সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে,যেন অনেকদিন পর আকাশের বিশাল হৃদয়ে কেউ আঘাত করায় তার মন খারাপ। জোড়কাঁটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জরাজীর্ণ ভবনটাকে এই মেঘলা আবহাওয়ায় আরো বেশি মুমূর্ষু দেখাচ্ছে। স্কুলের কোনো কোনো কক্ষ থেকে ভেসে আসছে সমস্বরে দুইয়ের ঘরের নামতা পড়ার শব্দ,”দুই এক্কে দুই,দুই দুগুণে চার…”। আবার কোনো কোনো কক্ষ থেকে ভেসে আসছে “আয়রে আয় টিয়ে,নায়ে ভরা দিয়ে” ছড়াপাঠের সম্মিলিত ঐকতান। স্কুলের পাশ দিয়ে এই মুহূর্তে কোনো ভবঘুরে পথচারী হেঁটে গেলে তার মনে হতো, ঠিক যেন অজস্র পাখি কলকাকলী উপস্থাপনের প্রচ্ছন্ন মেলা বসিয়েছে স্কুলে। দেশ বিদেশ ঘুরে আসা ক্লান্ত পথচারীর সমস্ত ক্লান্তিই যেন দূর হয়ে যেত তখন।
দ্বিতীয় শ্রেণিতে এখন শেষ পিরিয়ড চলছে। ক্লাসরুমের একদম শেষ বেঞ্চে একটি হাড্ডিসার ছেলে একা বসে আছে। তার গায়ের রঙ অসম্ভব ফরসা,ডাগর-ডাগর চোখ দুটো অন্যদের তুলনায় সজীব। তৈলাক্ত চুলগুলো মাথার বাম দিকে বেশ পরিপাটিভাবে সিঁথি করা। ছেলেটির নাম সবুজ। অন্যান্য বেঞ্চে দুজন করে বসলেও সবুজের পাশে কেউ বসতে চায় না। কিংবা কেউ বসতে চাইলেও বাবা মার তরফ থেকে সবুজের পাশে বসতে নিষেধ করা হয়। ছোটবেলা থেকেই সে এরকম এক বেঞ্চে একা বসে আসছে। দীর্ঘ কিছু সময়ের পরিক্রমায়, একা বসার এই ব্যাপারটা সবুজের ছোট্ট মস্তিষ্ক অবলীলায় মেনে নিয়েছে,যেন তার পাশে কেউ বসবে না, এমনটাই স্বাভাবিক। একবার তো ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছেলেটার মা তার দিকে আঙুল তুলে বলেছিল,”শোন,আসাদ,ওই ছেলের সাথে ভুলেও মিশবি না।”
সবুজের ছোট্ট বুকটা একটু কেঁপে উঠেছিল সেই সময়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়েছিল সে।
সবুজ নিজেও সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। কারো সাথে বিশেষ কথা বলে না। শুধু স্যার ম্যাডাম পড়া ধরলে সে তার রিনরিনে কণ্ঠস্বর দিয়ে আমতা আমতা করে পড়া বলার চেষ্টা করে।
শেষ পিরিয়ডে আজকে বাংলা ক্লাস হচ্ছে। ছুটি হতে আর বেশি দেরি নেই। বইখাতাগুলো চেইনকাটা নীল ব্যাগটায় ঢুকিয়ে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালো সবুজ। ঘড়িতে এখন দুপুর একটা বেজে ৫৫মিনিট। আর মাত্র ৫ মিনিট বাদেই ছুটির ঘণ্টা পড়বে।এই শেষ ৫ মিনিটে বাংলা আপার সাথে সমস্বরে ছড়া পাঠ করতে হয় ওদের। ব্যাপারটা বেশ ভালোই লাগে সবুজের। আজকে বাংলা আপা ক্লাসে “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে” ছড়াটা পড়িয়েছেন। কাজেই সেই ছড়াটাই আজ সমস্বরে পড়ার জন্য নির্বাচিত হবে বলে মনে হলো সবুজের। হলোও তাই। বাংলা আপা ব্ল্যাকবোর্ড মুছে সুর করে বলে উঠলেন,” বাচ্চারা, এবার সকলে আমার সাথে-সাথে বলো,আয় বৃষ্টি ঝেঁপে”
সবুজসহ সবাই চেঁচিয়ে উঠলো,”আয় বৃষ্টি ঝেঁপে”
বাংলা আপা বললেন,”ধান দেব মেপে”
তার সাথে সাথে ক্লাসরুমের সবাই আবার চিৎকার করে উঠলো,”ধান দেব মেপে…”
সবুজ ছড়ার সুরে গলা মেলাতে মেলাতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে বাইরে।এইটুকু সময়ের মধ্যেই আকাশটা আরো বেশি কালো হয়ে উঠেছে। রাতের সব কালো অন্ধকার যেন কোনো এক বিচিত্র উপায়ে শুষে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে নীল আকাশটা। আর সে কারণে এই ভরদুপুরেও চারপাশের ধুলোর শহরে নেমে এসেছে সন্ধ্যের অন্ধকার। সবুজ দেখলো,ওদের স্কুলের বারান্দায় দুটো শালিক পাখি উদ্দেশ্যহীনভাবে পায়চারি করছে। সামনের বড় মেহগনি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাদামি রঙের ছাগল। গলায় দড়ি নেই ওটার। শহরের ছাগলগুলি এভাবেই চলাফেরা করতে অভ্যস্ত। বাতাসের আলোড়নে মেহগনি গাছ থেকে যেসব পাতা ঝরে ঘাসের ওপর পড়ছে,সেগুলোই পরম আনন্দে সাবাড় করে চলেছে ছাগলটি।
দুইটা বাজার ২মিনিট আগেই আজকে ছুটির ঘণ্টা ভেসে এলো। সবাই হুটোপুটি খেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেও,সবুজ বেশ ধীরে সুস্থে বের হয়ে হাঁটা শুরু করলো ওর বাসার দিকে।
মিনিট পাঁচেক হেঁটেই পাড়ার গলির মুখে চলে এলো সবুজ। ওরা শহরের যেখানটায় থাকে,সেটা খুব একটা শুনসান না হলেও,আজকের এই মেঘলা দিনে বেশ নিস্পন্দ হয়ে উঠেছে জায়গাটা। গলির মুখটাকে যেন প্রাণহীন নগরীতে ঢোকার প্রবেশপথ বলে মনে হচ্ছে সবুজের। ইতোমধ্যেই মেঘ গুড়গুড় করতে শুরু করেছে। বৃষ্টি নামবো নামবো করেও নামছে না। মাথাটা উঁচু করে আকাশের দিকে একবার তাকালো সবুজ। দেখলো,কালো মেঘমালা আরো বেশি ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়িই বৃষ্টি নেমে যাবে। দ্রুত বাসায় পৌঁছাতে না পারলে কাকভেজা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।এসব ভাবতে ভাবতেই গলির ভেতরে ঢুকে গেল সবুজ। প্রায় সাথে সাথেই অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা কালো নেড়ি কুকুরটা লেজ নাড়াতে নাড়াতে ছুটে এলো ওর দিকে। কুকুরটার নাম “কালু”। কালু সবুজের পোষা কুকুর। তার গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, তবে মাথাটা দুধের মতো সাদা। যেন বিধাতা ওর সারা দেহ কালো রঙ করার পর মাথাটা রঙ করতে গিয়ে খেয়ালবশত মাথার ওপর সাদা রঙ ঢেলে দিয়েছিলেন। গত চার বছর ধরে সবুজের একমাত্র বন্ধু,খেলার সাথি,খাওয়ার সাথি,বেড়ানোর সাথি, সবকিছুর সাথি এই একটি মাত্র চারপেয়ে সারমেয়-কালু। তাদের সম্পর্কটা অনেকটা যেন মায়ের পেটের ভাইয়ের মতোনই গভীর। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় কালু সবুজকে গলির মুখ অবধি এগিয়ে দেয়। আবার স্কুল থেকে ফেরার সময়ও সে ঠিকই নিয়ম করে গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকে সবুজকে নিয়ে বাসায় ফেরার জন্য। বাকি সময় সে সবুজদের বাসার সামনে বসে থাকে। সবুজের মাকে যেন নিজের মায়ের মতোই সঙ্গ দেয় কালু। সবুজ প্রায়শই স্কুল থেকে ফেরার পথে কালুর জন্য কুসুম খালার দোকান থেকে পাউরুটি কিনে আনে। পাউরুটি ওর ভীষণ পছন্দ।
সবুজ কালুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।তারপর বললো,,”কীরে ছ্যামড়া! তুই আজকেও আসছোস!”
কালু কোনো জবাব দিল না। লেজ নেড়ে নিঃশব্দে ওর পাশে হাঁটতে লাগলো।
সবুজ বললো,”কাইল তোরে কুসুম খালার দোকান থেইকা পাউরুটি কিইন্যা খাওয়ামু যা। মারে কমু নে ট্যাহা দিতে।”
কালু আগের মতোই চুপচাপ হাঁটতে থাকলো। সবুজও আর কিছু বললো না ওকে। এরই মধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাসাও আর খুব একটা দূরে নয়। পৌঁছতে মিনিট দুয়েকের বেশি লাগবে না। একটু দ্রুতই পা চালিয়ে এগোতে লাগলো ওরা। ফুলি খালার বাড়ি পার হওয়ার সময় সবুজ দেখলো,ফুলি খালা বারান্দায় বসে ভাত খাচ্ছে। না চাইতেও সবুজের চোখ চলে গেল ফুলি খালার হাতে ধরা ভাতের থালাটার দিকে। মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত মাখিয়ে খাচ্ছে ফুলি খালা। থালার এক কোণে একটা কাঁচা মরিচ আর লেবুর কোয়াও চোখ এড়ালো না ওর।আড়চোখে দেখলো,কালুও লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে। শেষ কতদিন আগে মাংস খেয়েছিল মনে পড়ে না সবুজের।তবে মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে যে তৃপ্তিটা সবুজ পেয়েছিল সেটা পরিষ্কার মনে পড়ে গেল। সবুজের থালার দিকে তাকিয়ে থাকা দেখেই কিনা কে জানে ফুলি খালা সবুজকে আন্তরিক গলায় বললো,”কীরে সবুইজ্যা! ছুটি হইলো তগো?”
সবুজ উত্তর দিল,”হ,খালা।”
মরিচে একটা কামড় দিয়ে ফুলি খালা বললো,”ভাত খায়া যা,বাপ। খাসির মাংস রানছি।”
সবুজ বললো,”না,খালা। মা রানছে বাসায়। আমি বাইরে খাইলে রাগ হইবো।”
বেশি যাচলো না ফুলি খালা। নিরাশ ভঙ্গি করে বললো,”আইচ্ছা তাইলে যা। বাড়িত যা। তোর মা নাকি চার মাস ধইরা অসুস্থ। এহন কী অবস্থা?”
সবুজ বললো,”ওষুধ খাইতেছে। ওষুধ খাইলে জ্বর কমে। বাদ দিলে আবার আসে।”
ফুলি খালা খেতে খেতে বললো,”শহরতলিতে একখান ভালো ডাক্তার আইছে শুনলাম। তার কাছে লইয়া যাইস একদিন। এতদিন ধইরা জ্বর! আল্লাহ! বেটিরে সুস্থ কইরা দেও।”
সবুজ “আইচ্ছা” বলে আবার হাঁটা শুরু করলো। ও ভালো করেই জানে, শহরতলির ডাক্তারের কাছে সে তার মাকে নিয়ে যেতে পারবে না। টাকার সংকটে আছে ওরা। মা অসুস্থ থাকায় কাজ বন্ধ।নতুন করে টাকা আসছে না হাতে। আগের জমানো টাকাও শেষের দিকে। ইদানীং বাকির উপরে সংসার চলছে। কুসুম খালার দোকান থেকেই প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র কেনে ওরা। কুসুম খালা নিতান্ত ভালো মানুষ হওয়ায় এখনো দেনা পরিশোধের তাগাদা দেন নি ওদেরকে। সবুজ সেদিন দুপুরবেলা লুকিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে চালের ড্রামে উঁকি দিয়ে দেখেছে,ঘরে চাল বাড়ন্ত। এও দেখেছে, প্রায়দিনই ওর মা আধপেটা খেয়ে দিন পার করে দেয়। সবুজ ওর মাকে যখন জিজ্ঞেস করে,”মা,তুমি খাবা না?”
মা তখন উত্তর দেয়,”তোর খাওয়াই আমার খাওয়া রে বাপ। তুই খা। পাতিলে ভাত আছে। আমি পরে খামু।”
সবুজ জানে,পাতিলে আসলে ভাত বিশেষ নেই। মা হাঁড়ি মুছে পোড়া ভাত খাবে পরে। কালু ইদানীং দক্ষিণের ময়লা ফেলার বড় ভাগাড়টায় গিয়ে এঁটোকাঁটা খেয়ে আসে। সবুজ মাঝে মাঝে ভাবে,মানুষ না হয়ে কুকুর হওয়াটাই বরং ভালো ছিল। পেট খালি থাকতো না অন্তত! ভাগাড়ের নোংরা উচ্ছিষ্ট খেয়ে কি কালু বেঁচে নেই? সবুজ আর ওর মায়ের দেহ হাড় জিড়জিড়ে হয়ে গেলেও, ভাগাড়ের আবর্জনা কালুকে দিব্যি হৃষ্টপুষ্ট করে রেখেছে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সবুজ। আরো সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই বাসার সামনে চলে এলো ওরা। ঠিক বাসা না, টিনের ছোট্ট কুঠি বা দুই কামরার কবুতরের খোপ বলা যায় এটাকে।
কালু বাসায় পৌঁছেই বারান্দার এক কোণায় বসে পড়লো। ঝুম বৃষ্টি নামলো এইসময়। দরজা খোলাই ছিল। সবুজ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,”মা,আমি ফিরছি। কই তুমি?”
রান্নাঘর থেকে সবুজের মা জমিলার গলা ভেসে আসলো,”এইতো বাপ! আমি রানতেছি।রান্দা অবশ্য শেষ। তুই জামা পালটায় ল। আমি খাবার দিতেছি।”
সবুজ বললো,”কী রানছো,মা?”
জমিলা বললো,”বেগুন ভাজি আর ভাত রানছি বাপ।”
কিছুটা হতাশ হলো সবুজ। বাড়িতে বাজার আসা বন্ধ হয়েছে এক হপ্তা হলো। ইদানিং বেগুন ভাজা, আলু ভর্তা কিংবা রেললাইনের ধার থেকে তুলে আনা বালিমাখা কলমি শাক এসবই তাদের নিত্য আহার্য হয়ে উঠেছে। বলবে না ভেবেও লজ্জার মাথা খেয়ে মাকে আজ বলেই ফেললো সবুজ,”মা,মাংস খাই না ম্যালা দিন। কবে কিনবা?”
জমিলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো,”বাপ আমার। আমি অসুস্থ তুই জানসই তো। সুস্থ হই বাপ। আবার ইনকাম হইবো।”
সবুজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”আজ কেউ আসছিলো,মা?”
জমিলা বললো,”আসছিলো বাপ। আমি ফিরায় দিছি।”
সবুজ বললো,”ওহ।আইচ্ছা।”
***
বারান্দায় বসে ভাত খাচ্ছে সবুজ। শুকনো মরিচ দিয়ে ভাতটাকে ভালো করে মাখিয়ে নিয়েছে সে। বেগুনের তরকারি দিয়ে খেতে খারাপ লাগছে না। সবুজের নিজের হাতে লাগানো গাছেরই বেগুন এগুলো। তাই খাওয়ার সময় একটা আলাদা তৃপ্তি অনুভব করছে ও। বৃষ্টি সেই তখন থেকেই অবাধ্য মেয়ের মতো চঞ্চলা হয়ে মুষলধারে ঝরছে। ছোট্ট গলিটাকে আরো স্যাঁতস্যাঁতে করে তুলেছে অসভ্য বৃষ্টি। বাড়ির পাশের ড্রেন থেকে ভেসে আসছে বোঁটকা গন্ধ। কিন্তু সেসব কিছুই খাওয়ার চেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে না সবুজের। সে খেয়ে যাচ্ছে আপনমনে। এক গ্লাস পানি খেয়ে সবে ভাতের আরেকটা লোকমা মুখে পুরতে যাবে সবুজ,এমন সময় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একজন দশাসই লোক দৌঁড়ে এসে ওদের ঘরে ঢুকে গেল। কালু পাশেই ছিল। সেও “ঘেউ” করে ডেকে উঠলো। বেশ অস্বস্তি লাগলো সবুজের। চিনতে পেরেছে ও লোকটাকে। জহিরুল মাস্তান। প্রায়ই সবুজের মায়ের কাছে আসে।
সবুজ কান খাড়া করে রইলো। ভাত খাওয়ার প্রতি আর ছিঁটেফোঁটা আগ্রহও নেই ওর। সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এখন ভেতরের কথোপকথন।
-“শইলডা ভালো না।কাস্টমার ফিরায়ে দিতেছি। আমি সুস্থ হইলে আইসেন।”
(একটা ঠাস করে চড়ের শব্দ ভেসে আসলো বাইরে।)
-“মাগি,তুই কারে ফিরাইতে চাচ্ছোস,জানস? তুই আর তোর ওই খানকির পোলা সবুজরে চার টুকরা কইরা কুত্তা দিয়া খাওয়ানোর মতো ক্ষমতা রাখি আমি।পতিতালয়ে থাকিস,পতিতারে যা কমু,তাই তার করা লাগবে। এইটা নিয়ম। এখন শাড়ি খোল,মাগি।”
সবুজ ওর ছোট্ট আঙুলগুলো দিয়ে ভাত নাড়াচাড়া করতে লাগলো। কিছুতেই আর সে ভাত মুখে দিতে ইচ্ছে হলো না ওর। ছোট্ট মাথাটা হঠাৎ কেমন ঘুরতে শুরু করলো। দরজার কাছ থেকে মায়ের ফিসফিসে গলা শুনতে পেল সবুজ,”বাপ,কাইল তোরে আর কালুরে মাংস রাইন্দে খাওয়ামু।” পরক্ষণেই খট করে শব্দ হলো। সবুজ বুঝলো,মা দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
কালু এর মধ্যেই কখন যেন উঠে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়েছে।কুঁই কুঁই শব্দে ডাকছে ও। যেন সবুজের বুকের মধ্যে থাকা কষ্ট কিছুটা হলেও কালু বুঝতে পেরেছে। সবুজের কী মনে হলো, ওর থালার সমস্ত ভাত বারান্দায় ঢেলে দিল। তারপর কালুকে ইশারা করলো ভাতগুলো খেয়ে নিতে। কালু কোনো কিছু না ভেবেই বুভুক্ষুর মতো গিলতে শুরু করলো সাদা ভাতগুলো। সবুজ সেদিকে তাকিয়ে রইলো স্থির চোখে। কালুর লোমশ পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো সে। ওর রিনরিনে গলা ফুঁড়ে সেতারের শব্দের মতো বেরিয়ে এলো,
“আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
ধান দেব মেপে
লেবুর পাতা করমচা
যা,বৃষ্টি ঝরে যা।”
একই ছড়া বার বার কাটতে লাগলো সে। এভাবে কতক্ষণ ছড়া কেটেছে জানে না সবুজ। শুধু দেখেছে, এরই মধ্যে কালু ভাত খেয়ে ওর গায়ের মধ্যে লেপটে শুয়ে ঘুমে ঢুলতে শুরু করেছে। আর দেখেছে,চঞ্চলা বৃষ্টির ক্লান্ত হয়ে থেমে যাওয়ার পর রূপকথার রাজ্যের রঙিন সকালের মতো সোনালি রোদ ওঠা। হঠাৎই দরজা খোলার শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেল সবুজ। শুনতে পেল, ওর মা ঠাণ্ডা গলায় বলছে,”ট্যাহা দিয়া যান। আমার পোলাডা মাংস খাইতে চাইছে।”
জহিরুল চড়া গলায় বললো,”এর পরের বার একেবারে নিস।অহন আসি।”
ঘর থেকে টলতে টলতে বাইরে বেরিয়ে এলো জমিলা। দেখলো, জহিরুল মাস্তান বুক ফুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গলির শেষ মাথার দিকে। ছোটখাটো এই নিষিদ্ধপল্লী থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় উঠলেই শহরের যান্ত্রিক জনস্রোতে মিশে যাবে জহিরুল মাস্তান। কেউ জানবেও না একটু আগেই অসুস্থ এক অসহায়ের ওপর সে কীরকম পুরুষত্ব জাহির করে এসেছে।
জমিলার সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করলো হঠাৎ। জ্বর আসার পূর্ব লক্ষণ এটা। শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে ঈষৎ অনুভূতিহীন চোখেই সবুজের দিকে তাকালো জমিলা। কী মায়াবিই না লাগছে তার ছেলেটিকে এই বৃষ্টি শেষের রোদে! সবুজও ছলছল চোখ নিয়ে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মায়ের পরির মতো ফরসা গালে একটা কালশিটের দাগ পরিষ্কার দেখতে পেল ও। কালু এতক্ষণ শুয়ে ছিল সবুজের পাশে। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো সে। জমিলার মুখের দিকে মায়াবি চোখে তাকিয়ে “কুঁই কুঁই” করতে লাগলো এরপর। কালশিটের দাগটা সম্ভবত এই বুদ্ধিহীনেরও নজর এড়ায় নি! জমিলা একটু হাসার ভান করে কালুর দুধ সাদা মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
***
আজকে স্কুল ছুটির পর গলির মুখে এসে কালুকে দেখতে পেল না সবুজ। একটু চিন্তিত হলো সে। পরক্ষণেই নিশ্চিন্ত হলো। কারণ কাছেই কোথাও অনেকগুলি কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে।কুকুরদের দলীয় সভা বলা হয় এটাকে। কালু নিশ্চয়ই কুকুরদের দলীয় সভায় যোগ দিতে গেছে। ফেরার পথে কুসুম খালার দোকান থেকে পাউরুটি কিনে এনেছিল সবুজ। কালু বাসায় ফিরলেই নিজের হাতে ওকে পাউরুটি খাইয়ে দেবে বলে ভাবলো সে।
ঘরে ঢুকে প্রতিদিনের মতো আজকেও মাকে জিজ্ঞেস করলো সবুজ,”মা,আইজ কী রানছো?”
জমিলা আনন্দিত গলায় বলে উঠলো,”বাপ,আইজ মাংস রানছি। খাসির মাংস। জহিরুল মাস্তান ট্যাহা দিয়া গ্যাছে তুই স্কুল যাওনের পর।”
খুশিতে সবুজের চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো।কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল সে। তারপর দ্রুত জামা পালটে বসে পড়লো বারান্দায়। জমিলা গরম ভাত আর মাংস বেড়ে এনে দিল তাকে। সাথে পেঁয়াজ, মরিচ আর এক কোয়া লেবু!
জমিলা চারদিকে দেখে সবুজকে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো,”কালু কই? আইজকে তরে নিতে যায় নাই?ওর জন্যও তো মাংস রাখছি!”
সবুজ বললো,”কুকুরগো মিটিং বসছে আইজকে। কালু ওখানেই গেছে মনে হয়। এট্টু পরেই চইলা আসবো দেইখো।”
জমিলা নিশ্চিন্ত গলায় বলল,”হ। তাই হইবো হয়তো।আইচ্ছা তুই খা। লেবুডা চিইপ্যা ল ভালো কইরা।”
সবুজ তৃপ্তি করে ভাত খেতে লাগলো। আনন্দে জমিলার চোখে পানি এসে গেছে। সে কাঁদো কাঁদো স্বরে জিজ্ঞেস করলো,”রান্ধন ভালো হইছে বাপ?”
সবুজ বললো,”হ মা! একের হইছে।আরেকটু ভাত দাও।”
জমিলা পরম যত্নে তার আদরের ছেলের পাতে ভাত তুলে দিল।
খাওয়া শেষ হলে জমিলা সবুজকে বললো,” আইজ নাহয় থালেই হাত ধুইয়া ল,বাপ। কলপাড়ে যাওন লাগবো না। মায়ে কইতো,মাংস হইতেছে রাজার খাবার। রাজার খাবার খাইয়া বাসনে হাত ধুইতে হয়। নাহলে নাকি অনর্থ ঘটে।”
সবুজ মায়ের কথা শুনে বাধ্য ছেলের মতো থালাতেই হাত ধুয়ে নিল। তারপর দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা গামছায় মুখ মুছে জমিলাকে বললো,”মা,আমি ঘুমাইলাম।বিকালে ডাইক্যা দিও।”
জমিলা কিছু বললো না। সবুজের এঁটো থালার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললো। ছেলেটা আজকে একদম থালা মুছে ভাত খেয়েছে। কাঁদতে কাঁদতেই এঁটো থালাবাসনগুলো নিয়ে কলপাড়ে চলে এলো জমিলা। সবুজকে ইচ্ছে করেই কলপাড়ে আসতে দেয় নি সে। সন্তানের ইচ্ছে পূরণের জন্য মায়েদের অনেক সময় ইস্পাত-কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। জমিলাও নিয়েছে। কারণ সেও একজন মা। সে তার সবুজের মা। নিজের নাড়ি ছিঁড়ে যাকে জন্ম দিয়েছে তার মনের ইচ্ছা জমিলা অপূর্ণ রাখবে কী করে?
সবুজ এখন বিছানায় কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আরামে ঘুমোচ্ছে। একটা সুন্দর স্বপ্নও দেখছে সে ঘুমের মধ্যে। দেখছে- সে, মা আর কালু একটা অদ্ভুত বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরো বাগানটা জুড়ে শুধু লেবু আর করমচা গাছের আধিপত্য! এই গাছগুলোই যেন অদ্ভুত বাগানটার রাজা! চারপাশে অনেক রকম মজাদার খাবারের দোকানও রয়েছে এখানে। সবাই বিনামূল্যে সেগুলো খেতে পারছে। সবুজের যখন যা খেতে মন চাইছে,তাই সে খাচ্ছে বিভিন্ন দোকানে গিয়ে। সবুজের মাও খাচ্ছে।কিন্তু খাচ্ছে না কেবল কালু। সবুজ ওকে জিজ্ঞেস করলো,”কীরে কালু,খাচ্ছোস না ক্যান?”
কালু অভিমানের গলায় উত্তর দিল,”আমি হইতেছি কুকুর। মাইনষের খাওন আমি কেমনে খামু? তার চেয়ে আপনে খান। আপনে খাইলেই আমার পেট ভরবো।”
সবুজের করমচার মতো টুকটুকে ঘুমন্ত মুখখানায় বেলিফুলের ন্যায় শুভ্র একটা হাসি ফুটে উঠলো। একটু পরেই বিকেল হবে। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙবে ওর। এই সুন্দর স্বপ্নটা থেকে বাস্তবের দুঃখ কষ্টের জীবনে ওকে ফিরে আসতে হবে আবার। তবে এবারের দুঃখটা ভাগাভাগি করার জন্য সবুজের পাশে হয়তো ওর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কেউ একজন থাকবে না!
দুপুরে খাওয়ার পর সবুজ হাত ধোয়ার জন্য কলপাড়ে গেলে দেখতে পেত,ভাঙা নলকূপের এককোণে শানের ওপর একটা কাটা মাথা আর চারটা কালো রঙের পা অযত্নে পড়ে আছে।অজস্র মাছি উড়ে এসে এক নতুন আস্তরণ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ছিন্ন প্রত্যঙ্গগুলোর ওপর। কাটা মাথাটা ছিল দুধ সাদা, লোমশ। মুখটা ছিল অসম্ভব শান্ত-সুন্দর কিন্তু তার বৃষ্টিকাজল চোখ দুটোয় ছিল রাজ্যের অবিশ্বাস!
____________________
লেখক: নাদিম মাহমুদ সতেজ (Nadim Satej)
Send private message to author






