একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত গল্প
রহিম সাহেবের বয়স ৬৫ তে ঠেকলো। আবার এদিকে তার স্ত্রী মুনিরা বেগম ৬০ এ পা দিয়েছে। তাদের সন্তান সন্ততি সব বিদেশে স্যাটেল, কোন একটা করনে ভিসা প্রসেস হচ্ছেনা তাদের, কাজেই যাওয়া হচ্ছে না। ভিসা হয়ে গেলেই কিছুদিন পর তাদেরও নিয়ে যাবে বাইরে, এমনই কথা চলছে।
বাহিরে চলে যাওয়ার পক্ষপাতি কখনোই ছিলো না রহিম সাহেব, ভিসা হচ্ছে না দেখে, অনেকটা খুশিও তাতে। শেষ জীবনটুকু একান্তই নিজেদের মতো করে পার করছে তারা। রহিম সাহেবের বানানো বাংল বাড়িতেই চলছে তাদের শেষ বয়সের প্রেম।
তবে এর মাঝেও যেন বিষাদের শেষ নেই। বৃদ্ধার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে একবার, ডাক্তার বলে দিয়েছে পরেরবার হয়তো তাকে বাচানো যাবে না। এইসব নিয়েই রহিম সাহেবের সাথে ওভার ফোনে আলাপ করছে তার ছেলে। বাবা ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বলে তারা শেষ জীবনটা এভাবেই পার করতে চায় তারা। আর বলে দেয় কখনো দেখতে ইচ্ছা করলে যেন তাদের বাড়ি এসে দেখা করে যায়। তারা কোথাও যাচ্ছে না।
শেষ জীবনে এসে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ভালোবাসা কখনো কমবে তো দুরের কথা আরো বেড়ে গেছে। ইদানিং বৃদ্ধা একটি বই লিখছে। বৃদ্ধ লোকটা একদিন একটা পান্ডুলিপি পায়, সে পড়া শুরু করে, মুঘল আমলের একটি প্রেক্ষাপটে লেখা গল্পটা, রাজকন্যার সাথে এক যোদ্ধ্যার প্রেমকাহিনী। খুব কিউরিসিটি নিয়ে বইটা পড়ছে রহিম সাহেব। তার কল্পনারাজ্যে বার বার এক পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পায় রহিম সাহেব। এটা মুনিরা বেগমের ভয়েস, বইটা কেড়ে নিয়ে বৃদ্ধা বলে, “মানুষের পারসোনাল জিনিসপত্রে হাত দেয়ার অভ্যাস তোমার এখনো গেলো না, সময় হলে ঠিকি পড়তে দিতাম তোমাকে”। রহিম সাহেব চায় সেই সময়টা দ্রুত আসুক।
মাঝে মাঝেই বৃদ্ধার নাতি-নাতনিদের মিস করে সে। অন্য দেশের টাইমজোন চেঞ্জ থাকায় সবসময় কথা বলার সুযোগটা হয়ে ওঠে না। তারপরও মাঝেমাঝেই নাতি নাতনিদের সাথে ফোনালাপ হয় মুনিরা বেগমের, কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে রহিম সাহেবকেও ধরিয়ে দেয়। একদিন বৃদ্ধা কথা শেষে বলে, “খুব দেখতে ইচ্ছা করে নাতি নাতনিদের জানো।” বৃদ্ধ শুনে অনেকটা এড়িয়েই যায় কথাটা।
বাসায় ফেরার পথে একদিন মোবাইলের শো-রুমে ঢুকে ডিজিটাল টাচস্ক্রীন ফোন দেখে রহিম সাহেব, ফোনগুলোর ফিচার সম্পর্কে জেনে, দাম দেখে বেড়িয়ে যায় শো-রুম থেকে। বাসায় ফিরে দেখে মুনিরা বেগম আজ তার প্রিয় চিংড়ি ভুনা রান্না করেছে। রহিম সাহেব খুব মজা করে খাচ্ছে আর মুনিরা বেগম পাশে বসে নিস্পলক দেখছে, রহিম সাহেব বেপারটা খেয়াল করতেই বৃদ্ধা হেসে দিয়ে আরো বেশি করে চিংড়ি পাতে তুলে দেয়। খাওয়ার ফাকে মুনিরা বেগম তাদের এনিভার্সারির কথা মনে করিয়ে দেয় রহিম সাহেবকে।
শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় মুনিরা বেগমের বই নিয়ে প্রসংগ উঠে, বৃদ্ধা বলে “জানো আর মাত্র একটা চ্যাপ্টার লিখা বাকি, শেষ হলেই পড়তে দিবো তোমাকে”। বলতে বলতে বৃদ্ধা একটু কেশে উঠে। কাশি যেন থামছেই না, কাশতে কাশতে এক সময় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, রহিম সাহেব তড়িঘড়ি করে ড্রায়ার থেকে একটা ইনহেলার এনে দেয়। বৃদ্ধা পাফ নিতে থাকে। রহিম সাহেব তার ফোন বের করে ডাক্তারকে ফোন দিতে গেলে মুনিরা বেগম থামায় তাকে।
বৃদ্ধা বলে “ডাক্তারের কাছে গেলে শুধু শুধু এক গাদা ঔষধ দিবে, ঔষধ মোটেও পছন্দ না আমার, এর চেয়ে বরং আমাকে একটু সময় দাও, তোমাকেতো কাছেই পাই না আমি, সারাদিন কই কই ঘুরে বেড়াও, আমাকে নিয়ে গেলেও তো পারো”। বৃদ্ধ লোকটা হাসে, হাসতে হাসতে নিজেও শোয় বিছেনায়, চাদর টেনে বৃদ্ধার গায়ে টেনে দিয়ে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে বৃদ্ধ লোকটা। পাশে শুয়ে বৃদ্ধা একের পর এক নালিশ দিয়ে যাচ্ছে তার নামে। রহিম সাহেবের চোখ বেয়ে টলটল করে পানি ঝরছে।
দেখতে দেখতে তাদের এনিভার্সারি চলে আসে। একদিকে বৃদ্ধা বেপক রান্নাবান্নায় মন দিয়েছে অন্যদিকে রহিম সাহেব কেকের উপর খুব যত্ন করে তাদের নাম লেখাচ্ছে। রাতে বৃদ্ধ লোকটা বাসায় আসতেই দেখে তার পুরনো বন্ধুরা হাজির। প্রচুর গল্প গুজবের মদ্ধ্যে তারা কেক কাটা ও খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সারে। বৃদ্ধের পুরনো বন্ধুরা চলে গেলে সে একটা নতুন ফোনের প্যাকেট নিয়ে বৃদ্ধার হাতে দেয়। বৃদ্ধা খুব খুশি হয়ে প্যাকেটটা খোলে, দেখে নতুন একটা ফোন। বৃদ্ধ লোকটা ফোনটা নিয়ে একটা ম্যাজিক দেখাবে বলে ভিডিও কল দেয় ছেলেকে। খুব আবেগ আপ্লুত হয়ে যায় বৃদ্ধা। নাতি নাতনিদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে ও আসার দাওয়াত দেয়। ফোন কেটে দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বৃদ্ধা একটা র্যাপিং করা প্যাকেট এগিয়ে দেয় বৃদ্ধকে। বৃদ্ধ খুব অবাক হয় দেখে বৃদ্ধা বলে, “রহিম সাহেব, শুধু দিলেই হবে? নিতে হবে না?”
এতোক্ষনে রহিম সাহেব প্যাকেটটি খুলে ফেলেছে, প্যাকেটটা খোলার পর তার মুখটা খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। বৃদ্ধা তার বই লিখে শেষ করেছে, খুব সুন্দর লেদারে বাধাই করা বইটা রহিম সাহেবকে দিয়েছে। রহিম সাহেবের এতোদিনের অপেক্ষার পালা শেষ হলো এবার। তরিঘরি করে প্যাকেটটি খুলতে থাকে রহিম সাহেব। মনিরা বেগম এর মাঝখানেই বলে উঠে, “কাল হাটতে বের হবা, আমাকে নিয়ে”। রহিম সাহেব রাজি হয়ে বই এর দ্বিতীয় চ্যাপ্টার পরা শুরু করে এবং কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়।
হঠাত করেই পড়ার টেবিলে ঘুম ভাংগে রহিম সাহেবের। উঠে দেখে মুনিরা বেগম নেই বিছানায়। বারান্দায় গিয়ে দেখে নাতি নাতনিদের সাথে কথা বলছে মুনিরা বেগম।
রহিম সাহেব ও মুনিরা বেগম রাস্তা ধরে হাটছে। বই নিয়ে প্রসংগ উঠলে মুনিরা বেগম তার বই লেখার পেছনের প্রেক্ষাপট বলে। হঠাৎ করেই আকাশের দিকে তাকিয়ে সেন্সলেস হয়ে যায় মুনিরা বেগম।
হাসপাতালে ওয়েটিং রুমে বসে আছে রহিম সাহেব। ডাক পরতেই ছুটে যায় মুনিরা বেগমের রুমে, মুনিরা বেগম মিটিমিটি হাসছে। “দেখলে তোমার জন্য, যেতে গিয়েও বার বার ফিরে আসি” রহিম সাহেব স্যালাইন লাগানো হাতটা ধরে নিজের গালে বুলাতে থাকে। কথায় কথায় মুনিরা বেগম বলে, মরে গেলে উঠানের শিউলি গাছটার তলে যেন তার কবর হয়। রহিম সাহেব কথাগুলো বারবার এভয়েড করতে চাইলেও বৃদ্ধা বলে, “এটাই সত্য, আর এটাই চিরন্তন, আমার ষোল কলা সম্পুর্ন হয়েছে এবার”। রহিম সাহেব বলে, “তবে আমাকেও সাথে নিয়ে যেও”। বৃদ্ধা হাসতে হাসতে বলে, “আজ রাতটা থেকে যাওনা আমার সাথে” রহিম সাহেব আস্বস্ত করে।
চেয়ারে বসে সেই বইটি পড়ছে রহিম সাহেব। হুট করেই হার্টরেট রিডিং মেশিনের টীট টীট আওয়াজে তন্দ্রা ভাংগে রহিম সাহেবের। চোখ খুলতেই দেখে ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামছে হার্টরেট। কি করবে বুঝতে পারছে না রহিম সাহেব। বডি নাড়াচাড়া দিয়ে দেখার চেষ্টা করে রহিম সাহেব,পরে এলার্ম বাটুনে চাপ দিতেই দৌড়ে ডাক্তার চলে আসে। ইলেক্ট্রিক শক দিয়েও শেষ রক্ষা হয় না। বৃদ্ধা মারা যান।
পৃথিবীর যত বিষাদ ঝড়ে পরতে থাকে বৃদ্ধের মনরাজ্যে।
বৃদ্ধাকে কবরস্থ করা হয় সেই শিউলি গাছের তলায়। ছেলে ছেলের বৌ, নাতি, নাতনী চলে এসেছে বিদেশ থেকে। তারপরও কোনকিছুই রহিম সাহেবকে টানছে না। নিরবে কবরের পাশে দাড়িয়ে কেদে চলেছে। গাছ থেকে একটা একটা করে শিউলি ফুল ঝড়ে পরছে কবরের উপর। আকাশের মেঘগুলোও কেমন এলোমেলো হয়ে উড়ে যাচ্ছে। দমকা হাওয়ায় কবরের উপরে গড়াগড়ি খাচ্ছে শিউলি ফুলগুলো।
– SH Wasi
Send private message to author





