসি! হাসতে হাসতে আম্মাকে শুধু বললেন ‘ও বৌমা! চা টা ঠান্ডা হয়ে গেছে,একটু গরম করে দাও না সোনা!”
ভালোবাসা জিনিসটা সত্যিই অদ্ভুত!
খাদিজা তুল কোবরা কাব্য
Send private message to author





